গণি মিয়ার মন খারাপ
- গোলাম মাওলা রনি
- ১০ নভেম্বর ২০২২, ২১:১৮
ইদানীং আমার কী হয়েছে জানি না। প্রায়ই অতীতের কথা মনে পড়ে। আর ক্ষণে ক্ষণে মানুষের মুখের পানে চোখ পড়ে যায়। মাঝে মধ্যে খুব করে আকাশ দেখি। সে দিন হঠাৎ করেই বহুক্ষণ ধরে উদিত সূর্যের রক্তিম রূপ দেখলাম। আবার ঠিক গত রাতে যখন ঘুম ভেঙে গেল তখন মনে হলো ঘরের মধ্যে জিন-পরী ঢুকছে। সারা ঘর আলোকময় হয়ে পড়েছে। ঘোর কাটতেই বুঝতে পারলাম যে জানালা দরজা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকেছে। বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে গেলাম। অনেকক্ষণ নিবিষ্টচিত্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাণভরে চাঁদ দেখতে গিয়ে কেন যে মন খারাপ হয়ে গেল, তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলাম না।
আমার অবস্থা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাই। আমি তো আগে এমন ছিলাম না- অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতাম না। মানুষের মুখচ্ছবি আমাকে প্রভাবিত করত না। তাদের আকুতি হাসি-কান্নায় প্রভাবিত হতাম বটে; কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে লোকজনের পানে তাকিয়ে তাদের মর্মবেদনা খোঁজার অভ্যাস আমার ভেতরে কিভাবে এলো তা ভেবে পাচ্ছি না। আমার মধ্যকার এই পরিবর্তন সমাজসংসারে অন্য কারো কোনো কাজে দিচ্ছে কি না বলতে পারব না। তবে নিজেকে নিদারুণভাবে ভোগাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে অতীতের কথা মনে পড়া- রাস্তার মেহনতি মানুষের মুখ-পেট-বুক এবং কোটরগত চোখের ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ হওয়া যে ভালো লক্ষণ নয় তা বিলক্ষণ টের পাচ্ছি নিজের অস্বাভাবিক বিবর্তন দেখে।
আমার সাম্প্রতিক বিবর্তনের কারণে রীতিমতো ঘুম হারাম হয়ে গেছে। প্রতিদিন পত্রিকা খুলে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেশ জাতির খারাপ খবরগুলো পড়তে গিয়ে নিজের অভাব অভিযোগ বেমালুম ভুলে যাচ্ছি। বাজারে প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের মড়ক লাগে। আজ দাম বৃদ্ধি তো কাল ব্লাক আউট অর্থাৎ সরবরাহে ঘাটতি। শাকসবজি-আটা-ময়দা-তেল-চিনির মতো বর্তমান দুনিয়ার সহজলভ্য পণ্যগুলো কেন দেশের বাজারে অগ্নিমূল্যে বিক্রি হচ্ছে এবং তাও আবার প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে না- তা চিন্তা করতে গেলে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের পর সোনা বিক্রির খবরের সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো লেনদেন নেই। অথচ এই দু’টি ঘটনা মনে হলে মন খারাপ হয়ে যায়। বহু প্রশ্ন মনের মধ্যে আসে এবং সেগুলোর জবাব না পেয়ে কিংবা জবাবদিহিতার কোনো স্থান খুঁজে না পেয়ে নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রবল চিৎকার আমার মধ্যে সুনামি সৃষ্টি করে।
আমি যখন রাস্তায় বের হই তখন উন্নয়নের গদা হাতে অসম্পূর্ণ ও ব্যর্থ দৈত্যগুলোকে দেখি তখন স্থির থাকতে পারি না। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, দুর্বিষহ যানজট, অস্বাভাবিক কোলাহল হইচই-গালিগালাজ ও খিস্তি খেউয়ের শব্দে কান ঝালাপালা হতে হতে আজ আমার শ্রবণশক্তিও মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পরিচিত সমাজ, সংসারের কারো মুখে হাসি নেই। কথা বললেই এমন সব দুঃসংবাদ শুনতে হয়, যা মনের মধ্যে নিদারুণ এক ভয় সৃষ্টি করে ফেলে। আমার বাকি জীবন ও উত্তরসূরিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইদানীং যেভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি তা জন্মের পর কোনোকালে ঘটেনি।
আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, ইদানীং অতীতের ঘটনা খুব মনে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা বিক্রির খবরে শৈশবের গণি মিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। আমার ছেলেবেলায় কম করে হলেও দশ-বারোজন গণি মিয়া ছিলেন। কেউ প্রতিবেশী কেউবা গ্রামের মাতব্বর আবার কেউবা সহপাঠী অথবা নিকটাত্মীয়। এসব গণি মিয়ার মধ্যে দুই গণি মিয়ার কাহিনী আমাকে প্রায়ই নস্টালজিয়ার মধ্যে ফেলে দেয়। প্রথম গণি মিয়া হলেন পাঠ্যপুস্তকে পড়া সেই দরিদ্র কৃষক যার নিজের জমি নেই, অন্যের জমিনে বর্গা চাষ করে বহু কষ্টে জীবন-যাপন করেন। তারপর কর্জ করে মহা ধুমধামে ছেলের বিয়ের জিয়াফত আয়োজন এবং ঋণের জালে আটকা পড়ে দুর্বিষহ যাপিত জীবনের কাহিনী। আমার বয়সী অন্যসব বিদ্যার্থীর মতো আজো আমি সেই গণি মিয়ার কথা স্মরণ করি। আমার শৈশবের সেই গণি মিয়ার গল্প থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছি তা অনুসরণ করার কারণে হাওলাত করে ফুটানি দেখানোর স্পর্ধা আমার কোনোকালে হয়নি। দ্বিতীয়ত, গণি মিয়ার মতো অপকর্ম যারা করে তাদের ঘৃণা করার যে নৈতিক শিক্ষা পেয়েছি তাও ইদানীংকালে আমার জন্য বোঝা হয়ে পড়েছে।
আমার জীবনের দ্বিতীয় গণি মিয়া কল্পলোকের কোনো গল্পের চরিত্র নন। তিনি ছিলেন আমাদের বিদ্যালয়ের দফতরি। বয়স্ক মানুষ। তখন তার বয়স বড়জোর পঞ্চাশ বছর হয়েছিল আর আমি ছিলাম সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। সেকালে মানুষের গড় আয়ু এখনকার মতো ছিল না। তখন নারীরা ত্রিশে বুড়ি হয়ে যেতেন আর পুরুষরা চল্লিশেই বুড়াদের খাতায় নাম লেখাতেন। ফলে পঞ্চাশ বছরের দফতরি গণি মিয়া তার পাকা চুল দাড়ির কারণে আজকের দিনের আশি বছর বয়সী বুড়াদের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। গণি মিয়া কৃষক গণি মিয়ার মতো কর্জ করে চলতেন না। তিনি পরিশ্রম করতেন। বিদ্যালয়ের চাকরির পাশাপাশি প্রতি হাটবারে টুকটাক ব্যবসা করতেন- কখনো আম-কাঁঠালের পাইকারি মহাজনী। নৌকা থেকে পণ্য কিনে তা খুচরা বিক্রি করে ত্রিশ-চল্লিশ টাকা লাভ করে বেজায় খুশিমনে বাজার সদাই করে বাড়িতে ফিরতেন।
দফতরি গণি মিয়া দুটো কারণে আমাদের এলাকায় নিদারুণ হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। প্রথমটি ছিল তার বিয়ে। তিনি বুড়ো বয়সে অনিন্দ্য সুন্দরী এক কিশোরীকে বিয়ে করে আমাদের এলাকার তাবৎ পুরুষের মনে নিদারুণ এক হিংসার তীর ছুড়ে দিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় কারণ ছিল স্ত্রীর প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসার দরুণ কোনো এক বর্ষণমুখর বিকেলে অভিনব উপায়ে ইলিশ মাছ কিনে এলাকায় অনন্য উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে। আমাদের কৈশোর বেলার দফতরি গণি মিয়ার ইলিশ মাছ কেনার কাহিনী পুরো এলাকায় মশহুর হয়ে পড়েছিল এবং সেই কাহিনী বললেই বুঝতে পারবেন যে, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে কেন গণি মিয়ার কথা নস্টালজিয়ার মধ্যে ফেলে দেয়।
উলানিয়া নামক একটি বড়সড় বন্দরে আমরা বসবাস করতাম। বন্দরের শেষপ্রান্তে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে গণি মিয়া তার কিশোরী নববধূকে নিয়ে থাকতেন। ঘটনার দিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। কিশোরী বধূ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন দেখছিলেন এবং তাদের কাকভেজা শরীর এবং মেঠোপথে পা পিছলে পড়ার দৃশ্য দেখে ভারি মজা পাচ্ছিলেন। এমন সময় পল্লীবধূ দেখলেন একজন পথচারী দুটো ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরছে। গণি মিয়ার বউ জানতে পারলেন যে বাজারে পানির দরে ইলিশ বিকোচ্ছে। তিনি স্বামীর কাছে আবদার করলেন ইলিশ কিনে আনার জন্য। গণি মিয়ার ঘরে সে দিন টাকা ছিল না। তিনি এক সের পরিমাণ চাল বাজারে নিয়ে গেলেন এবং সেই চাল বিক্রি করে বিরাট এক ঢাউস ইলিশ মাছ কিনে বীরদর্পে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে বাড়িতে ফিরে স্ত্রীকে অবাক করে দিলেন।
উল্লেখিত দুই গণি মিয়ার পর আমি আজকের নিবন্ধের তৃতীয় গণি মিয়ার কাহিনী বলব যিনি বয়সে কিশোর। লেখাপড়া শিখেছেন কি না তা বলতে পারব না। নিউ মার্কেটের কোনো এক ফুটপাথের দোকানের কর্মচারী গণি মিয়া থাকেন কামরাঙ্গীরচরে। সাত সকালে কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে এসে সারা দিন কাজ করে অভুক্ত শরীরে পুনরায় হেঁটে কামরাঙ্গীরচরের বস্তিতে গিয়ে রাতে রান্না করে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার মনে কী বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা বুঝতে পারবেন তার জবানিতে। একটি সামাজিক মাধ্যমে তার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তার দৈনন্দিন কর্ম ও আয়-রোজগারের যে হিসাব দিয়েছেন তা শুনলে গল্পের গণি মিয়া এবং দফতরি গণি মিয়া শোকে দুঃখে মর্মব্যথী হয়ে গড়াগড়ি করে কাঁদতেন। কিশোর গণি মিয়া বলেন, বস্তিভাড়া এবং রাতের খাবার বাবদ টাকা পরিশোধের পর তার হাতে মাত্র দুই হাজার টাকা থাকে। গ্রামে দরিদ্র পিতা-মাতার জন্য ১৫০০ টাকা পাঠানোর পর তার হাতে থাকে মাত্র পাঁচ শ’ টাকা, যা দিয়ে সকাল কিংবা দুপুরে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে সারাটি মাস তাকে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। রাতে অভুক্ত শরীরে বহু পথ হেঁটে যেতে তার কী পরিমাণ কষ্ট হয় সেই উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন যে, তার দুঃখ সরকার বুঝবে না। তারপর মন খারাপ করে তিনি এমনভাবে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকান যে, প্রশ্নকর্তা তাকে পুনরায় প্রশ্ন করার সাহস হারিয়ে ফেলেন।
তৃতীয় গণি মিয়ার মন খারাপের দৃশ্যের সাথে যখন রাষ্ট্রপতির রাজকীয় বিদেশ ভ্রমণ কিংবা প্রধানমন্ত্রীর বিলাসবহুল বিদেশ সফরের দৃশ্য সংযুক্ত করি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা বিক্রির খবর পড়ি তখন অজানা এক শঙ্কা আমার মনের মধ্যে আছর করে। যখন বিএনপির জনসভার খবর পড়তে গিয়ে জানতে পারি যে, লাখ লাখ লোক ষাটের দশকের মতো চিড়া-গুড় নিয়ে হেঁটে তিন চার দিনের জন্য জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে পড়েন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে যোগ দিতে তখন মস্তিষ্কের সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আবার অন্য দিকে যখন দেখি আওয়ামী লীগের জনসভায় ভাড়া করা লোকজন আহাজারি করে বলছেন যে, তাদের দুপুরে রাতে বিরিয়ানি, যাতায়াত এবং নগদ টাকা ও গেঞ্জি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনা হয়েছিল; কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী দালাল তাদেরকে অভুক্ত রেখে, তাদের টাকা মেরে দিয়ে লাপাত্তা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা জনসভা শেষে অভুক্ত অবস্থায় শত মাইল পাড়ি দিয়ে গভীর রজনীতে বাড়ি ফেরার জন্য রাস্তায় দলবেঁধে আহাজারি করতে করতে যে অভিসম্পাত দিচ্ছেন তা শুনলে অবোধ বোবা প্রাণীর মনও খারাপ হয়ে যাবে।
উল্লিখিত হাজারো বৈসাদৃশ্য বৈপরীত্য এবং পরস্পরবিরোধী ঘটনা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে একধরনের বোবাকান্না সৃষ্টি করে চলেছে। শোষণ-নিপীড়ন, অন্যায়-অত্যাচার, অপশাসন এবং অবিচারের বড় বড় হাতিয়ার যেভাবে সাধারণ মানুষের মন-মস্তিষ্কে এবং শরীরে ত্রিমাত্রিক আঘাত হানছে তাতে করে আমাদের জাতিসত্তা অনাগত দিনে কোন অবস্থায় গিয়ে পৌঁছায় তা কল্পনা করলে ভয় আতঙ্ক, লজ্জা এবং ঘৃণায় দেহের পেশিগুলো শক্তি হারিয়ে মানুষকে নির্জীব বস্তুতে পরিণত করে ফেলে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা