দেড় যুগের পথ চলা
- আলমগীর মহিউদ্দিন
- ২৫ অক্টোবর ২০২২, ০০:০২
সময়টি ২০০৪ সাল। মে মাস। তখনো আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়নি দৈনিক নয়া দিগন্তের। একজন স্বপ্নচারী মহান ব্যক্তিত্ব এ আয়োজনের আনুষ্ঠানিক অভিযাত্রার ভিত তৈরি করছেন। ইডেন কমপ্লেক্সের এক ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা সাদা কালো চার পৃষ্ঠার ডামি প্রকাশ করছি। নিকটেই নয়া দিগন্ত ভবন নির্মাণের কাজ চলছিল। ছাপার জন্য রোটারি মেশিন আনা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। জাহাঙ্গীর সাহেব সেটি স্থাপন করছেন নয়া দিগন্ত ভবনের নিচতলায়। তদারকি করছেন স্বপ্নচারী মীর সাহেব, কখনো পরিচালক বিশিষ্ট শিল্পপতি শিব্বির মাহমুদ। কখনো বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এনায়েত সাহেব। দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের পক্ষ থেকে শামসুল হুদা এফসিএকে প্রকাশনার আনুষ্ঠানিক কার্যাদি শেষ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সেটি সম্পন্ন করছেন। সাথে রয়েছেন আবু তাহির মোস্তাকিম। পত্রিকা প্রকাশের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সংঘটিত করার কাজে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন বাবর। সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেছি আমি।
দিগন্ত মিডিয়ার পরিচালকরা দেশের সেরা একটি মিডিয়া হাউজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। স্বপ্নটি ছিল আরো আগে থেকেই। দেশের সফল কিছু শিল্পোদ্যোক্তা এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশাসনিক দায়িত্বপালনকারী ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে গঠন করা হয় দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা কমোডর অব: এম আতাউর রহমান করপোরেশনের প্রথম চেয়ারম্যান। নতুন এই অভিযাত্রার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। কর্মজীবনে তিনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। তার রয়েছে বিআইডাব্লিউটিসি, চালনা বন্দর, টিসিবি ও ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা। ১৯৪৯ সালে কলকাতা বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন তিনি। পাকিস্তান নৌবাহিনী কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেন ১৯৫০ সালে। ’৫১ সালে ব্রিটেনের মানাডন পলিমাউথ থেকে তিনি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন থেকে অবসরের পর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন তিনি। আমৃত্যু জড়িয়ে ছিলেন এসব কাজে। দেশের প্রধান বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের দ্বিতীয় চেয়ারম্যান হন তিনি। ব্যাংকটির অগ্রযাত্রায় তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। দীর্ঘ সময় তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।
দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের নীতিনির্ধারণী বৈঠকগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তার সভাপতিত্বে নেয়া হয়। ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইবনে সিনা ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন কমোডর আতাউর রহমান। এ ছাড়াও বহু সমাজসেবা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন।
কমোডর আতাউর রহমানের পর চেয়ারম্যান হন কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান। শাহ হান্নান ছিলেন এই মিডিয়া গ্রুপের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি সব সময় নয়া দিগন্তের সম্পাদকীয় টিমের সদস্যদের গাইড করতেন, পরামর্শ দিতেন। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি আরো নিবিড়ভাবে তদারকি করেন প্রতিষ্ঠানটিকে।
শাহ আবদুল হান্নান ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক, প্রায়োগিক অর্থনীতিবিদ ও সমাজসেবক। তিনি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান। ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর। দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ছিলেন। ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি দেশ ও সমাজ উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। পাইওনিয়ার ও উইটনেস নামের দু’টি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি দেশ বিদেশে হাজার হাজার একাডেমিক ও অন্যান্য অঙ্গনে সক্রিয় ব্যক্তিদের শিক্ষক ও গাইড হিসেবে কাজ করেছেন। তার পরিবার কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানার বিখ্যাত শাহ পরিবার।
তাঁর পূর্বসূরিরা এ দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। শাহ হান্নান আধুনিক বাংলাদেশ ও নীতিবোধভিত্তিক একটি সমাজ গঠনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তিনি জনপ্রশাসনে ছিলেন সততার প্রতীক। তার সততা সিভিল সার্ভিসে অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত। তিনি রাজস্ব ও ব্যাংক খাতের সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন।
শাহ আবদুল হান্নান উদারনৈতিক নীতিবোধ লালনকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যিনি সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। বিরোধ বিপত্তি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। সততার প্রশ্নে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদও ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। নয়া দিগন্ত ও দিগন্ত টেলিভিশনে তিনি সব সময় তার লালন করা মূল্যবোধকে মানবতার কল্যাণে প্রসারের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে উৎসাহিত করে গেছেন।
১৯৬২ সালে ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে তার কর্মজীবন শিক্ষকতার পেশা দিয়েই শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান ফিন্যান্স সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি ছিলেন রাজস্ব ব্যবস্থায় ভ্যাট চালুর অন্যতম প্রবক্তা। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ছিলেন। তার আগে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক। ১৯৯৮ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৪ সাল থেকেই ছিলেন দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের পরিচালক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান।
শাহ আবদুল হান্নানের মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান হিসেবে দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের হাল ধরেছেন বিশিষ্ট শিল্পপতি শিব্বির মাহমুদ। তিনি পোশাক শিল্পের শুরুর দিকের অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি একজন শিক্ষাবিদ। নয়া দিগন্ত এবং দিগন্ত টেলিভিশনের প্রতিটা অভিযাত্রায় তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। দেশ বিদেশের নানান কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতাকে তিনি দিগন্ত মিডিয়ার কাজে উজাড় করে দিচ্ছেন। এই ব্যক্তিত্ব দেশের বিভিন্ন আর্থিক ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছেন আজো। তিনি ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (আইএফআইএল) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সুইসটেক্স গ্রুপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি পোশাক খাতে শুরু করেন অভিযাত্রা। তিনি আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য। আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপাতালের গভর্নিং বডিরও একজন সদস্য। শিব্বির মাহমুদ জনতা ডিগ্রি কলেজ, লক্ষ্মীপুর এর প্রতিষ্ঠাতা এবং উক্ত কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে বিপদের মুখে গণমাধ্যম। পাশাপাশি করোনা মহামারীর কারণে গণমাধ্যম-শিল্প তীব্র চাপের মুখে পড়েছে। এ সময় এই অরাজনৈতিক সমাজসেবী ব্যক্তিত্ব দৈনিক নয়া দিগন্তকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য যোগ্য হাতে হাল ধরেছেন।
দৈনিক নয়া দিগন্তের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে ছিল তাঁর বিশেষ পদক্ষেপ। তার অনন্য উদ্যম আর গতিশীল চিন্তাভাবনা এই গণমাধ্যমের প্রতিটা সঙ্কট উত্তরণে সহায়তা করছে।
নয়া দিগন্তের উৎপত্তি ও বিকাশের প্রতিটা মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ইসি চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনন্য অবদান রয়েছে। একজন স্বপ্নচারী ব্যক্তি হিসেবে তিনি প্রতিটি প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন। সকল বাধা পেরিয়ে সামনে এগোনোর উদ্যম ছিল তাঁর। স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য অবদান রাখার পথপ্রদর্শক ব্যক্তিত্ব হিসেবে রেখেছেন অনন্য অবদান। বিভিন্ন কাজের সাহস ও অভিজ্ঞতা তিনি মিডিয়া প্রতিষ্ঠার কাজে লাগিয়েছেন। এই দুঃসাহসী অভিযাত্রায় তিনি কখনো হতাশ হননি। ধৈর্য আর মহান প্রভুর প্রতি অতিউচ্চ বিশ্বাসে বলিয়ান ছিলেন। তার অনুপস্থিতি এই গণমাধ্যম গ্রুপটি গভীরভাবে অনুভব করে।
নানা প্রতিকূলতায় প্রতিষ্ঠানটিকে সামনে অগ্রসর হতে হয়। সেই কঠিন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেন দেশের নির্মাণ শিল্পের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার ইস্কান্দর আলি খান। দিগন্ত মিডিয়ার ইসি চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। প্রতিষ্ঠানটির দেড় যুগ অতিক্রম করার ক্ষেত্রে তার পদক্ষেপ বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। পারিবারিক প্রয়োজনে ইঞ্জিনিয়ার খানকে দেশের বাইরে যেতে হয়। ফলে এই দায়িত্ব অর্পিত হয় পত্রিকার প্রকাশক শামসুল হুদা এফসিএ’র ওপর। তিনি এই গণমাধ্যমের প্রাথমিক গঠন ও অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখেন। ইসি চেয়ারম্যান হিসেবেও রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন প্রবীণ উদ্যোক্তা ও শিক্ষক তিনি। দিগন্ত মিডিয়ার আর্থিক হিসাব নিকাশ তদারকিতে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন।
এরপর দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অর্পিত হয় সাবেক সচিব ড. আইয়ুব মিয়ার ওপর। তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নয়া দিগন্তকে এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ড. আইয়ুব দায়িত্ব পালন করেন সংক্ষিপ্ত সময়।
এরপর দিগন্ত মিডিয়ার ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান ও এমডির দায়িত্ব অর্পিত হয় কাজী হারুন অর রশীদের ওপর। তিনি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি বস্ত্র খাতের বিশিষ্ট উদ্যোক্তা। ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব এবং ব্যবসা বাণিজ্য ও বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অনন্য অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। দৈনিক নয়া দিগন্তকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন ও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক শিল্প উদ্যোক্তার অবদান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মুহাম্মদ ইউনুস, আলহাজ এনায়েত হোসেন ও আলহাজ জাকির হোসেন ভাতৃদ্বয়ের রয়েছে বিশেষ অবদান। তারা বিনিয়োগ করেছেন। প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তাদের শ্রম তাদের ঘাম প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রার সাক্ষী হয়ে আছে। বস্ত্র খাতের অন্যতম উদ্যোক্তা ও বিটিএমএ নেতা আবুল কালাম আজাদ প্রতিষ্ঠানটির নানা সঙ্কটে এগিয়ে এসেছেন। দেশ বিদেশের হাজারো শেয়ার হোল্ডার দিগন্ত মিডিয়ার অগ্রযাত্রায় রক্ত সঞ্চালনের মতো অবদান রেখেছেন। অথচ তারা পাননি কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা। সবকিছু মিলিয়ে দৈনিক নয়া দিগন্ত অব্যাহত রেখেছে তার অগ্রযাত্রা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা