২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গণতন্ত্র বনাম আমলা ও টাকাতন্ত্র

লেখক : তৈমূর আলম খন্দকার - ফাইল ছবি

রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, যারা ক্ষমতায় রয়েছেন বা ছিলেন তারা সবাই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মন-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে রঙচঙ মাখিয়ে ফলাও করে প্রচার ইতোপূর্বেও করেছেন এবং বর্তমানেও করছেন। ক্ষমতাধরদের বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়, তাদের ছাড়া গণতন্ত্র হুমকির মুখে, তারা ছাড়া বিপর্যয়ের হাত থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার মতো রাজনৈতিক দল বা এমন ব্যক্তি রাষ্ট্রে নেই এবং ভাবখানা এমন, ভবিষ্যতেও জন্ম নেবে কি না সন্দেহ। বাকপ্রতিবন্ধী এই ‘গণতন্ত্র’ যেন শুধু ক্ষমতাধরদের হাতেই নিরাপদ- এ ধরনের মনোভাব নিয়েই চলছে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

তাদের কথায় আরো প্রতীয়মান হয়, সংবিধানকে রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীনরা জীবন বাজি রেখেছে ও রাখছে, জীবন দিয়ে হলেও সংবিধানকে অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করবে এবং সাংবিধানিক নির্দেশনা থেকে একচুলও সরে দাঁড়াবে না, প্রয়োজনে মৃত্যুকে কবুল করে নেবে, তবুও সংবিধান সমুন্নত রাখবে এবং এ প্রতিশ্রুতিতে তারা বদ্ধপরিকর। ভাষণগুলো শুনতে খুবই ভালো লাগে, মজা লাগে, আরো উপলব্ধি করা যায়, ক্ষমতার লোভে মানুষ কী পরিমাণ ভণ্ড হতে পারে (!) পাকিস্তানের সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো সাহেবরাও অনুরূপ ভাষণ দিয়েছেন, সেই ভাবগম্ভীর জোরালো কণ্ঠ আমি কেন, অনেকেই শুনেছেন।

পতনের দুই দিন আগেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (ফুলের মালা গলায় ছিল) দীপ্ত কণ্ঠে ভাষণে বলেছিলেন, ‘জীবন দিয়ে হলেও সংবিধানকে সমুন্নত রাখব।’ ভাষণের রকম, রঙঢঙ মোটামুটি একই ধরনের বটে, তবে ভাষণে শুধু ভাষার পরিবর্তন হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে, যেমন- উর্দু, ইংরেজি ও বাংলা। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাধর পূর্বসূরিদের একইভাবে অনুসরণ ও অনুকরণ করছে উত্তরসূরিরা, কি সুন্দর এই ট্রাডিশন (!) কথায় বলে- চোরে চোরে খালাতো ভাই। এখন দেখা যায়, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ক্ষমতাসীনরা ভাই ভাই, মাঝখানে ক্ষমতার কশাঘাতে চ্যাপ্টা হয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে অসহায় ‘গণতন্ত্র’ ও বাকরুদ্ধ ‘সংবিধান’, যার ফলে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অসহায় জনগণ।

স্বীকৃত মতে- বাঙালি বীরের জাতি। কারণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীন হয়েছে। আবার যার নেতৃত্ব মিত্রবাহিনী দিয়েছিল বলে ভারতীয় নেতা ও সেনাদের দাবি। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর কাছে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ না করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভারতীয় সেনাপতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এ নিয়ে ভারতের দাবি বেশ জোরালো ছিল, এখনো আছে। কিন্তু সময়ের সন্ধিক্ষণে আমাদের পুলিশ, আনসার, ইপিআর, সেনাবাহিনীর সাথে ট্রেনিংবিহীন বাঙালিরা যে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায়ই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ জন্যই মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে ৯৫ হাজার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। জনসমর্থন না পেয়েই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এই বীরের জাতিকে কোনো কালে কে বা কারা ‘হুজুগে বাঙালি’ টাইটেল দিয়েছিল তার ঐতিহাসিক দিনক্ষণ পাওয়া না গেলেও বিষয়টির মর্মার্থ পর্যালোচনার দাবি রাখে।

যথোপযুক্ত পাত্রে খাঁটি ঘি বা মধু না রাখলে তা দূষিত হয়ে যায়। গণতন্ত্রকে নার্সিং করে টেকসই ও মজবুত করার জন্য রাজনৈতিক দলই এর প্রধান ও প্রথম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। রাষ্ট্র শাসনে বাদশাহী আমলের মতো উত্তরাধিকার, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলেও জেঁকে বসেছে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অনুশীলন বা চর্চা না থাকাই স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম কিছু রাষ্ট্র থাকলেও এশিয়া মহাদেশের রাজনীতি উত্তরাধিকারভিত্তিক। ফলে এ দেশে তৃণমূল রাজনৈতিক কর্মীরা সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত, ব্যতিক্রম যা আছে তা নিছক শুধু পরিস্থিতির কারণে। কারণ মন্ত্রীর আপ্রাণ চেষ্টা থাকে- মৃত্যুর পর তার সন্তানই যেন মন্ত্রী হয় সে রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য সম্ভাবনাময় তৃণমূল নেতাকর্মীদের ছেঁটে ফেলা বা সাইজ করা হয়। যিনি এমপি আছেন তিনিও একই ধ্যান-ধারণা নিয়ে এগিয়ে যান। হালে সুযোগমতো এমপি-মন্ত্রীর স্ত্রীদের করা হচ্ছে পৌরসভার মেয়র বা উপজেলা চেয়ারম্যান। ফলে নেতৃত্ব বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তৃণমূল।

ক্ষমতাসীনরা গণতন্ত্রকে যেভাবে বোঝান, জনগণ যদি সেভাবেই বুঝে নেয় তবে তো খেয়ালখুশিমতো রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতাসীনদের অসুবিধা হয় না। তা ছাড়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১) মোতাবেক জনগণ রাষ্ট্রের মালিক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামত এখন গুরুত্বহীন। অনুরূপ রাজনৈতিক দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামত গুরুত্বহীন। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রশাসিত হয় আমলাদের মাধ্যমে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১(২) মোতাবেক ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রতিটি ব্যক্তি জনগণের বেতনভুক্ত কর্মচারী হলেও তারাই এখন দলীয় রাজনীতিতে বেশি তৎপর। যারা ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্যে নেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে সাংবিধানিক ন্যায্য অধিকার থেকে।

যে যখন যে অবস্থায় (চৌকিদার থেকে বিচারক, প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত) থাকে তখন তার ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে বুঝে আসে না। তখন ক্ষেত্রবিশেষে তারা মনে করে, তারা যা করেছে তা শুধু সঠিকই নয়; বরং উৎকৃষ্ট। কিন্তু নিম্নস্তর বা তৃণমূল বা জনগণ তখন জি হুজুর, জাহাপনা বলে সব মেনে নিতে বাধ্য হলেও মন থেকে তা মানে না। মনে মনে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের সৃষ্টি হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৭-২৫৩ সালে তৎকালীন রাজনীতিজ্ঞ কোটিল্য (চাণক্য নামে পরিচিত) ‘অর্থশাস্ত্র’ শিরোনামে একটি রাজনৈতিক বইয়ে লিখেছেন, যুদ্ধ তিন প্রকার যথা- ১. প্রকাশ্য যুদ্ধ; ২. গোপন যুদ্ধ ও ৩. নীরব যুদ্ধ। স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে জনগণের নীরব যুদ্ধের কারণেও প্রভাবশালী স্বৈরশাসকদের পতন ঘটেছে, যার জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে পতনের তফসিল ঘোষণা করতে হয়নি।

ভোটারবিহীন নির্বাচনই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা সৃষ্টিতে শুধু আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা দায়ী নন; বরং এ ভোট কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপট সৃষ্টি ও প্রয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে বেতনভুক্ত কর্মচারী ‘আমলারা’ এবং এর সাফাই গেয়েছেন বুদ্ধিজীবী নামধারী একধরনের চাটুকার। গায়েবি মামলার পরিকল্পনা ও কার্যকর আমলারাই করেছে। এসব অপকর্ম করে আমলারা যে জাতি ও সংবিধানের [অনুচ্ছেদ-২১(২)] সাথে বেঈমানি করছে তা তারা বুঝেও এ মর্মে সাফাই গাইছে, তারা স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রাখছে, যদিও তারা শুধু নিজেদের ভাগ্য আকাশচুম্বী করার জন্য জেনেশুনে এসব অপকর্মে জড়িত হচ্ছে, কিন্তু দোহাই দিচ্ছে ‘স্বাধীনতা চেতনার’। স্বাধীনতার চেতনা অবশ্য অবশ্যই একটি অতি মূল্যবান কথা। কিন্তু বিভিন্ন অপকর্মের ওসিলায় ব্যবহৃত হয়ে এ মহামূল্যবান কথাটি সস্তা বাক্যে পরিণত হয়েছে।

গ্রামগঞ্জে বা রাজধানীতে সৃষ্টি হওয়া কিছু সাংবাদিক নিজের স্বার্থচরিতার্থ করার জন্য আমবিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, মাছবিক্রেতা, হকার প্রভৃতি স্থানে আইডি কার্ড শো করে কার্ডের মূল্যায়ন সস্তা করে ফেলেছে। অনুরূপ স্বাধীনতার চেতনা কথাটি এখন যত্রতত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, যা কোনো কারণে দেশপ্রেমিক একজন বাঙালির কাম্য হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার চেতনা বা চেতনার রাজনীতি জনগণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে টাকা ও আমলাতন্ত্রের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে। তৃণমূল থেকে সৃষ্টি হওয়া রাজনীতিবিদ সব বড় দল থেকেই ছিটকে পড়ছে, সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে টাকাওয়ালা ও আমলারা, অবসর গ্রহণের পরও সেই অপশক্তি পরিপূর্ণভাবে সচল থাকছে। এদের সুবাদেই সাংবাদিকদের কলমে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘কমিটি বাণিজ্য’, ‘নমিনেশন বাণিজ্য’ নামে দু’টি শব্দযুগল প্রচলন হয়েছে। এ নিয়ে তৃণমূলের হৃদয়ে হচ্ছে যথেষ্ট রক্তক্ষরণ। আমাদের জাতীয় সংসদ টাকাওয়ালাদের আড্ডা হয়ে গেছে।

‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’ এবং ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ এসব কথামালা রাজনৈতিক অঙ্গনে ভণ্ডামির সাফাই গাওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য জবাবদিহিমূলক নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিল, যা এখন শুধু স্মৃতিমাত্র। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলে মন্ত্রিত্ব হারিয়ে নিজ দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, আমিরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম ও বাম দলের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন হয়েছিল যার প্রতি সমর্থন ছিল গোটা জাতির। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাম নেতা ইনু-মেননরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে সংবিধান থেকে মুছে ফেলে এখন সংবিধান রক্ষার জন্য জীবন বাজি রাখায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন ও ক্ষমতার মোহে মানুষ যতটুকু বিবেকবর্জিত ও নীতিহীন হতে পারে এটিই কি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে না? যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির রচয়িতা ও প্রবক্তা- ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তারাই এখন এ পদ্ধতির বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমেছে। ক্ষমতার লোভে ভণ্ডামি কত প্রকার ও কী কী হতে পারে জাতি তার সাক্ষী হয়ে রইল। তবে সময় একদিন কথা বলবে, রচিত হবে রাজনৈতিক নোংরামির ইতিহাস।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement