০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

জ্বালানি উপদেষ্টা ফাটিয়ে দিয়েছেন

লেখক : ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী - ফাইল ছবি

বর্তমান সরকারের একঝাঁক মন্ত্রী রয়েছেন। তাও যে কে কোন দফতরের মন্ত্রী, সেটি সুস্পষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না। তারা তেমন কোনো কাজ করেন বলেও মনে হয় না। কারণ, কদাচিৎ তাদের নাম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাধারণত যে মন্ত্রী যে দফতরের নন, তিনি সে বিষয়েই অধিকতর কথা বলতে পছন্দ করেন। যেমন- কৃষিমন্ত্রী বিদ্যুতের কথা বলেন, সংস্কৃতিমন্ত্রী খাদ্য সঙ্কটের কথা বলেন, নৌমন্ত্রী রেলের কথা বলেন। আর যে যে কথাই বলেন না কেন, তার মধ্যে বিএনপিকে গালি দেয়ার একটি সাধারণ প্রবণতা আছে। এই গালি দিতে কেউ ১৯৭২-এর কথা বলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলেন। ১৯৭৫ সালে মুজিব পরিবারের হত্যাকাণ্ডের কথা বলেন, ’৭৮ সালের নির্বাচনের কথা বলেন। তারপর মূল কথা বলেন। সে কথা সামান্যই। কিন্তু কত চিপায়-চাপায় কত যে মন্ত্রী আছেন সেটি সঠিকভাবে বলতে পারি না। কেউ বলতে পারবেন বলে বিশ্বাসও হয় না। কারণ, এদের বেশির ভাগই সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মন্ত্রী হননি। কারো ব্যক্তিগত পছন্দ কিংবা তদবিরে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী হয়েছেন। ফলে তাদের দায়-দায়িত্বও কম।

এর উপরে আবার আছে একদল উপদেষ্টা যারা মন্ত্রী পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। এখন যে লুটপাটের শাসন তা থেকে তারাও ব্যতিক্রম নন। এর মধ্যে বেশি শোনা যায় জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও গওহর রিজভীর নাম। তৌফিক-ই-ইলাহী শেখ হাসিনার সাথে নাইকো দুর্নীতি মামলায় আসামি হয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় এসে সেই মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং তৌফিক-ই-ইলাহীকে তার জ্বালানি উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন। মিডিয়ায় তিনি একটু বেশি সরব। তিনি যখন কোনো বিষয়ে কথা বলেন, তখন ধরেই নিতে হয়, ওই কথাটি সরকারের ভাষ্য। তিনি কথা বলেন মাঝে মধ্যে, কিছু কাজ করেন প্রকাশ্যে বা সংগোপনে। তার সর্বশেষ বড় কেলেঙ্কারি ঘটেছে নির্বাচনে। কুয়েতে আদম ব্যবসায় করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন শহিদ ইসলাম পাপুল নামে এক ব্যক্তি।

২০১৮ সালের নির্বাচনে ভাগাভাগির খেলায় ওই আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল; কিন্তু পাপুল এমন এক জাদু করলেন যে, জাতীয় পার্টির অরাজনৈতিক প্রার্থী নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। তার বিনিময়ে পাপুলদের কাছ থেকে তিনি কত টাকা পেয়েছিলেন তা অবশ্য জানা যায়নি। জাতীয় পার্টির প্রার্থী যদি রেসে থাকতেন তবে জয় তার অবশ্যম্ভাবী ছিল। তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় ওই আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থিতা ছিল না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের পর্যায় থেকে ওই আসনে কাউকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কিন্তু হঠাৎ-ই দেখা গেল, ওই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন কুয়েত প্রত্যাগত আদম-প্রতারক শহিদ ইসলাম পাপুল। কেমন করে মনোনয়ন পেলেন এই পাপুল? কিন্তু কিছুই লুকানো থাকল না। জানা গেল, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী একটি চিঠি লিখে ওই আসনে পাপুলকে সমর্থন দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ মোতাবেক কাজ করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ফলে পাপুল ওই নির্বাচনে জয়লাভ করেন।

পাপুল কুয়েতে আদমপাচারের ব্যবসায় করতেন। সে ব্যবসায় করতে গিয়ে তিনি ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেন। সেখানকার মন্ত্রী-এমপিদেরও তিনি ঘুষ দিয়ে তার মানবপাচার কার্যক্রম চালিয়ে যান। কুয়েতের আদালত তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়, জরিমানা করে। আর কুয়েতের সাবেক পার্লামেন্টে সদস্য সালাহ খুরশেদকে সাত বছর কারাদণ্ড দেয় ও সাত লাখ ৪০ হাজার কুয়েতি দিনার জরিমানা করে। কুয়েতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মেজর জেনারেল সাজেন আল-জারাহকেও সাত বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। পাপুল এখন কুয়েতে জেল খাটছেন। এই পাপুলকে কেন সমর্থন দিয়ে জেতালেন তৌফিক-ই-ইলাহী ভোটবিহীন নির্বাচনে? সাদা চোখে দেখতে গেলে এখানেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু, তৌফিক-ই-ইলাহীর না গেছে চাকরি, না তাকে কেউ প্রশ্ন করেছে। সাধারণ মানুষের কাছে এগুলো সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলে, ঘটনাটি চাপা পড়ে গেছে।

এই তৌফিক-ই-ইলাহী স¤প্রতি একটি নীতিনির্ধারণমূলক বক্তব্য দিয়ে আবারো তুমুল আলোচনায় এসেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না, সামনে কী হবে। এখন এলএনজি আমদানি করছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি আমদানি করতে যাই তাতেও চাহিদা মেটাতে অন্তত ছয় মাস লাগবে। তবে তা কেনার মতো অবস্থা আছে কি না, জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে। গত ২৩ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত ‘শিল্পে জ্বালানি সঙ্কটের সমাধান’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কবে শেষ হবে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া গেলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতাম। আমাদের ভোলায় কিছু গ্যাস আছে। সেগুলো সিএনজি করে নিয়ে আসব।

দুই-তিন মাসের মধ্যে সেটি নিয়ে আসার চেষ্টা করব। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ পাব। আরো এক হাজার মেগাওয়াট সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদন করব, তখন সমস্যা অনেকটাই সমাধান করতে পারব। জনাব তৌফিক বলেন, আমরা যদি গ্যাস বাঁচাতে চাই, তাহলে লোডশেডিং বাড়বে। তখন আপনারাই সমালোচনা করবেন। অথচ একসময় সব জায়গায় বিদ্যুৎ ছিল না। আমরা চাইলে এসি বন্ধ রাখতে পারি, বিদ্যুৎ ব্যবহার কমাতে পারি। সারা দেশে যে পরিমাণ এসি চলে তাতে পাঁচ-ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। আমরা এসি বন্ধ রাখব বা কম চালাব। এতে দুই-তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। গ্যাস সাশ্রয় হবে। সবাই মিলে যদি রাজি হই, লোড কমাব, তাহলে কিছু গ্যাস রিলিজ হবে। আমরা কৃষি ও ইন্ডাস্ট্রিতে বেশি বিদ্যুৎ দেয়ার চেষ্টা করব। প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহারই করব না। বিদ্যুৎ যদি আমরা শিল্পে দেই তাহলে আবাসিকে সাপ্লাই কমাতে হবে। তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় তো আমাদের কিছুই ছিল না। তখনো আমরা চলেছি; এখনো পারব। এখনো দিনে গড়পড়তা ছয়-সাত ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে। ভালোই বলেছেন তৌফিক-ই-এলাহী, ছয়-সাত ঘণ্টা যদি চলতে পারেন, তাহলে ১২ ঘণ্টা চলতে পারবেন না কেন?

তবে দিনের বেলায় ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখলে অফিস-আদালত, কল-কারখানা, কৃষি, লেখাপড়া কিভাবে চলবে- সে রকম কোনো প্রস্তাব দেননি ড. তৌফিক। তিনি হয়তো ভেবেছেন, ৫০ বছর আগে বিদ্যুৎ ছাড়া মানুষ যেভাবে চলত সেভাবেই চলতে থাকবে। তখন এত ধানও উৎপন্ন হতো না, চলেছে। আর শিল্প-কারখানায় তো পরিবেশ দূষণ হয়। সেটি বাড়িয়ে কী লাভ? অফিস-আদালতে ফের টানা পাখার ব্যবস্থা করলেই তো হবে। উপদেষ্টার কী সাঙ্ঘাতিক পশ্চাৎমুখী উপদেশ!

প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলছেন, উন্নয়নে উন্নয়নে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে। তিনি বলেছিলেন, ঘরে ঘরে নাকি বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তাহলে এখন কেন তার উপদেষ্টা বলছেন, দিনের বেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হবে?

অপর দিকে, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, সরকারের তরফ থেকে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি তৌফিক-ই-ইলাহী সাহেবের নিজস্ব বক্তব্য। এরকম আজগুবি ভাষ্য আমরা মাঝে মধ্যেই শুনতে পাই। সরকারের মন্ত্রীরা একেকটা কথা বলেন, অন্য কোনো মন্ত্রী আবার বলেন, এটি সরকারের বক্তব্য নয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নিজস্ব বক্তব্য। এই যেমন কিছু দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছিলেন, ভারতে গিয়ে ভারত সরকারকে বলেছি- তারা যেন আগামী টার্মে শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করেন। ড. মোমেন তৌফিকের মতো উপদেষ্টা নন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। কিন্তু, এর দু’-একদিন পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, নির্বাচনে জিততে ভারতের সহযোগিতা চাওয়ার দায়িত্ব কাউকে দেয়া হয়নি। ওই বক্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজস্ব। তাহলে কী দাঁড়াল? চার মন্ত্রী চার কথা বলেন। র‌্যাবের ডিজি বললেন, র‌্যাবে সংস্কারের প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, র‌্যাবে সংস্কার হচ্ছে। তাহলে কার কথা ঠিক? কোন মন্ত্রীর কথাটি সত্য? দেশের নীতিনির্ধারণ কে করেন?

রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের আইডিয়াটি নাকি এই তৌফিক-ই-ইলাহীরই। এসব কোম্পানির সাথে চুক্তিটি এমনই যে, তারা বিদ্যুৎ দিক বা না দিক তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যেতেই হবে। আবার সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আট টাকায়; কিন্তু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে কিনতে হয় প্রতি ইউনিট ১৭ টাকায়। সেভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা গেছে। হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। আবার সে দুর্নীতির কারণে বিদ্যুৎ খাতে এই ভরাডুবি হয়েছে। কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুৎ সঙ্কট সহজে দূর হবে না। আমাদের রেড়ি বা ভেন্নার তেল দিয়ে পিদিম জ্বালাতে হবে অথবা কেরোসিন কুপি। সমাজ এগিয়ে যায়; কিন্তু এ সরকারের ব্যাপক দুঃশাসন ও অপশাসনে আমরা শত বছর পিছিয়ে গেছি। আর সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ ঘন অন্ধকার।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement