ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২৭ জুলাই ২০২২, ২০:৩৮
অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব পলিটিক্স অনুযায়ী ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হচ্ছে ‘মানুষ যা করতে চায় না তাকে তা করানোর দক্ষতা’। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ প্রত্যয়টি প্রথম ব্যবহার করেন লর্ড হিউম তার বিখ্যাত রচনা ‘Of the Original Contract’-এ। এর আগে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রিন্স’-এ ক্ষমতার আধুনিক ভিত্তি রচনা করেন। ম্যাকিয়াভেলি সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি রাজনীতিকে নৈতিকতা, নিয়মতান্ত্রিকতা ও আইনানুগতা ব্যতিরেকে কেবল ‘ক্ষমতা’ হিসেবেই ব্যাখ্যা করেন। হিউম গতানুগতিক গণতন্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিকতাকে ভড়ং হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আসলে এগুলো হয় ক্ষমতার জবরদখল অথবা বিজয়ের অর্জন। নির্বাচনের মাধ্যমে এরা বিজয়ের ভান করে। এরা এভাবে দেখায় যেন জনগণ স্বেচ্ছায় তাদের আনুগত্য করছে। তাবত তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে তিনি বলেন, এগুলো শক্তি ও সন্ত্রাসের প্রদর্শনী মাত্র। বাস্তবে রাজনৈতিক শক্তি কিভাবে কাজ করে তার একটি নেতিবাচক বর্ণনা দেন হিউম। তিনি অবশেষে উপসংহারে পৌঁছান : ‘Politics is seen to be abort might rather than right’.
এভাবে গায়ের জোরে একবার ক্ষমতার মসনদ দখল করতে পারলে তা নিয়মতান্ত্রিকতা ও বৈধতা অর্জন করে বলে মনে করে ক্ষমতাসীন চক্র। এভাবে ক্ষমতা হয়ে উঠে রাষ্ট্রব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা কোনো নৈর্ব্যক্তিক বিষয় নয়। ক্ষমতা প্রয়োগ করে নেতৃত্ব। নেতৃত্ব যদি নিয়মতান্ত্রিক হয় তাহলে সেখানে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর যদি নেতৃত্ব কর্তৃত্ববাদী হয়, তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তিতন্ত্র, দলতন্ত্র ও গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এটি নির্ভর করে ক্ষমতার বিভাজন ও প্রয়োগের ওপর। ক্ষমতার যদি কেন্দ্রীকরণ ঘটে তা প্রকারান্তরে ব্যক্তিকে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ দেয়। আর তা দুর্নীতিকে নিশ্চিতভাবেই ধারণ করে।
প্রচলিত প্রবাদটি এরকম : ‘Absolute power corrupts absolutely’। সার্বিক ক্ষমতা সার্বিকভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের এসব উপদ্রব লক্ষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান মন্তব্য করেন, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ গণতন্ত্রের জন্য অশনি সঙ্কেত। গত শনিবার প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ রিসার্চ সেন্টার আয়োজিত স্মারক বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। জাতির এই বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবী বলেন, ‘যে দেশে জনগণ সরকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সেটি হলো গণতন্ত্র। যে দেশে জনসরকারের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ নেই, তা ভোট হোক আর যাই হোক সেটিকে প্রকৃত গণতন্ত্র বলা চলে না।’
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে সাথে গণতন্ত্রের বদলে একধরনের ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ সৃষ্টি হয়। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের চরম প্রকাশ ঘটে। ক্ষমতাশ্রয়ীরা মনে করেন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই তাদের রক্ষাকবচ। আসলে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন স্বাভাবিকভাবেই সমাজে অসন্তোষ, ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার সৃষ্টি করে। ক্ষমতার মোকাবেলায় আরেকটি ক্ষমতার সন্ধান করে মানুষ। এভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর আগমন ঘটে। স্বাভাবিকভাবে সামরিক নেতৃত্ব কখনোই গণতন্ত্রবান্ধব নয়। এ ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ছিলেন একটি নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনা।
তখনকার পরিবেশ ও পরিস্থিতি জিয়াউর রহমানকে একনায়কত্বের পথ দেখালেও তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রবর্তন করেন। তার মৃত্যু সামরিক বাহিনীর ক্ষমতালোভী অংশকে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশায় ১৯৯০ সালে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন হলেও তা জনগণকে সত্যিকার গণতন্ত্র এনে দেয়নি। বরং রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের বদলে অগণতন্ত্রের নমুনা উপস্থাপন করে। রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব ও কোন্দল ২০০৬ সালে এক-এগারোর মতো ঘটনা অনিবার্য করে তোলে। যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সুশাসন প্রত্যাশিত ছিল, তা না হয়ে অন্য নামে অন্যভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটে। এ নিবন্ধের শুরুতে যে তত্ত্বকথার অবতারণা করা হয়েছে তারই অনুকরণ, অনুশীলন ও অনুশাসন লক্ষ করা যায়। সামরিকবাহিনী ও বহিঃশক্তির সমীকরণে একটি প্যাকেজ ডিলের আওতায় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীন সরকার দেশ শাসন করছে। দৃশ্যমানভাবে ও প্রচলিত জনমত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের নিকৃষ্ট নমুনা প্রত্যক্ষ করছে। এরই প্রকাশ ঘটেছে বরেণ্য বুদ্ধিজীবী আকবর আলি খানের মন্তব্যে।
উষ্ণতা মাপার জন্য যেমন আছে থার্মোমিটার, দুধের ঘনত্ব মাপার জন্য আছে ল্যাক্টোমিটার ও পানির গভীরতা মাপার জন্য আছে ফ্যাদোমিটার- তেমনি সমাজ, রাজনীতিকে বোঝার জন্য এখন নানা ধরনের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ব্যারোমিটারের অনুসন্ধান চলছে। উপস্থাপিত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চিহ্নিত করার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নানা তত্ত্বের তালাশ করছেন। সমাজবিজ্ঞানী এন্ডারসন রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর মাত্রার কথা বলেন। এন্ডারসন বলেন, যেখানে বিকেন্দ্রীকরণের মাত্রা নির্ণিত হওয়া উচিত সেখানে এখন কোথায় কতটা নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হচ্ছে তা দেখতে হচ্ছে।
আরেকজন তাত্ত্বিক ডুহারজার কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ তত্ত্বে বলেন : ‘নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে কিভাবে ক্ষমতা বণ্টন করা হচ্ছে তা-ই এখন ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার প্রমাণ দেবে’। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জান্ডা আশির দশকের দিকে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের আটটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেন। এ বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে- ১. রাষ্ট্রিক কাঠামোর জাতীয়করণ; ২. জাতীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ; ৩. জাতীয় সংসদের সদস্যদের মনোনয়ন; ৪. সম্পদ বণ্টন; ৫. নীতিনির্ধারণ, ৬. যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ; ৭. প্রশাসনিক তথা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও ৮. নেতৃত্বের কেন্দ্রিকতা। এই আটটি বৈশিষ্ট্যের নিরিখে যদি আমরা বাংলাদেশের বিগত দেড় দশকের খতিয়ান নিই, তাহলে স্বচ্ছ প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।
রাষ্ট্রিক কাঠামোর জাতীয়করণ : রাষ্ট্রিক কাঠামো বলতে সংবিধান ও রাষ্ট্রের অনিবার্য আরো তিনটি অঙ্গ- নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের কথা বোঝানো হয়। আরো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানও রাষ্ট্রিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। ক্ষমতাসীন সরকার প্রথমেই ক্ষমতার কাঠামো নিয়ন্ত্রণের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যা তারা নিজেরাই প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তা উঠিয়ে দেয়। বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে নেয়ার প্রয়াস পায়। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিপরীত অবস্থানের পর প্রধান বিচারপতির সাথে তারা কী ব্যবহার করেছে তা সবারই জানা কথা। আইন বিভাগ তথা জাতীয় সংসদের ৯৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। সেখানে প্রশংসা ও প্রশস্তি ব্যতীত আর কিছুই উচ্চারিত হয় না। আমলাতন্ত্র দলতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক পদ নিকৃষ্ট দলীয় অবস্থান নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বণ্টিত হয় না। প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন, প্রণয়ন ও প্রয়োগ হচ্ছে।
জাতীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ : দল ও রাষ্ট্রে জাতীয় নেতার মর্যাদায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটে। প্রাথমিক অবস্থায় এক নেতা এক দেশ বলা হয়েছে। এখন উন্নয়নের গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংবিধানিক পরিবর্তন ও সংশোধনগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার উদাহরণ হয়ে আছে। তিনি সাংবিধানিকভাবে এতটাই একক যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাকে রাজা-বাদশাহর চেয়ে ক্ষমতাবান মনে করেন। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের নেতা ও দলীয়প্রধান। তিনি সব কিছুর নিয়ন্তা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রিয়াজ এ ব্যবস্থাকে বলেছেন প্রধানমন্ত্রিত্ববাদ। দলীয় নিয়ন্ত্রণ এতটাই নিরঙ্কুশ যে, প্রতিটি কাউন্সিল অধিবেশন শেষে তাকে কমিটি গঠনের সর্বময় কর্তৃত্ব দেয়া হয়। আঞ্চলিক ও জেলাপর্যায়ে নেতৃত্বও তার মর্জির ওপর নির্ভর করে।
জাতীয় সংসদের সদস্যদের মনোনয়ন : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় দলের মনোয়নে আইনসভার নির্বাচনের জন্য মনোনোয়ন পেতে হয়। যদিও একটি দলীয় মনোনয়ন কমিটি রয়েছে। তবুও এটি সত্য যে, দলীয়প্রধানের অনুগ্রহ ব্যতিরেকে কোনো মনোনয়ন পাওয়া সম্ভব নয়। গণমাধ্যমে এ ধরনের মনোয়নের বিনিময়ে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আরো লক্ষণীয় বিষয়- সৎ, ত্যাগী ও নির্মোহ নেতৃত্বের বদলে সম্পদশালী ও সন্ত্রাসী চরিত্রকে প্রাধান্য দেয়া হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সংসদের বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন। গণমাধ্যম সংসদকে বলে, কোটিপতির ক্লাব।
সম্পদ বণ্টন : আজকাল রাজনীতির মানেই হচ্ছে ‘সম্পদের কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টন ক্ষমতা’। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় সহায় সম্পদের লুটপাট। অসংখ্য মেগা প্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতির অভিযোগ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বিদ্যুৎ খাতের কথা বলা যায়। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে কোটি কোটি টাকা বণ্টন করা হয়েছে। এখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকার সর্বত্র। অথনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, রিজার্ভ ফান্ডের যে অবস্থা তা শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। দেশের ব্যাংকগুলো একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে যেন ইজারা দেয়া হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদে এ লুটপাটকারীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। অপর দিকে, এসব লোক হাজারো কোটি টাকা লোন নিয়ে ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে ফেলেছে। অকাতরে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে। রাজনীতিতে যেমন তাদের নিরঙ্কুশ অবস্থান রয়েছে, তেমনি অর্থনীতিতেও তাদের একক প্রাধান্য বজায় রয়েছে। দেশের এমন কোনো খাত নেই যেখানে তাদের দুর্নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
নীতিনির্ধারণ : যেকোনো দেশের নীতিনির্ধারণে জাতীয় আদর্শ, উন্নয়ন কৌশল ও দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রাধান্য দেয়া হয়। জাতীয় স্বার্থে আরো যে নীতিমালা গ্রহণ করতে হয় যেমন- শিক্ষানীতি, শিল্পনীতি, পরিবহন নীতি ইত্যাদি। দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও স্বল্প আয়ের লোকদের উন্নয়নে নজর দেয়া হয়। ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে দেশটি কোনো বছরই দুর্নীতির শীর্ষ অবস্থান থেকে পিছু হটেনি। তাদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক স্বার্থ সুবিধানীতির কারণে দেশে এক বিশেষ ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছে। গোটা বিশ্বে দ্রুত ধনীর দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। গরিব ক্রমেই আরো গরিব হয়েছে। এই ধনিক শ্রেণী দেশের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে। অবাধে লুটপাট করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো ভালো নীতি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টোটি।
যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ : যোগাযোগ ব্যবস্থার দু’টি দিক। একটি হলো পরিবহন। অপরটি হলো প্রযুক্তিগত যোগাযোগ। দেশের নৌ, রেল ও সড়কপথে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্বার্থে এসব খাতে আইন ও শৃঙ্খলার কোনো প্রমাণ থাকছে না। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সড়কপথে প্রাণ হারায়। রেলের কালো বিড়ালের গল্পের কথা এখন সত্য। বিমান প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। প্রযুক্তিগত যোগাযোগ মোবাইল, নেট ও এ ধরনের অন্যান্য খাতে বেসরকারি পর্যায়ে বিপুল অঙ্কের লাভের কথা শোনা যাচ্ছে। অপর দিকে, সরকারি মালিকানাধীন মোবাইল কোম্পানির ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।
প্রশাসনিক তথা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ : দেশের সংবিধানে ভারসাম্যের কথা বলা হলেও আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের কোনো স্বীকৃত সীমারেখা নেই। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগে কথিত বিভাজন এখন গল্পকথায় পরিণত হয়েছে। তোফায়েল আহমেদের মতো প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাও বলছেন, রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই।
অতি সাম্প্রতিককালে একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবসান হয়েছে। সেখানে আমলাতন্ত্র এখন রাজনৈতিক দলের প্রধান আশ্রয় ও প্রশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নির্বাহী বিভাগের স্থায়ী অংশ অর্থাৎ আমলাতন্ত্র এতটাই দলীয় পরিচয়ে সম্পৃক্ত হয়েছে যে, প্রশাসন ও শাসকদলের মধ্যে সীমারেখা নির্ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
নেতৃত্বের কেন্দ্রিকতা : বাংলাদেশের গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা এতটাই ব্যাপক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, গ্রামীণ সমাজেও সেই স্বাভাবিক ও সনাতন পরিবেশ আর নেই। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন রাজনৈতিক বিবেচনায় স্থান পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’গুলো অশান্তিতে ভরে গেছে। সেখানের নেতৃত্ব ও সম্পদের বণ্টন দলীয় পর্যায়ে নির্ধারিত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে একটি জাতির মধ্যে যে সহজ সরল ও অস্বাভাবিক সম্প্রীতি থাকে তা বিনষ্ট হয়েছে। শাসক আওয়ামী লীগের বিপরীতে কোনো নেতৃত্ব বা ভিন্নমতের বিকাশ তো দূরের কথা- টিকে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী দল অভিযোগ করছে তাদের লাখ লাখ কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। জেল, জুলুম ও নির্যাতন ভোগ করছে লাখ লাখ মানুষ। আর এর একটি কারণ ক্ষমতা, সম্পদ ও সমাজের সবটুকু নিরঙ্কুশ কেন্দ্রিকতা। গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রই হচ্ছে এই ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার একমাত্র উত্তর। আকবর আলি খান সে দিকেই গোটা জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমাদের দেশে গণতন্ত্র গড়ার প্রয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে তিনি বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় বাতলে দিয়েছেন। গোটা জাতির মুক্তি চাইলে গণতন্ত্র একটি অনিবার্য প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা