২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘৪৮-এর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এম এ গণি

মেজর আবদুল গণি - ছবি : সংগৃহীত

১. যে সেনাবাহিনী না হলে হয়তো বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত না; যে সেনাবাহিনী দেশের লাল-সবুজ পতাকাকে উড্ডীন করেছে সারা বিশ্বব্যাপী, বয়ে এনেছে আমাদের জন্য সম্মান ও গৌরবের অনন্য সব বীরত্বগাথা, সে সেনাবাহিনীর সূচনাকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি। মাত্র ৪২ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে তিনি ইতিহাসের পাতায় চিরঅম্লান হয়ে আছেন। এমন এক সময়ে তার আবির্ভাব ঘটেছিল যখন বাংলার মানুষ ছিল বড়ই অবহেলিত; মানুষের জীবন যাত্রার মান ছিল নিতান্তই দরিদ্র শিক্ষা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, সরকারি চাকরিতে যাদের প্রবেশাধিকার ছিল নামেমাত্র। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার বহু আগে থেকেই বাংলা ও আসামের অবহেলিত মুসলমানদের জন্য ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরিরত দুঃসাহসী কিছু বাঙালি মুসলমান সামরিক অফিসার এ ভূখণ্ডের অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ে ও সামরিক বাহিনীতে নিজেদের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। এ সব বীর সূর্যসন্তানদের অন্যতম হলেন মেজর আবদুল গণি। বঙ্গশার্দুল বাহিনী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা বা জনক হিসেবে তিনি ‘বঙ্গশার্দুল’ ও ‘টাইগার গণি’ নামেই বেশি পরিচিত।

২. ১৯৪৭ সালের আগে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের সেনাবাহিনীতে বড় বড় সব জাতি-গোষ্ঠীর লোকদের নিয়ে তাদের জাতির বা এলাকার নামে সামরিক রেজিমেন্ট ছিল। কিন্তু ছিল না কেবল অসহায়, অবহেলিত বাঙালি জাতির কোনো রেজিমেন্ট। বিশ্বযুদ্ধের প্রয়োজনে বাঙালি মুসলমানদেরকে নিয়ে কিছু বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করা হলেও মহাযুদ্ধ শেষে সেগুলো ভেঙে দেয়া হয়। তা ছাড়া বাঙালিরা বিভিন্ন রেজিমেন্টে যোগদান করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং আরো অনেক স্থানীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি সৈনিকের পাশাপাশি কমিশনড অফিসারদের মধ্যে মেজর আবদুল গণি (১৯১৫-১৯৫৭) ছিলেন অন্যতম। ব্রিটিশ শাসনকালে এ প্রচেষ্টা আলোর মুখ না দেখলেও পাকিস্তান কায়েম হওয়ার সূচনালগ্নেই তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন-১ ‘ইস্ট বেঙ্গল।’

৩. ১৯১৫ সালের পয়লা ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার বর্তমান ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ গ্রামে মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আবদুুল গণি। বাবা মোহাম্মদ সরাফত আলী ছিলেন কৃষিজীবী ও মা জোবেদা খাতুন আদর্শ গৃহিণী। জন্মের আড়াই বছর পরই তার মমতাময়ী মা ইন্তেকাল করেন। সৎ ভাই মো: সিদ্দিকুর রহমানসহ তারা ছিলেন দুই ভাই ও দুই বোন। মুসলিম ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য হিসেবে ইসলামী সংস্কৃতি ও জীবনধারার মধ্যেই শৈশব, কৈশোর অতিবাহিত করেন। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী তাকে মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। জীবনের শুরুতেই তিনি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ওপর জ্ঞানার্জনের সুযোগ লাভ করেন তার বাকি জীবনের প্রতিটি কর্মে এর প্রতিফলন ঘটে। স্থানীয় শিদলাই জুনিয়র মাদরাসায় পড়াশোনা শেষে তাকে চট্টগ্রামে ইসলামিয়া হাই মাদরাসায় ভর্তি করানো হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। চট্টগ্রামে ইসলামিয়া হাই মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে মহানবী সা:-এর ‘হিলফুল ফুজুল’ অনুকরণে গড়ে তোলেন ‘সবুজ কোর্তা’ নামে সমাজসেবামূলক সমিতি। সবুজ কোর্তা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অল্প সময়ের ব্যবধানে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রামে আন্তঃজেলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এম এ গণির নেতৃত্বে সবুজ কোর্তার কুচকাওয়াজে তিনি ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। বিভাগীয় কমিশনার তার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা ও পুরস্কার দেন।

৪. গণির ছাত্রজীবন কেটেছে আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার অমায়িক আচরণ, নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয়, শিষ্টাচার, সাহসিকতা, সমাজসেবা, পরোপকারী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে আর্থিক অভাবের সময় এগিয়ে আসেন চট্টগ্রামের মহকুমা প্রশাসক হামিদ হাসান নোমানী, যিনি ছিলেন অবাঙালি ও অত্যন্ত উঁচুমানের মানবহিতৈষী ব্যক্তিত্ব। গণির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেন তিনি। গণিকে তিনি তার ছেলের সাথে চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি করে নিজ বাড়িতে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে দেন। জনাব নোমানী খুলনা জেলায় বদলি হলে গণিকেও তিনি খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি করে দেন। ১৯৩৬ সালে এ স্কুল থেকেই তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানেও তার আর্থিক সঙ্কট ছিল। এমতাবস্থায় তার মামা ডাক্তার সোবহান এগিয়ে আসেন ভাগ্নের সহযোগিতায়। ইসলামিয়া কলেজ থেকে তিনি ১৯৩৮ সালে আইএ এবং ১৯৪০ সালে বিএ পাস করার পর তিনি কলকাতা ফায়ার ব্রিগেডে অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন।

৫. ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন বেজে উঠল, এম এ গণি আর বসে থাকতে পারলেন না। তিনি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার পদে যোগদানের জন্য আবেদন করেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় পাইওনিয়ার কোরে কমিশন লাভ করেন। শুরু থেকেই গণি ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, নির্ভীক, বিনয়ী, কৌশলী ও কর্মতৎপর অফিসার, যা সিনিয়র ব্রিটিশ অফিসারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রিয়ভাজনে পরিণত হন। ১৯৪২ সালের শেষ দিকে তিনি লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। এ সময় তাকে মিয়ানমারের আরাকানে জাপানি আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন করার জন্য পাঠানো হয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে জাপানিদের দ্বারা কয়েক হাজার সৈন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল বলে মূল বাহিনী থেকে তাদেরকে খাদ্য পাঠানো খুবই অসুবিধাজনক ছিল। পরিশেষে পাথর সঙ্কুুল পর্বতের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে ক্যাপ্টেন আবদুল গণির নেতৃত্বে আটকেপড়া ১২০০ সৈন্যের বিরাট বাহিনী প্রতিরোধ ভেদ করে বের হয়ে আসে। এ বিপজ্জনক সময়ে বাঙালি মুসলমান সৈনিকদের সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখে ক্যাপ্টেন গণি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন এদেরকে নিয়ে একটি বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করতে।

৬. মহাযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৪৬ সালে ক্যাপ্টেন গণিকে ভারতের ঝালনায় কোর সেন্টারে বদলি করা হয়। এ সময় থেকে তার চিন্তা-চেতনা কাজ করতে থাকে কিভাবে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠন করা যায়। এ সময় তিনি দাক্ষিণাত্যের বিশাখাপত্তম, হায়দরাবাদ, সেকান্দারাবাদ ও মুম্বাইতে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির দায়িত্ব পালন করেন যা তার জীবনে বড় ধরনের একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজে লাগে। এখানে তিনি ১২৫৬ ও ১৪০৭ দু’টি পাইওনিয়ার কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ব্রিটিশ জেনারেল মেসারভি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। আগে থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন গণিকে চিনতেন মহাযুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য। সে সুবাদে তিনি জেনারেল স্যার মেসারভিকে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠন করার অনুরোধ জানিয়ে একটি পত্র লিখেন। এ পত্রের সাথে তিনি সব তথ্য ও যুক্তি পেশ করে ২০ পৃষ্ঠার একটি স্মারকলিপিও পেশ করেন। মেসারভি এ প্রস্তাবকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছিলেন এবং এ পত্রের উত্তরে জানান, ‘আমি আশা করি, বিশ্বকে তোমরা দেখাতে পারবে বাঙালি মুসলমান সৈনিকরা অন্যান্য সৈনিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’ ঝালনার কোর সেন্টারের অধিনায়ক লে. কর্নেল মারিয়াটি বাঙালি রেজিমেন্ট গঠনের বিষয়ে ক্যাপ্টেন গণিকে পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন গণির অধীনে ১২৫৬ ও ১৪০৭ পাইওনিয়ার কোম্পানি দু’টি বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে গঠিত ছিল বলে এগুলো পূর্বপাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ১৯৪৭ সালে ক্যাপ্টেন গণির নেতৃত্বে কোম্পানি দু’টি বিশেষ ট্রেনযোগে মুম্বাই থেকে ঢাকায় আনা হয়।

৭. ঢাকায় আসার পর বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করার জন্য ক্যাপ্টেন গণি জোর তৎপরতা শুরু করেন। অবশেষে বাংলার বাঙালি মুসলমানদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রাণের আকুতি, ক্যাপ্টেন গণির আজীবন লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করতে শুরু করে। পাকিস্তান জন্ম লাভের শুরুতেই সরকার ক্যাপ্টেন গণি ও আরো অনেকের ইচ্ছানুযায়ী বাঙালি মুসলমানদের জন্য একটি রেজিমেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যার নামকরণ করা হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। ক্যাপ্টেন গণি ও অন্যান্য অফিসারের আপ্রাণ চেষ্টায় মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গঠনের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সেনা অফিসার লে. কর্নেল ভি জে ই প্যাটারসনকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে নিয্ক্তু করা হয়। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় বাঙালি মুসলমানদের বহু প্রতীক্ষিত সে মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়। এ ঐতিহাসিক দিনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন-১ ইস্ট বেঙ্গল। পাকিস্তানের ইতিহাসে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পূর্বপাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও মন্ত্রিপরিষদের সব গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান, উচ্চপদস্থ সব সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। শুরু হয় বাঙালিদের গৌরবময় ইতিহাসের শুভযাত্রা এবং মার্শাল রেস হিসেবে প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ। মুছে গেল ২০০ বছরের গ্লানি। এর মাধ্যমে বীজ বপন করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের। ‘সৌম্য, শক্তি ও ক্ষিপ্রতা’র আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যাত্রা শুরু করে ‘বঙ্গশার্দূল’ বাহিনী। কে জানত যে, এ রেজিমেন্টই একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবে!

৮. অনুষ্ঠানের চা-চক্রে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার অবতারণা হয়। ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান সবার উদ্দেশে বলেন, ‘From now onwords Bengali Soldiers will speak in Urdu, not in Bengali.’ এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করে ক্যাপ্টেন গণি সবার সামনে আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, ‘Excuse me Sir, We Bengali soldiers will never speak in Urdu, but in our mother tongue Bengali.’ এর জবাবে আইয়ুব খান ‘Shut up. Sit down.’ বলে ক্যাপ্টেন গণিকে থামিয়ে দেন। এ দুঃসাহসী ভূমিকার জন্য এ সময় থেকেই তাকে ‘টাইগার গণি’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। এরকম স্পষ্টবাদিতার উদাহরণ আজকার দিনে বিরল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো- এ ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালেই প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় এবং মেজর গণি হলেন এ অদৃশ্য আন্দোলনের মহানায়ক। এ ঘটনার পর থেকে সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন গণির অবস্থান নড়বড়ে হতে থাকে। চৌকস অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তার পদোন্নতি হচ্ছিল না। ইস্ট বেঙ্গল থেকে তাকে বদলি করা হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড, দিনাজপুরে। সর্বশেষ তাকে ১৪ ডিভিশন হেড কোয়ার্টার, ঢাকায় বদলি করা হয়। যথাযথ মূল্যায়ন ও পদোন্নতি না হওয়ায় ১৯৫৩ সালের শেষদিকে তিনি রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। পদত্যাগ গৃহীত হয় এবং তাকে অবসর দেয়া হয়। অবসরকালীন ক্যাপ্টেন গণিকে তার অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অবসরোত্তর (retrospective) ‘মেজর’ পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

৯. রাজনৈতিক জীবন : মেজর গণির নতুন জীবন শুরু হয়। অযথা সময় ক্ষেপণ না করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নিজেকে কাজে লাগানোর জন্য তিনি রাজনীতিতে নেমে পড়েন। তিনি ছিলেন ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে সুশিক্ষিত। তিনি আরবি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রাণজাগানিয়া বক্তব্য শুনে অসংখ্য মানুষ তার ভক্তে পরিণত হয়। তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বে উদীয়মান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৫৪ সালের ২২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে তার চিন্তা-চেতনা ছিল অনেক সুদূরপ্রসারী। তার সামগ্রিক চেষ্টা ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণ, সাম্য, ইনসাফ ও ন্যায়নীতি কায়েম, মানুষের চারিত্রিক উন্নয়ন, জনগণের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করা এবং মানুষকে সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহ্বান জানানো। তিনি সরকারের কাছে দেশ ও জাতির কল্যাণে বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেন। যেমন- দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীতে পূর্বপাকিস্তানের যুবকদের কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগদানের জন্য ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা; সারা দেশের যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। পূর্বপাকিস্তানের পার্লামেন্টে তিনি জ্বালাময়ী ভাষায় অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে মাটি ও মানুষের কথা তুলে ধরতেন। তার বক্তব্য এতই শ্রুতিমধুর ও আকর্ষণীয় ছিল যে, প্রত্যেক সদস্য ও স্পিকার মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ করতেন। মানুষের কল্যাণ সাধনই ছিল তার জীবনের ব্রত। মানুষের ওপর মানুষের শোষণ, জুলুম, নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির পথ হিসেবে ইসলামী জীবনাদর্শই যে একমাত্র পথ। তাই তিনি একটি প্রকৃত ইসলামী দল গঠনের উদ্যোগও নিয়েছিলেন যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘ইসলাম লীগ’। এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার আগেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। সামরিক বাহিনীতে মাত্র ১২ বছর সময়ে জুনিয়র একজন অফিসার হয়েও তিনি অসাধ্যকে সাধন করে নিখাদ দেশপ্রেমের উজ্জ্বল ও বিরল এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন। রাজনীতিবিদ হয়েও অতি অল্প সময়ে তিনি জনগণের জন্য যা করেছেন তার তুলনা হয়তো ইতিহাসে দ্বিতীয় একটি পাওয়া যাবে না।

১০. ১৯৫৭ সালের ২৯, ৩০ ও ৩১ অক্টোবর তিন দিনব্যাপী ওয়ার্ল্ড ভেটার্ন্স ফেডারেশন আয়োজিত সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের জন্য জার্মানির বার্লিনে যান। এ সম্মেলনে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উদ্দীপনামূলক, উত্তেজনাপূর্ণ ও জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। একপর্যায়ে তিনি আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১১ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যান। তার লাশ দেশে আনার পর যথাযথ সামরিক মর্যাদায় কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে দাফন করা হয়। চলে গেলেন মেজর গণি, কিন্তু রয়ে গেল তার সৃষ্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ক্ষণজন্মা এ নির্ভীক বীরপুরুষ, সামরিক অফিসার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাত্র ৪২ বছর এ নশ্বর দুনিয়ায় বেঁচে ছিলেন।

১১. অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কাজ করার তীব্র স্পৃহা, নির্ভীক ও তেজস্বী মনোভাব ও সর্বোপরি শক্তিশালী ঈমানি শক্তি থাকলে স্বল্প সময়েও যেকোনো অসাধ্যকে সাধন করা যায়, মেজর গণি এর উদাহরণ। তিনি সামরিক বাহিনীতে উচ্চপদে আসীন হতে না পারলেও তার মাধ্যমে যে অসাধারণ ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সাধিত হয়েছিল তা বাঙালি মুসলমানদের জন্য ছিল অত্যন্ত সম্মান, গৌরব ও উচ্চ মর্যাদার এবং জগতের বুকে ‘চির উন্নত মমশির’ নিয়ে বেঁচে থাকার বিষয়। আর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল, এ জাতির জন্য বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ সৃষ্টির নিমিত্তে যুদ্ধ করার জন্য একদল তাজা, জীবন্ত, আত্মত্যাগী, জানবাজ সংগ্রামী বীর সেনানীর রেজিমেন্ট সৃষ্টি করা। তাই তার জীবন ইতিহাস ‘তাজা জীবন্ত শ্রমমহান’ হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে চির উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত করে রাখবে। বাংলাদেশ যতদিন পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে, মেজর আবদুল গণি ততদিন এর আকাশে ধ্রুবতারার মতো চির উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন।

লেখক : সামরিক ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement