ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে
- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ২২ অক্টোবর ২০২২, ২০:৩২, আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২২, ০৬:২৪
ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অফিস ১৮৫০ সালে প্রথম ‘মধ্যপ্রাচ্য’ নামটি উল্লেখ করে। তবে মার্কিন মেরিন অফিসার ১৯০২ সালে আরব ও ইন্ডিয়ার সীমারেখা চিহ্নিত করার জন্য নামটি ব্যবহার করলে এটি ব্যাপক প্রচার পায়। ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে বিশ্বে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব ও পশ্চিম বিশ্বের প্রায় মধ্যস্থলে অবস্থিত এ অঞ্চলটির বিস্তৃতি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপজুড়ে। এই অঞ্চলে রাষ্ট্র ১৭টি, জনসংখ্যা প্রায় ৪১১ মিলিয়ন এবং আয়তন প্রায় ২৭ লাখ ৮২ হাজার ৮৬০ বর্গমাইল। এই ১৭টি রাষ্ট্রের মধ্যে ইসরাইল ছাড়া সব ক’টি রাষ্ট্রের অধিবাসী মুসলিম। তাদের ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি ও জাতিগত ইতিহাসও প্রায় অভিন্ন। পাঁচটি সাগর-মহাসাগর ও বিশ্বের নৌযোগাযোগের চারটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রণালীও বেষ্টিত মধ্যপ্রাচ্য। ফলে এ অঞ্চলটির অপরিসীম গুরুত্ব সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে।
মধ্যপ্রাচ্যের রয়েছে অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো অঞ্চল এটি। ইসলামের নবী-রাসূলদের মধ্যে উল্লেখ করার মতো প্রায় সবাই এই অঞ্চলে এসেছেন। শোনা যায়, আদম আ: ও বিবি হাওয়াকে এই অঞ্চলেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন আল্লাহ। আদম আ: ও বিবি হাওয়ার পুনর্মিলনও মধ্যপ্রাচ্যে হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এই অঞ্চলেই বিভিন্ন খলিফাদের শাসন, উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফত, রোমান সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা এবং উসমানীয় সভ্যতার শাসন পরিচালিত হয়। মোট কথা, মানব সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস এই অঞ্চলকে ঘিরেই।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পতন যেভাবে হয় : এক সময়ের শৌর্য-বীর্যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, অর্থ-সম্পদ, নীতি-নৈতিকতা এবং নেতৃত্বে বলীয়ান এই অঞ্চলের মারাত্মক পতন ঘটে অনেক আগেই; পতনের উল্লেখযোগ্য কারণ এখানে বর্ণনা করা হলো-
উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন : উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন অবধি মধ্যপ্রাচ্যের ১৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের একটির সাথে অন্যটির সামান্য সদ্ভাব তো নেই-ই; বরং রয়েছে চরম শত্রুতা। এই শত্রুতা ধর্মীয় বিশ্বাস, যেমন- শিয়া-সুন্নি বিভাজন; আরব জাতীয়তাবাদ; সভ্যতার দ্বন্দ্ব; শাসন ব্যবস্থায় ভিন্নতা, যেমন রাজতন্ত্র, ইসলামী ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র ইত্যাদিতে। এই দ্বন্দ্বের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাও যোগ হয়েছে। এই স্বার্থের জন্য অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছে এরা নিজেদের মর্যাদা বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয় না। প্রয়োজনে চিরশত্রু ইহুদির কাছে মাথানত করতেও দ্বিধা করে না। নিজেদের সম্পদ দিয়ে স্বধর্মের রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য শত্রুর সাথে আঁতাত করে, কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র কেনে। মধ্যপ্রাচ্যের অমূল্য খনিজসম্পদ হাতে তুলে দিচ্ছে ডলাররূপী কাগজের বিনিময়ে।
ইহুদি-মার্কিন চক্রান্ত : মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় পুরো নিরাপত্তা ইহুদি-মার্কিন বলয়ের নিয়ন্ত্রণে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সারা বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলিম এক কোটি ৫৪ লাখ ইহুদির কাছে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শৌর্য-বীর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি, মর্যাদা প্রভৃতি বিবেচনায় কত তুচ্ছ, কত নগণ্য, কত দুর্বল, তা মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দিকে নজর দিলে বোঝা যায়। অথচ এক সময় হাজার বছর ধরে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে মুসলমানরা। তারপর শুধুই ভোগ বিলাসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এই শায়খরা। আল্লাহর ওপর নির্ভর করে থাকে অথচ আল্লাহর হুকুম-আহকাম থেকেও সরে গেছে অনেকদূর। এরা ভুলে গেছে, আল্লাহ তাদেরকেই সহায়তা করেন যারা নিজেদের সহায়তা করে।
অনৈক্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানে পশ্চাৎপদতা : অনৈক্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের আধুনিক বিশ্বের সাথে নিজেদের অভিযোজিত করতে পারে না এরা। অথচ একসময় মুসলিম সারা বিশ্বকে শাসন করেছে। তখন তাদের মধ্যে ঐক্য ছিল। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যজয় কিংবা প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য সেসব কৌশল ও দক্ষ হওয়ার মতো জ্ঞান ছিল। এখন তারা যুগোপযোগী জ্ঞান থেকে পিছিয়ে। পিছিয়ে আধুনিক সমরাস্ত্র এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও সমর কৌশলে।
পশ্চিমাদের দখলের রাজনীতি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়কালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অপরিকল্পিত বিভক্তি, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মুসলমানদের বুকের ওপর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এর কারণ। মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি বিদেশী আগ্রাসী শক্তিগুলোর লোলুপ দৃষ্টি এবং পাশাপাশি রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে অব্যাহতভাবে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ লেগেই আছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে পশ্চিমারা। সমরাস্ত্র বিক্রি করা ও তাদের আবিষ্কৃত নতুন মারণাস্ত্রগুলো পরীক্ষার ক্ষেত্র যেন এই মধ্যপ্রাচ্য। এর সাথে গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ, সঙ্ঘাত ও গৃহযুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে।
মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি : অর্থনৈতিকভাবেও মধ্যপ্রাচ্য বেশ সমৃদ্ধিশালী। আগেই বলেছি, বিশাল আয়তনের ও জনসংখ্যার এই অঞ্চল। এখানে রয়েছে পাঁচটি সাগর, মহাসাগর ও চারটি নৌ-চ্যানেল। এই অঞ্চলের তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য দৃষ্টি কেড়েছে পুরো বিশ্ব স¤প্রদায়ের। তেল আর প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য যুগে যুগে বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাই মধ্যপ্রাচ্যে প্রভুত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য শীতল যুদ্ধে জড়িয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওপেকভুক্ত দেশগুলোর দৈনিক তেল উৎপাদনের ক্ষমতা প্রায় ২৩.২ বিলিয়ন ব্যারেল যার ১৪.২ বিলিয়ন ব্যারেল উৎপাদন করে মধ্যপ্রাচ্য। বিশ্বের মোট মজুদের ৬২ শতাংশই রয়েছে উপসাগরীয় দেশগুলোয়। ইরান ও কাতারের রয়েছে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস রিজার্ভ। রয়েছে অনেক ধরনের খনিজসম্পদ। তুরস্ক, মিসর ও দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের জন্য আকর্ষণীয়। তুরস্কে একটি গ্যাস-হাব তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া যা তুরস্কের শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই নয় রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টিরও সহায়ক হবে। চলতি বছর, প্রায় ২২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক কাতার। এই কেন্দ্রিক অনেক শিল্পও গড়ে উঠেছে। ইদানীং তুরস্ক ও ইরান অস্ত্র রফতানিও করছে। হজ এবং ওমরাহর কারণেও প্রচুর উপার্জন মধ্যপ্রাচ্যের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে এই দেশগুলোর। সর্বোপরি, পেট্রো ডলার নামে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলারের নিয়ন্ত্রণও এদের হাতে।
মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক শক্তি : এক সময় খুবই দুর্বল সামরিক শক্তির এই মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক শক্তি ও সক্ষমতা বর্তমানে অনেক বেড়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখ করার মতো শক্তিশালী কয়েকটি দেশের বর্ণনা এখানে দেয়া হলো। কাতার ছোট দেশ অথচ রয়েছে ৬৬ হাজার নিয়মিত এবং ১৫ হাজার রিজার্ভ সেনা; উন্নত ও দামি অস্ত্র; রয়েছে এফ-১৫ ও রাফায়েল যুদ্ধবিমান। জর্দানের রয়েছে আরবের অন্যতম পেশাদার প্রায় এক লাখ নিয়মিত সেনা। পাশাপাশি ৬৫ হাজার রিজার্ভ ও ১৫ হাজার প্যারামিলিটারি। দেড় হাজার ট্যাংকসহ বিশাল পদাতিক বাহিনী। মুসলিম দেশের মধ্যে সৌদি আরবের পর আরব আমিরাতের সামরিক বাজেট। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার র্যাঙ্কিংয়ে দেশটির অবস্থান ৩৬ নম্বরে। নিয়মিত ৬৫ হাজার সেনার পাশাপাশি প্যারামিলিটারি আছে ১২ হাজার। সম্প্রতি ফ্রান্সের কাছে রাফায়েল বিমান অর্ডার করেছে এই দেশটি। আরব আমিরাত তুরস্ককে সাথে নিয়ে নিজেরাও অস্ত্র উৎপাদন করছে। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে উঠে এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সিরিয়া। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার র্যাঙ্কিংয়ে এ দেশটির অবস্থান ৪৭ নম্বর। রয়েছে এক লাখ নিয়মিত সেনা, ৬৫ হাজার প্যারামিলিটারি এবং সাড়ে তিন হাজার ট্যাংক। ইরাক গ্লোবাল ফায়ার র্যাঙ্কিংয়ে ৩৪ নম্বরে। রয়েছে দুই লাখ নিয়মিত সেনার পাশাপাশি এক লাখ ৩০ হাজার সেনা। একই সাথে আধুনিক ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান সজ্জিত হচ্ছে।
রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্রে শক্তিশালী হচ্ছে আলজেরিয়া। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার র্যাঙ্কিংয়ে দেশটি ৩১ নম্বরে। দেশটির রয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার নিয়মিত, এক লাখ ৩৫ হাজার রিজার্ভ ও দুই লাখ প্যারামিলিটারি মিলে চার লাখ ৬৫ হাজার সেনা। আগামী ১০ বছরে আলজেরিয়া আরব বিশ্বের শক্তিধর দেশে পরিণত হবে। মুসলিম বিশ্বের বড় সামরিক বাজেট সৌদি আরবের। দেশটির দুই লাখ ২৫ হাজার নিয়মিত সেনা এবং এক লাখ ২৫ হাজার প্যারামিলিটারি মিলে তিন লাখের বিশাল বাহিনী। অস্ত্রশস্ত্রের বিবেচনায় সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক বাহিনী। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার র্যাঙ্কিংয়ে দেশটি ২০ নম্বরে। মিসরের রয়েছে সাড়ে চার হাজার ট্যাংক। সাড়ে চার লাখ নিয়মিত, চার লাখ ৮০ হাজার রিজার্ভ ও তিন লাখ প্যারামিলিটারি মিলে সোয়া ১২ লাখ সেনা। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার র্যাঙ্কিংয়ে এ দেশটি ১২ নম্বরে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান সব থেকে বেশি আত্মনির্ভরশীল। পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার চেষ্টা করছে বলেও পশ্চিমাদের অভিযোগ। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার র্যাঙ্কিংয়ে ১৪ নম্বরে ইরান। পৌনে ছয় লাখ নিয়মিত, সাড়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা ও ৯০ হাজার প্যারামিলিটারি আছে ইরানের। নিজস্ব প্রযুক্তিতে নিজেরাই তৈরি করছে সাবমেরিন, মিসাইল এবং ড্রোন, আন্তঃমহাদেশীয় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়াকে দিচ্ছে। রাশিয়া থেকে সংগ্রহের চেষ্টা করছে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান। সাবমেরিন এবং যুদ্ধজাহাজে সমৃদ্ধ দেশটি এখন পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে উপসাগর এবং হরমুজ প্রণালী; চ্যালেঞ্জ করছে আমেরিকা ও ইসরাইলকে। তুরস্ক গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার র্যাঙ্কিংয়ে ১৩ নম্বরে। ন্যাটো জোটে আমেরিকার পরই বৃহত্তম বাহিনী। মোট চার লাখ ২৫ হাজার নিয়মিত সেনা; দুই লাখ রিজার্ভ ও দেড় লাখ প্যারামিলিটারি। তুরস্ক নিজেদের সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে বাড়ানোর পাশাপাশি বিশাল অস্ত্রশিল্প গড়ে তুলছে। বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়াই তুরস্কের নিজস্ব তৈরি আকাশ ড্রোন, নৌ-ড্রোন এমনকি পঞ্চম প্রজন্মের মনুষ্যবিহীন বিমান এখন বিশ্বের কাছে আতঙ্ক।
আজারবাইজান ও ইউক্রেনে তুরস্কের তৈরি ড্রোন ভয়ঙ্কর সফলতা পাচ্ছে। রয়েছে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। রাশিয়া থেকে এসইউ-৫৭ পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তুরস্ক নৌ-শক্তিতেও বলীয়ান। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করছে অস্ত্র বিভিন্ন দেশে। বাহরাইন, ওমান, কুয়েত ও ইয়েমেনও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের হাওয়া শুরু হয়েছে যেভাবে
মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির কিছুটা ধারণা আগেই দেয়া হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের জ্বালানি বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তাতে আরব দেশগুলো বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে; বাড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ইউরোপের নির্ভরতা। ইরানের তেল পাওয়ার চেষ্টা করছে ইউরোপ। জ্বালানি তেলের চড়া দামে ভর করে সৌদি আরব এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ; এ বছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। কাতার, কুয়েত, আমিরাত, বাহরাইন ও ইরানের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। সৌদি আরব, কাতার এবং আমিরাতের সহযোগিতায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে তুরস্ক ও মিসরের অর্থনীতিও।
উল্লেখ করার মতো অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি থাকার পরও মধ্যপ্রাচ্য ছিল পশ্চিমা বিশ্বের একটি হাসির অঞ্চল। পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-সঙ্ঘাত ও প্রক্সিযুদ্ধের খেলায় মেতে উঠেছিল এ দেশগুলো। এই সুযোগে পশ্চিমারা তেলসম্পদ লুট, মারণাস্ত্র পরীক্ষা এবং মুসলমান নিধনের খেলায় মেতে উঠেছিল। তবে গেল দু’বছরে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলো সক্ষম হয়েছে তাদের কয়েক দশকের শত্রুতা ভুলে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে; চেষ্টা করেছে ব্যবসায়, নিরাপত্তা ও কূটনীতিকে সামনে রেখে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের শেষ দিকে। আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ২০২১, গত বছর ইরান সফর করেন এবং ধারাবাহিকভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে ২০২১ সালের শুরুর দিকে সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে পুরনো শত্রু সৌদি আরব ও ইরান সরাসরি প্রক্সিযুদ্ধে ইয়েমেন ও ইরাকের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এক দশক ইয়েমেনে সামরিক অভিযান চালিয়ে হুতিদের পরাজিত করতে পারেনি সৌদি আরব; বরং মিসাইল ও ড্রোন হামলায় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে সৌদি আরব ও তার তেলক্ষেত্র। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইরাকের মধ্যস্থতায় ইরানের সাথে আলোচনা শুরু করে সৌদি আরব। সৌদি আরব ও ইরান নতুন করে যে প্রক্সিযুদ্ধে জড়াবে না তা এখন প্রায় নিশ্চিত। ইরানের পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করছে ইসরাইল কিন্তু সমর্থন পাচ্ছে না কোনো আরব দেশের।
নিজেদের অবস্থান সংহত করার কৌশলে নতুন করে ইরানের সাথে দ্ব›দ্ব বাড়াতে চায় না এরা। ইরানের সাথে সঙ্ঘাতের অর্থ হচ্ছে, পুরো আরব অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি করা। পরমাণু চুক্তির মাধ্যমে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে যা আরবদেশগুলো ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করে। এ ছাড়া ইরানের সাথে তুরস্ক, আরব আমিরাত ও কাতারের রয়েছে নিবিড় বাণিজ্য সম্পর্ক।
মিসরের সাথে কাতার ও তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা হচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সৌদি আরব সফর করেন। ‘আরব বসন্ত’কে কেন্দ্র করে এক দশকের ক‚টনৈতিক টানাপড়েনের পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মিসরের সাথে কাতারের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। মিসরের প্রেসিডেন্ট কাতারের আমিরের সাথে বাগদাদ, বেইজিং ও কায়রোতে তিন দফা বৈঠক করেন। মিসরের অর্থনীতি সচল করতে কাতার দেশটিতে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। একই সময়ে তুরস্কের সাথে মিসরের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক বড় দেশ তুরস্ক যার অন্যতম সমস্যা কুর্দি, যাদেরকে পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কুর্দিদের থেকে পশ্চিমা সমর্থন প্রত্যাহার এবং সেই সাথে প্রতিবেশী সিরিয়া ও ইরানের সমর্থনের জন্য এই দুই দেশের অন্যতম মিত্র রাশিয়াকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে এরদোগান।
একসময় প্রেসিডেন্ট আসাদের সাথে এরদোগানের ছিল সুসম্পর্ক; আরব বসন্তের সময় সেই সম্পর্কে চিড় ধরে। সম্প্রতি তেহরানে পুতিন, এরদোগান ও রাইসির বৈঠক তুরস্কের নীতিতে পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। সিরিয়ার ভূখণ্ডে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসছে তুরস্ক। তুরস্কে থাকা সিরিয়ান শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য এরদোগান আসাদের সাথে অলিখিত সমঝোতায় যেতে পারেন।
মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সক্রিয় সমর্থন সীমিত করার শর্তে মিসরের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন এরদোগান। সিরিয়ার সাথে একই কৌশল নিতে পারে তুরস্ক। সামগ্রিকভাবে সিরিয়ার নীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পরিবর্তন আসছে। প্রেসিডেন্ট আসাদ চলতি বছরের মার্চে আরব আমিরাত সফর করেন যা ছিল কোনো আরব দেশে তার প্রথম সফর। ইতোমধ্যে সিরিয়ার সাথে আরব আমিরাত, জর্দান ও মিসরের সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে। তুরস্কের সাথে সিরিয়ার সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে পুরো পরিস্থিতি বদলে যাবে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রিস ও ইসরাইলের সাথে জোট বেঁধেছিল মিসর। সে অবস্থান থেকে সরে আসে কায়রো। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতায় আসার শুরুতেই সৌদি আরবের বিন সালমান ও তুরস্কের এরদোগান তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ফলে সালমান ও এরদোগানের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির কমন গ্রাউন্ড তৈরি হয়, যার সূচনা হয় এরদোগানের সৌদি আরব সফরের মধ্য দিয়ে। ইস্তাম্বুলে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার সাথে সম্পৃক্ততা নিয়ে সালমানকে কোণঠাসা করেন বাইডেন। তুরস্ক সালমানের ওই মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে সালমান এখন দায়মুক্ত।
অপরদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কটে থাকা তুরস্কের পাশে দাঁড়ায় সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। লিবিয়ায় বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতার এর পেছনে সমর্থন কমিয়ে আনে সৌদিআরব ও আরব আমিরাত। ফলে লিবিয়ায় তুরস্কের অবস্থান সুদৃঢ় হয়। ক’দিন আগে ভ‚মধ্যসাগরে তেল অন্বেষণ চুক্তি করে দেশ দু’টি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পর্কের এই মেরুকরণের অন্যতম কারণ ছিল তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক পুনস্থাপন; এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন কমে নতুন এক স্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।
বলতে হয়, মধ্যপ্রাচ্যের রয়েছে তেল-গ্যাসের মতো জ্বালানি শক্তি। রয়েছে বিশাল ভৌগোলিক আয়তন ও জনসংখ্যা। রয়েছে ৫০ লাখেরও বেশি সমরশক্তি। মধ্যপ্রাচ্য এখন শুধু অস্ত্র ক্রয় নয়; বরং পঞ্চম প্রজন্মের আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তিসহ সব অস্ত্র নিজেরা তৈরি করছে। রয়েছে রাশিয়ার এস-৪০০-এর মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ইরান ও তুরস্কের রয়েছে শক্তিশালী নৌশক্তি। মধ্যপ্রাচ্যের পাশেই রয়েছে আফগানিস্তানের মতো বিশ্বের সব পরাশক্তিকে পরাজিত করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যোদ্ধা। তারই পাশে পারমাণবিক শক্তিধর ও গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার র্যাঙ্কিংয়ে ৯ নম্বরের দেশ পাকিস্তান। মধ্য এশিয়ায় আজারবাইজানের মতো শক্তিশালী দেশও রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সেনাবাহিনী ইউরোপ, রাশিয়া এবং আমেরিকার তৈরি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। এই দুই দেশই ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন ও মিসাইলও তৈরির অস্ত্র শিল্প গড়ে তুলেছে। তুরস্কের পঞ্চম প্রজন্মের স্টিল ফাইটার প্রজেক্টেও এই দুই দেশ অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছে। রয়েছে বাংলাদেশ, ইয়েমেন, সুদান, তিউনেশিয়া, মরক্কো এবং নাইজেরিয়া।
পরিশেষে বলতে হয়, এত শক্তি-সম্পদ থাকার পরেও মধ্যপ্রাচ্যে এবং মুসলিম বিশ্বের ছিল না শুধু পারস্পরিক ঐক্য এবং ঐক্য করতে নেতৃত্ব দেয়ার মতো নেতা; সেই ঘাটতিও অনেকটাই পূরণ হয়ে আশার আলো ছড়াচ্ছে বিশ্বে; আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশও পুরোপুরিভাবে ইউরোপ-ওয়াশিংটনকে সমর্থন দেয়নি; বরং রাশিয়া ও চীনের সাথে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। বাইডেন নিজে এবং জার্মান চ্যান্সেলর সৌদি আরব গিয়ে ওপেক প্লাস-কে তেল উৎপাদন বাড়ানোর অনুরোধ করার পরও উৎপাদন না বাড়িয়ে; বরং প্রতিদিন দুই মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তথা মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের এক মাইল ফলক। খেয়াল রাখতে হবে, আল্লাহ তাদেরকেই সহায়তা করেন যারা নিজেদের সহায়তা করে। সুতরাং নিজেদের সহায়তা করার দৃঢ় মনোভাব এবং ঐক্য ধরে রাখতে পারলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে নতুন শক্তি হিসেবে আবার আবির্ভূত হবে মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্ব; ইনশাআল্লাহ।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা