২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রাষ্ট্রভাষা বনাম বাংলা একাডেমি

-

কুরআনের মর্মমতে- সৃষ্টিকর্তা মানুষকে কথা বলতে শিখিয়েছেন, (সূরা আর-রহমান) এবং কথা বলার প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা। জাতিসঙ্ঘ ‘ইশারা’ ভাষাকে ভাষার একটি ধরন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ‘ইশারা’ ভাষা দিবস পালন করে বটে, কিন্তু ভাষা ছাড়া শুধু ইশারার মাধ্যমে মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না। যে মানুষটির কণ্ঠে ভাষা নেই সে বুঝতে পারে পৃথিবীটা তার জন্য কতটুকু বোঝা।

যে পরিবারে একজন বধির বা বোবা জন্মগ্রহণ করে সে পরিবারটি বুঝতে পারে। পৃথিবীর মধ্যে যে একটি ‘অন্ধকার’ চিত্র আছে তা উপলব্ধি করা তখন সম্ভব হয়। কেবল তখনই অনুমান করা যায় পৃথিবীটা কতটুকু নিষ্ঠুর (!) ফলে এটিই প্রতিষ্ঠিত যে, ‘ভাষা’ মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। এ মূল্যবান উপহারের মধ্যে আরো মূল্যবান হলো ‘মাতৃভাষা’। বাঙালি তাদের মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা রক্ষা করতে আন্দোলন-সংগ্রামে পাকিস্তান সরকারের বুলেটে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছে। পৃথিবীতে মাতৃভাষার জন্য গুটিকয়েক জাতি প্রাণ দিয়েছে তার মধ্যে বাঙালি অন্যতম। পার্শ্ব¦বর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র আসামে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে।

বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্যও রক্ত দিতে হয়েছে। এ জাতির যা কিছু অর্জন হয়েছে তা হয়েছে রক্তের বিনিময়ে। পৃথিবীর মধ্যে অনেক কম জাতিই আছে যারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে নিজ মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছে। এ কারণেই বাঙালি জাতি যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গৌরব অর্জন করে। তবে দেশ স্বাধীনতার বীজ লুকায়িত ছিল মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার আন্দোলনের মধ্যে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পাকিস্তানিদের মুখোমুখি দাঁড়ানোই ছিল বাঙালির প্রথম প্রতিবাদ যা পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার, পরে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। ফলে ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করেছে, ফলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসঙ্ঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন তারা বলেছেন, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। এ প্রবাদটি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে যা এখনো বেদবাক্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক কবিতা, প্রবন্ধ রচিত হয়েছে, ছাপা হচ্ছে মনোমুগ্ধকর পোস্টার ও দেয়াললিখন।

প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতি বাংলাদেশে তো বটেই, বহির্বিশ্বেও যেখানে বাঙালি আছে সেখানে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে, ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে। কিন্তু বাঙালির প্রিয় মাতৃভাষা ‘বাংলা’ কি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রয়োগ হচ্ছে? সংবিধানের প্রথম ভাগের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। কাগজ-কলমে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবিধানে ‘বাংলা’ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বটে কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা কি ব্যবহৃত হচ্ছে? রাষ্ট্রের বিভিন্ন অফিস-আদালতে এখনো ইংরেজি ভাষাকে মর্যাদার আসনে বসানো হচ্ছে। আদালতসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দফতরে ইংরেজিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ইংরেজি যে জানে না তার জীবনটাই যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার মানসিকতা এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। তবে ‘ইংরেজি’ যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সেহেতু ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী থাকার অনেক গুরুত্ব রয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দফতরে ইংরেজি ব্যবহার ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী থাকা এক কথা নয়।

স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, আন্তর্জাতিক ভাবধারা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়, তবে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য যথাযথ নয়। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ও সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলাদেশের ইতিহাসে (১৭০৪-১৯৭১) ‘রাষ্ট্র ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে (পৃষ্ঠা-৭৯) দেখা যা, ‘ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক অনুদানে মাদরাসা ও সংস্কৃত কলেজ পরিচালিত হয়েছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুদানে ১৭৮১ সালে কলকাতা মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯২ সালে জোনাথন ডানকান প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃত কলেজ। ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক মেকলের ভারত উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রসারকে ভারত সরকারের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য বলে গ্রহণ করেন। তৎকালীন সরকারি নীতির এ পরিবর্তনের ফলে ক্রমেই সরকার পরিচালিত সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত, বাংলায় বেশ কিছু ইংরেজি স্কুল ও কলেজ গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা প্রধানত বাংলায় উচ্চাভিলাষী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখনই সরকারি চাকরিতে ইংরেজি শিক্ষিতদের অগ্রাধিকার দেয়ার নীতি পরিবর্তিত হয়।’

লেখক বদরুদ্দীন উমর ‘ভাষা আন্দোলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শুধু সাংস্কৃতিক মহলই নয়, রাজনৈতিক মহলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ভাষাবিষয়ক কিছু উল্লেখযোগ্য চিন্তাভাবনা ছিল। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের সামনে পেশ করার জন্য যে খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক ভারত বিভাগ সম্পর্কিত রোয়েদাদ ঘোষণার পর মুসলিম লীগের অল্পসংখক বামপন্থী কর্মীর উদ্যোগে জুলাই মাসে ঢাকায় গণআজাদি লীগ নামে একটি রাজনৈতিক গ্রুপ গঠিত হয়। কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় কর্মী একটি কমিটি গঠন করে।

এ গ্রুপ ‘আশু দাবি কর্মসূচি আদর্শ’ নামে যে ম্যানিফোস্টা প্রকাশ করে তাতে বলা হয়- মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করতে হবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশে যথোপযোগী করার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করতে হবে।’ এতে প্রতীয়মান হয়, পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই বাঙালি জাতি বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে সোচ্চার ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানগতভাবে বাংলা একাডেমির ওপর বর্তায়। কিন্তু বাংলা একাডেমি সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বাংলা একাডেমি এখন সরকারি দলের একটি অঙ্গসংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সরকারি অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার করার জন্য ভাষার প্রয়োগ সাবলীল করার পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির ওপর। কিন্তু গবেষণামূলক কার্যক্রম থেকে বাংলা একাডেমি সরে গিয়ে সরকারের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। প্রতি বছর কয়েক দফা পদক বিতরণ করাই একাডেমির মুখ্য কর্ম। কিন্তু পদক বিতরণে একাডেমি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন না করে শুধু সরকারি ঘরানার লোকদেরই পদক প্রাপ্তিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

একটি রাষ্ট্রে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার যাতে দল-মত নির্বিশেষে সব মতের মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের মধ্যে মতবিনিময়ের মাধ্যমে জাতির প্রতি অবদান রাখতে পারে। বাংলা একাডেমি সে ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান হতে পারত; কিন্তু এর পরিবর্তে একাডেমি সরকারি দলের সেবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সরকারের বিরোধী ঘরানার লেখকদের বই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে না। গবেষণায় রয়েছে তাদের পক্ষপাতিত্ব। ইতিহাস সৃষ্টিতে রয়েছে সত্য-মিথ্যার দোলাচল; যে ইতিহাস রচনা করলে ক্ষমতাসীনরা খুশি থাকবে, সে ইতিহাসই বাংলা একাডেমির গবেষণার ফল। সবচেয়ে বড় কথা এই, একাডেমির অনেক আজীবন ও সাধারণ সদস্য রয়েছেন। সদস্যদের মধ্যে দল-মত নির্বিশেষে অনেকেই সদস্য রয়েছেন, যারা সরকারি ঘরানার বা সরকারি সমর্থক সদস্য নন তাদের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা বাংলা একাডেমির কাছে নেই। সরকার দাবি করে, দেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান। অথচ বাংলা একাডেমি চলছে একটি অনির্বাচিত কমিটি দিয়ে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলা একাডেমি কোনো নির্বাচিত কমিটিতে পরিচালিত হয়নি। সরকার দেশের সংস্কৃতিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই বাংলা একাডেমিকে সরকারি ঘরানার অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে পরিচালিত করছে।

মাতৃভাষা কোনো সরকারের সম্পদ নয়। এটি একটি জাতীয় ঐতিহ্য ও সম্পদ। এ সম্পদকে জাতীয়ভাবেই রক্ষা করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমেই এটি সম্প্রসারিত হবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৭-এর নির্দেশনায় সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বটে, কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিরক্ষর। স্বাধীনতা-উত্তর নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য সরকারি যে উদ্যোগ ছিল তা-ও থেমে গেছে। দেশ স্বাধীনতার পর সরকারি উদ্দেশ্যেই কয়েকবার নিরক্ষরতা দূরীকরণে উদ্যোগ নেয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক অসহযোগিতার জন্য সফল হতে পারেনি। পরবর্তী স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে (কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) নিরক্ষরতা দূরীকরণ অর্থাৎ ধনী-গরিব নির্বিশেষে নিরক্ষর ব্যক্তিদের অক্ষরজ্ঞান দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও পরে সে উদ্যোগেরও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অপমৃত্যু হয়। স্বাধীনতার পর সরকারের সমাজসেবা অধিদফতরের অনুমোদনক্রমে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভাভিত্তিক ‘কেন্দ্রীয় নিরক্ষরতা দূরীকরণ সংস্থা’ গঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাবে এর কার্যক্রমে ভাটা পড়ে।

পুরো জাতিকে ভাষার সাথে পরিচিত করাতে হলে অক্ষরজ্ঞান শিখানো প্রয়োজন যা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এককভাবে সম্ভব নয়; দায়িত্ব নিতে হবে গোটা শিক্ষিত সমাজকে। দেশে বস্তিবাসী গরিব মেহনতি মানুষ যাদের ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ তাদের পক্ষে কোনো স্কুলে ভর্তি হওয়া যেমন সম্ভব নয় এবং অভাবের তাড়নায় বস্তিতে বেড়ে উঠা তাদের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর পরিবর্তে কর্মস্থলে পাঠানোই খেটেখাওয়া মেহনতি মানুষ জরুরি মনে করে। ভাষা শিক্ষার জন্য অক্ষরজ্ঞান ও অক্ষরজ্ঞান সর্বস্তরে পরিচিত করার জন্য সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের আরো উদ্যোগী ও সুদূরপ্রসারী টেকসই কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement