এক মনীষীর জীবনালেখ্য
- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
- ২১ আগস্ট ২০২২, ২০:০৪
ছাত্রজীবন থেকে মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ:-কে চিনতাম। যখন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া আলিয়া মাহমুদুল উলুম মাদরাসায় দাখিল-আলিম (১৯৬৯-১৯৭৩) শ্রেণীতে অধ্যয়ন করি তখন তার সাথে পরিচয় হয়। আমরা ছাত্ররা মাদরাসা অধ্যক্ষের মাধ্যমে করাচি থেকে দৈনিক জং, দৈনিক জাসারত, মাসিক তুলুয়ে ইসলাম, ঢাকা থেকে দৈনিক আজাদ, করাচি দারুল উলুম থেকে মাসিক আল-বালাগ, পেশোয়ারের আকোড়া খটক থেকে মাসিক আল-হক, সাপ্তাহিক নেযামে ইসলাম, কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে মাসিক মুনাদীসহ নানা ম্যাগাজিন আনার ব্যবস্থা করি। সাতকানিয়া আলিয়া ও পটিয়া আল-জামিয়া ইসলামিয়ায় অধ্যয়নকালীন আমাদের শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু-আরবি। পরীক্ষার খাতায় উর্দু ভাষায় উত্তর প্রদান ছিল সাধারণ রেওয়াজ।
আরবি ভাষায় উত্তর দিলেও কোনো অসুবিধা হতো না। তখন কিন্তু মাদরাসা অঙ্গনে বাংলার প্রচলন ব্যাপকতা পায়নি। আমরা উর্দু-আরবি-বাংলা তিন ভাষার চর্চা করতাম। সাতকানিয়া আলিয়া মাদরাসার তৎকালীন মুহাদ্দিস, প্রিয় উস্তাদ আল্লামা মুফতি আবদুল হালিম বুখারি রহ: ভাষাচর্চার ব্যাপারে আমাদের সর্বদা উৎসাহিত করতেন। প্রতি সোমবার জোহর নামাজের পর মাদরাসা মসজিদে ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে পর্যায়ক্রমে আরবি, বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দিতেন। আমরা এর মাধ্যমে প্রণোদনা লাভ করতাম।
সে সময় কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে মাওলানা আতাহার আলী রহ:-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ও মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ:-এর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত মাসিক মুনাদী আমাদের আকর্ষণ করত। নানা কলাম বিশেষত মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ:-এর লিখিত বিভিন্ন নিবন্ধ আমরা মনোযোগসহকারে অধ্যয়ন করতাম। ওলামা মাশায়েখদের মধ্যে সে সময় উন্নত রচনাশৈলীসমৃদ্ধ নিবন্ধ লেখক ছিলেন হাতেগোনা ক’জন মাত্র।
মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ:-এর চমৎকার শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস ও উপমা উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্ব আমাদের কিশোর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখত। ধীরে ধীরে আমরা তার ভক্ত হয়ে উঠি। পরবর্তীতে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তার সুচিন্তিত নিবন্ধাবলি আমাদের চিন্তা ও মননের খোরাক জোগাত। তিনি আমাদের কাছে আইকন ও আইডল। ইন্তেকালের পর চট্টগ্রাম থেকে কিশোরগঞ্জ গিয়েছি তাকে জিয়ারত করতে।
১৯৮০-৮২ সালে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি একদিন পটিয়া আল জামিয়া ইসলামিয়ায় তার সাথে পরিচয় হয়। তখন তিনি তার বড় সন্তান মাওলানা উবায়দুর রহমান নদভী (নাসিম) ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। নাসিম ভাই সে সময় জামিয়ায় অধ্যয়নরত ছিলেন। এরপর দীর্ঘসময়ে তার সাথে আমার পত্র বিনিময়, দেখা-সাক্ষাৎ ও মোবাইলে কথা হতো। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ ও আদর করতেন। একটি ব্যাপার সব সময় লক্ষ করেছি, কেউ তার কাছে চিঠি লিখলে তিনি উত্তর দিতে দেরি করতেন না। এ গুণ ভারতীয় ও ইউরোপীয় স্কলারদের মজ্জাগত হলেও বাঙালিদের মধ্যে কদাচিৎ দেখা যায়। তার ইন্তেকালের বছর খানেক আগে খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ:-এর স্মারকগ্রন্থের জন্য একটি লেখা চেয়ে চিঠি লিখি। কয়েক দিনের মধ্যে তিনি চিঠির জবাব দেন। লেখাও পাঠিয়ে দেন। লেখাটি পরবর্তীতে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধের শুরুতে তার দরদভরা আকুতি ও আহাজারি আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে।
মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ:-এর চেতনা ছিল শাণিত, চিন্তা ছিল স্বচ্ছ, কথা ছিল গোছানো। তিনি একাধারে সুলেখক, ভালো বক্তা, অভিজ্ঞ একাডেমিসিয়ান, বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও দক্ষ সংগঠক। জ্ঞানের ঐশ্বর্য, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, হৃদয়ের ঔদার্য ও মেধার বহুমাত্রিকতা তার জীবনকে মহীয়ান করে তোলে। তাফসির, হাদিস, ফিকহ, ইলমুল কালাম, দর্শন, আরবি ও উর্দু ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিল ঈর্ষণীয়। তিনি ভালো ইংরেজি ও ফারসি ভাষা জানতেন। ছাত্রজীবন থেকে সময়কে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। সময়ানুবর্তিতা তার জীবনের এক আলোকিত দিক। অনুবাদ ও মৌলিক রচনায় তার হাত ছিল পাকা। তার লিখিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে তাফসিরে সূরা মূলক, পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্র ও ইসলাম, ইসলামের অর্থবণ্টন ব্যবস্থা, মুসলিম শিশুশিক্ষা ও মাওলানা আতহার আলী রহ:-এর স্মৃতি।
মাওলানা আতাউর রহমান খান ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ কিশোরগঞ্জের ইটনা থানাধীন হাতকাবিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা আহমদ আলী খান রহ: ছিলেন মাওলানা আতাহার আলী রহ:-এর প্রধান খলিফা। মাওলানা আতাউর রহমান খান কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। জামিয়া ইমদাদিয়ায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা। প্রতিভার বহুমাত্রিকতা তার জীবনকে ঋদ্ধ ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে। এক সাথে তিনি অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভনর্সের সদস্য, জাতীয় শরিয়াহ কাউন্সিলের সদস্য, জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জের ভাইস প্রিন্সিপাল, জামিয়া ফারুকিয়া কিশোরগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, ঢাকার ফরিদাবাদ ও মিরপুর ৬নং মাদরাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন।
তার মার্জিত ব্যবহার, পরিশীলিত আচরণ ও হৃদয়-প্রসারিত আতিথ্যপ্রীতি আমার মতো অনেককেই বাৎসল্যের বাহুডোরে আবদ্ধ করেছে গভীর নিবিড়তায়। দেশ, জাতি ও মিল্লাতের ফিকিরে তিনি সবসময় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। ইসলামী আদর্শের আলোকে একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তার আশৈশব লালিত স্বপ্ন। ইসলামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্ল্যাটফরমে আনার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আদর্শিক মুগ্ধতার টানে কওমি ধারার আলিমদের ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি যে নিরলস খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন তা জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাকুল মাদারিস) মহাসচিব হিসেবে সংগঠনকে একটি শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে তার প্রচেষ্টা ছিল একনিষ্ঠ, পরিকল্পনানির্ভর ও বাস্তবভিত্তিক।
মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ: যোগ্য উত্তরসূরি রেখে গেছেন। দয়ার্দ্র মনোবৃত্তি, কঠোর নজরদারি এবং নিবিড় পরিচর্যায় তিনি তার সন্তানদের গড়ে তুলতে এবং উচ্চশিক্ষা প্রদান করতে সফলতা দেখিয়েছেন। তারা সবাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাবার রেখে যাওয়া মিশন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মযজ্ঞে ব্রত রয়েছেন। মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, মাওলানা ওয়ালিউর রহমান খান, ড. মাওলানা খলীলুর রহমান, মাওলানা রেজওয়ানুর রহমান খান ও জাগ্রত কবি মাওলানা মুহিব খান নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।
একজন দক্ষ শিক্ষাবিদ হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন জননন্দিত রাজনৈতিক নেতা। প্রথম জীবনে তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির কর্মী ছিলেন। পরে বিএনপির ব্যানারে ১৯৯১ সালে কিশোরগঞ্জ-০৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দুঃখের সাথে বলতে হয় বিএনপি তাকে মূল্যায়ন করেনি।
ব্যক্তিজীবনে মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ: ছিলেন অমায়িক, বন্ধুবৎসল ও সাদা মনের মানুষ। ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ ও বিনয়ের মহৎ গুণে অপরাপর ব্যক্তি থেকে তাকে আলাদাভাবে চেনা যায়। রুটিন মাফিক জীবন পরিচালনায় ছিলেন অভ্যস্ত। ফরজ-ওয়াজিবের পাশাপাশি নফল ইবাদতের প্রতি তার বিমোহন লক্ষ করার মতো। নিয়মিত পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত ও অজিফা তাকে তন্ময় ও আবিষ্ট করে রাখত। সুগভীর চেতনা ও বিস্তৃত উপলব্ধি দিয়ে তিনি জীবনকে অবলোকন করেন।
২০০৮ সালের ৩০ জুলাই তিনি ইন্তেকাল করেন। কিশোরগঞ্জের মাটি বহু সোনার মানুষ তৈরি করেছে মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ: তাদের মধ্যে অন্যতম। তার কর্ম ও কীর্তির মাঝে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমরা তার অভাব অনুভব করি প্রতি ক্ষণে, প্রতি মুহূর্তে। আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে তিনি এখনো প্রাসঙ্গিক। আমরা এ মনীষীর স্মৃতির প্রতি অনুপম শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের উচ্চাসনে অভিষিক্ত করেন, আমিন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা