২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আমি ও আমার টুকরোগুলো

লেখক : মুসা আল হাফিজ - ফাইল ছবি

জল পড়ার শব্দে যখন নড়ে উঠল কালের কিনারা, আমি তখন পূর্বপরিচিত শব্দার্থসমূহে বুনছিলাম সম্প্রসারণের বীজ, যেন শব্দেরা আরো বেশি অর্থের দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা হয়! নৈসঙ্গের চৌকাঠে একহাঁটু আশ্রয় নিয়ে বসে আছে আমার সময়। যাপনের সংশয়গুলোকে সে ধুয়ে দিচ্ছিল স্বশাসনের পানিতে। তারপর বোধকে সেঁকে তুলব নিজস্ব রোদ্দুরে। তখনই আমার কাজের ভেতর নেমে এলেন ইবনে খালদুন।
বললেন, আলোআঁধারি রূপকথার নির্মাণে তুমি অনেক খেটেছ, এবার নিজেকে তর্জমা করো কালের সামনে। আর সেতু গড় দিগন্তবিস্তারে, যেন নিজের বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলোকে খুঁজে পাও। ফলে দূরত্বগুলো যেন ছিন্নভিন্ন হয় আর দৃশ্যেরা হয়ে ওঠে একের তাফসির!
মঞ্চে দাঁড়ালাম। বললাম-

এক.
নিজের প্রকাশকে আমি জানি। আমার শব্দেরা আরোহ অবরোহ বেয়ে অতীন্দ্রিয়বোধের অভিগামী। তারা নিজের জানালায় চায় মুগ্ধ বাতাস; দৃষ্টিপথে চায় মাতালগন্ধী জোছনা; নিজের আঁচল ভরে রাখে রোদ্দুরের নেশায়; প্রকাশের প্রান্তরেখায় বাজায় চেনা-অচেনা স্বরগ্রাম। এর মধ্যে তারা বহুস্তরীয় হতে চায়। বিচিত্র অর্থের সম্ভাবনা নিয়ে শব্দেরা রচনা করে আপন আত্মপ্রকাশের জীবনী।

তাদের দিয়ে আমি প্রকাশ করব বোধকে। বোধকে যখনই ভাষা দিতে চাই, দেখি শব্দেরা জড়ো হয়ে রচনা করেছে চারাগাছ। গাছটি বড় হয়। ভেতর-বাইরের সীমানা ভেঙে দেয়। নিজের বৃক্ষসত্তা এবং ছায়াকে সে করে তোলে রহস্যময়। সে হয়ে ওঠে বিমূর্ত উল্লাস। তার ভেতরে লতিয়ে ওঠে অবিন্যস্ত জীবন, রহস্য, পরারহস্য। জন্ম ও মৃত্যুর চত্বরে দাঁড়িয়ে বোধকে ডাক দিই অসামঞ্জস্য থেকে উত্তরণে, অন্তরঙ্গ ও সৃজনশীল আত্মসমীক্ষায়। সে ক্রমেই ধোঁয়াশাকে অতিক্রম করে। রহস্যকে ভেতরে স্থাপন করে নিজের স্থাপত্যকে দেয় বাস্তবের চেহারা।

এরপর যাকে মনে হতো মায়ার, তাকে পাওয়া যায় বাস্তবে। যাকে দেখা যেত অসম্ভবে, তাকে দেখা যায় সম্ভবে। যাকে মনে হতো নিরুদ্দেশ, তাকে পাওয়া যায় নৈকট্যে। আপন নিত্যতার মধ্যে সে প্রতিস্থাপন করে বিস্ময়কে। সহজাতের শিকড়ে কত অণুরেণু! বিভ্রম ও কল্পপ্রয়াসকে তাড়া করে তার কম্পিত ডালপালা। এরই মধ্যে তন্ময়তা তৈরি করে অনঙ্গ তরঙ্গ। সে স্পর্শ করতে চায় আকাশ, আবার জাপটে ধরে মাটিকে। উভয়ের সঙ্গমে আনতে চায় অনন্তের বৈভব। জীবনের বাস্তবতায় স্থাপিত বোধকে আমি বৃহত্তর প্রকৃতির সাথে মেলাই। প্রকৃতি জানিয়ে দেয়, স্বভাবজাত বোধ হচ্ছে দ্বিতীয় প্রকৃতি।

দুই.
যে সময়কাল পাড়ি দিচ্ছি, সে আমার দ্বিতীয় প্রকৃতির বন্ধু নয়। সে আপন নয় প্রথম প্রকৃতিরও। রহস্যময়ীর ইতিবৃত্তে জটিল বন্ধন সে খোঁজে। কিন্তু বস্তুই তার দেবতা। সে তুষার ছাড়া পতন দেখে না, অভিধান ছাড়া হৃদয় দেখে না, স্বার্থ ছাড়া সম্পর্ক দেখে না। তার সংজ্ঞায় যার নাম জাগরণ, সে আসলে বর্ণচোরা নিদ্রা। সে যাকে বলে বন্ধন, তা আসলে এমন এক দাঁড়ি, যার পর বৈঠা বেয়ে নৌকা নিয়ে এগুনো মানেই যুদ্ধ। ইবনে খালদুন তাহলে আমাকে যুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছেন?

তিন.
আমার জলবায়ুতে মিশেছে পূর্ব-পশ্চিম। আমার অর্থনীতিতে আকাশের ফল-ফসল, জমিনের কৃষি সমান। আহত রোদকে ব্যথিত দিনের আলনায় গুছিয়ে রাখি আমি। কারণ আমার আছে বিকল্প রোদ। ভিজে হাওয়া দিয়ে ভেজা কাপড় শুকাবার বিকল্প হাওয়া আছে আমার। যে আকাশে চাঁদ উদিত হয় না, আমি তার জন্যেও বরাদ্দ রেখেছি নিজস্ব চান্দ্রমাস! কিন্তু বন্ধনের নির্মাণ এমন এক কসরত, যেখানে সবার বৃষ্টিকে পৌঁছাতে হবে সবার ভূমির রেহেমে। স্বপ্ন দিয়ে কাজটি হবে না। বাস্তবতা তাই ডাক দিলো আমাকে। বলল, আমার কাছে নিজেকে তুমি বন্ধক রেখে দাও। শুনে হাসলাম। সে জানে না, বাস্তবতার খাবার নই আমি। আমি বরং গড়তে চাই নিজস্ব বাস্তবতা।

চার.
দিনকে মাপতে গিয়ে তারা পেয়েছে পুঁজি। রাতকে মাপতে গিয়ে তারা পেয়েছে বন্য বন্যার ঠোঁট। তারা বলছে, এখন নয় পোশাকের দিন। ঐতিহ্যকে গছিয়ে দিয়েছে গোরখোদকের হাতে। ঐহিত্যকে প্রাচীন পুস্তিকায়। তাদের আকাশ পিতল। জমিন ধাতব। এখানে বাজনা বাজায় পশুর পিপাসা। কিন্তু জীবনের জরুরি জলযুক্তি নিয়ে এসেছি আমি। জানি, বদলের প্রয়োজনে আলাদিনের চেরাগ পাবো না। অনুভবের শব্দবাহিনীও যথেষ্ট নয়। আমি তাই রণাঙ্গনে হৃদয়কে পাঠালাম। আমার পথের দাগে ছড়িয়ে পড়া স্পন্দন কুড়িয়ে কবিরা হচ্ছে বালেগ, আমার ক্রিয়া-বিক্রিয়া থেকে মাথারা হতেছে সন্তানসম্ভবা!

সমুদ্রে নিজেকে ফুঁকে দিলাম। তারপর থেকে ভূমি ও আকাশকে আপন পরিচয়ে ফিরিয়ে নেবার জলরোলে কি ভেঙে পড়ছে না তোমাদের রূপ ও রূপক? আমার রূপনগর অসীমতাকে পুঁতে দেয় সসীমতায়! তার সত্তা ও সত্যে ভেঙে পড়ছে তোমাদের বস্তুনগরের কল্পবালাখানা। দ্যাখো, দ্যাখো!

পাঁচ.
দ্যাখো আমার চিহ্ন ও চিহ্নক। বস্তু ও বস্তুগুণ, অর্থ ও উত্তরণ। যা লোপাট করে দিচ্ছে কালের বস্তুগুণের গরিমা, অর্থের ঈশ্বরী। যারা আমার গঠনতন্ত্রের শরীর দেখেছে, মর্মমূল দেখে নাই, তারা আমাকে দেখে নাই। কারণ আমার গঠনেই নিহিত আছে তার কর্মপ্রণালী। কিন্তু গূঢ়সত্য হলো, আমার গঠন সত্যের সংগঠন থেকে ক্লোন হয়েছে। আমাতে টোকা দিলে প্রতিধ্বনি হয় সত্যের বুকে। আমি তার গায়ে যুক্ত হয়ে আছি তার নিজস্ব নিয়মে। ফলে আমার চারপাশে যে হাওয়া বইছে, সে তার। যে বৃষ্টি হচ্ছে বছরজুড়ে, সে তার। যে সবুজে আসঙ্গলিপ্সায় প্রাণেরা মাতাল হয়ে উঠছে, সে তার। যে বিন্দু বিন্দু আলো ও অন্ধকার, সে তার। যে বিষয় ও ব্যাকরণ, সেও তার।
আমি তাই আমি নই শুধু, সত্যের সন্তান।

ছয়.
কিন্তু আমার দুর্বলতা আমার শক্তির দিকে হানছে ভ্রূকুটি। আমি যখনই ঐক্যবদ্ধ হতে চাই, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাই। কারণ আমার সত্যসমূহ আমার বিচ্ছিন্ন টুকরোসমূহের সীমানা সমান। আসলে সত্য কারো সীমানা সমান নয়, সত্য কেবলই নিজের সমান। কিন্তু আমার প্রতিটি খণ্ড নিজের সীমানাকে সত্যের সীমানা ভেবে নিজেকেই সত্য বলে তৃপ্ত হয়ে আছে। ফলে সকলেই সত্যে থাকার সুখে আছে, কিন্তু কোথায় তাদের সত্যিকার সত্যস্বাদ? আমার টুকরোগুলো আমার শক্তি হতো বটে, কিন্তু অগণিত টুকরোর মুখে আত্মসংহারের দাঁত। নিজস্ব কারণে তারা বেশ ভঙ্গুর। তাদের মনের গান লিখে দেয় ভাঙা কাচ। প্রতিটি উপলক্ষে তারা কাচস্তোত্র গেয়ে চলে ...

পরিশেষে
আমার কথন হাওয়ায় উড়ছে আর ইবনে খালদুন অদ্ভুত ডানায় চড়িয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন বিস্ময়কর মাহফিলে। যেখানে আমার হারানো অংশগুলো যার যার ভিন্নতাসহ দাঁড়িয়েছে একই সমতলে। প্রত্যেকেই রক্তাক্ত, ক্লান্ত, ব্যস্ত। যুদ্ধাস্ত্র সবার হাতে। সবার আছে নিজস্ব ইতিহাস। এক টুকরো অন্য টুকরোর আঘাতে রক্ত দিয়েছে কিংবা বীরের মতো ঝরিয়েছে রক্ত তীব্র আঘাতে।

প্রত্যেকের চোখে-মুখে সেই রক্তপাতের ছড়। তাদের অব্যাহত আত্মবিনাশের আবেগের ফেনা জমে জমে পাথর হয়েছে। সেসব পাথরের ওপর পা রেখে প্রত্যেকেই দাঁড়িয়ে আছেন।
বিনম্র দৃঢ়তায় আমি দাঁড়ালাম ছিন্নভিন্ন নিজের টুকরোদের সামনে।
বললাম, হে আমার বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলো!

বাইরের অবয়ব ও শব্দতরঙ্গে অনেক ঘুরেছ। একান্ত ইন্দ্রিয়ানুভূতির গতরে হাত দাও।
তোমাদের প্রতিটি টুকরোয় আছে প্রাণ। আর প্রতিটি প্রাণের জারক রসে অনবরত জীবনের যে বিদ্যুৎ বইছে তার নাম মুহাম্মদ (সা:)।

পার্থক্যের যে দুর্বলতায় আপনারা এক নন, সে আসলে পার্থক্যের শক্তি, যা গহিন ভেতর থেকে আপনাদের মিল দেখায় বাইরের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও!

আপনাদের উচ্চারণ বিচিত্র, কিন্তু ভাবনালোকের গহিনে মেলবন্ধন, এর মধ্যে কি নেই বন্ধনের নতুন ইশারা? সবাই যার যার গায়ে লিখে রেখেছ ডাকনাম। কে রেখেছে নামগুলো? সবাই বলছেন, নাম রেখেছেন সত্য, আপন জবানে।

কিন্তু পৃথিবীটা বিন্দু বিন্দু বিচ্ছিন্নতার ঐক্য। ভাষাগুলো বিন্দু হরফ-প্রতীকের সমাহার। বৃষ্টি কি নয় সেই জলপাত, যারা একদা এক ছিল না? আমাদের প্রতিটি বিচ্ছন্ন ভূমিতে বৃষ্টি তার হাসি রেখে যায়। তেমনি আমাদের সব টুকরোয় সত্য তার রেখে গেছে পদচ্ছাপ। জলগর্ভী কোনো মেঘই অনন্ত নয়। কিন্তু সেই সত্যকেন্দ্র অনন্ত, যার বারিবিন্দু আমাদের সত্তার বীণাপাণি।

আমার বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলো ছিল তৃষ্ণার্ত। তারা নিজেদের বীণাপাণির নাম শুনে উপলব্ধি করলো আপন মাতৃডাক। সবাই নিজেদের জন্মসূত্রের কাছে ভিড় করল। সবাই জানতে চায় আপন উৎসনাম। যে সুখ নিজের মৃত্যু অনুভব করত এতকাল, এখন সে নিজের জন্ম অনুভব করল প্রত্যেকের মনে; যখন আমি সেই জন্মসূত্রের নাম উচ্চারণ করলাম।
কী ছিল সেই নাম?
মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

লেখক : কবি, গবেষক
E-mail : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের কৃতিত্ব জীবদ্দশায় পাননি যে বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার করে যাব : আসিফ নজরুল সীমান্তে বিজিবিকে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালনের আহ্বান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার শেখ হাসিনার অনেক গুমের সহযোগী ভারত : রিজভী জুলাই বিপ্লবে গুলিবিদ্ধ মাদরাসা শিক্ষার্থী আরাফাতের ইন্তেকাল ডাবরের পরিবেশনায় বঙ্গ নিয়ে এলো গেম শো ফ্যামিলি ফিউড দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুল হাদিস আল্লামা কমরউদ্দিনের ইন্তেকাল নতুন মামলায় সালমান-ইনু-আনিসুলসহ গ্রেফতার ৮ নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে ২ পারের রোহিঙ্গাদের জাবালিয়ায় ইসরাইলি সেনা কর্মকর্তাকে গুলি হামাসের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন

সকল