২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দার্শনিক যুক্তিসর্বস্বতা ও ঈশ্বর

- ছবি : সংগৃহীত

ডেভিড হিউমের (১৭১১-১৭৭৬) অস্বীকৃতি বস্তুবাদী বিবেকের কাছে আদর্শ বলে বিবেচিত হয় এবং দার্শনিকদের বড় এক অংশ হৃদয়বৃত্তির অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে অলীক অসার বস্তুবাদী ভ্রান্তিবিলাসকে পরিতুষ্টির আধার হিসেবে চর্বণ করতে থাকেন। তারা একে আধুনিকতা বা নতুন চিন্তা বলে আখ্যায়িত করলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল বহু শতাব্দী ধরে দার্শনিকদের যুক্তিপূজার এক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া মৌলিকভাবে পাশ্চাত্য দর্শনের এক বৈশিষ্ট্য। পাশ্চাত্য দর্শন যেদিন জন্মগ্রহণ করেছে, সেদিন থেকেই ঐশী নির্দেশনার বিরুদ্ধে যুক্তি তালাশ করেছে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে তার সীমা বুঝতে দেয়নি এবং বুদ্ধিকে হাতিয়ার বানিয়ে স্রষ্টার ঐশী-সত্যকে উপেক্ষা করেছে। সে যখন ধর্মীয় পরিবেশ দ্বারা বেষ্টিত ছিল, তখনো খোদার সত্যের প্রতি নিঃসঙ্কোচ হতে পারেনি এবং খোদার প্রতি বিশ্বাসী হয়েও চিন্তাধারার নানা বাঁকে খোদাকে খারিজ করেছে চেতনে-অবচেতনে। সে ভেবেছে খোদার বিরুদ্ধে তাকে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হতে হবে। এ কারণেই সে যুক্তি ও বিজ্ঞানকে খোদার সমান্তরাল হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছে।

র‌্যঁনে দেকার্তের (১৫৯৬-১৬৫০) মতো দার্শনিক, যিনি খোদার অস্তিত্বের সত্যকে বিশ্বাসের প্রাণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তিনিও বিশ্বপ্রকৃতির নিদর্শনাদি বিশ্লেষণে যন্ত্রকে ভাবলেন সর্বশেষ অবলম্বন। সূচনা করলেন যান্ত্রিক বিশ্লেষণ পদ্ধতির যা পরে যে উঠল নিষ্প্রাণ বস্তুবাদ। বিচার, বুদ্ধি, চিন্তা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দার্শনিক সত্যতা লাভ করাই ছিল দেকার্তের মূল লক্ষ্য। এ জন্য তিনি গুরুত্ব দিলেন এমন স্টেটমেন্ট বা সত্যবচন রচনায়, যা হবে সন্দেহাতীত এবং তার মধ্যে থাকবে স্বয়ং বিশ্বস্ততা। পূর্ববর্তী ধারণাকে তিনি গ্রহণ করতে রাজি নন সত্যের মানদণ্ড ছাড়া। তার সত্যের কেন্দ্রে আছে যান্ত্রিকতা। যুক্তি-বুদ্ধি!

সারবস্তুকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ঈশ্বরে বিশ্বাসের অনুকূলে। সারবস্তু হলো তাই, যা দিয়ে কোনো কিছু গঠিত। কিংবা কোনো কিছু মূলত যা, তাই হচ্ছে সারবস্তু। কিংবা কোনো কিছুকে শেষ পর্যন্ত যে মৌলিক অংশে কমিয়ে আনা যায়, সেটাই সারবস্তু। দেকার্তের মতে যা স্বনির্ভর, তাই সারবস্তু বা দ্রব্য এবং দ্রব্য হলো গুণের আধার। অর্থাৎ বিশুদ্ধ দ্রব্য কেবল তাকে বলা যাবে, যা তার অস্তিত্বের জন্য অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে না। সে স্বনির্ভর এবং অন্যের মুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত। সে অসীম এবং অনন্তসত্তা। আর যেহেতু স্বনির্ভর ও স্বয়ম্ভু হতে পারেন কেবলই ঈশ্বর, অতএব তিনিই একমাত্র বিশুদ্ধ সত্তা। বিশুদ্ধ সারবস্তু।

দেকার্তে আবার দ্রব্য হিসেবে তাকেও দেখাচ্ছেন, যা গুণের আধার বা গুণের আশ্রয়। প্রতিটি বস্তু হয়তো দ্রব্য, নতুবা চেতনা। কারণ যে জগতে আমরা বাস করি, তাতে আছে জড়জগৎ ও চেতনা জগৎ। পাথর, কাঠের টুকরো বা স্থাপনা ইত্যাদি হচ্ছে জড়দ্রব্য। তাদের দেখা যায়। কিন্তু চেতনাজগতে যা আছে, তাদের দেখা যায় না। সে হচ্ছে মন। আমরা সরাসরি তাকে দেখি না, দেখি তার গুণকে। এই গুণকে যখন দেখি, তখন বুদ্ধি আমাদের বলে দেয় এই গুণের আড়ালে আছে এক সত্তা, এক দ্রব্য। বিশুদ্ধ বুদ্ধিই আমাদের জানিয়ে দেয়, গুণ কখনো নিরাশ্রয় থাকতে পারে না। তার থাকতে হয় কোনো আশ্রয়। ফলে বুদ্ধি আমাদের শেখায় জড়জগতের মূলে আছে জড়দ্রব্য, চেতন জগতের মূলে আছে চেতনদ্রব্য বা আত্মা। জড়ের ধর্ম হলো বিস্তার, চেতনের ধর্ম হলো আত্মা। উভয়েই স্বতন্ত্র। উভয়েই পরস্পরবিরোধী। জড়ে বিস্তার থাকলেও নেই চেতনা। চেতনার অস্তিত্ব থাকলেও নেই বিস্তার। জড় ও আত্মা পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল না হলেও তারা ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল। সত্তা হিসেবে তারা কখনোই ঈশ্বরের সমান নয়। জগতে জড়দ্রব্য, আত্মাদ্রব্য দুই সত্তা। আর সবার উপরে আছেন পরম বা সর্বোচ্চ সত্তা ঈশ্বর। তাহলে দেখা যাচ্ছে দেকার্তের আত্মা আছে, কিন্তু তাকে চেনা যায় যুক্তির দ্বারা। মানে যুক্তি যেহেতু বলছে আত্মা আছে, অতএব আত্মা আছে। যুক্তির স্বীকৃতি যেহেতু ঈশ্বরের পক্ষে, অতএব ঈশ্বর আছেন।

দেকার্তের পরে টমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) এলেন অবিলম্বে। দেকার্তের দর্শনে বস্তুতান্ত্রিকতার সাথে অতিপ্রাকৃতের যে সমন্বয় ছিল, হবস একে অস্বীকার করলেন। প্রত্যাখ্যান করলেন বিশ্বাসের স্বীকৃতিকে, সংহতিকে। তিনি অস্বীকার করলেন যন্ত্রের বিশ্লেষণে যা ধরা পড়ে না, তাকে। সব অশরীরী সত্য ও সম্ভাবনাকে, এমনকি আত্মাকেও। বস্তুবাদে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং তার মতে বিশ্বে যা কিছু ঘটছে তার মূলে রয়েছে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদকে তিনটি ভাগে তিনি ভাগ করেন। যথা- ১. প্রথম স্তরে আছে পৃথিবী অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহ ও জ্যোতিষ্ক ইত্যাদি জড় পদার্থসমূহ, ২. দ্বিতীয় স্তরে আছে গণিত, জ্যামিতি ও যন্ত্রবিদ্যার স্থান, ৩. সর্বশেষটি হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণাগুলো।

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাই তার কাছে জ্ঞানের উৎস। অতীন্দ্রিয় সব কিছুর বিরোধিতা করেন তিনি এবং বলেন কোনো মতবাদেরই সত্যতা স্বীকার করতে হলে বিজ্ঞানের কথা শুনতে হবে। সে যদি তাকে সত্য বলে রায় দেয়, তাহলে সে সত্য। নতুবা নয়। তিনি ঘোষণা করলেন ‘ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাই হলো সব জ্ঞানের আকর।’ দুনিয়াতে যা কিছুর অস্তিত্ব বিদ্যমান, সবই একেক জড়বস্তু। বস্তুই সব। বস্তু থেকেই জ্ঞান। আগে বস্তুর অস্তিত্ব, তারপরে সেই বস্তুর জ্ঞান। বস্তু জ্ঞানকে সৃষ্টি করে। মনের এখানে ভূমিকা নেই। জগতের সব কিছুর মূলে আছে বস্তু। বস্তু অসংখ্য। তাদের অবস্থান মনের বাইরে। তারা জ্ঞানের সৃষ্টি করে, জ্ঞানকে করে প্রভাবিত। মনের এখানে নেই কারবার। মানবদেহকে তিনি আখ্যা দিলেন বস্তু, আর মানব মনকে অভিহিত করলেন ক্ষয়িষ্ণু পদার্থ। গাছ, পাথর, গাড়ির টায়ার, লোহার যন্ত্র যেভাবে বস্তু, মানুষও তেমনি এক বস্তু। পার্থক্য একটাই; সেটা হলো মানুষ নামক যন্ত্র যুক্তি প্রয়োগ করতে পারে। তার আছে এই একটি বিশেষ অতিরিক্ত উপাদান। যুক্তিই মানুষকে মানুষ করে, তার ভাবনা-চিন্তা, চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদির জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে।

মানুষের আছে দু’টি প্রবণতা। একটি আকাঙ্ক্ষা, অপরটি বিতৃষ্ণা। উভয়টির দ্বারা চালিত হয় তার যাবতীয় কাজ; ভালো-মন্দ, আকর্ষণ-বিকর্ষণ, প্রেম-অপ্রেম। মানুষের অনুভূতিতে যে জিনিস আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে, তাকে মানুষ পেতে চায় জীবনে। তার জন্য সে চেষ্টা করে, সাধনা জারি রাখে। একে পাওয়াটাই তার সুখ। তার অনুভূতিতে যে জিনিস প্রতিকূল সাড়া তৈরি করে, এর প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে এবং এর জন্য করে দুঃখবোধ। আনন্দদায়ক বস্তু মানুষের জন্য কল্যাণকর, বাদবাকি সব অকল্যাণের। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার ভিত্তিতে কল্যাণ অকল্যাণেরও ভিন্নতা থাকবে।

মানুষ আকাঙ্ক্ষা দ্বারা পরিচালিত হলেও সে তার আকাঙ্ক্ষাকে কেবলমাত্র বর্তমানের সুখের তালাশে সীমাবদ্ধ রাখে না। আকাঙ্ক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে এমন এক ক্ষমতা, যার সাহায্যে সে তার আগামী দিনের আকাঙ্ক্ষার পথকে সুগম করতে পারে। যা সে কামনা করে, তাকে ‘কোনো এক সময়ে মাত্র একবার উপভোগ করা মানুষের আকাঙ্ক্ষার লক্ষ্য নয় বরং তার আকাঙ্ক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার পথ নিশ্চিত করা।’

মানুষে মানুষে বড় রকমের কোনো পার্থক্য নেই, তারা মোটামুটি সবাই সমান। কেউ দেহে শক্তিশালী, কেউ শক্তিশালী মনে। দেহে, মনে এই ব্যবধান থাকলেও যেখানে মানুষের মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই, সেটা হলো স্বভাব। স্বভাবগতভাবে সব মানুষই স্বার্থপর, লোভী, আত্মকেন্দ্রিক এবং ক্ষমতালিপ্সু। সব মানুষই এমন এবং এই হচ্ছে হবসের মানুষ!

কৌতুককর বিষয় হলো, খোদার অস্তিত্বের প্রত্যয় হবসের কাছে ছিল। কেননা এই অস্তিত্বের কার্যকারণ শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে বিশ্বজগতের শৃঙ্খলাকে বুঝতে পারছিলেন না তিনি। অতএব খোদা আছেন কেবল এতটুকুই। তার সত্তার ব্যাপক বা সক্রিয় কোনো উপলব্ধি নেই।

বারুখ স্পিনোজাও (১৬৩২-১৬৭৭) বিশ্বাসী ছিলেন। তার ছিলেন নিজস্ব ঈশ্বর। ঈশ্বরের জন্য তিনি প্রাচ্যের নানা মতবাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিশ্বাস তার ছিল, আবার ছিল বস্তুবাদের প্রতি প্রবল পক্ষপাত। আত্মাকে তিনি ধরতে পারেননি। দেহকে বুঝেছিলেন। অতএব দেহই তার কাছে ছিল আত্মা। ঈশ্বর এবং জগৎ অভিন্ন। কাজেই অতিজাগতিক ঈশ্বরের সন্ধানে দৃশ্যমান জগতের বাইরে যাওয়ার দরকার নাই-বর্তমানের সীমিত অভিজ্ঞতায় ঈশ্বরলাভ বা ঈশ্বরজ্ঞান সম্ভব। প্রকৃতি কিংবা ঈশ্বর স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বয়ংসম্পূর্ণ বটে, কিন্তু এই ঈশ্বর শক্তিরহিত, কার্যকারিতাশূন্য। এই হচ্ছে তার ঈশ্বরে বিশ্বাস!

এরা বিশ্বাসী দার্শনিক। বিশ্বাস রাখতেন, তেমন আধুনিক পশ্চিমা দার্শনিকদের এই হলো নমুনা। এ প্রবণতা থেকে মুক্ত ছিলেন না নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩), গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২), জোহানেস কেপলার (১৫৭১-১৬৩০), জন লক (১৬৩২-১৭০৪), আইজ্যাক নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭), গটফ্রিড লিবনিজসহ (১৬৪৬-১৭১৬) পশ্চিমা দর্শন ও বিজ্ঞানের অন্যান্য অগ্রনায়কদের চিন্তাধারা। যারা খোদার সত্যে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য উদঘাটনে বস্তুকেই মানতেন সর্বোচ্চ সহায়ক হিসেবে।


এ ঈশ্বর বিশ্বাসের স্বরূপ বুঝতে হলে সমকালীন দুই বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর চিন্তাকে আমরা নির্দেশ করতে পারি। তারা হলেন লিবনিজ ও নিউটন। নিউটনের জড়- সূত্র বলে, বাইরে থেকে কোনো বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির এবং গতিশীল বস্তু সুষম গতিতে সরল পথে চলতে থাকে। অতএব কোনো বস্তুর ওপর যদি নিট বলের পরিমাণ শূন্য হয়, তখন বস্তুর ভরকেন্দ্র হয় স্থির হবে, নয় সমবেগে গতিশীল থাকবে। এ সূত্রের দাবি হলো সময় ও স্থান হচ্ছে পরমতম স্বাধীন সত্তা। অর্থাৎ ঈশ্বরকে যদি অস্তিত্বশীল হতে হয়, তাহলে তাকে সময় ও কাল এর মধ্যেই অস্তিত্বশীল হতে হবে। লিবনিজ এ প্রশ্নে নিউটনের বিরুদ্ধে গেলেন। কারণ তার মতে, ঈশ্বরের কাজ হলো অস্তিত্বশীল হওয়া এবং সৃষ্টি করা। যদি সময় ও স্থানের সাথে তাকে অস্তিত্বশীল হতে হয়, তাহলে দ্ব›দ্ব তৈরি হয়। এটা কি সম্ভব যে, ঈশ্বর একটা মহাবিশ্ব তৈরি করবেন এমন একটা জায়গায়, যে জায়গা আগ থেকেই তৈরি হয়ে আছে! যদি মহাবিশ্ব তৈরির জায়গাটা আগ থেকেই তৈরি থাকে, তাহলে ঈশ্বর মহাবিশ্বটা রাখবেন কোথায়? কোনো পয়েন্টে? পরম সেই জায়গাটি যেহেতু আগ থেকেই তৈরি হয়ে আছে, আর তিনি যেহেতু ঈশ্বর, তাই তার কাছে এই স্থানিক মাত্রার সব পয়েন্ট একই। তাহলে কিভাবে তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করবেন এক পয়েন্ট রেখে আরেক পয়েন্টে? যদি তিনি কোনো পয়েন্টে মহাবিশ্ব তৈরিই করেন, সেটা করবেন কোন যুক্তিতে? কেন তিনি মহাবিশ্ব রাখার জন্য সেই জায়গা তৈরি করবেন, যে জায়গা তৈরি হয়ে আছে আগ থেকেই? ঈশ্বর কি খামখেয়ালি কাজ করতে পারেন? তিনি তো শুধু সৃষ্টির পরম নন, যুক্তিরও পরম। অযৌক্তিকতা বা খেয়ালিপনার শিকার তো হতে পারেন না তিনি।

একই বাস্তবতা সময়ের ক্ষেত্রেও। যদি সময়ের মধ্যে ঈশ্বরকে থাকতে হয়, তাহলে তাকে সময়ের নির্দিষ্ট কোনো এক পয়েন্ট বেছে নিতে হবে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য বেছে নিতে হবে এক মুহূর্তকে। যদি তাকে বিশেষ ও নির্দিষ্ট সময়েই তা বানাতে হয়, তাহলে কেন সেই বিশেষ সময়ে তা বানাবেন? কেন তার কয়েক সেকেন্ড আগে বা কয়েক শত বছর পরে নয়? পরম সত্তা কি যখন যা ইচ্ছা, তা করেন?

নিউটনের ঈশ্বর তাই লিবনিজের ঈশ্বর হতে পারেন না। লিবনিজের ঈশ্বরের সবকিছু হতে হবে যৌক্তিক। পরম সত্তার স্বরূপ ব্যাখ্যায় লিবনিজ এক অভিনব মতবাদ পেশ করেন। তার মতে, আদি সত্তা হলো অবিভক্ত, অবিভাজ্য ও অস্তিত্বশীল। কারণ যা বিভক্ত বা বিভাজ্য, তা অবশ্যই ভঙ্গুর। আর যা ভঙ্গুর তা কখনো সত্য হতে পারে না। আদি সত্তা তাই অবিভাজ্য, পূর্ণ ও চিরন্তন। যা অপূর্ণ, বিভাজ্য ও সাময়িক, তা অসত্য ও অনস্তিত্বশীল। কিন্তু এখানে যে প্রাথমিক প্রশ্ন জন্ম নেয়, সেটা হলো আদি সত্তা অবিভাজ্য হয়ে কি করে অস্তিত্ববান হতে পারে? এ প্রশ্নের জবাব দেবেন বলে লিবনিজ গ্রিক পরমাণুবাদ ও কার্টেসীয় দার্শনিকদের মতবাদের মধ্যে সমন্বয় বিধানের চেষ্টা করেন। গ্রিক পরমাণুবাদীরা বস্তুর পরমাণুকেই আদি সত্তা বলে মনে করেন। যাকে কোনো অবস্থাতেই বিভক্ত করা যায় না তাকেই বলে পরমাণু। লিবনিজের মতে, পরমাণুগুলো জড়ীয় (material) বলে তারা কখনো অবিভাজ্য হতে পারে না। কেননা জড় পদার্থের বিস্তৃতি বলে একটি অপরিহার্য গুণ আছে। জড়ীয় হবার কারণে পরমাণুদের বিস্তৃতি আছে। আর যার মধ্যে বিস্তৃতি গুণ রয়েছে তা অবশ্যই বিভাজ্য। তাই জড়ীয় পরমাণুকে কোন অবস্থাতেই আদি সত্তা বলা যায় না। পক্ষান্তরে, কার্টেসীয় মতে, গাণিতিক বিন্দু অবিভাজ্য হতে বাধ্য। কেননা গণিতে বিন্দু বলতে এমন কিছুকে বুঝায়, যার কোনো দৈর্ঘ্য ও প্রস্ত নেই, তা সম্পূর্ণ অমূর্ত। আর এ কারণে অবিভাজ্য হয়েও অনস্তিত্বশীল। যা অনস্তিত্বশীল তা কখনো আদি সত্তা (ultimate reality) হতে পারে না। উপরোক্ত দুই পরস্পরবিরোধী মতের সমন্বয় করে লিবনিজ এমন এক পরমাণুর সন্ধান দিলেন, যাকে বলে মোনাড বা চিৎপরমাণু। মোনাড হচ্ছে একক, গাণিতিক একক, বিশ্বের মূল একক। লিবনিজের মোনাড পরিবর্তনশীল। মানুষের মনও এক মোনাড। যা জড় পরমাণুর মতো অস্তিত্বশীল হয়েও কার্টেসীয় বিন্দুর মতো অবিভক্ত। লিবনিজের মতে, পরমাণু যদি চেতন ও আধ্যাত্মিক স্বভাবের অধিকারী হয় তাহলে তা একাধারে অবিভাজ্য ও অস্তিত্বশীল হতে বাধ্য। লিবনিজের এ পরমাণু একই সাথে আধ্যাত্মিক ও চেতনাপূর্ণ। কিন্তু লিবনিজের এ প্রয়াস এমন কোনো উপসংহারে আমাদের নেয় না, যা স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য। তিনি প্রথমে বহু চেতন পরমাণুর পরমত্বের বিশ্বাস নিয়ে দার্শনিক চিন্তা শুরু করেন। যা বহুচেতন পরমাণুকেই পরম সত্তা হিসেবে দাবি করে। কিন্তু এতে একাধিক স্বাধীন পরমাণুর পারস্পরিক শৃঙ্খলা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। সেই ব্যাখ্যার জন্য অবশেষে ঈশ্বরের অস্তিত্ব মেনে নিতে বাধ্য হন। তার বিশ্ব মোনাডের সমষ্টি, পরমাণুর নয়, এবং ঈশ্বর নিজেও এক মোনাড। তিনি কাজ করেন বটে। কিন্তু যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হন। যুক্তি যদি ঈশ্বরের কাজের চালক হয়, তাহলে যুক্তিই প্রকারান্তরে ঈশ্বর হয়ে যাচ্ছে না? এর মানে দাঁড়াচ্ছে, যখন ঈশ্বরকে মানা হচ্ছে বা পূজা করতে চাওয়া হচ্ছে, তখনো যুক্তিকেই মানা হচ্ছে মূলত, পূজাটাও হচ্ছে যুক্তিরই!

ঈশ্বরের স্বরূপ জনে জনে ভিন্ন হচ্ছে। কারণ একেক দার্শনিকের যুক্তি ও বিচারপদ্ধতি একেকরকম। প্রত্যেক যুক্তিই আক্রান্ত হচ্ছে অন্য যুক্তির দ্বারা। প্রতিটি যুক্তিই অন্য যুক্তির কাছে কোনো না কোনো দিক থেকে ভঙ্গুর, অন্ধ, অবিবেচক। কোনো যুক্তিই অসংশয় সত্যের দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে না। কারণ যুক্তি অসংশয় সত্যকে নিশ্চিত করতে পারে না। ফলে অসংশয় সত্য যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের ব্যাপারে যুক্তি আমাদের শেষ শিক্ষক হতে পারে না।

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
কারো সাথে সম্পর্ক ভালো করতে গিয়ে আর স্বার্থ বিকিয়ে দেবে না রাশিয়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার পেঁয়াজ বীজ সরবরাহ মার্সেল সিওলাকু পুনরায় রোমানিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত বাংলাদেশে সরবরাহ কমেছে, শ্রীলঙ্কায় বিদ্যুৎ বিক্রি করতে চায় আদানি বিপিএলের মিউজিক ফেস্ট শুরু ট্রেন দুর্ঘটনার প্রতিবাদে সার্বিয়ার রাজধানীতে বিক্ষোভ সরকারি-বেসরকারি স্কুলে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা জুনে, বার্ষিক নভেম্বরে ফেনীতে প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার বিতরণ লক্ষ্মীপুরে পুকুরের পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু দৌলতদিয়ায় ৫২ হাজারে পদ্মার বোয়াল বিক্রি দেশের মেরিন অ্যাকাডেমিগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের করা হবে : নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা

সকল