০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

খবরদার, বিদ্যুৎ নিয়ে প্রশ্ন করবেন না

খবরদার, বিদ্যুৎ নিয়ে প্রশ্ন করবেন না -

এটি কোনো কথার কথা নয়। সরকার যখন বিদ্যুৎ নিয়ে নয়-ছয়ের পরিকল্পনা করল, তখনই এক আইন করে, এই বিদ্যুতের উৎপাদন ও সংগ্রহ নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতে কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। আইন তো হয়ে গেছে, এখন তাহলে কী হবে? রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এক মেগাওয়াটও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ৯ মাসে নিয়ে গেছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। সরকার তো নিষেধ করেছিল, কিন্তু আওয়ামী ঘরানার কাগজগুলো এখন সে সত্যও প্রকাশ করছে।

একবার এক টিভি টকশোতে আমার সাথে এসেছিলেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। তাকে যেই মাত্র জিজ্ঞেস করলাম রেন্টাল-কুইক রেন্টালে কেন শত শত কোটি টাকা ব্যয় করলেন? এই প্রশ্ন শুনে তিনি একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। গলার স্বর একটু উঁচিয়ে বললেন, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল রাখতে হয়; যা জানেন না তা নিয়ে কথা বলবেন না। আমি তর্ক জুড়লে বিষয়টি দৃষ্টিকটু হয়ে যেত। তবু আমার যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। তিনি বারবার ওই একই কথা বললেন, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল রাখতে হয়। কিন্তু আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারলেন না। ভাবলাম, ‘তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন’? আমি যত যুক্তির কথায় যাই, তিনি তত যুক্তিহীন বাকোয়াছি করেন। আমি বললাম, ধরেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল চুক্তিতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেন মামলা করা যাবে না? জবাবে তিনি বললেন, সরকার সারা দিন মামলা নিয়ে থাকবে? নাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে?
সে কারণে এই আইন করা হয়েছে। এরপর আর কথা থাকে না। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। অবশ্য যাওয়ার আগে তিনি বললেন, বিএনপি তো যাওয়ার আগ পর্যন্ত এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন করতে পারেনি। আমরা তো হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি, ভালো লাগে না! তার যে ভাষা, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, তার কোনোটাই গ্রহণযোগ্য ছিল না; অর্থাৎ ‘চুরির উপর চুরি তার উপর সীনাজুড়ি’। সরকারি লোকেরা এ ধরনের যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করেন। এখন আস্তে আস্তে সেসব গোমর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক বা না করুক রেন্টাল ও কুইক রেন্টালকে দিতে হবে ক্যাপাসিটি চার্জ।
সেই ফাঁস সরকারের গলায় আটকে গেছে। বৈষম্যমূলক এ ব্যয়ের খাত অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রও বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও সরকারের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। আর হাতেগোনা কয়েকটি দেশী-বিদেশী কোম্পানি শুধু লাভবান হচ্ছে আর সার্বিকভাবে লোকসানের মুখে পড়ছে সরকারের বিদ্যুৎ খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বর্তমান অর্থনীতির বিবেচনায় বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতি টালমাটাল। তা ছাড়া করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে ভারমুক্ত হতে হবে। একই সাথে সরকারকে বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জের চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে এখন কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে হবে; অন্যথায় বিদ্যুৎ খাত অনেক নাজুক অবস্থায় চলে যাবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া মানে সেখানে সরকারের অপচয় বা নয়-ছয় হচ্ছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর হয়ে এখনই চুক্তি স্থগিত করে কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া উচিত। যদি কোনো কেন্দ্র বছরে খুব কম ব্যবহৃত হয় কিংবা যেসব কেন্দ্র একেবারে ব্যবহৃত হয়নি, স্ট্যান্ডবাই হিসেবে বসে আছে; সেগুলো চালু করার প্রশ্নই ওঠে না। এসব কেন্দ্র নির্মাণ অনৈতিক হয়েছে এবং এগুলো এখন অর্থনীতির জন্য বোঝা। এর মাধ্যমে মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে; বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ছে, তেলের দাম বাড়ছে ও ভর্তুকি বাড়ছে।

বিদ্যুৎ না থাকায় শহরাঞ্চলে দিনে দুই-তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না; গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরো ভয়াবহ। সেখানে কোথাও ১০-১২ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। সরকার বলছে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জ্বালানি সঙ্কট হয়েছে। এ কথা সত্য নয়। কারণ রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে আমরা জ্বালানি তেল কিনি না। কিংবা এমনো নয় যে, রাশিয়ার তেল আমরা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে কিনি। তা হলে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের অজুহাত একেবারে অকার্যকর। আসলে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সেক্টরে যে বেহাল দশা তৈরি হয়েছে, তা মূলত তৈরি হয়েছে রেন্টাল আর কুইক রেন্টালের কারণে। ভাড়াভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি থেকে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণের মানদণ্ড না থাকায় বিদ্যুৎ না পেলেও শত শত কোটি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।

এসব কেন্দ্রের শীর্ষে রয়েছে- সামিট গ্রুপ, অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদি গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও এপিআরএন এনার্জি।

এর বাইরে আছে দেশ এনার্জি, এনার্জি প্যাক, ডরিন গ্রুপ, সিনহা গ্রুপ, রিজেন্ট গ্রুপ, আনলিমা গ্রুপ- এসব কোম্পানির বেশির ভাগই সরকারি দলের নেতা ও সরকারি দল সমর্থিত ব্যবসায়ী। শিল্পপতি, গার্মেন্ট ব্যবসা বা কাঠের ব্যবসা করছেন এমন কোম্পানিকেও রাজনৈতিক পরিচয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। এগুলো থেকে বিদ্যুৎ না পেলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, দলীয় বিবেচনায় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অনুমতি দিয়ে এবং ওই সব কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার কারণে দেশের বিদ্যুৎ খাতে বিপর্যয় নেমে আসার উপক্রম হয়েছে। কার স্বার্থে এসব কোম্পানিকে বসিয়ে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। এ দিকে সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো পাঁচটি কোম্পানিকে নতুন করে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের আওতায় আনছে। যারা চুক্তি করেছেন তাদের সততা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যথাযথভাবে চুক্তি না হওয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। আর এর বোঝা চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেছেন, চলমান লোডশেডিং জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য করা হচ্ছে। সারা বছর ব্যবহার না করে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হলে, সেটিও সমস্যার কারণ। বসিয়ে রেখে বা খুব কম চালিয়ে সক্ষমতার ব্যয় পরিশোধ করা হলে বুঝতে হবে, ওই কেন্দ্রটির দরকার নেই। ২০০৯-১০ সালে জরুরি বিদ্যুৎ উৎপাদনে তিন থেকে পাঁচ বছরের অসম চুক্তিতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করা হয়েছিল। কিন্তু তার পর একই শর্তে কেন্দ্রগুলোর চুক্তি কেন নবায়ন করা হলো, সেটি স্পষ্ট নয়।

এখন বিদ্যুৎসঙ্কটে রাত ৮টার পর শপিংমল-দোকানপাট বন্ধ, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি তবে ব্যবহার হয় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। অতিরিক্ত সক্ষমতা বসিয়ে রাখতে হয়। তার জন্য সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। দেশে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নতুন কেন্দ্র স্থাপন এবং সেগুলো ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদর্শ কোনো মানদণ্ড নেই। ২০১২ সালে বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। একটিমাত্র কোম্পানি সামিট গ্রুপ দরপত্রে অংশ নেয়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি ধরা হয়।

বাংলাদেশে বিদেশী ঋণবিষয়ক এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার কোম্পানিগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় বসে বসে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা আদায় করছে। এগুলো এখন গলার কাঁটা। উপরন্তু সরকার কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার কারণে এগুলো এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে খরচও বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র চলুক আর না চলুক সরকারকে প্রতি মাসে কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যেতে হবে। তবে এর সব কিছু প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখতে আইন করা হয়েছে। কেন?

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement