গৃহপালিত বিরোধী দলের সাতকাহন
- গোলাম মাওলা রনি
- ০৩ নভেম্বর ২০২২, ২০:১৫
গৃহপালিত শব্দটি নিয়ে কেউ যদি কোনো নিবন্ধন রচনা করতে চান তবে তাকে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তিনি গৃহপালিত পশু নাকি গৃহপালিত মানুষ নিয়ে লিখবেন। অন্য দিকে, আজকের শিরোনাম অর্থাৎ গৃহপালিত বিরোধী দল নিয়ে কারো রচনাই পূর্ণাঙ্গতা পাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত নিবন্ধকার গৃহপালিত পশুর আচার-আচরণ, চাল-চলন, অভ্যাস-হাঁক-ডাক, খানা-খাদ্য, আহার-বিহার, নিদ্রা এবং বায়োলজিক্যাল অর্থাৎ জন্মবৃত্তান্তসহ জীবনচক্র সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের অধিকারী হবেন। পশু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের পর তাকে গৃহপালিত নর-নারীদের সম্পর্কে একই জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং পরবর্তীতে রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে পশু-মানুষ রাজনীতি এবং গৃহপালিত এই শব্দগুলোকে একটি চতুর্ভুজের চারটি কোণে স্থাপন করে সুদীর্ঘ গবেষণার পরই গৃহপালিত বিরোধী দল সম্পর্কে নিবন্ধ রচনা করলে তা সুখপাঠ্য হবে।
আজকের শিরোনাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার আগে লম্বা ভূমিকা টেনে আমি মোটামুটি নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার যে চেষ্টা করলাম তা কতটা বাস্তবসম্মত কেবল নিবন্ধ পাঠ অন্তেই সম্মানিত পাঠক আন্দাজ করতে পারবেন। কাজেই সময় নষ্ট না করে এখন মূল প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করতে চাই যাতে পাঠকের আগ্রহের যেন ঘাটতি না দেখা দেয়।
আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, গৃহপালিত পশু নিয়ে আলোচনা ব্যতিরেকে মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাবে না। তাই পশু-পশুত্ব ও গৃহপালিত ওই তিনটি শব্দমালা নিয়ে অতি সংক্ষেপে আমার বক্তব্য পেশ করতে চাই।
প্রকৃতিতে পশুরা এমনই সব কাজ সুচারুরূপে করতে পারে যখন তাদের আবাসস্থল হয় কোনো নিবিড় বনভূমি বা অভয়ারণ্য যেখানে প্রকৃতির আপনলীলায় অন্য পশুদের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই সংগ্রাম করে প্রতিটি পশুকে টিকে থাকতে হয়। একইভাবে পাখি-কীট পতঙ্গ পানিতে বসবাসরত হাজারো প্রাণী এবং মাটির নিচে বসবাসরত নানা রকম অদ্ভুত সব জীবও তার আপন আলয়ে বসবাসের সুযোগ পেলে তার চরিত্র ঠিক রাখতে পারে। বনের জন্তুকে চিড়িয়াখানায় অথবা বন্যপশুকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করা অথবা উড়ন্ত পাখিকে খাঁচায় বন্দী অথবা মাছকে অ্যাকুরিয়ামে আটকে রেখে প্রাণীগুলোর আদি ও আসল বৈশিষ্ট্য অনুধাবন অসম্ভব।
মানুষ আর পশুর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো, পশুর বিবেক নেই। তারা বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা করতে পারে না। এ ছাড়া পশুরা মানুষের মতো বিদ্রোহ বিপ্লব করে না এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে নেতা নির্বাচন করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, পশুদের লজ্জা-শরম হায়া নেই। স্মরণশক্তি খুবই নিম্নমানের। তার বিক্ষুব্ধ হয়ে হঠাৎ গোঁয়ার্তুমি শুরু করে এবং পরে শান্ত হয়ে গেলে গোয়ার্তুমির কার্যকারণ মনে রাখতে পারে না। তাদের মধ্যে প্রকৃতিপ্রদত্ত শৃঙ্খলা ছাড়া অন্য কোনো শৃঙ্খলা নেই। নিয়ম-কানুন আইন-আদালত-নীতি নৈতিকতা পশু সমাজে নেই। যৌনতা, খানাপিনা, সন্তান উৎপাদন ইত্যাদি কাজকর্মে তাদের সাথে মানুষের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
পশুদের কয়েকটি বিশেষ শ্রেণী বা গোত্রকে সেই আদিকাল থেকেই মানুষজন বশ্যতা স্বীকার করিয়ে এবং পোষ মানিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার যে রীতি চালু করেছিল তা আজও অব্যাহত রয়েছে। মূলত খাদ্য ও পানিয়ের উৎস হিসেবে সুস্বাদু গোশত ও দুধের উৎস হিসেবে কিছু পশু টার্গেট বা নির্বাচন করা হয়। কিছু পশু নির্বাচন করা হয় ভারবাহী হিসেবে এবং কিছুকে পোষ মানানো হয় শখের বসে বা নিরাপত্তাজনিত কারণে। গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, মোরগ, মুরগি ইত্যাদি পশুপাখি গৃহপালিত বানানোর কারণ আমরা সবাই বুঝি। অন্য দিকে, হাতি, ঘোড়া, মহিষ, গাধা, ইত্যাদি পশুর বশ্যতা মানবজাতির কী প্রয়োজনে লাগে তা অনুধাবনের জন্য খুব বেশি পাণ্ডিত্যের দরকার নেই। আর কুকুর, বিড়াল, খরগোশ ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তাও আমরা কমবেশি বুঝি।
মানুষ তার প্রয়োজনে পশুকে গৃহপালিত করার পর মানুষ আর পশুর মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য দেখা দেয় তা হলো- পরাধীন মানুষের বংশধররা স্বাধীনতার লড়াই সংগ্রামের সূচনা করে। অন্য দিকে, গৃহপালিত পশুর পরবর্তী বংশধররা একান্ত অনুগত গৃহপালিত প্রাণিরূপে নিজেদের আত্মস্থ করে ফেলে। এই দুনিয়াতে হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে একটি সাধারণ উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে গৃহপালিত গাধা ঘোড়া গরু ছাগলের বাচ্চারা বন্দিত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে বন জঙ্গলে ফিরে গেছে এবং তাদের আদি পুরুষদের সাথে বসবাস করেছে। অথবা এমন দৃশ্যও পৃথিবীবাসী দেখেনি যেখানে কোনো বনগরু বনমোরগ অথবা বন্যহাতি তাদের স্বজাতীয় গৃহপালিত পশু-পাখিদের মনুষ্যজাতির বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার জন্য সদলবলে লোকালয়ে হামলা চালিয়েছে।
পশু-পাখিদের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের সাথে যদি পরাধীন মানুষদের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাবো যে, তারা সর্বদা মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ছিল। কোনো কোনো স¤প্রদায় হয়তো পরাধীনতার সুফল থেকে মুক্তির জন্য বংশপরম্পরায় হাজার বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ ও আহ্বাদ মন-মস্তিষ্ক থেকে বাদ দেয়নি। এটি কেবল তখনই সম্ভব হয়েছে যখন তারা নিজেদের মধ্যে মনুষ্যত্বের বোধ বৃদ্ধি রুচি অভিরুচি, বিবেক, নীতি-নৈতিকতা, বিচারশক্তি এবং মানবিকতা সংরক্ষণ করতে পেরেছে। কিন্তু যারা পশুর মতো সবকিছু অবশেষে মেনে নিয়েছে, নিজেদের মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছে এবং নিজেদেরকে ভারবাহী অথবা গোশত দুগ্ধ সরবরাহকারীরূপে সমর্পিত করে ফেলেছে তারা পশুদের চেয়েও অধিকতর গ্রহণযোগ্য গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। আপনি যদি প্রশ্ন করেন যে, কিছু মানুষ যদি পশুদের মতো গৃহপালিত হয়ে যায় তবে এমনকি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে পড়ে। আপনার এমনতর প্রশ্নের উত্তরে আমি সরাসরি কিছু না বলে ছোট একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি অনেকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন- ধরুন একটি বনগরু বা বন্যগাভীর কথা। কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কিংবা একজন মানুষও যদি বনের মধ্যে কোনো বনগরুর সামনে পড়ে তবে তাদের মধ্যে এমন হাঁটু কাঁপুনি শুরু হয়ে যাবে যে, ঠিকমতো দৌড়ে পালানো কিংবা কোনো গাছে উঠে আত্মরক্ষার হিম্মতটি পর্যন্ত উধাও হয়ে যাবে। অথচ একই প্রাণী যখন গৃহপালিত হয়ে যায় তখন সাত আট বছরের দুরন্ত ও দুষ্ট বালক-গরুটির লেজটি উঁচু করে প্রাণীটির গুহ্যদার কিংবা যৌনাঙ্গে মরিচের গুঁড়ো ঢুকিয়ে দিয়ে তামাশা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। গৃহপালিত প্রাণীটি যখন প্রবল যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তখন দুষ্ট বালক খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে।
পশুদের মতো কিছু মানুষ যখন গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত হয় তখন তাদের জীবনের দুঃখ দুর্দশা, হতাশা-বিপর্যয় এবং অপমান পশুদের থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অন্য দিকে, গৃহপালিত পশুদের মধ্যে কেবল শিকারি কুকুর এবং কিছু শিকারি পাখি দ্বারা নীতিহীন কর্ম করানো সম্ভব হয়। বাকি পশু-পাখিরা নীরবে সবকিছু সহ্য করে কেবল দুধ-গোশত দেয়া অথবা ভারবহনসহ ব্যক্তিগত বিনোদন অথবা সার্কাসের বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু গৃহপালিত মানুষদের দিয়ে এমন সব কুকর্ম করানো হয় যা দেখে পৃথিবীর নিকৃষ্ট ও হিংস্র প্রাণীরা পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। শয়তানরা ভয় পেয়ে যায়। অশরীরী আত্মাগুলো অস্থির হয়ে পড়ে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশে কান্নার রোল পড়ে যায়।
পশু পশুত্ব গৃহপালিত শব্দ এবং মানুষ ও পশুর গৃহপালিত্বের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা আর না বাড়িয়ে এবার আজকের শিরোনাম সম্পর্কে আলোচনা আরম্ভ করতে চাই। গৃহপালিত বিরোধী দলের সাতকাহন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে অতি সংক্ষেপে রাজনীতি নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক। বাংলা ব্যাকরণে রাজনীতিকে বলা হয় ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। রাজার যে নীতি তাই রাজনীতি। অনেকে ভুল করে রাজনীতিকে নীতির রাজ্য বলে থাকেন যার সাথে পৃথিবীর কোনো ভাষার ব্যাকরণগত সম্পর্ক যেমন নেই, তেমনি বাস্তবতার সাথেও মিল নেই। তো বাংলা ব্যাকরণ মতে, রাজার নীতি যদি রাজনীতি হয় তবে রাজার চরিত্র-অভ্যাস-শিক্ষা-দীক্ষা-চিন্তা চেতনা-ব্যথা-বেদনা আনন্দ উৎসব ইত্যাদি সব কিছুই রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়।
রাজার ইচ্ছায় রোম নগরীতে আগুন লেগেছিল এবং সেই আগুনের লেলিহান শিখা দেখে মনের আনন্দে রাজার মনে বাঁশি বাজানোর প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছিল। রাজার ইচ্ছে হয়েছিল মানুষের মাথা দিয়ে বিজয় স্তম্ভ তৈরি করার অথবা মানুষের রক্ত দিয়ে দজলা ও ফোরাত নদীর পানি রাঙিয়ে দেয়ার। অন্য দিকে, রাজার ইচ্ছে হয়েছিল তাজমহল-পিরামিড, মহাপ্রাচীরসহ ঝুলন্ত বাগান অথবা মহাসাগরের ভেতরে বাতিঘর নির্মাণের এবং তা নির্মিত হয়েছিল। তো একইভাবে রাজা যদি চান রাজনীতিতে পশুদের মতো করে কিছু প্রাণীকে গৃহপালিত রাজনৈতিক বিনোদন বালক বা নটী বিনোদিনী বানাতে তবে রাজার নীতির কী বেহাল দশা হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সর্বকালে সব সমাজে ছিল এবং এখনো আছে।
আমরা আজকের আলোচনার একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। কাজেই শিরোনাম প্রসঙ্গে দু’একটি কথা বলেই আজকের নিবন্ধ শেষ করাব। উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশে গৃহপালিত মানুষ, গৃহপালিত দল এবং গৃহপালিত বিরোধী দলের অস্তিত্ব, তাদের স্বভাব চরিত্র, হাল-হকিকত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ আমার সম্মানিত পাঠকরা ইতোমধ্যেই বুঝে গেছেন আমি আসলে কী বলতে চেয়েছি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা