‘ঝরে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের আরেক তারকা’
- কর্নেল (অব:) মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি
- ০৩ আগস্ট ২০২২, ২০:১২, আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২২, ২০:৩৩
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের আকাশে এখনো ঝলমল করছে অসংখ্য তারকা। বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আইন উদ্দিন, বীর প্রতীক ছিলেন তাদের একজন। গত ২ আগস্ট সকাল সাড়ে ৭টায় ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এ নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে গেলেন। ‘নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব।’ (সূরা বাকারা-২:১৫৬)
সামরিক বাহিনীর সুপরিচিত এ মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত। তার অনবদ্য অবদান যেমন মুক্তিযুদ্ধে বিস্তৃত, একইভাবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিকবাহিনী পুনর্গঠন ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষাবাহিনী গঠনেও তা কোনো অংশে কম নয়। তিনি সামরিক আইনজ্ঞ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
মুহাম্মদ আইন উদ্দিন ১৯৪৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার লক্ষ্মীপুরের কুলিয়ার চরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন সুরুজ আলী।
১৯৬৫ সালে তিনি প্রথম পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (পিএমএ) ওয়্যার কোর্সের ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ সালের ৮ মে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কমিশন লাভ করে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়ন, ৪ ইস্ট বেঙ্গলে যোগ দেন। এ ইউনিটে তিনি লেফটেন্যান্ট ও পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে পল্টনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ ‘কোয়ার্টার মাস্টার’-এর দায়িত্ব পালন করেন। ৪ ইস্টবেঙ্গল সামরিক বাহিনীতে তিনি ‘বেবি টাইগার্স’ হিসেবে পরিচিতি পান।
১৯৭১ সালে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান ছিল কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসে। সে ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল খিজির হায়াৎ খান (অবাঙালি), উপ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ, আরো ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন গণহত্যা চালানোর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে এবং এরই অংশ হিসেবে ৪ ইস্টবেঙ্গলকে বিভিন্ন ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে ইউনিটকে দুর্বল করার চক্রান্ত করা হয়।
ইউনিটের ‘কোয়ার্টার মাস্টার’ হিসেবে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের দায়িত্ব ছিল অস্ত্র-গোলাবারুদ, যানবাহন, সাজসরঞ্জামাদি, খাদ্যসামগ্রী, রসদ ইত্যাদি জোগান দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা। আর এ সুযোগটি তিনি শতভাগ কাজে লাগিয়েছেন তার নিজের ইউনিটের বিচ্ছিন্ন হওয়া কোম্পানিগুলোকে সম্পূর্ণভাবে রণসজ্জায় সজ্জিত করেন। মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সাফায়াত জামিল, অন্যান্য অফিসার ও জওয়ানরা এ কারণেই বিপুল শক্তি নিয়ে শত্রুকে সহজেই ঘায়েল করতে পেরেছিলেন। বন্দী করতে পেরেছিলেন অবাঙালি অধিনায়ক, অন্যান্য অফিসার ও জওয়ানদের।
ইউনিট যখন সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটে অবস্থান করছে, ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন একদিন পাকিস্তানিদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তার স্ত্রী ও কোলের দুই ছোট্ট মেয়েকে সেনানিবাসে রেখে সাইকেলে করে সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য।
অতঃপর, ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন ৪ ইস্ট বেঙ্গল ও ২ নং সেক্টরের অধীনে বিভিন্ন অপারেশনে সফলতার সাথে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে থাকেন। একসময় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের নবম ইউনিট অর্থাৎ ৯ ইস্ট বেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাকে মেজর পদে পদোন্নতি দিয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ৪ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি ও দক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আইন উদ্দিন অতি অল্প সময়ে পল্টনের প্রতিষ্ঠা করেন ও যুদ্ধপোযোগী হিসেবে গড়ে তোলেন। এরপর ৯ ইস্ট বেঙ্গল যুদ্ধ শুরু করে তার দক্ষ নেতৃত্বে। ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর কসবাকে তিনি হানাদার বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করেন। এরপর মুক্ত করেন চন্দ্রপুর, লাকুমুড়া, কৃষ্ণপুর, বাগবাড়ি ও কুমিল্লা শহর। মিরপুর মুক্তকরণেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। এভাবেই একদিন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় মেজর আইন উদ্দিনের মতো আরো অসংখ্য বীর সেনানীর অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ ও দুঃসাহসিক যুদ্ধে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অসামান্য অবদান ও বীরত্ব প্রদর্শন এবং বীরত্বসূচক অবদানের জন্য ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে চতুর্থ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ও বীরত্বসূচক খেতাব ‘বীর প্রতীক’ হিসেবে ভূষিত করা হয়। এরপর লে. কর্নেল, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন। একই সাথে তিনি কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন নবগঠিত সেনাবাহিনী তথা সামরিক বাহিনীকে একটি শক্তিশালী অবয়ব দেয়ার জন্য।
তিনি দেশে-বিদেশে উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ যেমন- ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের প্রধান প্রশিক্ষক, প্রশাসনিক স্কুলের কমান্ড্যান্ট, ৭২ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার, বাংলাদেশ রাইফেলসের উপমহাপরিচালক, ঢাকা লজিস্টিক এরিয়ার কমান্ডার হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯ পদাতিক ডিভিশন, যা ঘাটাইল সেনানিবাসে অবস্থিত। ৩০ বছর চাকরি করার পর ১৯৯৬ সালের ১৪ জুন তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
জেনারেল মুহাম্মদ আইন উদ্দিন ছিলেন তিন কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের জনক। তার বড় মেয়ের স্বামী আল-আরাফাহ ব্যাংকের ডিএমডি, দ্বিতীয় মেয়ের স্বামী সেনাবাহিনীর সুপরিচিত অফিসার লে. কর্নেল (অব.) মেসবাহ রবিন তৃতীয় মেয়ের স্বামী মেজর জাহেদ।
‘প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দিয়ে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সূরা আম্বিয়া-২১:৩৫)
‘নভোমণ্ডল ও ভ‚মণ্ডলের রাজত্ব তাঁরই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। তিনি সব কিছু করতে সক্ষম।’ (সূরা হাদিদ-৫৭:২)
‘প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন।’ (সূরা মুনাফিকুন-৬৩:১১)
আমরা এ বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।
লেখক : সামরিক ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ
Email: hoque2515@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা