হাদিস অধ্যয়নের প্রাচ্যতাত্ত্বিক ধারা ও দৃষ্টিকোণ
- মুসা আল হাফিজ
- ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:২৭, আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:২৯
ইসলামী জীবনব্যবস্থায় কুরআনের পরের ভিত্তি হচ্ছে হাদিস। হাদিস কুরআনকে ব্যাখ্যা করে এবং এর যথার্থতার স্বীকৃতি স্বয়ং কুরআনে নিহিত। কুরআন মুসলিমদের জানিয়েছে, আল্লাহর ভালোবাসা নবীর আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। নবী যা শেখান, যা করতে বলেন বা নিষেধ করেন তা মানতে হবে, যদি কুরআনকে মানতে হয়। নবী যা বলেন, আল্লাহর আদেশেই বলেন, এখানে প্রবৃত্তির অংশগ্রহণ থাকে না, এ হচ্ছে ওহি। হাদিসকে বাদ দিলে ইসলামী জীবনব্যবস্থার গোটা বুনিয়াদই এলোমেলো হয়ে যায়, ভেঙে পড়ে। ফলে হাদিসের শুদ্ধতা ও সত্যতা নিশ্চিত করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি হাদিসের নামে বানোয়াট, ভিত্তিহীন বক্তব্যের প্রচার রোধ করা এবং এর স্বরূপ উন্মোচনও জরুরি। ইসলামী জ্ঞানকলা উভয় কাজ সম্পন্ন করার প্রশ্নে বরাবরই যত্নশীল ও দায়িত্ববান। এর নীতি ও পদ্ধতি যেমন বিন্যস্ত, এর অনুশীলনও তেমনি ধারাবাহিকভাবে চলমান। নবীযুগ থেকেই হাদিস নয়, এমন কিছু যাতে হাদিস হিসেবে প্রচারিত না হয়, এর নিশ্চয়তা বিধানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও সতর্কতা জারি থেকেছে।
শুদ্ধ হাদিস থেকে জাল বা প্রক্ষিপ্ত হাদিস পৃথকীকরণের কাজটিও তখন থেকে শুরু হয়, এ কাজ অবিন্যস্তভাবে হয়নি। সাহাবিগণ এ জন্য অবলম্বন করতেন নির্দিষ্ট ম্যাথড বা পদ্ধতি। তাকে আরো সম্প্রসারিত করে অচিরেই হাদিসের শুদ্ধতা ও মান যাচাইয়ের শাস্ত্রগুলো দাঁড়িয়েছে, বানোয়াট হাদিসগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এর প্রতিটি শব্দ-বাক্য ও এর বর্ণনাকারীদের ওপর চালানো হয়েছে চিরুনি-অনুসন্ধান। এর ফলাফলও গ্রন্থিত হয়েছে হাজার হাজার নয়, বরং লাখ লাখ পৃষ্ঠায়। হাদিস নয়, এমন উক্তি হাদিসের নামে প্রচারিত হলেও তা প্রত্যাখ্যানের মূলনীতি ও কর্মসূচি এত সবল ও সক্ষম, যা নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করেছে যেকোনো বিখ্যাত বর্ণনাকেও। আবার যা যথার্থ হাদিস, তাকে হাদিস নয় বলে কেউ দাবি করলেও সেই দাবির যথার্থতা যাচাই ও বিশ্লেষণের নীতিমালা এত শক্তিশালী, যার চোখে ফাঁকি দিয়ে সঠিক হাদিসকে ভ্রান্ত প্রমাণের কোনো গোপন পথ কোথাও নেই। নাকদুল হাদিস বা হাদিস যাচাইয়ের এই প্রক্রিয়া হাদিস ফিল্টারিংয়ের কাজটি সম্পন্ন করতে বিপুল ও অবিশ্বাস্য কর্মপ্রয়াস ও কর্মধারার ঐতিহ্য তৈরি করেছে। এটি দেখিয়ে দেয় হাদিসের সুরক্ষা কত শক্ত, সুদৃঢ় ও ফলপ্রসূ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিশ্চিত।
কিন্তু প্রাচ্যবিদ অনেকেই হাদিসের ভিত্তি ও সুরক্ষার ব্যবস্থাটি অস্বীকার করতে চেয়েছেন। হাদিস নিয়ে পরিকল্পিত বিভ্রান্তির বহু নজির আছে তাদের রচনাকর্মে। হাদিসের প্রশ্নে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা অ্যাকাডেমিক রূপ লাভ করেছে। এর পুরোভাগে আছেন হাঙ্গেরিয়ান পণ্ডিত ইগনায গোল্ডযিহার (১৮৫০-১৯২১) ও তার অনুসারী পোল্যান্ডের পণ্ডিত জোসেফ ফ্রাঞ্জ শাখত (১৯০২-১৯৬৯)। তাদের পথরেখা অবশ্য তৈরি করে দেন পূর্ববর্তীরা। বিশেষত গুস্তাভ ওয়েল (১৮০৮-১৮৮৯) জার্মান বিশেষজ্ঞ ড. এ স্প্রেঙ্গার (১৮১৩-১৮৯৩), স্যার উইলিয়াম ম্যুর (১৮১৯-১৯০৫), আর্থার জেফরি (১৮৯২-১৯৫৯), ডানকান ব্যাক ম্যাকডোনাল্ড (১৮৬৩-১৯৪৩), আলফ্রেড গিয়োমসহ (১৮৮৮-১৯৬৫) অনেকেই। স্প্রেঙ্গার লেখেন দুই খণ্ডে The Life of Muhammad, প্রকাশিত হয় এলাহাবাদ থেকে ১৮৫১ সালে।
ম্যুরের বিখ্যাত Life of Mahomet প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত জেফরির Materials for the History of the Text of the Qur'an এবং ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত The Textual History of the Qur'an কিংবা ১৯৮০ সালে প্রকাশিত A Reader on Islam গ্রন্থ হাদিসের ন্যায্যতাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে। এর বিশ্বস্ততার ওপর সংশয়ের কুয়াশা বিস্তার করেছে। ১৯০৩ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ম্যাকডোনাল্ডের Development of Muslim Theology, Jurisprudence and Constitutional Theory এবং আলফ্রেড গিয়োমের বিখ্যাত The traditions of Islam: an introduction to the study of the Hadith literature এ ধারায় অন্যতম গ্রন্থ। গিয়োমের বইটি প্রকাশিত হয় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে, ১৯২৪ সালে। তার islam গ্রন্থও হাদিসের বিশ্বাসযোগ্যতাকে দেখেছে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে।
হাদিস নিয়ে প্রাচ্যতাত্ত্বিক অধ্যয়নের প্রথম নমুনা কার মধ্যে পাওয়া যায়, এ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। হেনরিক এলবার্ট জায়নবলের (১৯৩৫-২০১০) মতে, এলওয়েজ স্প্রেঙ্গার পদ্ধতিগত হাদিস অধ্যয়নকারী প্রথম প্রাচ্যবিদ। হাদিস অধ্যয়নে তার ছিল বিশেষ প্রস্তাবনাও। যার সারকথা হলো হাদিসের প্রধান অংশটাই কারসাজির ফসল, বানোয়াট।
ওয়ায়েল হাল্লাকের মতে, হাদিসের প্রশ্নে প্রাচ্যতাত্ত্বিক প্রথম প্রস্তাবনা হাজির হয় স্প্রেঙ্গারের কাজের আগে, ১৮৪৮ সালে। সেটা করেন গুস্তাভ ওয়েল। গুস্তাব ও স্প্রেঙ্গারকে অনুসরণ করেন স্যার উইলিয়াম ম্যুর। এডওয়ার্ড ব্রাউন মনে করেন এই ধারাকে শীর্ষে পৌঁছে দেন ইগনায গোল্ডযিহার। মোস্তফা আজমীর মতে পদ্ধতিগত প্রাচ্যবাদী হাদিস অধ্যয়নের জনক হচ্ছেন গোল্ডযিহার।
অগ্রগণ্য প্রাচ্যবিদ থিওডর নোল্ডেক (১৮৩৬-১৯৩০) ও স্নোক হরগ্রোঞ্জের (১৮৫৭-১৯৩৬) সাথে গোল্ডযিহার হচ্ছেন ইউরোপে আধুনিক ইসলামিক গবেষণার প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৮০ সালে Muhammedanische Studien গ্রন্থে হাদিস প্রশ্নে তার মতামত প্রকাশিত হয়। বইটি জার্মান ভাষায় দুই খণ্ডে প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে ইংরেজি-আরবিসহ নানা ভাষায় অনূদিত হয়। ঐতিহাসিক এ জে ওয়েনসিঙ্ক (১৮৮২-১৯৩৯) মনে করেন হাদিসের ব্যাপারে প্রথম প্রাচ্যবাদী প্রস্তাবক হলেন স্নোক হরগ্রোঞ্জে। ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার রেভরে কলোনিয়াল ইন্টারন্যাশনাল। এতে হাদিস প্রশ্নে স্পষ্ট বয়ান ছিল। ওয়েনসিঙ্কের যুক্তি হলো হরগ্রোঞ্জের কাজটি গোল্ডযিহারের কাজের চেয়ে চার বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল।
পরবর্তীতে এ অধ্যয়ন এগিয়ে যায় হেনরি লেমেন্স (১৮৬২-১৯৩৭), স্যামুয়েল মারগোলিয়োথ (১৮৫৮-১৯৪০) ও আলেকজান্ডার হেমিল্টন গিবের (১৮৯৫-১৯৭১) হাত দিয়ে। গিবের রচনা মোহামেডানিজম এবং শর্টার এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলামের মাধ্যমে প্রাচ্যবাদী হাদিস-চিন্তা আরো গতিশীল হয়। হাদিস অস্বীকৃতির যুক্তি-অন্বেষা ছিল যার প্রধান প্রবণতা। তার পর প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে এগিয়ে আসেন জোসেফ শাখত। ১৯৫০ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত গবেষণাকর্ম The origin of Muhammedan jurisprudence । প্রকাশ করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। শাখত-এর আরেক বিখ্যাত গ্রন্থ An Introduction to Islamic Law. অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে।
গোল্ডযিহার ও শাখত মৌলিকভাবে দেখাতে চান, হাদিস কোনোভাবেই মহানবীর সা: কথন নয়, তাঁর কাজের প্রকৃত বিবরণ নয়। গোল্ডযিহারের বিচারে হাদিস সাহিত্য তৈরি হয়েছে পরবর্তীতে, বিশেষত উমাইয়া আমলে, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে। তিনি হাদিসের মতো বা টেক্সট থেকে দেখাতে চান হাদিসটি তৈরি করেছে কারা এবং তা করেছে কোন স্বার্থে? শাখতের বিচারে হাদিস তৈরি হয়েছে মুসলিমদের আইনি প্রয়োজনে, আইনব্যবস্থার বিনির্মাণ ও উন্নতির জরুরতে। মুসলিমদের জন্য আইনি জীবন ছিল অবধারিত। আইনি ধারাগুলো সেই প্রয়োজনের নির্দেশে বিকশিত হয়। তারা নিজেদের প্রামাণ্যতা নিশ্চিত করার জন্য হাদিস বানাত। কোনো হাদিস কে ও কেন বানাল, শাখত তার সিদ্ধান্ত নিতে চান হাদিসের সনদ বা সূত্র পরম্পরার ভিত্তিতে। তিনি দেখান, প্রতিটি সনদে অনেক বর্ণনাকারী থাকেন। কিন্তু সনদ নামক চেইনের একটি সাধারণ কেন্দ্র থাকে, যিনি শিকলের আংটার ভূমিকা রাখেন। সনদের নানা শাখা যার থেকে বিস্তৃত হয়। তিনি হাদিসের বর্ণনাপরম্পরার মূলসূত্র। অতএব তিনিই হাদিসটি তৈরি করে থাকবেন। তাকে চিহ্নিত করতে পারলেই স্থির করা যাচ্ছে হাদিস গড়ার কারিগরকে!
গোল্ডযিহার তার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নে মুখর পৃষ্ঠাগুলোতে হাদিসের সত্যতার প্রতি সন্দেহের বয়ানকে বিন্যস্ত করেন; যা হাদিস অস্বীকৃতিকে প্রতিষ্ঠা দিতে স্থিরলক্ষ্য। তার কাজ প্রাচ্যবিদদের দ্বারা `একটি পবিত্র গ্রন্থ` হিসেবে বিবেচিত হয়। জোসেফ শাখতের বইটি ছিল এ বিষয়ক `Ôthe second scripture`বা দ্বিতীয় ধর্মগ্রন্থ। উভয়গ্রন্থকে পরবর্তী প্রাচ্যবিদরা দিকনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের হাদিসের অধ্যয়ন ও গবেষণায় এ দুই গ্রন্থের প্রভাব ছিল সরাসরি, সুস্পষ্ট ও অপ্রতিহত।
আমরা তাদের পরবর্তী হাদিস গবেষকদের মধ্যে হেনরিক আলবার্ট জায়েনবলের (১৯৩৫-২০১০) কথা বলতে পারি। জায়েনবল ছিলেন ইসলাম অধ্যয়নে পশ্চিমা অ্যাকাডেমিয়ায় বরেণ্য একজন। ক্যাম্ব্রিয়ান ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত তার Muslim Tradition. Studies in Chronology, Provenance and Authorship of Early Hadith । গ্রন্থটি তাকে দেয় দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। এর মধ্যে নতুন মাত্রা আসে ১৯৯৬ সালে, Studies on the Origins and Uses of Islamic Hadith গ্রন্থ প্রকাশের ফলে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত Encyclopedia of Canonical Hadith । হাদিসে বিশেষজ্ঞ হিসেবে পশ্চিমে তিনি ছিলেন স্বীকৃত, হাদিস প্রশ্নে বিশটিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় তার। প্রাচ্যতত্ত্ব হাদিস অধ্যয়নে তার অবদানকে `উল্লেখযোগ্য এবং যুগান্তকারী` হিসেবে অভিনন্দিত করেছে। তাকে এ ক্ষেত্রে প্রতিভাবান ও অক্লান্ত সাধক হিসেবে দেখানো হয়েছে। উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট ( ১৯০৯-২০০৬) আরেক বিখ্যাত নাম। হাদিস অধ্যয়নে তার কাজের নিদর্শন আছে ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত Islamic Political Thought এবং ১৯৬১ সালে প্রকাশিত Muhammad : Prophet and Stateman, a summary of the above two major works গ্রন্থে। ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক বার্নার্ড জি ওয়েইস (১৯৩৪-২০১৮) আরেক উল্লেখযোগ্য নাম। বিখ্যাত The Search for God's Law গ্রন্থে তার হাদিস অধ্যয়ন ও বিচারের নমুনা প্রশস্ত। ইরা এম. ল্যাপিডাস (জন্ম-১৯৩৭-) এর কথাও বলা যায়। বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক তিনি। তার বিষয় মধ্যপ্রাচ্য এবং ইসলামিক ইতিহাস। তিনি লিখেছেন এ হিস্ট্রি অফ ইসলামিক সোসাইটিজ এবং কনটেম্পরারি ইসলামিক মুভমেন্টসের মতো গ্রন্থ। এতে পাওয়া যায় হাদিস প্রশ্নে তার বিস্তৃত অধ্যয়নের ফসল।
গুস্তাভ এডমন্ড ভন গ্রুনবাউম (১৯০৯-১৯৭২) এর মতো অস্ট্রিয়ান ইতিহাসবিদ এবং প্রাচ্যবিদ, কিংবা ইতালীয়-আমেরিকান শিক্ষাবিদ, জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির ধর্ম, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি এবং ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক জন লুই এসপোসিটোর (জন্ম-১৯৪০-) কথা বলা যায়, তাদের কাজেও মূলত প্রতিধ্বনিত হয়েছেন গোল্ডযিহার-শাখত। হাদিস প্রশ্নে পশ্চিমা একাডেমিয়া এই দুই `পয়গম্বরের` রচিত `বাইবেলের যুগে` এখনো বসবাস করছে।
তবে এটাও ঠিক যে, অনেকেই তাদের হাদিস বয়ানকে মেনে নেননি। এ ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্ড অ্যাবট-এর নাম উল্লেখ করা যায়। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত Islam and Pakistan গ্রন্থে তিনি স্পষ্টতই গোল্ডযিহার-শাখতের তত্ত্বের বিরোধিতা করেন।
হাদিসের উপাদানকে তিনি ভাগ করেন তিনটি প্রধান স্রোতে। ১. সাধারণভাবে নবীর জীবন চিত্রিত হাদিস ২. নবীর কথার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হাদিস এবং ৩. এমন হাদিস, যা নবী কর্তৃক প্রাপ্ত ওহিকে বয়ান করে। অ্যাবটের এ বিভাজন মুসলিম হাদিস বিশেষজ্ঞদের ঐতিহ্যের সাথে যায় না। কিন্তু অ্যাবট মেনে নিয়েছেন হাদিসের নববী উৎস।
নাবিয়া অ্যাবোট-এর Studies in Literary Papiry: Qur'anic Commentary and Tradition গ্রন্থের কথা আমরা বলতে পারি। দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস থেকে বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। নাবিয়া এতে প্রমাণ করেন নবীর হাদিসগুলো নবীর সময়ে বিদ্যমান ছিল, এর সম্ভাব্যতা সুস্পষ্ট। এটি প্রমাণিত সত্য যে, হিজরি প্রথম শতকের পরে মুসলমানরা হাদিস তৈরি করেননি। তারা তখন নবীর সময়ে বিদ্যমান হাদিসগুলোকে সঙ্কলিত করেছেন নতুন মাত্রায়। যদিও এ সঙ্কলনের ঐতিহ্য নবীর যুগ থেকেই শুরু হয়। জার্মান বিশেষজ্ঞ জোহান ফুকের (১৮৯৪-১৯৭৪) জবানিতে আমরা শুনব একই উচ্চারণ। হরগ্রোঞ্জে, গোল্ডযিহার ও শাখতের বিচারের মধ্যে তিনি প্রত্যক্ষ করেন অবিচার। কিন্তু তাদের এ বিরোধিতায় কর্ণপাত করা হয়নি আদৌ। সে সব আপত্তি হারিয়ে গেছে উপেক্ষার উদ্যমে।
এটি বোধগম্য যে, পশ্চিমা মন হাদিস অধ্যয়নে ইসলামের সাথে পাশ্চাত্যের সম্পর্কের পুরনো ও সমকালীন ক্ষতগুলো থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। ইসলামের প্রতি পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে আছে যেসব ভাবধারা ও আবেগ, হাদিস বিচারেও সেগুলো কাজ করেছে। এসব ভাবধারা ও আবেগের প্রভাবে বিচারের যেসব ধারা ও ধরন তৈরি হয়, তাকে তিনটি বর্গে ফেলা যায়। প্রথম ধারাটি ক্রুসেডের আগে মুসলিম দুনিয়া ও পশ্চিমা জগতের মধ্যে সম্পর্কের মধ্যে যে ধরন ছিল, তার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ভয় ছিল এর মধ্যে। ছিল প্রচণ্ড ঈর্ষা ও এক ধরনের সমীহ।
দ্বিতীয় ধারাটি ক্রুসেড ও তার পরের মনোভাবের প্রতিনিধিত্ব করে। যাজকতন্ত্রের প্রচারণা দ্বারা যা উদ্দীপিত। এ ধারার মনোভাব হলো, ইসলাম মানেই বিনাশ, যাকে আগে বিনাশ না করলে সে খ্রিষ্টীয় দুনিয়ার বিনাশ নিশ্চিত করবে। সে এক মিথ্যা, এক হুমকি, এক আতঙ্ক। যাকে মোকাবেলা করতে হবে সব শক্তি দিয়ে। এ এক পবিত্র দায়িত্ব বটে!
তৃতীয় ধারাটি যুক্তিবাদী ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের চেতনা দ্বারা চালিত। প্রাচ্যবাদের বিকাশের পথে ইসলামকে উপলব্ধির যে মনোভাব প্রায়ই জেগে উঠেছে, তার ফসল ছড়িয়ে আছে নানা রচনায়। যদিও এ ধারা শতভাগ বস্তুনিষ্ঠ হতে পারেনি, তবুও ইসলাম উপলব্ধির জ্ঞানীয় অভিপ্রায় সে হারায়নি, ইসলাম প্রশ্নে প্রায়ই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন এ ধারার অনুবর্তিরা।
হাদিসের ক্ষেত্রে, প্রাচ্যবাদী মনোভাব এ তিন ধারার সমাহার। প্রথম ও দ্বিতীয় ধারা এখানে প্রবল। তৃতীয় ধারা মৃদু, অনুচ্চ। ইসলাম বা হাদিস প্রসঙ্গ নবী মুহাম্মদ সা: সম্পর্কিত তাদের উপলব্ধির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কেননা, হাদিসবিষয়ক আলোচনা সর্বদা মুহাম্মদ সা:-এর কথা, কাজ এবং অনুমোদনের সাথে যুক্ত। কিন্তু মুহাম্মদ সা:কে কিভাবে দেখে প্রাচ্যবাদ? প্রাচ্যবিদদের দৃষ্টিতে মুহাম্মদ সা:-এর ছবি দু’টি দিক থেকে দেখা যায়। এক দিকে তাঁকে একজন নবী ও রসূল হিসেবে দেখা হয়। যিনি মানবজাতিকে অত্যাচার থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
ফরাসি ঐতিহাসিক হেনরি ডে বৌলা ভিলিয়ার্স (১৬৫৮-১৭২২) আন্দ্রে ড্যানিয়েল সার্ভারি (১৭৪৩-১৮০৮) থেকে নিয়ে জার্মান কবি ইয়োহান ভল্ফগাং ফন গ্যোটে (১৭৪৯-১৮৩২), ফরাসি কবি ভিক্টর হুগো (১৮০২-১৮৮৫) প্রমুখের কণ্ঠে এই মতামত উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু গড়পড়তা প্রাচ্যবিদরা মুহাম্মদকে (সা.) একজন পৌত্তলিক, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মত্যাগী নকল নবী হিসেবে দেখতে চেয়েছে। যার শিক্ষা ও ধর্ম খ্রিষ্টান ও ইহুদি ঐতিহ্যকে ধ্বংস করবে। তিনি একজন চৌকস চিন্তাবিদ, যার রয়েছে শক্তিশালী কল্পনা ও প্রভাবক ক্ষমতা। তাকে সা: দেখা হয়েছে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার হিসেবে, যিনি ডাইনি প্রভাব ও মৃগী রোগে আক্রান্ত। এ ধারাটি প্রধান ও প্রবল।
প্রাচীন ইতালীয় কবি দান্তে আলিঘিয়েরি (১২৬৫-১৩২১) ফরাসি পণ্ডিত বার্থেলেমি ডি হারবেল্ট (১৬২৫-১৬৯৫) থেকে নিয়ে আধুনিক পণ্ডিত গোল্ডযিহার ও শাখত এ মতের ধারক, বাহক। অতএব তারা হাদিসকে সত্য হিসেবে বিশ্বাস না করার যুক্তি তালাশ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কেননা মতের দ্বৈধতা থেকে হাদিস অধ্যয়নের ভিন্নতা তৈরি হয়েছে। মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে যাদের নেতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, হাদিসের প্রতি তারা নৈতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রচারে মনোযোগী থেকেছেন। তাদের প্রবল ও বিস্তৃত স্রোতের তোড়ে পশ্চিমা দুনিয়ায় বিপরীত আওয়াজ ম্রিয়মান থেকেছে, এটা যতটা সত্য, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো তাদের চিন্তাধারার প্রভাব মুসলিম দুনিয়ায় নানা মাত্রায় ক্রিয়াশীল ও ক্রমপ্রসারমান!
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা