২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘তৃতীয় মাত্রা’

- ফাইল ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে বিতর্ক, বিতণ্ডা ও বিভেদ নতুন নয়। প্রথম যে মতটি আসে স্বাভাবিকভাবেই তার দ্বিতীয় মতটি প্রকাশিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় মতের সমন্বয়ে তৃতীয় মতটি গড়ে ওঠে। দর্শনতত্ত্বে বলা হয়- থিসিস, অ্যান্টি থিসিস ও সিনথেসিস। বাংলায় বলা হয়- অস্তি, নাস্তি ও স্বস্তি।

একটি ধারণা বা বিতর্কের যখন সূচনা হয় তখন তার বিপরীতে আরেকটি ধারণার বা বক্তব্যের আবির্ভাব হয়। প্রথম ধারণা ও দ্বিতীয় বক্তব্য নিয়ে তৃতীয় মত বা ধারণা সমন্বিত হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই তৃতীয় মতকে গ্রহণ করে, প্রাধান্য দেয়, যৌক্তিক মনে করে। তার কারণ, প্রথম ও দ্বিতীয় ধারণাটিতে যে বিপরীত বিতর্ক সৃষ্টি হয় তৃতীয় মতে তা সমঝোতা সৃষ্টি করে। লোকজন তৃতীয় মতকে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মনে করে।

লক্ষ করা গেছে, এই তৃতীয় মতের প্রতি জনগণের সতত সমর্থন থাকে। আরেকটি বিষয়- মাত্রাজ্ঞান। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এই মাত্রাজ্ঞানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কোথাও যদি স্বাভাবিকতার ব্যতিক্রম ঘটে তাহলে ‘মাত্রাজ্ঞান নেই’ বলে মানুষ উষ্মা প্রকাশ করে। এই নিরিখে ‘চ্যানেল আই’য়ে প্রবর্তিত ‘তৃতীয় মাত্রা’ বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে যথার্থভাবে প্রকাশ করে। যেমন- বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি এমনকি অর্থনীতিতে দুটো বিপরীত ধারা প্রবহমান। এ কথা ‘ওপেন সিক্রেট’ যে, বাংলাদেশের প্রতিটি গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে। তারা ‘এ’ এবং ‘বি’- এই দু’ভাগে বিভক্ত। অবশ্য যখন যারা সরকারে থাকেন অথবা বিশেষ কারণে প্রাধান্য অর্জন করেন তখন তাদের মাত্রাজ্ঞান অতিক্রম করতে দেখা যায়। অর্থাৎ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হয়ে জ্ঞান ও তথ্যের দলীয়করণ ঘটে। অনেকে অবশ্য এই দ্বন্দ্বকে ভাবাদর্শের সঙ্ঘাত বলে অভিহিত করেন। প্রশংসা, প্রশস্তি ও স্তুতি নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আবার এর বিপরীতে নিন্দা, সমালোচনা ও শত্রুতা তীব্রতা পায়। লোকেরা প্রশংসা ও নিন্দার বিপরীতে তৃতীয় বক্তব্যকে গ্রহণ করে। চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় উপস্থাপক জিল্লুর রহমান এই ধারাটি গ্রহণ করে বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত্বের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রকৃত অর্থেই জিল্লুর উপস্থাপিত টকশোটি তৃতীয় মতের ও স্বাভাবিক মাত্রাজ্ঞানের।

জিল্লুর রহমান বাংলাদেশে টকশোর একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। তৃতীয় মাত্রার জনপ্রিয়তা অন্যান্য চ্যানেলকেও টকশো করার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। তৃতীয় মাত্রার বৈশিষ্ট্য এই যে, আসলেই দু’পক্ষের মাঝামাঝি একটি নিরপেক্ষ, ন্যায়নিষ্ঠ ও নীতিবান একটি ধারা সৃষ্টিতে তিনি সক্ষম হন। ২০০৩ সালের ১৭ জুলাই অনুষ্ঠানটি প্রথম টিভিতে সম্প্রচারিত হয়। বর্তমানে তৃতীয় মাত্রা বাংলাদেশ সময় প্রতিদিন রাত ১টায় ও সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটির পরিকল্পক, পরিচালক ও উপস্থাপক জিল্লুর রহমান। তৃতীয় মাত্রায় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। প্রতিটি পর্বে দু’জন অতিথি থাকেন, যারা নিজেদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। তৃতীয় মাত্রা মূলত রাজনীতি-নির্ভর আলোচনা অনুষ্ঠান হলেও এটিতে সমাজ, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্যসহ মানববিদ্যা- প্রতিটি বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবসে, অনুষ্ঠানাদিতে রাজনীতির বাইরের বিষয়েও আলোচনা করা হয়। ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটির মোট সাত হাজার ৮৪টি পর্ব প্রচারিত হয়েছে। টকশো হিসেবে এটি বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক পুরস্কৃত হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের আলোকিত আলোচনায় তৃতীয়মাত্রা একটি অনন্য ও স্বকীয় ধারা সৃষ্টি করে। এসব টকশোতে বাংলাদেশের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা এমন সব কথা বলেন যা সমাজকে সময়ে সময়ে আলোড়িত করে। অপ্রিয় সত্য বেরিয়ে আসে। তৃতীয় মাত্রার আরেকটি গুণ হলো- উপস্থাপক খুব কম কথা বলেন। আলোচকদের বক্তব্যকে আরো ধারালো করতে প্রশ্ন ছুড়ে দেন।

বিগত দেড় দশক ধরে মানবিক মৌলিক অধিকারের সীমা সীমিত হয়ে আসছে। ছোট হয়ে আসছে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় এ ধরনের টকশো শীর্ষ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উষ্মার সম্মুখীন হয়। তাদের বলা হয়, নিশাচর। বিগত দশকে টকশো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তৃতীয় মাত্রার দর্শকপ্রিয়তাও বাড়ে। মানুষ প্রশস্তির বিপরীতে সমালোচনা শুনতে চায়। যদিও অনেকের কাছে পছন্দ নয় তা। সরকারি অনুদানের লোভ, আনুকূল্যের জন্য স্বআরোপিত সেন্সর ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত-অলিখিত বিধিনিষেধ টকশো আঙ্গিনাকে সঙ্কুচিত করে তোলে। যারা ক্ষমতাসীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন তাদের উপস্থিতি হ্রাস পায়। সাত রাজার ধন-মানিকরা চ্যানেলগুলোকে বন্দনার বাক্সে পরিণত করেন। তবে তৃতীয় মাত্রা তার অবস্থানে থেকে যায়। প্রথম থেকেই একটা অংশ একে ভালো চোখে দেখছিল না। তৃতীয় মাত্রা সতর্কতার সাথে ভারসাম্য বজায় রাখলেও তুষ্ট হয়নি প্রতিপক্ষ।

এ দিকে জিল্লুর রহমানের গ্রহণযোগ্যতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানিকতা পায়। গঠিত হয় বেসরকারি বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন ‘সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্ট্যাডিজ’-সিজিএস। গত কয়েক বছর ধরে সুশাসনের উন্নয়নের জন্য সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি সংগঠনটি এর স্বকীয় ধারায় ‘বে-অব বেঙ্গল কনভারসেশন’ নামে একটি বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই সম্মেলনে ৭০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধি যোগদান করেন। বাংলাদেশের প্রায় ৬০০ বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণী এতে অংশগ্রহণ করে। সব মতের, সব পথের মানুষকে আমন্ত্রণ জানায় তারা। সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ও প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের লোকদের সমন্বিত করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উদ্বোধন এবং সমাপ্তি অধিবেশনে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করার কথা ছিল। তবে তারা আসেননি। একই সময়ের রাজনৈতিক উত্তাপ সরকারকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। উল্লেখ্য, দেশী-বিদেশী অংশগ্রহণকারীরা গতানুগতিকভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনের তাগিদ দেন। এতেও সরকার তরফে ভুল বার্তা যায়। জিল্লুর রহমান চিহ্নিত হন একজন সরকারবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে। অথচ তার ব্যক্তি, পরিবার ও পেশাগত জীবনে কখনো সক্রিয় দলীয় অবস্থান ছিল না।

ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের শোচনীয় পরিস্থিতির কথা সবারই জানা। যেখানে বন্দনাই প্রধান সেখানে নিরপেক্ষতা ও ভিন্নমত পোষণের অধিকারও যে অস্বীকৃত হবে- এটিই স্বাভাবিক। জিল্লুর রহমানের ব্যাপারেও তা-ই ঘটেছে।

গত ২১ ডিসেম্বর জিল্লুর রহমানের গ্রামের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। জিল্লুর রহমান এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন, পুলিশ তথ্য সংগ্রহের নামে শরীয়তপুরে তার পৈতৃক বাড়িতে গেছে। তিনি ঢাকায় থাকেন। তার একটি অফিসও রয়েছে। কোনো তথ্য দরকার হলে পুলিশ সরাসরি তার কাছে যেতে পারত বা টেলিফোন করতে পারত। তারা তার পৈতৃক বাড়িতে গেছে। জিল্লুর মনে করছেন- তাকে, তার পরিবার ও তার প্রতিবেশীদের ভয় দেখানোর জন্য এটি করা হয়েছে। উপস্থাপক হিসেবে তার ভূমিকা ও কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্যই পুলিশ এটি করেছে। ফেসবুক পোস্টে তিনি আরো বলেন, ‘এটি শুধু নিন্দনীয় নয়, এটি দেখা অত্যন্ত বিরক্তিকর যে, আমার কণ্ঠ রোধ করতে পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

জিল্লুর রহমানের প্রতি এ ধরনের অবমাননামূলক ব্যবহারে জনমনে ক্ষোভের উদ্রেক করেছে। গণমাধ্যমে ব্যাপক নিন্দা পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিন্দা ও প্রতিবাদ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এক বিবৃতিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা এর প্রতিবাদ জানান। গণমাধ্যমে প্রদত্ত বিবৃতিতে তারা বলেন, বিজয়ের মাসে স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিকের এমন অভিযোগ এই আশঙ্কার উদ্রেক করে যে, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। এটি সার্বিকভাবে নাগরিক অংশগ্রহণ ও অধিকার-ভিত্তিক বাংলাদেশের টেকসই অগ্রগতিকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বুদ্ধিজীবীরা ওই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও শাস্তি দাবি করেন। সেই সাথে বুদ্ধিজীবীরা জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা ও সংবিধানে সংরক্ষিত মত প্রকাশ এবং সমাবেশের অঙ্গীকার রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। বিভিন্ন পেশাজীবী ও সচেতন নাগরিকরা প্রতিবাদ করছেন।

গণ অধিকার পরিষদ এই ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে। সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতিতে পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া ও সদস্য সচিব নুরুল হক এই উদ্বেগ জানান। বিবৃতিতে তারা বলেন, জিল্লুর রহমানকে পুলিশি হয়রানি অনভিপ্রেত ও উদ্বেগজনক। দেশে সাংবাদিকদের প্রতিনিয়ত হয়রানি করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের সাথে এমন আচরণ মূলত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ ও মুক্ত সাংবাদিকতার পথে বাধা সৃষ্টির নামান্তর। প্রবীণ সাংবাদিক ইশতিয়াক রেজা বলেন, জিল্লু রহমানের বাড়িতে পুলিশের হানা উদ্বেগজনক। আসিফ নজরুল তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এই আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানান। ঢাকা ট্রিবিউনের হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া একজন সচেতন নাগরিকের ওপর এই হামলার প্রতিবাদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদের আবেদন জানান। একজন সচেতন নাগরিক মোস্তফা কামাল বলেন, সামাজিকভাবে জিল্লুর রহমানকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই এটি করা হয়েছে। অপর দিকে, পুলিশ তার বাড়িতে যাওয়ার হাস্যকর যুক্তি দেখিয়েছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তারা এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজনে তার বাড়িতে গেছে। অন্য এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এটি তাদের নিয়মিত ডিউটির অংশ ছিল।

জিল্লুর রহমানের প্রতি এ ধরনের আচরণ প্রমাণ করে, এই সরকারের অধীনে মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান কোনোটিই নিরাপদ নয়। যদি পরিসংখ্যান নেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে, এই সরকারের আমলেই সবচেয়ে বেশি জীবনহানি হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে সমষ্টিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রিক সম্পদ বেপরোয়াভাবে লুটপাট হয়েছে। ব্যাংকগুলো ফোকলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট হয়েছে। কোটি কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পদ যদি লুটপাট হয় তাহলে তারা ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারায়। এখানে জিল্লুর রহমান কোটি কোটি অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রতীকী উদাহরণ মাত্র। তিনি কোদালকে কোদাল বলতে চেয়েছেন, সত্যকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। জিল্লুর রহমানের এটাই কি অপরাধ? সত্যের স্বার্থে, মানুষের অধিকার রক্ষার স্বার্থে তৃতীয় মতের ও তৃতীয় মাত্রার এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement