৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ৩০ রজব ১৪৪৬
`

বিদায় রানী স্বাগত রাজা

বিদায় রানী স্বাগত রাজা - ছবি : সংগৃহীত

রাজা রানীরা আমৃত্যু সিংহাসনে আসীন থাকেন এবং রাজা রানী হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো বয়সসীমার রীতি নেই। তাই যদি থাকত তাহলে ২৫ বছর বয়সে সিংহাসনে বসে ৯৬-এ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উত্তরাধিকারীকে ৭০ বছর অপেক্ষা করে ৭৩ বছর বয়সে গদিতে বসার ফুরসত মিলত না। একজনের শেষ আর একজনের শুরু হওয়ার মধ্যে যোজন যোজন দূরের এ মাহাত্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথকেও হয়তো তার সেই বিখ্যাত গানের বাণী ও স্বরলিপি পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ত। অ-রাজতন্ত্রে তাই ক্ষমতায় যাওয়া, থাকা ও নামার সময়সীমা বেধে দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে, জুড়ে দেয়া হয়েছে নানান শর্ত সাবুদ। পদ্ধতি প্রক্রিয়াও ঠিক করা আছে ক্ষমতায় ওঠা-নামার। আবার সেই পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে বিকলাঙ্গ করে বেশি দিন থাকার কৌশল রপ্ত করার কোশেষেশ কাটতি নেই, ঘাটতি নেই। নিয়মনীতি স্বাভাবিকভাবে না চললে শেষমেশ প্রকৃতিকেই সুয়োমটো উদ্যোগ নিতে হয়। রাজতন্ত্রে এক সময় কমবেশি এসব ছিল, এখন রণে ভঙ্গ দিতে ক্ষমতা কাটছাট করে, ভ‚মিকা পালনের পথে নিন্দার কাঁটা বিধানোর বিধান করা হয়েছে। নিন্দুকেরা বলে থাকেন, সে সময় টিআইবি, সিপিডি, সুজন আর অডিট বিভাগ থাকলে সম্রাট শাহজাহান এত টাকা ও সময় ব্যয় করে তাজমহল বানাতে পারতেন না। গত বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর ) ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজশাসক রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার ৭০ বছর রাজত্ব আর ৯৬ বছরের বর্ণাঢ্য এক জীবনের অবসান হলো। এলিজাবেথ ১৯৫২ সালে সিংহাসনে আসীন হন। জীবদ্দশায় বিশাল সামাজিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছিলেন তিনি। রানীর মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে, সাবেক প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লস এখন নতুন রাজা এবং ১৪টি কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের প্রধান।

রানীর জীবনাবসানের মাত্র দুদিন আগে ৬ সেপ্টেম্বর লিজ ট্রাস যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ পেতে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসলে রানীর কাছে যান। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রথা ভেঙে এটা করা হয়। সাধারণত রানী লন্ডনে থাকেন, সেখানে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হবু প্রধানমন্ত্রীরা। লিজ ট্রাসের বিরল সৌভাগ্য যে তিনি রানীর শুভাশীষ পাওয়া ১৫ জন প্রধানমন্ত্রীর ( উইনস্টন চার্চিল থেকে লিজ ট্রাস) সারিতে নাম লিখাতে পেরেছেন।

রানী এলিজাবেথ ছিলেন ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে অটল কর্তৃত্বের অধিকারিণী। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যখন ব্রিটেনের প্রভাব ক্রমে কমেছে, সমাজে আমূল পরিবর্তন এসেছে, রাজতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখনো অনেকের কাছে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জনপ্রিয়তা কমেনি। ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে নিজ কর্তৃত্বে তিনি অটল থেকেছেন। অথচ তার জন্মের সময়ও কেউ ভাবেননি তার ভাগ্যে রয়েছে ব্রিটেনের সিংহাসনে আরোহণ।

এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল। বাবা অ্যালবার্ট, ডিউক অব ইয়র্ক এবং মা সাবেক লেডি এলিজাবেথ বোওজ-লিওনের তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান। অ্যালবার্ট ছিলেন পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় সন্তান। তবে তার বড় ভাই ডেভিড ১৯৩৬ সালে তৃতীয় এডওয়ার্ড উপাধি পেয়ে সিংহাসনে বসলেও দুবার বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া আমেরিকান এক ধনী রমণী ওয়ালিস সিম্পসনের সঙ্গে বিয়ের কারণে সিংহাসন ছাড়তে হয়। এলিজাবেথের বাবা ডিউক অব ইয়র্ক অনিচ্ছার সঙ্গে সিংহাসনে বসেন রাজা ষষ্ঠ জর্জ হিসেবে। বাবার অভিষেক অনুষ্ঠান কিশোরী এলিজাবেথকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে।

রাজা ষষ্ঠ জর্জ, তার স্ত্রী ও দুই কিশোরী কন্যাকে নিয়ে যখন রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে ইউরোপে ঘুরছেন, তখন ১৯৩৯ সালে ইংল্যান্ডে এলিজাবেথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে গ্রিসের যুবরাজ প্রিন্স ফিলিপের। এলিজাবেথের বয়স যখন ১৮, তখন ১৯৪৪ সালে ফিলিপের প্রতি তার প্রণয় গভীর হয়ে ওঠে। ঘরে ফিলিপের ছবি রাখতেন, দু’জন দু’জনকে চিঠি লিখতেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে তরুণী প্রিন্সেস এলিজাবেথ আধাসামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে লরি চালানো ও লরির সার্ভিস করার শিক্ষা নেন। যুদ্ধ শেষে প্রিন্স ফিলিপকে বিয়ে করতে চাইলে তাকে বেশ বাধার মুখে পড়তে হয়। এলিজাবেথ ছিলেন রাজার আদরের কন্যা। ফিলিপের বিদেশী বংশপরিচয়ের কারণে রাজা তার হাতে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হননি। কিন্তু তাদের ইচ্ছার জয় হয় শেষপর্যন্ত। ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর এলিজাবেথ ও ফিলিপ ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ফিলিপের উপাধি হয় ডিউক অব এডিনবরা। তিনি নৌবাহিনীর কর্মকর্তা পদে বহাল থাকেন। বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর তারা স্বাভাবিক বিবাহিত জীবন কাটান। এ সময়ই তাদের প্রথম পুত্র চার্লস ও কন্যা অ্যান জন্ম নেন।

১৯৫২ সালে যখন এলিজাবেথের বয়স ২৫, তখন রাজা ষষ্ঠ জর্জ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শয্যা নেন। এলিজাবেথ স্বামীকে নিয়ে বিদেশ সফরে যান বাবার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে। চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে রাজা তাকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিল পিতা-কন্যার শেষ দেখা। এলিজাবেথ কেনিয়ায় বসে বাবার মৃত্যু সংবাদ পান। ১৯৫৩ সালের জুনে তার আনুষ্ঠানিক অভিষেকে দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহণ ও শপথগ্রহণ লাখ লাখ মানুষ দেখেন টিভি পর্দায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ উপনিবেশ তখন গুটিয়ে এসেছে। নতুন রানীর দায়িত্ব নিয়ে তিনি যখন ১৯৫৩ সালে কমনওয়েলথ দেশগুলোতে দীর্ঘ সফরে বের হলেন, তখন ভারতীয় উপমহাদেশসহ অনেক দেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। ক্রমে রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিচ্ছিন্ন আনুগত্যে বদল আসতে শুরু করে। সমাজে নানা ধ্যান-ধারণা দ্রুত বদলাতে থাকে। রানীও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলান। ক্রমে ‘রাজতন্ত্র’র জায়গা নেয় ‘রাজপরিবার’। রানীর রাজত্বকালের মূল স্তম্ভ হয়ে ওঠে সাংবিধানিক সততা রক্ষা। তবে সরকারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে চলে যান রানী। তার দায়িত্ব সীমিত থাকে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন, দেশের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত থাকা, সরকারকে পরামর্শ দেয়ার মধ্যে। ষাটের দশকের শেষদিকে, বাকিংহাম প্রাসাদ সিদ্ধান্ত নেয় যে রাজপরিবারকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। রানী এবং তার পরিবারও যে আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের মতো ঘরকন্নার নানা কাজ করে তা দেখাতে বিবিসিকে ‘রয়্যাল ফ্যামিলি’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরির অনুমতি দেয়া হয়।

রানীর দৈনন্দিন ঘর-সংসারের নানা ছবি ধারণ করা হয়। অনেকে বলেন, ওই তথ্যচিত্র রাজপরিবারের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা-ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। রানী এলিজাবেথ নিজের দায়িত্ব পালনে নানা দেশে ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন।

১৯৬১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা এবং চট্টগ্রামে প্রথম সফরে আসেন রানী। বাংলাদেশে তার দ্বিতীয় সফর ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৩ সালের ১৬ নভেম্বর দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে গাজীপুরের শ্রীপুরবাসীর কাছে। এ দিনে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ শ্রীপুরের বৈরাগীর চালা আদর্শ গ্রামে পা রাখেন। রানীর পদস্পর্শে শ্রীপুরের মাটিতে শুরু হয়েছিল শিল্পায়ন। রানীর কল্যাণে আজ শ্রীপুর শিল্পাঞ্চল।

সেদিন রানীর আগমন উপলক্ষে সেজেছিল শ্রীপুর। শ্রীপুর রেলস্টেশন থেকে বৈরাগীর চালা আদর্শ গ্রাম পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা পিচ ঢালাই করা হয়েছিল। রাস্তার দুই পাশে রোপণ করা হয়েছিল গাছের চারা। সাজানো হয়েছিল গ্রামের প্রতিটি বাড়ি। হেঁটে গ্রাম ঘুরে দেখেছিলেন রানী। সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিলেন তিনি। আর রানীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন শ্রীপুরবাসী।

ঢাকা থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে শ্রীপুরের পল্লী গ্রামে আসেন রানী বিশেষ ট্রেনে। লাল গালিচার সংবর্ধনায় বরণ করা হয়েছিল তাকে। সেখান থেকে বিশেষ গাড়িতে আদর্শ গ্রাম বৈরাগীর চালায় যান তিনি। সড়কের দু’পাশে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের পতাকা নেড়ে রানীকে স্বাগত জানায়। ‘লং লিভ কুইন’ স্লোগানে মুখরিত ছিল চারদিক। রাস্তার দু’পাশে ছিল উৎসুক জনতার ভিড়। হাত নেড়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান রানী।
ঐতিহাসিক ক্ষণে আদর্শ গ্রামে এসে সাধারণ মানুষের সাথে একাকার হয়েছিলেন রানী। গ্রাম ঘুরে রানী দেখেছিলেন মুড়ি ভাজার দৃশ্য। মুড়ির স্বাদও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। মুগ্ধ হয়েছিলেন পুকুর থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরা দেখে। দেখেছেন তাঁতের কাপড় বোনা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের দৃশ্যও তাকে মুগ্ধ করেছিল। রানীর কল্যাণে শ্রীপুরের নাম বিশ্ববাসী জানতে পায়। রানীর পদচারণায় শ্রীপুরে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। একটি আদর্শ গ্রাম দেখতে রানী বৈরাগীর চালার মতো পল্লীতে এসেছিলেন। রানী গ্রামের মানুষের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। পুকুর থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরা দেখার সময় একটি বড় আকৃতির মাছ লাফিয়ে রানীর পায়ের কাছে এসে পড়েছিল।
১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর তিনি আমেরিকা সফরে যান। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্রিটিশ রানী যিনি আমেরিকান কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন। এর এক বছরের মধ্যে তার পরিবারে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি ও দুর্যোগের ঘটনা শুরু হয়। রানীর দ্বিতীয় ছেলে ডিউক অব ইয়র্ক এডওয়ার্ড ও স্ত্রী সারা আলাদা হয়ে যান। মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান ও স্বামী মার্ক ফিলিপসের বিয়ে ভেঙে যায়। প্রিন্স ও প্রিন্সেস অব ওয়েলস, অর্থাৎ চার্লস ও ডায়ানা বিয়েতে যে গভীর অসুখী এ খবর জানাজানি হয়। তারাও আলাদা হয়ে যান। রানীর প্রিয় বাসভবন উইন্ডসর ক্যাসলে ওই বছরই বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। ওই ভবন মেরামতের খরচ সাধারণ মানুষ জোগাবে নাকি তা রানীর তহবিল থেকে ব্যয় করা উচিত তা নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক।

এক দিকে ইউরোপের সাথে নতুন জোট গঠনের মধ্য দিয়ে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সাথে ব্রিটেনের যোগাযোগ কিছুটা শিথিল হয়ে আসা, অন্য দিকে ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে অব্যাহত বিতর্ক- এর মধ্যেও যখন রানী রাজপরিবারের উজ্জ্বল স্তম্ভ হিসেবে তার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট, তখন প্রিন্সেস ডায়ানার আকস্মিক মৃত্যু ব্রিটেনের রাজপরিবারের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হয়ে আসে। ১৯৯৭ সালের আগস্টে প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা মারা যাওয়ার পর রানীর বিরুদ্ধে ওঠে সমালোচনার ঝড়। যখন প্রাসাদের বাইরে বিশাল মানুষের ঢল ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্যে ভরে উঠেছে প্রাসাদের ফটকের বাইরের রাস্তাঘাট, তখন সেই শোকের মুহূর্তের সাথে রানীর আপাতদৃষ্টিতে একাত্ম হতে না পারায় মানুষ সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।

মানুষের তীব্র সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত রানীকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে হয়, যে ভাষণে তিনি ডায়ানার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং সময়ের সাথে রাজপরিবারকে বদলানোর অঙ্গীকার দেন। রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটেনের মানুষের আগ্রহ, উদ্দীপনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ২০০২ সালে মহাসমারোহে উদযাপিত হয় রানীর সিংহাসন আরোহণের সুবর্ণজয়ন্তী, এরপর রানীর ৮০ বছরের জন্মদিনে উইন্ডসরের রাস্তায় সাধারণ মানুষের সাথে তার বিশেষ সাক্ষাৎ-সফর, রানী ও প্রিন্স ফিলিপের বিয়ের ৬০তম বার্ষিকী উৎসব এবং ২০১১ সালে রানীর নাতি উইলিয়াম ও ক্যাথরিনের বিয়ে ও ২০১২ রানীর সিংহাসন আরোহণের হীরকজয়ন্তী। সবশেষ ২০২২-এর জুন মাসে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়েছিল রানীর সিংহাসন আরোহণের ৭০তম বার্ষিকী বা প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী।

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর যুক্তরাজ্যের নতুন রাজা হয়েছেন তার বড় ছেলে চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ। সিংহাসনে মায়ের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার অপেক্ষায় চার্লস কার্যত তার পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। বস্তুত চার্লস সিংহাসনে আরোহণের পথে দীর্ঘ সময়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে রেকর্ড গড়েছেন। যদিও রানীর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য চার্লস পেয়েছেন। একবার চার্লস বলেছিলেন, ‘সমস্যাটা হলো এখানে কাজের কোনো বিবরণ নেই। তাই যদি এগিয়ে যেতে চাও, বরং নিজেই সেটা তৈরি করে নাও।’

ব্যক্তি হিসেবে অনেক বিষয়ে সক্রিয় ছিলেন চার্লস। যদিও সেটা পাদপ্রদীপের আড়ালে ছিল। চার্লস নিজেকে একজন ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে দেখেন। যুবরাজ হিসেবে তার কাঁধে ছিল প্রত্যাশার বোঝা। আত্মসম্মান বোধ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না বলে জীবনে তাকে কম ভুগতে হয়নি। তবে সঠিক কাজটি করতে ছিল তার বিরামহীন চেষ্টা।

চার্লস তার মায়ের প্রজাদের জীবনমান উন্নয়নে সাহায্য করাকে নিজের কর্তব্য হিসেবে দেখেছেন। মন থেকে যেসব বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতেন, সেসব বিষয়ে ছিলেন স্পষ্টভাষী। বিশেষ করে স্থাপত্য, পরিবেশ, কৃষিকাজ, বিশ্বাস ও বিকল্প চিকিৎসা। প্রায়ই যুবরাজের দৃষ্টিভঙ্গি খারিজ করে দেয়া হয়। উদ্ভট বা ফ্যাশনেবল বলে উপহাস করা হয়। কিন্তু অন্যরা মনে করেন, তিনি বর্তমান চিন্তাধারা থেকে এগিয়ে আছেন।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের সতর্ক করেছিলেন চার্লস। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা থেকে অর্জিত বিশ্বের সব অতিরিক্ত সম্পদ দিয়ে কী লাভ হবে, যদি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে এটিকে পুড়তে দেখা ছাড়া আপনি এর জন্য কিছু করতে না পারেন।’

চার্লস ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর বাকিংহাম প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন। সিংহাসনের উত্তরাধিকারের দিক থেকে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। দাদা রাজা ষষ্ঠ জর্জ ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মারা গেলে উত্তরাধিকারী হন। তার মা হন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। চার্লসের গৃহশিক্ষিকা ক্যাথরিন পিবলসের চোখে, বালক হিসেবে চার্লস অতি সংবেদনশীল, একাকী ও অত্যন্ত লাজুক ছিলেন। পড়াশোনা ও অঙ্কন ছিল তার নীরব সাধনা।

১৯৫৮ সালে ৯ বছর বয়সে চার্লসকে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ ঘোষণা করা হয়েছিল। এমন ঘোষণায় তিনি ছিলেন অপ্রস্তুত। এই পদবি ১৪ শতকের শুরুর দিক থেকে দৃশ্যত সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর জন্য সংরক্ষিত ছিল। চার্লসকে ১৩ বছর বয়সে গর্ডনস্টউনে পাঠানো হয়। তার বাবাও এই স্কটিশ বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন। নিদারুণ একাকিত্বের কারণে তিনি স্কুলটিকে অপছন্দ করতেন। ওই স্কুলে কাটানো তার সময়গুলো ‘পুরোপুরি নরক’, ‘কারাভোগ’ ও ‘বন্দী শিবিরের’ সাথে তুলনা করেন যুবরাজ।

চার্লস অস্ট্রেলিয়ান গ্রামার স্কুলে ১৯৬৬ সালে পড়াশোনার সময়টুকু উপভোগ করেছেন। তিনি পরিপক্ব, বিকশিত ও স্বরূপে আবির্ভূত হন। চার্লস ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে দ্বিতীয় শ্রেণী নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ১৯৬৯ সালে কেরনারফন দুর্গে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ হিসেবে অভিষেক হওয়ার আগে এক মেয়াদে ওয়েলস ভাষাও শিখেছিলেন চার্লস। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত রাজকীয় নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন চার্লস। একজন যোগ্য পাইলট হিসেবে ‘কাজের মানুষের’ ভাবমর্যাদা অর্জন করেন চার্লস। সার্ফিং এবং বিমান থেকে লাফিয়ে পড়ায় ছিলেন দক্ষ। অবসরের পর নৌবাহিনী থেকে পাওয়া ৭ হাজার ৪০০ পাউন্ড দিয়ে দাতব্য সংস্থা ‘প্রিন্স ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। দাতব্য সংস্থাটি তার ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পর্যন্ত ৮ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি সুবিধাবঞ্চিত তরুণকে একটি পেশা খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে। চার্লস বলেন, ‘আমি পুরোটা সময় বেড়ে উঠেছি অন্যদের নিয়ে ভাবতে। আমি সব সময় কাজটি সঠিকভাবে করার চেষ্টা করেছি এবং অন্যদের দিয়েও সঠিক কাজটি করিয়েছি।’ স্বল্প সময়ের রোমান্সের পর ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৯ বছর বয়সী ডায়ানা স্পেনসারকে প্রস্তাব দেন ৩২ বছর বয়সী যুবরাজ। লন্ডনের সেন্ট পল ক্যাথেড্রালে ২৯ জুলাই তাদের ‘রূপকথার বিয়ে’ সম্পন্ন হয়। ওই বিয়ের অনুষ্ঠান বিশ্বব্যাপী টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। এটি ছিল বিগত শতকের অন্যতম জমকালো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান।

১৯৮২ সালে এই দম্পতির প্রথম ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম এবং দুই বছর পর তাদের দ্বিতীয় সন্তান প্রিন্স হ্যারির জন্ম হয়। ডায়ানার ওপর রাজকীয় দায়িত্বের চাপ বাড়তে থাকায় ইতোমধ্যে তাদের দাম্পত্য জীবন নড়বড়ে হয়ে পড়ে। দু’জন বিয়ের মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হন। চার্লস পুরোনো প্রেমিকা ক্যামিলার সঙ্গে আবার সম্পর্কে জড়ান। প্রতিশোধ নিতে ডায়ানাও একই ধরনের সম্পর্কে জড়ান বলে ছয় মাস পর একটি বইতে ফাঁস হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালের জুনে দু’জন আলাদা হয়ে যান। ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রীতিমতো বোমা ফাটান ডায়ানা। এরপর চার্লসের মা দু’জনকে বিচ্ছেদের আহ্বান জানান। ১৯৯৬ সালের ২৮ আগস্ট দু’জন বিচ্ছেদ সম্পন্ন করেন। ডায়ানা ১৯৯৭ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন। তখন চার্লস প্যারিস থেকে তার লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। তাকে পূর্ণ রাজকীয় মর্যাদায় সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন।

লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআর-এর চেয়ারম্যান
[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement
চকরিয়ায় স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের ১৫ দিন পর আহত শাশুড়িরও মৃত্যু কিয়েভের বাহিনী অধিকৃত গ্রামে ২২ জনকে হত্যা করেছে : রাশিয়া ইসলাম ব্যাতিত সামাজিক সুবিচার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত সম্ভব নয় : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান চাঁদপুরে পিকআপভ্যানের চাপায় মোটরসাইকেল-আরোহী নিহত শনিবার সুনামগঞ্জে কর্মী সম্মেলনে যোগ দিবেন জামায়াত আমির ৮৯ শতাংশ ইসরাইলিই মনে করে, গাজায় তারা ব্যর্থ : জরিপ ময়মনসিংহে মোটরসাইকেল উল্টে দুই তরুণের প্রাণহানি সিলেটে দুই বাসের সংঘর্ষ, আহত ২০ রংপুরে পাঁচ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫ ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন রুখতে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে : ড. আবদুল কাদের মেক্সিকোর সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বারোপ আনসারীর

সকল