০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

মোমেনের বেহেশতে ডিমের হালি কত

লেখক : ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী - ফাইল ছবি

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বলেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি। আল্লাহ তায়ালার বেহেশত সম্পর্কে মোমেন সাহেবের কোনো ধারণা আছে কিনা তা বলতে পারি না। কিন্তু ধারণা করি আল্লাহ তায়ালার বেহেশত সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তার জন্য যে লেখাপড়া করা দরকার সেটিও তিনি হয়তো করতে পারেননি। আর আলেমদের ওয়াজ বা বক্তৃতা শুনে যে কিছু শিখবেন সে পথও রুদ্ধ করা আছে। বহুসংখ্যক আলেমকে সরকার কারারুদ্ধ করে রেখেছে। যেন ৯২ শতাংশ মুসলমানের বাংলাদেশে তাদের জন্য কোনো স্পেস নেই। মোমেন সাহেবরা বাংলাদেশকে একেবারেই বেহেশত বানিয়ে ফেলেছেন। এটি বোধ করি ইউরোপ-আমেরিকাও কোনো দিন দাবি করেনি।

তিনি অবশ্য বলেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায়। সেই অন্যান্য দেশ কোনগুলো। সেটি কখনো খোলাসা করা হয়নি। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা অবিরাম বলে যাচ্ছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা খুব ভালো। তা হলে জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৪০-৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া হলো কেন? সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, যখন তারা এ তেল কিনে এনেছিল তখন তেলের বাজারমূল্য অনেক বেশি ছিল। সে কারণে মূল্য বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু, এখন তেলের দাম বিশ্ববাজারে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। তা হলে দাম কমাচ্ছেন না কেন? আর শ্রীলঙ্কা ও নেপাল ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশে তেলের দাম এভাবে বাড়ানো হয়নি। এ দু’টিকেই সরকার অন্যান্য দেশের তুলনায় বলছে।

আগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকারের তরফে যুক্তি ছিল- কোভিডের কারণে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটেছে। সে ধাক্কা সামলাতে সামলাতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বেধে গেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের সাথে আমাদের বাণিজ্য আছে। ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ গম আমদানি করে। সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এখন রাশিয়ার বাধার কারণে সে গমের জাহাজ প্রায় কোনো দেশে যেতে পারছে না। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এ সমস্যার এক আজব সমাধান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ আটার রুটি কেন খায়? চালের আটার রুটি খেলেই হয়, এতে গম আমদানি করতে হয় না। গমের আটার রুটি ও চালের আটার রুটির মধ্যে কী ফারাক। এ তথ্য ওই ‘পণ্ডিত’ মন্ত্রীর জানা আছে বলে মনে হয় না। এ মন্দার বাজারেও আটা ৪০-৪৫ টাকা কেজি। চালের ন্যূনতম মূল্য প্রতি কেজি ৫০ টাকা। সে চালও বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এক কেজি চাল ভাঙিয়ে আটা বানাতে ২০ টাকা লাগে। চালের আটার রুটি সাধারণত গোশত দিয়ে খাওয়া হয়। এক কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম এখন ২২০ টাকা। অথচ কিছু দিন আগেও এ মুরগি ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো। সরকার অবশ্য বলতে পারে- মুরগি লাগবে কেন? বুটের ডাল দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। বুটের ডালও প্রতি কেজি ১০০ টাকার উপরে। তাহলে, কেমন করে এ বর্ধিত মূল্যের চালের আটার রুটি খাবে মানুষ?

যদি প্রশ্ন করা হয়, চাল, আটা, গোশত, শাক-সবজি এসবের দাম এত বাড়লে কেন? সরকার হাইকোর্ট দেখায়। বলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু বিষয়টি সেখানে নয়। বিষয়টি হলো পথে পথে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি ও মাস্তানদের চাঁদাবাজি। কোরবানি ঈদের সময় গরুর পাইকার সেজে ট্রাকে করে ঢাকায় এসেছিলেন প্রথম আলোর একজন রিপোর্টার। তিনি চাঁদাবাজির বর্ণনা দিয়েছেন। যেসব পয়েন্টে চাঁদা দিতে হবে, সেখানে ট্রাকচালক বিনাবাক্য ব্যয়ে চাঁদা দিয়েছেন। কিন্তু যেখানে চাঁদা দেয়ার কথা না, সেখানেও ট্রাকের সামনে চাঁদাবাজরা এসে দাঁড়িয়েছে। ট্রাকচালক তাদের উপেক্ষা করে কিছুদূর সামনে এগোলেই পুলিশের লোকরা ট্রাকটি থামিয়েছে।

তারপর কাগাজপত্র পরীক্ষা, ট্রাকচালক কেন লুঙ্গি পরা, গায়ে নেই কেন নির্ধারিত শার্ট, এসব বলে শেষ পর্যন্ত চাঁদা দিতে বাধ্য করেছে। কোনো এক মন্ত্রী বলে ফেলেছেন, বাংলাদেশের পণ্যমূল্য হংকংয়ের চেয়ে সস্তা। তার হয়তো ধারণা নেই, হংকংয়ের মানুষের মাথাপিছু আয় ৫০ হাজার ডলারের মতো আর বাংলাদেশের আড়াই হাজার। সুতরাং, হংকংয়ের সাথে পণ্যমূল্যের তুলনা খুবই হাস্যকর। তবুও, সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা এসব কথা বলে যাচ্ছেন। সরকারের ডজন ডজন মন্ত্রী আছে; কিন্তু তাদের যে কী কাজ, সেটি বোঝা যায় না। এরা সব নন্দলাল নিরাপত্তার ঘেরা টোপে বসে বাণী দেন আর বাংলাদেশে সংঘটিত সব অপরাধের জন্য যে বিএনপি দায়ী সে কথা প্রচার করেন। যেকোনো সভা-সমিতিতে তা পশুপালনই হোক আর বিদ্যুৎ উন্নয়নই হোক সব অনুষ্ঠানে তারা বিএনপিকে কষে গাল দেন। বিএনপি ক্ষমতায় নেই ১৫ বছর। তারপর সব অপকর্মের জন্য তারাই দায়ী? দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির কথা উঠলে তারা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কথা তুলেন। তবে আমরা ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে শাক-সবজি শসা, ব্রয়লার মুরগি আমদানি করি?

সম্প্রতি বরগুনায় এক অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের পদধারী ও পদবঞ্চিত দু-গ্রæপের মধ্যে অনুষ্ঠানস্থলে ভয়াবহ লাঠালাঠি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ছাত্রলীগ কর্মীদের বেধড়ক পিটুনি দেয়। এতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, এতটা না করলেও চলত। তবে, ভোলায় পুলিশের সরাসরি গুলিতে বিএনপি ও ছাত্রদলের যে দু’জন সদস্য খুন হলো তাদের ব্যাপারে তো এমন কোমল কথা বললেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আপনাদের বেহেস্তে এই কী নিয়ম?

তবে মোমেন সাহেব বলেছেন, তিনি শিক্ষক মানুষ, সরলভাবে সব কথা বলেন। কিন্তু তাকে সিম্পল না বলে ‘সিম্পলসে’ বলাই বোধ করি ভালো। কারণ, তিনি দুনিয়াদারির কোনো খোঁজখবর রাখেন না। ভারতের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে একবার তিনি বলে ফেললেন যে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো। কোনো আত্মমর্যাদাশীল দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে এমন কথা শোভা পায় না। তিনি আজ এক কথা বলেন তো পরদিন আর এক কথা বলেন। মেরুদণ্ড সোজা করে কখনো দাঁড়াতে পারেন না। ভারতকে শত শত মাইল ট্রানজিট করিডোর দিচ্ছেন কিন্তু ভারতের কাছ থেকে ১২ মাইলের ট্রানজিট সুবিধা আদায় করতে পারছেন না। এই সুবিধা আদায় করতে পারলে আমরা নেপাল ও ভুটানে সরাসরি পণ্য রফতানি করতে পারতাম। কেন সে প্রশ্ন তুলতে পারছেন না? আপনি স্ত্রীর ভ‚মিকায় আছেন বলে?

আল্লাহ তায়ালার বেহেস্তে ফুল, ফল, হুর-পরীর ব্যাপক সমাহার। ইহ-জগতে যে পুণ্যের কাজ করবে, পরিশুদ্ধি অর্জন করবে, দান-খয়রাত করবে তারাই অনন্তকালের জন্য বেহেস্তে যাবে। সেখানে ইচ্ছা করলেই পাওয়া যাবে সুমিষ্ট ফল, সুঘ্রাণের ফুল। পাওয়া যাবে হুরদেরও, তারা অনিন্দ্যসুন্দরী। যে সৌন্দর্য কখনো ম্লান হবে না। কিন্তু মোমেন সাহেবের বেহেস্তে একটা মুরগির ডিমের দাম ১৩ টাকা। তবে মোমেন সাহেবের প্রিয় দেশ ভারতের কলকাতায় ডিমের হালি বাংলাদেশী টাকায় ২৬ টাকা, পেঁয়াজ ২০ টাকা, রসুন ৮০ টাকা, বেগুন ৪০ টাকা, পটোল ২২ টাকা, আদা ৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৮০ টাকা। তাহলে মোমেন সাহেব বাংলাদেশে আপনি কোন বেহেস্তে আছেন?

দরিদ্র মানুষের প্রোটিনের সহজ উৎস ডিম কিংবা পাঙ্গাশ মাছ। পুকুরে যে পাঙ্গাশ হয় তার কেজি ছিল ১০০-১২০ টাকা। মোমেন সাহেবেরা যখন বাংলাদেশকে বেহেস্তে পরিণত করলেন তখন তার মূল্য দাঁড়িয়েছে ২১০-২৩০ টাকা। এক দিকে বেহেস্তে কোনো কিছু কিনে খেতে হবে না। মোমেন সাহেব ও তার সহযোগীরা কোনো কিছু কিনে খান না, আপসেআপ এসে যায়। কিংবা তাদের মাথাপিছু আয় হংকংয়ের চেয়েও বেশি। এখানে মোমেন সাহেবের বেহেস্তবাসীরা হুরপরী উপভোগ করছেন। যুবতী, তরুণী, নারী, শিশু এরাই তাদের হুর। যে কাউকে যখন খুশি ঘরে ঢুকে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ভোগ করা যায়। এরা ইচ্ছা করলেই সরাবের শহরে বসবাস করতে পারেন। ইচ্ছা করলেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের (সুস্বাদু ফল আস্বাদন করতে পারেন)। মোমেন সাহেবদের জন্য বাংলাদেশ বেহেস্ত বৈ কী।

মোমেন সাহেব পণ্ডিত লোক। ধর্ম সম্পর্কে কিছু লেখাপড়া জানলে তিনি বাদশা সাদ্দাদের বেহেস্তের খবর জানার কথা। সাদ্দাদ ছিলেন ইয়েমেনের এক বাদশা। তার সব সম্পত্তি ছিল পর্বতপ্রমাণ। ছোট ছোট রাজ্যের রাজারাও তাকে নিয়মিত কর দিত। আল্লাহর নবী হজরত হুদ (আ:) সাদ্দাদকে বললেন, হে সাদ্দাদ, তুমি স্বীকার করো, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নাই। আর এ কথা যদি তুমি স্বীকার করো তাহলে তোমার বেহেস্তে যাওয়ার জিম্মাদার আমি হলাম। সাদ্দাদ সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করল। বললেন, আবার বলো, তোমার আল্লাহর স্বর্গে কী আছে? হুদ (আ:) আবার তাকে বেহেস্তের বর্ণনা দিলেন। তখন সাদ্দাদ বললেন, আমি পৃথিবীতেই আসল বেহেস্ত তৈরি করব। রাজা পরিষদ বর্গকে ডেকে তার পরিকল্পনা বললেন। রাজ্যে যার যা কিছু সোনা রুপা আছে সব রাজকোষে জমা দিতে বললেন কিংবা কেড়ে নিলেন। সোনার ইট দিয়ে বানালেন তার বহেস্তের প্রাচীর।

মূল্যবান সব উপকরণ দিয়ে সাজালেন বেহেস্তের ঘরবাড়ি। বইয়ে দিলেন শরাবের নহর। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের ধরে এনে ঢুকালেন বেহেস্তে বললেন ভোগ করো। রাজ্যের ফুল-ফলের গাছ তুলে এনে লাগালেন বেহেস্তের ভেতরে। দেশী-বিদেশী প্রকৌশলীদের দিয়ে নির্মাণ করলেন সুরম্য বালাখানা। মূল্যবান পাথরে খচিত নানান সুদৃশ্য চিত্রকর্ম। তারপর তিনি নিজেই রওনা হলেন বেহেস্তের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে দেখলেন এক অচেনা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। সাদ্দাদ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?

অচেনা ব্যক্তি বলল, আমি আজরাইল, তোমার জান কবচ করার নির্দেশ নিয়ে এসেছি। সাদ্দাদ বললেন, আমাকে একটু ভেতরটা ঘুরে দেখার সময় দাও। আজরাইল বললেন, সে সময় নেই, আমি এখনই, এখানে তোমার জান কবচ করব। সাদ্দাদ, তখন ঘোড়ার জিন থেকে এক পা খালি খুলেছেন, তখনই সাদ্দাদের জান কবচ করে নিলো। তারপর এক বিশাল শব্দের মধ্য দিয়ে তার স্বপ্নের বেহেস্ত ধূলায় মিশে গেল।

মোমেন সাহেব বেহেস্তে তো আছেন। কিন্তু আপনাদের সাধের সে বেহেস্ত ধূলায় মিশে যাবে না তো!

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement