পারিবারিক বিরোধ ও মেডিয়েশন পদ্ধতি
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ০৫ আগস্ট ২০২২, ২০:১৫
দেশ ও সমাজে অসহিষ্ণুতা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে চরম অবস্থা বিরাজমান। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিরোধ ছাড়াও পরিবারের অভ্যন্তরে সৃষ্ট গোলযোগের কারণে ঘরের ভেতরেও অনেকেরই শান্তি নেই। পরকীয়া, অভাব-অনটন, পারস্পরিক অবিশ্বাস, মাদকাসক্তি, উত্তরাধিকারের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়াসহ ছোটখাটো অনেক বিষয় বড় আকার ধারণ করার ফলে ক্ষণিকের বিরোধ চিরস্থায়ীভাবে চরম শক্রতায় পরিণত হচ্ছে। এ সব কারণে মানুষের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে স্বামীর হাতে স্ত্রী ও সন্তান খুন, স্ত্রীর হাতে স্বামী ও সন্তান খুনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আদালতের বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়া ও দীর্ঘসূত্রতা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে, অন্য দিকে মামলার ব্যয় নির্বাহ সম্ভব না হওয়ার কারণে প্রতিপক্ষের বিচার নিজেই করায় দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করছে, ফলে প্রতিশোধ গ্রহণের নিমিত্ত ‘আইন’ কেউ কেউ নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।
পরিবারের মধ্যে এমন সব ঘটনা বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধের ঘটনা চরম আকার ধারণ করার ফলে সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হওয়ার কারণে তারা বখাটে, Delinquent, কিশোর গ্যাং ও মাদক সেবনে আসক্ত হচ্ছে, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গোটা পরিবারের অন্য সদস্য ও কলুষিত হচ্ছে সামাজিক পরিবেশ যা প্রকট থেকে প্রকটতর আকার ধারণ করছে। সহজ পদ্ধতিতে মধ্যস্থতার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী বিরোধ মধ্যস্থতার মাধ্যমে মীমাংসার প্রশ্নে মহাগ্রন্থ বিজ্ঞানময় আল-কুরআন নিম্নবর্ণিত দিকনির্দেশনা দিয়েছে-
‘আর কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর কাছ থেকে দুর্ব্যবহারের আশঙ্কা করে বা নিজেকে উপেক্ষিত মনে করে তখন তারা দু’জনে মিলে আপস-নিষ্পত্তি করতে চাইলে কোনো অসুবিধা নেই। আসলে শান্তিপূর্ণ আপস-নিষ্পত্তি সবসময়ই ভালো। তবে মানুষের প্রবৃত্তি সাধারণভাবেই স্বার্থপর, লোভাতুর। আর জেনে রাখো, তোমরা আল্লাহ সচেতন হয়ে নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্য কিছু করলে আল্লাহ অবশ্যই তার খবর রাখেন।’ (সূরা নিসা, আয়াত-১২৮)
‘অবশ্য তোমরা যতই চাও না কেন, স্ত্রীদের সাথে সমান আচরণ করা তোমাদের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু একজনকে উপেক্ষা করে অন্যের দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ো না (যাতে কারো এটি মনে না হয় যে, তার স্বামীই নেই)। আর যদি তোমরা নিজেদের ভুল সংশোধন করে নাও এবং আল্লাহ সচেতন থাকো, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা নিসা, আয়াত-১২৯)
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে অটল থেকো। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সত্য সাক্ষ্য দেবে। সত্য বলার কারণে যদি তোমার নিজের ক্ষতি হয় অথবা মা-বাবা বা আত্মীয়ের ক্ষতি হয়, তবুও সত্য সাক্ষ্য দেবে। আর পক্ষদ্বয় বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন (সে বিবেচনা না করেই) সত্য সাক্ষ্য দেবে।
আল্লাহর প্রাধিকার ওদের সবার ওপরে, লোভ-লালসা বা প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ে ন্যায়বিচার থেকে দূরে সরে যেও না। যদি পক্ষপাতিত্ব করে পেঁচানো কথা বলো, সত্যকে বিকৃত করো বা পাশ কাটিয়ে যাও তবে মনে রেখো, আল্লাহ সব কিছুরই খবর রাখেন।’ (সূরা নিসা, আয়াত-১৩৫)
‘যখন তাদের ইদ্দতকাল প্রায় শেষ হয়ে আসবে, তখন হয় তাদের স্ত্রী হিসেবে ভালোভাবে রেখে দেবে অথবা সম্মানজনকভাবে বিয়েবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবে। তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন ন্যায়পরায়ণ লোককে (তোমাদের সিদ্ধান্তের) সাক্ষী রাখবে। আর সাক্ষীরা আল্লাহকে স্মরণে রেখে সাক্ষ্য দেবে। যারা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে, তাদের জন্যই এ উপদেশ। যারা আল্লাহ-সচেতন থাকে, আল্লাহই তাদের ঝামেলা ও অশান্তি থেকে বেরোনোর পথ করে দেন। আর অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে জীবনোপকরণ দান করেন। যে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তার অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করবেন। আল্লাহ সব কিছুরই মেয়াদ ও মাত্রা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।’ (সূরা তালাক, আয়াত-২/৩)
আপস নিষ্পত্তিমূলক বিচারব্যবস্থায় অল্প খরচে, একদম কম সময়ের মধ্যে বিরোধীয় পক্ষের পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সহজেই বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এ ব্যবস্থায় বিরোধ নিষ্পত্তি করতে আনুষ্ঠানিকতা কিংবা পদ্ধতিগত কোনো জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় না। পক্ষগণের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই একটি সমাধান বের হয়ে আসে। এর ফলে কেউই মামলায় হারে না।
দু’পক্ষই বিজয়ী হয়। বিচারপ্রার্থীরা খোলামন নিয়ে মেডিয়েটর বা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে মুখোমুখি কথা বলে সহজেই সমাধান বের করতে পারে। এ ব্যবস্থার আরেকটি সুবিধা হলো- মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় পক্ষগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বলে গৃহীত সিদ্ধান্তটি তারা নিজেদের মনে করে। ফলে গৃহীত সিদ্ধান্ত সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় বলে এর মাধ্যমে বিরোধের কার্যকর ও স্থায়ীভাবে শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হয়, প্রতিশোধ গ্রহণের মানসিকতা থাকে না।
আপস নিষ্পত্তিমূলক সামাজিক বিচারব্যবস্থার মূল পদ্ধতি হলো, মেডিয়েশনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ও দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি করা। সাধারণত বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তর আইনের ছকে বাঁধা। প্রচলিত আইনি পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি করতে অনেক দেরি হয়। ফলে মামলায় জড়িতদের ওপর এক দিকে যেমন মানসিক চাপ বাড়ছে, অন্য দিকে দীর্ঘদিন ধরে মামলা চালাতে গিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই বিকল্প পন্থায় বিরোধ নিষ্পত্তির কনসেপ্ট চালু হয়েছে। এ পদ্ধতিকে পশ্চিমা বিশ্বে Restorative Justice (R.J) এবং বাংলাদেশে Alternative Dispute Resolution (ADR) বলে পরিচিতি লাভ করেছে। আইনগত কিছু উদ্দেশ্য পূরণ ছাড়াও R.J বা ADR ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্যে পূরণে বিরাট অবদান রাখছে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক বন্ধনও সুদৃঢ় হয়। এই পদ্ধতিতে নিম্নবর্ণিত Advantage রয়েছে, যথা- ১. জয়সূচক ফলাফল (Win-Win outcome); ২. ব্যয় কমানো অথবা কোনো ব্যয় ছাড়াই মামলা নিষ্পত্তি (Minimise cost or no cost at all); ৩. সময় বাঁচায় (Less time consuming); ৪. সামাজিক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে (Creates social binding); ৫. পক্ষগণের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধভাব থাকে না (Absence of confrontational attitude) ও ৬. সামাজিক রীতিনীতি বজায় থাকে (Maintain social norms).
মেডিয়েশনের বাংলা শব্দার্থ হলো- মধ্যস্থতা বা সালিশ। যিনি মধ্যস্থতা বা সালিশ করেন তিনি ইংরেজি ভাষায় মেডিয়েটর, যার বাংলা শব্দার্থ হলো মধ্যস্থতাকারী। নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র তৃতীয় পক্ষ, একজন ব্যক্তির মাধ্যমে বাদি-বিবাদি উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে সন্তোষজনক ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করাই মেডিয়েটরের দায়িত্ব। এ পদ্ধতিতে উভয় পক্ষ সরাসরি মুখোমুখি হয়ে নিজেদের দাবি উপস্থাপন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মেডিয়েটর কোনো পক্ষকে সমর্থন করতে পারেন না এবং সমাধানের ফলাফলের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত বা কৌশল অবলম্বনপূর্বক কোনো প্রভাব কোনো পক্ষের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবেন না। ভিকটিম ও অপরাধীকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করাও Restorative Justice (RJ) বা Alternative Dispute Resolution (ADR)-এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
আদালতের বিচারব্যবস্থা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, কিন্তু মেডিয়েশন হতে হবে ব্যক্তিগত ও গোপনীয়। মেডিয়েশন সফল না হলে, ওই বৈঠক চলাকালে উভয় পক্ষের মধ্যে কথোপকথন প্রকাশ করা হবে নৈতিকতাবিরোধী ও অগ্রহণযোগ্য এবং মেডিয়েটর কোনো আদালতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো প্রকার সাক্ষ্য দিলে তা ন্যায়ত ও আইনত গ্রহণযোগ্য হবে না।
প্রবাদ রয়েছে, যেখানে আইনের প্রয়োগ বেশি সেখানে বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা নগণ্য (The More law, the less justice)। এটি সবাই স্বীকার করেন, আইনই ন্যায়বিচার পাওয়ার একমাত্র চাবিকাঠি নয়। যেখানে আইন ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ সেখানে ইক্যুইটি (Equity) শূন্যস্থান পূরণ করে। মেডিয়েশন পদ্ধতিতে কে হবে মেডিয়েটর বা তার যোগ্যতাটি কী হবে এ মর্মে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম-পদ্ধতি নেই, তবে তাকে হতে হবে সততার ঊর্ধ্বস্থানে অবস্থিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, ব্যবহার ও আচরণে থাকতে হবে নিরপেক্ষতা এবং মধ্যস্থতা করার প্রশ্নে প্রভাবমুক্ত একজন ব্যক্তি। বিরোধ নিষ্পত্তিতে মেডিয়েটর তার প্রজ্ঞা ও আন্তরিকতার মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ‘শান্তির দূত’ হিসেবে কাজ করবেন এবং মেডিয়েটর হওয়ার জন্য এটিই হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রথম যোগ্যতা।
বাংলাদেশে মেডিয়েশনের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করার কার্যক্রম দেওয়ানি বিচারব্যবস্থায় শুরু হলেও ফৌজদারি বিচারে এর ব্যাপকতা লাভ করেনি, কারণ এর পেছনে আইনগত জটিলতা রয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধির-১৯০৮-এর ৮৯(ক) ধারা সন্নিবেশিত করে ১-১০ সেকশন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে আউট-অব-কোর্ট দেওয়ানি বিষয় আইনে আরবিট্রেশন বা মেডিয়েশনে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮-এ ৩৪৫ ধারায় আপসযোগ্য ও অ-আপসযোগ্য মামলার তালিকা নির্ধারিত থাকায় ফৌজদারি আদালত সব ক্ষেত্রে আউট-অব-কোর্ট বিরোধ নিষ্পত্তি করার অনুমতি দিতে পারে না। তবে কোনো কোনো ফৌজদারি মামলা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যস্থতায় অ-আপসযোগ্য বিচারাধীন মামলায় বিরোধ এখনো নিষ্পত্তি হচ্ছে, এ জন্য আইন মেনে কিছু কিছু টেকনিক্যাল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়।
দেওয়ানি মামলায় মেডিয়েশন বা আপস নিষ্পত্তি পদ্ধতি আরো সহজ করার জন্য আপিল চলা অবস্থায় আপস নিষ্পত্তি করার আরো সুযোগ সৃষ্টির জন্য দেওয়ানি কার্যবিধি-১৯০৮ মূল আইনটি ২০০৩, ২০০৬, ২০১২ সালে সংশোধন করা হয়। অতঃপর সর্বশেষ ২০১৭ সালে ওই আইন সংশোধন করে, বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে পাঠানোর জন্য আদালতকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। লিগ্যাল এইড অ্যাক্ট-২০০০ আইন বলে লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ করা হয় ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। আরবিট্রেশন অ্যাক্ট-২০০১ মোতাবেক, মেডিয়েশনে উভয় পক্ষের সম্মতিতে চূড়ান্ত চুক্তি (Agreement) স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কোনো পক্ষই নতুন করে একই বিষয়ে কোনো মামলা, আপিল বা রিভিশন আদালতে দায়ের করতে পারবে না। অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩-এর ২২ ধারা ২০২১ সালে সংশোধন করে মেডিয়েশনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। ওই আইনের ৪৪ক ও ৩৮ ধারা মোতাবেক আপিল, রিভিশন, এমনকি রায় Execution-এর সময়ে মেডিয়েশন পদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে মেডিয়েশন অ্যাক্ট এখনো পাস করা হয়নি, যা এখন সময়ের দাবি।
গ্রাম আদালত-২০০৬, আরবিট্রেশন অ্যাক্ট-২০০১, মুসলিম ফ্যামিলি ল’ অর্ডিন্যান্স-১৯৬১, ফ্যামিলি কোর্ট অর্ডিন্যান্স-১৯৮৫, ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স-১৯৮৪, ভ্যাট অ্যাক্ট-১৯৯১, কাস্টম অ্যাক্ট-১৯৬৯, The Conciliation of Disputes (Municipul Areas) Board Act 2004, Real Estate Development and Management Act 2010 নিষ্পত্তি করার সুযোগ রয়েছে, যা Dispute পদ্ধতির আওতাভুক্ত।
আইনে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেডিয়েশন পদ্ধতি বাংলাদেশে এখনো জনপ্রিয়তা লাভ করেনি, যার কারণগুলো নিম্নে- উল্লেখ করা হলো-
ক. আইনজীবীদের অসহযোগিতা : গত ২০০ বছরের আইন পেশার ধারাবাহিকতায় মেডিয়েশন পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিজ্ঞ আইনজীবীরা উৎসাহ বোধ করেন না। এতে অর্থনৈতিক বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে স্কুলে মেডিয়েশন প্র্যাক্টিস করানো হয়। বাংলাদেশে ন্যূনতম, কলেজ ও বিশেষ করে এলএলবি কোর্সে মেডিয়েশন পদ্ধতি প্র্যাক্টিস ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
খ. মেডিয়েশন করার জন্য উপযুক্ত সেন্টারের অভাব : পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে ৪০ হাজার মেডিয়েশন সেন্টার রয়েছে ও বাংলাদেশে এ ধরনের নির্ধারিত স্থান বা অবকাঠামো নেই। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি আদালত প্রাঙ্গণে মেডিয়েশন সেন্টার স্থাপন করা আবশ্যক।
গ. মেডিয়েশন পদ্ধতি সস্পর্কে অজ্ঞতা : এ পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণের সচেতনতার অভাব রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় জনগণের প্রতি সচেতনতামূলক প্রচার ব্যাপকভাবে করা দরকার।
ঘ. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিয়েটরের অভাব : মেডিয়েশন করার জন্য নিরপেক্ষ, সৎ, প্রজ্ঞাবান, দক্ষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তির অভাব থাকার কারণে এ পদ্ধতি প্রসার লাভ করতে পারেনি। বিভিন্ন এলাকায় মেডিয়েটর প্রশিক্ষণ দেয়া আবশ্যক। প্রশিক্ষিত মেডিয়েটরদের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে একটি সম্মানী নির্ধারিত হওয়া আবশ্যক।
ঙ. মন মানসিকতার পরিবর্তন : সব ক্ষেত্রেই প্রতিশোধমূলক না হয়ে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিরোধে জড়িত জনগণের মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।
চ. আইনের প্রতিবন্ধকতা : আরবিট্রেশন অ্যাক্ট-২০০১-এর মতো বাংলাদেশে এখনো মেডিয়েশন অ্যাক্ট প্রণয়ন ও পাস করা হয়নি, যা কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরি।
একটি পরিবার সংশ্লিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি। একটি পরিবার যখন অশান্তিতে ভোগে তখন এর প্রভাব তার Nearest and Extended Family-এর ওপর বর্তায়। পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্র আক্রান্ত হয়। পরিবার সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘ যেভাবে মূল্যায়ন করে তা হলো- “Recognition of the inherent dignity and of the equal and inalienable rights of all members of the human family is the foundation of freedom, justice and peace in the world.”
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া Restorative Justice বা Alternative Dispute Resolution বা মেডিয়েশন পদ্ধতি চালু ও কার্যকর করা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ও পদক্ষেপের সময় এসেছে, এ জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১ মোতাবেক, আপিল বিভাগ ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিভাগ ঘোষিত আইন অধঃস্তন সব আদালতের জন্য অবশ্যই পালনীয়। বিশ্বসভ্যতার সাথে সমানতালে চলার জন্য বাংলাদেশকেও এগিয়ে আসতে হবে। বিচার প্রার্থনা করে প্রার্থীরা যে হয়রানি হয়, তাতে বিচার পাওয়ার তৃষ্ণা এমনিতেই মিটে যায়। এ মর্মে আরো গবেষণা ও কার্যকর পদক্ষেপ সর্বোচ্চ আদালত এবং রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে এখনই শুরু করা দরকার। মানুষ শুধু ইট-সিমেন্টের উন্নয়ন ও যান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চায় না, মনস্তাত্তি¡ক শান্তি লাভের বিজ্ঞানসম্মত উপায় খোঁজ করার চেষ্টা করে। বিজ্ঞানময় কুরআন মাজিদে মেডিয়েশন পদ্ধতির কথা উল্লেখ রয়েছে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা