বিশ্ব মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার আইএমএফ
- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:৪৫
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ আসলেই বিশ্ব মুদ্রাবাজারকে নিয়ন্ত্রণ ও মার্কিন ডলারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং সুরক্ষা দিতেই প্রতিষ্ঠিত কি না সেই প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে আসুন, আমরা দেখি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ আসলে কী, কখন, কিভাবে ও কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ধারণা, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ডব্লিউটিও ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকার নেতৃত্বে বিজয়ী দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মূলত বিশ্বে এই বিজয়ী শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যই। এই সংস্থাগুলোকে অনেকে মাফিয়া চক্রও বলে। এতে বেশির ভাগ মানুষ বিভ্রান্ত হলেও যারা অন্তর্দৃষ্টি, দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন তারা প্রথমেই বিষয়টি সর্বাংশে সঠিক বলে মেনে নেবে। তবে ষড়যন্ত্র যদি থেকে থাকে, সেটি এতই গভীরে যে, বুঝতে হলে অল্প করে হলেও এদের ইতিহাস জানা প্রয়োজন।
বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাস
উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৮০০ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তিতে ব্যাপক হলেও অর্থনৈতিকভাবে আজকের আমেরিকার মতো দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। ওই পুরো সমস্যাই সৃষ্টি করেছিল ইহুদি জাতীয়তাবাদের (জায়োনিজম) প্রবক্তা রথচাইল্ড ব্যাংক পরিবার। ইহুদি সমাজে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জাতীয়তাবাদী চেতনা অত্যন্ত প্রবল। ফলে ধীরে ধীরে ইহুদি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় যেখানে আমেরিকার কোটি কোটি ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানেরও সমর্থন রয়েছে। এই খ্রিষ্টানরা আমেরিকার রাজনীতিতে বড় প্রভাবক এবং এরা শুধু জায়োনিজম আদর্শের কারণেই ইসরাইলকে সমর্থন দেয়।
মধ্যযুগ থেকেই মুসলমান ও ক্যাথলিক সমাজে সুদের ব্যবসায় নিষিদ্ধ ছিল। তবে ইহুদি সমাজে তা ছিল না বিধায় ব্যাংক-ব্যবসায় ইহুদি সমাজে বিকশিত হয়েছিল। ১৫ শতকে পশ্চিম ইউরোপে ধনতন্ত্র বিকাশের সাথে হাত ধরাধরি করে ইহুদি ব্যাংক-ব্যবসায়ও বিকশিত হয়। যার ফলে রথচাইল্ড, ওয়ারবার্গ, জ্যাকব, গোল্ডম্যান স্যাকসদের মতো ধনী ইহুদি ব্যাংকিং পরিবার সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীতে ১৮ শতকে ব্রিটেনে ও আমেরিকায় শিল্প বিপ্লব এদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ইউরোপের প্রতিটি সরকারকে তারা সুদভিত্তিক শিকারি লোনের মাধ্যমে কব্জা করে নিয়েছিল যেভাবে বর্তমান আমেরিকান সরকারকে তারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের বাণিজ্যিক ব্যবস্থা অর্থাৎ আমেরিকা, ইউরোপ তথা বিশ্বের অর্থ, অস্ত্র, খনিজ, ড্রাগস, প্রাকৃতিক সম্পদ, খাদ্য, শিল্প-উৎপাদন ও বহুজাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রক ইহুদি সম্প্রদায়। সারা বিশ্বের মোট প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী ও গবেষণাধর্মী কর্মকাণ্ডের অর্ধেকেরও বেশি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। বলা হয়, আমেরিকা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে, আর আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদি সম্প্রদায়। আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের কম হয়েও ২০ শতাংশ বা প্রতি পাঁচজনের একজন আমেরিকান সিনেটর-কংগ্রেসম্যান ইহুদি। তা ছাড়া আমেরিকা প্রশাসনের শুধু প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বা মূল পদগুলো সবসময় তাদেরই দখলে থাকে।
সবচেয়ে বড় কথা, আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সেন্ট্রাল রিজার্ভ সিস্টেমসহ আমেরিকা ও ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকগুলো, ব্রিটিশ সরকারি ট্রেজারি বন্ডের ৭৫ শতাংশ মালিকানা তাদের। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের অর্থের মূল জোগানদাতা রথচাইল্ড, রকফেলারসহ অন্য প্রভাবশালী বিত্তবান পরিবারও ইহুদি সম্প্রদায় থেকে এসেছে। এই রথচাইল্ড পরিবার অত্যন্ত দক্ষ গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও মুদ্রা ছাপানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অতি সূত্রভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ১৯১৩ সালে ‘ফেডারেল রিজার্ভ’ নামে এক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তারা আমেরিকার অর্থনীতিকে ভেতর থেকে শোষণ করে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ঋণগ্রস্ত দেশে রূপান্তরিত করেছে। ঠিক একইভাবে রথচাইল্ড পরিবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছিল তাদের সাম্রাজ্যের পতনের পূর্ব মুহূর্তে। এই চক্রকে বলা হয় আন্তর্জাতিক অর্থনীতির কৃষ্ণগহ্বর। এরা বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ চিরস্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বের পর মিত্রশক্তির দেশগুলোকে কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। আইএমএফ তার অন্যতম। সুতরাং আসুন আমরা দেখি আইএমএফ আসলে কী?
আইএমএফ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যা বিশ্বের সব দেশের ঋণ নেয়ার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে সহায়তা দিতে গড়ে উঠেছিল এই সংস্থাটি। ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার পরিপ্রেক্ষিতেই আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার ধারণার জন্ম হয়। পরবর্তীতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অন্যান্য রাষ্ট্র অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ধারণা থেকেই, মহাযুদ্ধ যখন শেষ পর্যায়ে তখন বিচক্ষণ রথচাইল্ড পরিবার পৃথিবীর অর্থনীতির ওপর নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্যে ১৯৪৪ সালে এক সাথে বিশ্ব ব্যাংক (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে এক সম্মেলনের আয়োজন করে আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটনউড শহরে। যুদ্ধপরবর্তী অর্থনীতি যাতে স্থিতিশীল থাকে সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য মিত্রপক্ষের ৪৪টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে এবং দেশগুলোর প্রতিনিধিরা একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন যা ব্রেটনউডস নামে পরিচিত। এই চুক্তির ফসল হিসেবেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই আন্তর্জাতিক সংস্থা দু’টি বিশ্বব্যাপী আমেরিকাকে সামনে রেখে মূলত রথচাইল্ড পরিবার ইহুদি সম্প্রদায় বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি-রাজনীতিতে তাদের প্রভাববলয় সৃষ্টি করতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এই চুক্তি বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১৯০টি দেশ এই সংস্থার সদস্য, যারা এই সংস্থাটি পরিচালনা করে এবং এদের কাছেই আইএমএফকে জবাবদিহি করতে হয়। প্রাথমিকভাবে এর কাজ ছিল মুদ্রার নির্দিষ্ট বিনিময় হার তত্ত্বাবধান করা। ব্রেটনউডস চুক্তির মাধ্যমেই স্বর্ণকে পাশ কাটিয়ে মার্কিন ডলারকে আনুষ্ঠানিকভাবে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে কোনো একটি দেশের মুদ্রার মান মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুলনা করা হয়।
আইএমএফের মূল কাজ ও নেপথ্যের উদ্দেশ্য
বর্তমানে আইএমএফ বিভিন্ন দেশের মুদ্রার ওপর নজরদারি, ঋণদান ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। মূলত এর লক্ষ্য হচ্ছে, আর্থিক বা মুদ্রাব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে উৎসাহিত করা ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এমনভাবে বাড়ানো যাতে সেটি অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারে। বিশ্বের মুদ্রাব্যবস্থার ওপর কিছুটা নজরদারিও করে এই সংস্থাটি। এই কাজের অংশ হিসেবে আইএমএফ বৈশ্বিক অর্থনীতি ও সদস্য দেশগুলোর অর্থনীতির তথ্য রাখে। পরে অর্থনীতিবিদদের নিয়োগ করে দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে। প্রতি বছর আইএমএফ এসব দেশের অর্থনীতির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র বা বিশ্লেষণ সরবরাহ করে। আইএমএফ আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ করে সেগুলো নিরসন করে প্রবৃদ্ধি এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনে নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেয়।
আইএমএফ এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ঋণ দিয়ে থাকে। বিশেষ করে যেসব দেশ বৈদেশিক বিল পরিশোধ বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে সঙ্কটাপন্ন অবস্থা পার করছে কিংবা ভবিষ্যতে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে, এমন দেশকে জরুরি ভিত্তিতে ঋণ দিয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ওই দেশগুলোকে তাদের আন্তর্জাতিক রিজার্ভ পুনর্নির্মাণ, তাদের মুদ্রার মান স্থিতিশীল করা, আমদানি বিল পরিশোধের সহায়তা করা ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করা। একই সাথে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ সঙ্কট মোকাবেলায় সাহায্যের কথা বলে এই সংস্থাটি। বাহ্যিকভাবে সহায়তার উদ্দেশ্য থাকলেও নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণ উদ্দেশ্যও রয়েছে। আর এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেই প্রতিষ্ঠানটি ঋণের সাথে বিভিন্ন রকমের শর্ত জুড়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে বেঁধে ফেলে। অনেক সময় এই শর্তের মধ্যে দেশের জনগণের স্বার্থপরিপন্থী শর্তও থাকে যা পরিপালন করতে গিয়ে সরকারের পতনও ঘটতে দেখা যায়। তাই তো বলা হয়, একটি দেশের ঋণ পরিশোধে ত্রাতা হিসেবে আইএমএফ ঋণ দিলেও এতে শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লাভবান হয়। আর ঋণ গ্রহণকারী দেশটিকে পরবর্তীতে উচ্চ হারে সুদসহ সেই ঋণ পরিশোধ করতে হয়।
আইএমএফের মাধ্যমে ওই চক্র বিশ্বের মুদ্রাবাজারকে নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার হলো তাদের দেয়া চাঁদা। উল্লেখ্য, ওই প্রতিষ্ঠানটির তহবিলের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে সদস্য রাষ্ট্রের চাঁদা। কোনো একটি দেশ আইএমএফের সদস্য হতে হলে তাকে একটি নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদার পরিমাণ বিশ্ব অর্থনীতিতে ওই দেশের অর্থনৈতিক আকারের প্রতিনিধিত্ব করে যাকে সংক্ষেপে বলা হয় কোটা। কোটা যাদের যত বেশি নিয়ন্ত্রণ তাদের তত বেশি। সদস্য রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনেক সময় আইএমএফ ঋণ নেয়, এটিও তার একটি উৎস আর সদস্য রাষ্ট্রকে দেয়া ঋণের সুদও সংস্থাটির আয়ের উৎস।
যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আইএমএফকে নিয়ন্ত্রণ করে
বর্তমানে বিশ্বের ১৯০টি দেশ আইএমএফের সদস্য এবং এরা প্রত্যেকেই চাঁদা দেয়। তবে সবচেয়ে বেশি চাঁদা দেয় যুক্তরাষ্ট্র যা প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন ডলার, ফলে ভোট দেয়ার ক্ষমতাও বেশি। উল্লেখ্য, আইএমএফের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে তাতে সদস্যদের ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ ভোট দরকার হয়। সেখানে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের একার ভোট রয়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশের বেশি। ফলে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে ভেটো দেয়ার ক্ষমতাও রয়েছে এই দেশটির।
সংস্থাটির ২৪ জন ডিরেক্টরের সমন্বয়ে গঠিত আইএমএফের একটি এক্সিকিউটিভ বোর্ড রয়েছে। এই বোর্ডের ডিরেক্টরদের মধ্যে আটজন ডিরেক্টর স্থায়ী। এরা হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, রাশিয়া, সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্য। এই আটটি দেশের মধ্যে ছয়টি যুক্তরাষ্ট্রের মতানুসারী। বোর্ডের অন্য সদস্যরা ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয় যাদেরকে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দেই নির্ধারণ করা হয়। এই এক্সিকিউটিভ বোর্ডের চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক এর নেতৃত্বে থাকেন। শুরু কাল থেকেই সংস্থাটির চেয়ারম্যান হন একজন ইউরোপিয়ান ব্যক্তি। অন্য দিকে, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হন একজন আমেরিকান। দু’টি সংস্থার সদর দফতরই ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত। আইএমএফ আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে এবং দেশের মুদ্রার মানের পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে। সদস্য দেশের সাথে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির একটি হিসাব রাখে, বৈদেশিক বিল পরিশোধের সঙ্কটে পড়া দেশগুলোকে ঋণ দেয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে, কর্মসংস্থান বাড়ানোর সুযোগ দেয় এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বাস্তবভিত্তিক সহায়তা প্রদান করে।
বিশ্বব্যাংকের সদস্য হতে হলে প্রথমেই আইএমএফের সদস্য হতে হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এ ধরনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান যা ‘বৈদেশিক বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে সমন্বয় সাধন করে। কিন্তু কার্যত অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হল বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা, যা তারা আক্ষরিক অর্থেই অর্জন করতে সমর্থ হয়। এক কথায়, এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতি শোষণের উদ্দেশে ওই চক্রের একেকটি বৃহদাকৃতির ভ্যাক্যুয়াম ক্লিনার। এরা আন্তর্জাতিক ঋণ হাঙ্গর নামে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার কারণে হোক কিংবা গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করে হোক, তৃতীয় বিশ্বে ওদের দালালের অভাব হয় না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের দালালে রূপান্তর করার দক্ষতার ক্ষেত্রে ওদের জুড়ি নেই।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ইলেকট্র্রনিক মিডিয়া এবং প্রধান পত্রিকাগুলোর মালিক ও সম্পাদকদের তারা নিজেদের ‘গোলাম’ বানিয়ে ফেলে। এই দেশগুলোকে ঋণের জালে বন্দী করে তারা স্বাধীনভাবে হুকুম জারি করতে থাকে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তো অনেক দূরের কথা, ঋণের ভারে জর্জরিত এ সব দেশ ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রীতদাসে পরিণত হয়। খোদ ইউরোপ ও আমেরিকার নিরীহ জনগণকে জায়নিস্ট রথচাইল্ড ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, শেয়ার মার্কেট, বিভিন্ন অর্থনেতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথমে বেকার, পরবর্তীতে দরিদ্র, ভিটেছাড়া ও সবশেষে বিভিন্ন দেশকে দেউলিয়া বানিয়ে ফেলে; ঋণের জালে বেঁধে ফেলে।
সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো- এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্ত কার্যক্রম গোপনীয় ও এদের কোনো হিসাব অডিট করার সুযোগ কারো নেই। এরা কিছু সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নর এবং কিছু নিজস্ব অনুসারী ও তোষামোদকারী অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে গোপনে সব পলিসি তৈরি করে যা সরকারি এবং বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের অডিট করা তো দূরের কথা, ওই সব পলিসি দেখা কিংবা জানারও কোনো সুযোগ নেই। যত দিন জায়নিস্টদের ওই সব অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান চালু থাকবে তত দিন তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নত দেশ হতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। যেখানে তারা উন্নত দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলে দেউলিয়া করছে সেখানে অনুন্নত দেশের উন্নতি করার তো প্রশ্ন সুদূর পরাহত।
এ বিষয়ে জন পারকিনস নামে জনৈক বিশেষজ্ঞ ‘অর্থনীতি ধ্বংসকারী’ ওদের কার্যকলাপগুলো বিস্তারিতভাবে তার সাড়াজাগানো বই ‘এক অর্থনীতি ধ্বংসকারীর আত্মস্বীকৃতি’তে লিপিবদ্ধ করেন। কী গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতি ধ্বংস করে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ওই বইয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়। জন পারকিনস ওই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সাথে দীর্ঘ ২১ বছর জড়িত থাকার পর ইস্তফা দিয়ে আত্মস্বীকৃতিমূলক ওই বইটি লিপিবদ্ধ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত ওই চক্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে পৃথিবীতে গরিব দেশের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণের ফাঁদে পড়ে ২০০১ সালে আর্জেন্টিনা ব্যাপক আর্থিক সঙ্কটে পতিত হয়। এ ছাড়াও তিউনিসিয়া, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জ্যামাইকাসহ অনেক দেশ আইএমএফের ঋণের ফাঁদে সর্বস্বান্ত। ইদানীং পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি বাংলাদেশও সেই পথে পা বাড়াচ্ছে।
পরিশেষে বলতে হয়, মূলত কোনো দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে এবং চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিলে, যখন কোনো সংস্থা ঋণ বা সাহায্য দিতে চায় না, তখনই আইএমএফ এগিয়ে আসে। উল্লেখ্য, একটি দেশের যত সম্পদই থাকুক না কেন, শুধু বৈদেশিক মুদ্রা নামক ডলার না থাকলেই দেউলিয়া। আর এই সময় দেউলিয়াত্বের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আইএমএফ ডলার নিয়ে তার হাত সম্প্রসারণ করে।
বাহ্যিকভাবে তা খুবই উপকারী মনে হলেও নেপথ্যে থাকে ভিন্ন উদ্দেশ্য। আগেই বলেছি, আইএমএফের ঋণ হচ্ছে কোনো দেশের জন্য একটি শেষ আশ্রয়। বিশ্বে যত ধরনের প্রতিষ্ঠান ঋণ দেয় তার মধ্যে সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে আইএফএম। আইএফএম নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা অনেক ধরনের সমালোচনা দেশে দেশে। অর্থাৎ যখন একটি দেশ আর কোনোভাবেই পেরে ওঠে না অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বের হতে তখন তারা আইএমএফের কাছে যায়। যেমন- শ্রীলঙ্কা গেছে, অনেক দেরি করে গেছে। আমরা জানি, শ্রীলঙ্কা বলেছিল- আইএমএফের হাতে তো কোনো জাদুর কাঠি নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আইএমএফের কাছে যেতে হয়েছে; যেতে হয়েছে পাকিস্তানকেও। অনেক নাটকের পর বাংলাদেশও আবেদন করেছে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আইএমএফের কাছে। এসব দেশে নিজেদের সব সম্পদ আগের মতো থাকলেও কেবল স্বঘোষিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলার না থাকার কারণেই ঋণের আবেদন করতে হয়েছে। এভাবেই মূলত ওই সংস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলারকে সুরক্ষা দেয়া এবং রথচাইল্ড পরিবার ও তাদের অনুসারী জায়নবাদের বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করাই যেন মূল উদ্দেশ্য।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা