রাজনৈতিক নীচুতা
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ০৯ নভেম্বর ২০২২, ২০:২৪
রাজনীতিতে সততা, শুভ্রতা ও সৌজন্য নিঃশেষ প্রায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেতাবি ভাষায় একে বলা হয়, ‘নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি’। প্রথম থেকেই এ বদনাম রয়েছে আমাদের। বিগত একযুগে ক্ষমতাসীন দলের সৌজন্যে এই নিম্নমান তলায় ঠেকেছে। এটি কোনো ব্যক্তিগত মন্তব্য নয়। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বিভিন্ন সময়ে তাদের গবেষণা ফলাফলে ক্রম হ্রাসমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধোগতির প্রমাণ দিয়েছে। করোনা কালে মাঠের রাজনীতি না থাকায় এ বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন ছিল। এখন সমাগত নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক তৎপরতা যখন শুরু হয়েছে তখন সেই অধোগতির প্রমাণ মিলছে। গত কয়েক মাস ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত বিএনপি ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের জনশক্তি প্রকাশ করছে। প্রথম পর্যায়ে রাজধানী ঢাকা শহর এবং পরবর্তীকালে বিভাগীয় শহরগুলোতে তাদের বিশাল বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সামনে আরো কয়েকটি বিভাগীয় শহরে তাদের কর্মসূচি রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এসব রাজনৈতিক সমাবেশ অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই।
দেশের সংবিধান ও আইন নাগরিকদের সমাবেশের মৌলিক স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু সরকার রাজনৈতিকভাবে ও আইনের মাধ্যমে এসব সমাবেশ বন্ধ করে না দিয়ে রাজনৈতিক অপকৌশল প্রয়োগ করে নীচুতা, সঙ্কীর্ণতা ও বেপরোয়া মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। একদিকে তারা সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে, অপর দিকে সেই জনসভা ভানচাল করার জন্য অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। জনসমাবেশের প্রাক্কালে শহরগুলোকে একরকম অবরোধ করা হয়। সব ধরনের যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্বাভাবিক জনচলাচল বন্ধ করে মানুষের জন্য অশেষ দুর্ভোগের সৃষ্টি করা হয়। আর এসবই করা হয় নানা ধরনের সংগঠনের আদলে। এসব সমাবেশের মধ্যে বাধা, বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সদ্য সমাপ্ত বরিশালের সমাবেশ সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
বিএনপির বিভাগীয় সে সমাবেশের আগের দিন থেকেই বরিশাল শহরে প্রবেশের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিন চাকার যান ও বিভাগের অন্যান্য জেলা থেকে বরিশালমুখী লঞ্চ বন্ধ করে দেয়া হয় আরো দুদিন আগে। সমাবেশ শুরুর আগের দিন সকাল থেকে বন্ধ মাইক্রোবাস, সাধারণ বাস, সরকারি যানবাহন ও স্পিডবোট তথা সব ধরনের যানবাহন। অবশেষে ঢাকা-বরিশাল লঞ্চ সার্ভিসও বন্ধ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথ বন্ধ করে দেয়ার বাহানাও পাওয়া যায়। সরকারের বশংবদ মালিকরা তেলের দাম কমানো ও যাত্রী সঙ্কটের মতো কুযুক্তি দিয়ে লঞ্চ বন্ধ করার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে চান। এমনকি শহরের প্রবেশ পথগুলোতে পুলিশ স্কোয়াড বসিয়ে জনসমাবেশের আগমন প্রতিহত করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়।
সমাবেশের প্রবেশপথ চাঁদমারী স্টেডিয়ামের সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে সাধারণ মানুষ ও যানবাহন তল্লাশি করতে দেখা যায়। পুলিশ সদস্যরা বঙ্গবন্ধু উদ্যান ও লঞ্চঘাট এলাকায় যাওয়ার কারণ জানতে চায়। এতে জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েন। নগরীর প্রবেশপথ গড়িয়ারপাড়, রুপাতলী, কালিজিরা ও সদর রোডসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের তল্লাশি চৌকি ছিল। কার্যত বরিশাল শহর সারা দেশ থেকে তিন দিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনিতেই সমাবেশে বাধা দেয়ার কোনো নৈতিক অধিকার সরকারের নেই। সরকারি পুলিশকে বিরোধীদলীয় সমাবেশ পণ্ড করার কাজে লাগিয়ে সরকার ফৌজদারি অপরাধ করেছে। সমাবেশ ব্যাহত করার জন্য নানা ধরনের ছলবল কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়। তারা জনগণকে নিতান্তই নির্বোধভাবে। আর জনসাধারণ নিশ্চিতভাবেই বোঝে যে, ‘খলের ছলের অভাব হয় না।’ এর ফলে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হয়। অনিবার্য প্রয়োজনে তারা বরিশালে প্রবেশ করতে পারেননি। যাদের বরিশাল থেকে অন্যত্র যাওয়া প্রয়োজন তারা বরিশাল ছাড়তে পারেননি। এত কূটকৌশল করেও তারা নিশ্চিত ছিল না যে, জনসাধারণ আসবে কি আসবে না। সেজন্য তারা শক্তি প্রদর্শনের নগ্ন মহড়া দেয়। তাদের সোনার ছেলেরা বরিশাল শহরের বিভিন্ন সড়কে মোটরসাইকেল মহড়া দেয়। লাঠিসোটা নিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হয়। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, যে অন্যায়টি সোনার ছেলেরা করছে সেই অন্যায়বোধও তারা হারিয়েছে। মনে করছে, এটা বড় বাহবার কাজ।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবি প্রমাণ করে যে, অপরাধ যেন সাহসের অপর নাম। বরিশালের আগে আরো চারটি বিভাগীয় শহরে বিএনপির সমাবেশ হয়। সবখানেই নগ্ন সন্ত্রাস ও সরকারি হরতালের মাধ্যমে সমাবেশকে বানচাল করার প্রয়াস নেয়া হয়। তা ছাড়া সমাবেশে যাওয়ার পথে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও মারধর ছিল সাধারণ ঘটনা। বরিশালের ক্ষেত্রেও হামলা ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। বরিশালের গৌরনদীতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনসহ কয়েকজন নেতার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সেখানে যুবলীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে হামলা চালালেও মামলা করা হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। আরো মজার কথা, এই হামলার নেতা দাবি করেন যে, ইশরাক হোসেনের নেতৃত্বে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। এতে তাদের ১৫ জন আহত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার, গৌরনদী মডেল থানার ওসি বলেছেন, যুবলীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এতে ইশরাক হোসেনকে প্রধান আসামি করে ৭০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আরো ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ কৃতিত্বের সাথে দাবি করছে যে, তারা এজাহারভুক্ত সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন থানায় বিএনপির ৪০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।
এত বড় বড় সমাবেশ মহাসমাবেশ দেখে বিগড়ে গেছে তাদের মাথা। এত অল্প সময়ে এই বিরাট সাফল্য, পরিমাপ করছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা ছাড়ার ভীতিতে আক্রান্ত হয়েছে তারা। নভেম্বরে বিএনপিকে ছাড় দিলেও ডিসেম্বর থেকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিশাল সমাবেশকে তিনি ভাড়া করা লোকদের সমাবেশ বলে হাস্যকর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, লোক ভাড়া করে সমাবেশ করে আমাদের ভয় দেখান? এখন ছাড় দিচ্ছি, ডিসেম্বরে ছাড়ব না। ডিসেম্বরে খেলা হবে উল্লেখ করে বিএনপির উদ্দেশে তিনি আরো বলেন, নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা ভুলে যান। নির্বাচন করে আসতে হবে। তত্ত্বাবধায়কের ভূত মাথা থেকে নামান। এটি সর্বোচ্চ আদালত নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আমাদের কোনো দোষ নেই। তত্ত্বাবধায়ক আর আসবে না। ওইটা জাদুঘরে চলে গেছে।’
তিনি আরো বলেন, দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় আছে। তা দেখে বিএনপির ভালো লাগে না। তাই তাদের ভালো লাগার ওষুধ দিয়ে তাদের ভালো লাগাতে হবে। একই সভায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, সমাবেশের নামে তারা যদি আবার কোনো উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় তাহলে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ওই কেরানীগঞ্জের কারাগারে আমরা দেখব। সেটাই হলো, বিএনপি নেত্রীর যথাযথ স্থান। উল্লেখ্য, যে বেশ কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন। দেশ থেকে পালানো তারেক রহমানের নির্দেশে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায় ঢাকাবাসী তাদের শক্ত হাতে প্রতিহত করবেও বলে বাহাউদ্দিন নাসিম মনে করেন। এসব সমাবেশের মাঝে বিএনপির পতন ধ্বনি শোনার মজার মন্তব্য করেছেন ওবায়দুল কাদের।
ক্ষমতাসীন দল সাম্প্রতিক বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করে ক্ষ্যান্ত হয়নি। বিগত প্রায় ১৫ বছরে তারা প্রমাণ রেখেছে হত্যার রাজনীতির। মামলা-হামলার, গুম-খুনের রেকর্ড গড়েছে তারা। গত রোববার সিলেটে আম্বরখানা বড় বাজার এলাকায় ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে বিএনপি নেতা আ ফ ম কামালকে। বিএনপি নেতারা এ হত্যার জন্য বিরোধী পক্ষকেই দায়ী করেছেন। সিলেটে ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য বিভাগীয় সম্মেলনকে উত্তপ্ত করতেই এই খুন করা হয়েছে বলে তারা আশঙ্কা করেন। নিত্যদিন এ ধরনের হত্যা, গুম ও খুনের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। হামলা-মামলা ও নিপীড়ন-নির্যাতনে জর্জরিত বিরোধীপক্ষ। গোটা দেশে একটি ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একটি ভীতির রাজত্ব চলছে। প্রধান বিরোধী পক্ষ তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষেরা ও সিভিল সোসাইটির লোকেরা সাধারণ জনস্বার্থের দাবি জানিয়েও সরকারের কোপানলে পড়ছে। এটি শাসক দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নীচুতা বলেই চিহ্নিত হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা সবারই গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা তথা নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক পরিবর্তন জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। সেই লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধীদলসহ সব নাগরিক সাধারণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করবেন, এটাই জনগণের প্রত্যাশা। পক্ষ-বিপক্ষ সবাইকেই রাজনৈতিক নীচুতা পরিহার করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা