ঢাকার গণসমাবেশ ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:০৫
রাজনীতি দিয়ে রাজনীতির মোকাবেলা করা হয়- এটিই রাজনীতির সনাতনী নিয়ম। রাজনীতির মোকাবেলায় যখন ষড়যন্ত্র, শক্তিপ্রয়োগ, মিথ্যাচার, প্রতারণা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের নীতি গ্রহণ করা হয়, সেটি আর রাজনীতি থাকে না। সেটি পরিণত হয় অন্যায় ও অনাচারে।
শাসকদলের দ্বিতীয় নেতা তারস্বরে বলে যাচ্ছেন- ‘খেলা হবে’। যদিও কথাটি রাজনীতিকসূলভ নয়, তবুও মন্দের ভালো যদি খেলার নিয়ম মেনে চলা হয়। সবাই জানে, খেলারও নিয়ম আছে। বিবিধ খেলার বিবিধ নিয়ম আছে। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ভলিবল, বাস্কেটবল প্রতিটি খেলায় নিয়মনীতিকে নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষ আছে। খেলার মাঠে রেফারি আছে। কেউ যদি সেসবকে তোয়াক্কা না করে নিজ দল বা ক্লাবের পক্ষ অবলম্বন করেন আর অনৈতিক পথে জিতে যেতে চান- তা নন্দিত নয়, নিন্দিত বটে। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে- সেই অন্যায় পথের জিতে গিয়ে তাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার অপচেষ্টা। কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে ক্ষমতা ও শুধু ক্ষমতার দর্পে সব কিছুকে অতিক্রম করার রোগ একসময়ে চরম পরিণতি ডেকে আনে। সেই পথে হাঁটছে সরকারি দল। তারা রাজনৈতিকভাবে বহু আগে দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমাদের শাসক এলিটরা খেলার নিয়ম-কানুন সব ভুলে গেছেন। কথাগুলো মনে আসছিল আগামী ১০ ডিসেম্বর ২০২২ বিএনপি আহূত ঢাকার জনসভা প্রসঙ্গে।
রাজনৈতিক পথে রাজনীতির মোকাবেলা না করে শক্তি প্রয়োগের নীতি গ্রহণের বদনাম আগে থেকেই আওয়ামী লীগের আছে। ষাটের দশকে তাদের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে তখনো এ বদনাম ছিল। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দীর্ঘকালীন ক্ষমতায় থাকার পর্বেও তা আমাদের বারবার প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, আওয়ামী লীগ দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল। কার্যকালীন সময়ের বিচারেও তারা সর্বজ্যেষ্ঠ। তারা এখন দুর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করছে। তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব ও উত্তরাধিকারের দাবি করে। এসব বিবেচনায় তারা এখন যা করছে তা তাদের ঘোষিত নীতিমালার বিপরীত।
এই সে দিন বলা হয়েছে- গণভবন ঘেরাও করতে গেলেও কাউকে আটক করা হবে না; বরং তাদের চা-পানি খাইয়ে দেয়া হবে। বাস্তবে তাদের গণভবন থেকে অনেক দূরের মিছিলে গুলি খাইয়ে দিচ্ছে। তারা বলেছেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দেয়া হবে না। শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অশান্তিপূর্ণ, ভায়োলেন্ট ও সন্ত্রাসী প্রমাণ করার জন্য তারা সব ধরনের কোশেশ করে যাচ্ছে। আন্দোলন সহ্য করা তো দূরের কথা, তারা মানববন্ধনকেও রক্তাক্ত করছে। বিএনপি সূচিত বর্তমান আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে তারা বাধাবিপত্তি কিছুটা কম করলেও অবশেষে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদের নেতা-নেত্রীরা যে বিএনপিকে রীতিমতো কবর দিয়ে ফেলেছিল এখন তা দেখা যাচ্ছে তাদের জন্য কিয়ামতের ভীতি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এই বিএনপিকে তারা নাস্তানাবুদ করত, অস্তিত্বের সঙ্কটের কথা বলত এবং প্রতিদিন ভীতি প্রদর্শন করত। তার মানে হচ্ছে- একটি স্ববিরোধী প্রতারণামূলক বাতাবরণে বিএনপির নীরব অথচ গরিষ্ঠ সমর্থনের কথা জানত। যখন নীরব বিএনপি সরব হলো, জেলায় জেলায় লাখো মানুষের শপথে উদ্দীপ্ত হলো সাধারণ মানুষ। তখন তারা প্রমাদ গুনল। রাজনৈতিক নিচুতার সেসব ঘটনাবলি দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।
এখন যখন মানুষ ঢাকামুখী তখন তাদের বুকে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার হয়েছে। তারা মনে করছে, ঢাকায় যদি লাখ লাখ মানুষ বসে যায় তাহলে তাদের পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। অথচ বিএনপি বলেছে- এটি তাদের সে রকম কর্মসূচি নয়। এমনকি এটি জাতীয় সমাবেশ নয়। সব বিভাগের মতো বিভাগীয় সম্মেলন মাত্র। তাই সরকার পতনের তাৎক্ষণিক কর্মসূচি এটি নয়। কিন্তু আশ্বস্ত হচ্ছে না জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ। তাই তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে- বিএনপিকে জনসভা করতে দেয়া হবে না। সেই লক্ষ্য অর্জনে নানা ধরনের ছল-বল, কলা-কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে তারা-
১. সমাবেশের মাত্র দু’দিন বাকি। সর্বশেষ পাওয়া খবর পর্যন্ত, সমাবেশের স্থান নির্ধারিত হয়নি। বিএনপি নয়াপল্টনে জনসভা করতে চাচ্ছে। এটিই প্রমাণ করে, তারা সীমিত কর্মসূচিতে রয়েছে। অপর দিকে, সরকার তাদেরকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো বিপজ্জনক জায়গায় ঠেলে দিতে চাচ্ছে। বিএনপি অন্যত্র যেতে রাজি হলেও অনুমতি দিতে তারা গড়িমসি করে যাচ্ছে। স্থান নির্ধারিত হয়নি। দু’দিন আগে স্থান নির্ধারিত না হওয়ার অর্থ হচ্ছে- প্রকারান্তরে বিএনপিকে না বলা।
২. ১০ ডিসেম্বর ঘিরে সরকার ঢাকাকে অবরুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঢাকা ও আশপাশের এলাকা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণেই নিয়ে নেয়া হবে। তাদের সহযোগী হিসেবে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। ইতোমধ্যে রাজধানীর প্রবেশপথগুলো পুলিশ প্রহরা বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যাতে মানুষ ভীতির মুখে জনসভায় না যায়।
৩. ঘরে ঘরে তল্লাশি চলছে। বাইরে থেকে আসা লোকদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। হয়রানি করা হচ্ছে তাদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আটক করা হচ্ছে।
৪. এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সমানে গ্রেফতার অভিযান করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৩১৯ জন গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকা শহরে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চলছে।
৫. হামলার সাথে মামলাও পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মামলা হয়ছে ৪০৫টি। গ্রাম-গঞ্জে আওয়ামী লীগারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে- যাতে তারা মামলা মোকদ্দমা দিয়ে লোকজনকে ঢাকা যেতে বাধা দেয়।
৬. আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পাড়া-মহল্লায় তৎপর থাকতে বলেছে যাতে জনসভায় লোকজন না যেতে পারে। এই অভিযানে বিএনপির সমাবেশ ও কর্মসূচিতে অর্থায়নকারী, সক্রিয় সংগঠকদের ওপর খড়গ হবে আওয়ামী লীগ।
৭. বিএনপি জনসভাকে প্রতিহত করার জন্য সরকার সর্বাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শহরের প্রবেশপথ তো বটেই, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও রাস্তায় বিভিন্ন কৌশলে পুলিশ এবং আওয়ামী সহযোগী বাহিনী সক্রিয় থাকবে। ইতঃপূর্বে বিজয়ের মাসে ঢাকার রাজপথ নিরঙ্কুশ দখলে রাখার ঘোষণা তার দিয়ে রেখেছে। তবে মুক্তিকামী মানুষের স্পৃহা দেখে মনে হচ্ছে- এসব খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে।
কথায় বলে ‘খলের ছলের অভাব হয় না’। ঢাকার সমাবেশ ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য হেন অপকর্ম নেই যা আওয়ামী লীগ করছে না। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সমাবেশের নামে বাড়াবাড়ি করলে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। জনগণকে নিয়ে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। কোনটি নিয়মতান্ত্রিক আর কোনটি বাড়াবাড়ি সেটি ব্যাখ্যার সোল এজেন্সি তাদের। যেকোনোভাবে সন্ত্রাসের তকমা দিতে তাদের জুড়ি নেই। গত কয়েক সপ্তাহে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ঢাকায় পুলিশের হেফাজত থেকে দু’জন জঙ্গি ছিনতাই হয়েছে। নয়াপল্টনে ককটেল ফুটেছে। সব কিছুর জন্য তারা এখন বিএনপিকে দায়ী করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, বিএনপির সমাগত আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য সরকারই এসব করাচ্ছে। অতীতে সন্ত্রাসের টিকিট বিক্রি করে একসময়ে তারা পাশ্চাত্যকে বিভ্রান্ত করেছে। এখনো তারা এটিকে তুরুপের তাস মনে করছে। তবে দৃশ্যত পাশ্চাত্য এই প্রতারণায় আর শামিল হবে না বলে কূটনৈতিক তৎপরতা প্রমাণ দিচ্ছে। পুলিশ বিএনপিবিরোধী অভিযানকে জায়েজ করার জন্য এখন মহান বিজয় দিবস, বড়দিন ও থার্টিফাস্ট নাইটের অজুহাত দিচ্ছে।
এতসব করা হচ্ছে এটি দেখাতে যে, ঢাকার ওপর সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ঢাকায় যদি জেলা শহরগুলোর মতো বড় সমাবেশ হয় তাহলে তা জনমনে সাহসের সঞ্চার করবে। সেটি হতে দিতে চায় না ক্ষমতাসীন সরকার। সমাবেশ সফলতা পেলে সরকারের অন্দর মহলেও তা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। এমনিতেই এই সমাবেশটি অবস্থান ধর্মঘটে রূপ নেয় কি না সেটি দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। উৎসাহীরা ঢাকার ৫০টি স্থানে ৫০টি দলের সমাবেশের কথা বলেছে। জামায়াতসহ বিএনপির সহযোগী দলগুলো নৈতিক সমর্থন ঘোষণা করেছে। বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতি নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে। তার বাসার সামনে পুলিশ স্কোয়াড বসিয়েছে। এটি তার ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার জন্য হানিকর পদক্ষেপ।
আওয়ামী লীগ প্রথমত যে কম বাধা দিয়েছিল তা এখন নির্মমতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা মনে করে, ঢাকা সমাবেশ সফল হলে বিএনপির আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হবে। এই সমাবেশটি সরকার পতনের অবস্থান আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে পারে। বিএনপির এক শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন পরিষ্কার করে বলেছেন, এটি সরকার পতন আন্দোলনের সমাবেশ নয়; বরং সরকার পতন আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নের প্রস্তুতি মাত্র। সরকার জনসভার কারণে নিদারুণ ভীতির মধ্যে আছে। দেশ এবং বিদেশকে তারা দেখাতে চায় তাদের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ।
আমরা প্রথমেই বলেছি, যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলন রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমেই মোকাবেলা করা হবে- এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার নিয়মতান্ত্রিক পথে বিএনপির কর্মসূচি প্রতিহত না করে শক্তি প্রয়োগের নিন্দনীয় নীতি গ্রহণ করেছে। উপযুক্ত আলোচনায় তা প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগের মতো এত বড় দল তাদের কথিত ‘বিপুল জনপ্রিয়তা!’ এর ওপর নির্ভর না করে অন্যায়, অনিয়ম ও অযাচিত পথ বেছে নিয়েছে। প্রচলিত রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন ও সভ্যতা-ভব্যতা অতিক্রম করে নিপীড়ন ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। জনগণের ওপর আস্থাহীনতার নিদর্শন তারা অতীতের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে। একটি মানুষ অন্যায় করতে করতে যেমন অন্যায় বোধ হারিয়ে ফেলে, তেমনি আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ হারিয়ে রাজনৈতিক দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে। তারা গোটা জাতির আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার পরিবর্তে বিপরীত কিছু অর্জন করেছে। তারপরও মানুষ আশা করে- আওয়ামী লীগ আবারো সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় ফিরে আসবে। সবার জন্য গণতন্ত্র চর্চার উদার স্পেস দেয়ার পথ করে দেবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা