২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিভাজনের পথে আর নয়

বিভাজনের পথে আর নয়। - ছবি : নয়া দিগন্ত

আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক ও রাষ্ট্রনায়ক। ভবিষ্যতের রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা নিয়ে তার বেড়ে উঠার সহায়ক ভ‚মিকা করে স্কুলের পরিবেশ। এই পরিবেশ শিশুকে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, একতা এবং শৃঙ্খলাবোধ শেখায়। সবাইকে একসাথে নিয়ে পথ চলার প্রেরণা জোগায়। সামাজিক সমতার শিক্ষা স্কুল থেকে পায়। স্কুলে অভিন্ন সিলেবাস, অভিন্ন পোশাকের বিধান, একই ধরনের ব্যবস্থা ও শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। কারো জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেই। এসবই করা হয় শিশুরা যেন অভিন্ন মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে, বড় হয়; তাদের ভেতর যেন বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার আবহ তৈরি হয়। দুঃখজনক হলেও বাস্তবে আমরা তার প্রতিফলন দেখি না। জাতীয় চেতনাবোধ, দেশপ্রেমের শিক্ষা উপেক্ষিত; বিশেষ করে বিভিন্ন ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। ওই সব প্রতিষ্ঠানে যা পড়ানো হয় তার সাথে আমাদের দেশের পরিবেশ সামাজিকতা, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি নৈতিকতার কোনো মিল নেই। ফলে শিশুরা বিদেশী পরিবেশের সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠে। প্রথম থেকে তারা দেশের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠে। ফলে এদের বেশির ভাগ মানুষ দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে এবং সুযোগ পেলেই দেশ ছেড়ে চলে যায়। যারা মারা যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগ মেধাসম্পন্ন। তাদের মেধা থেকে জাতি বঞ্চিত হচ্ছে। এ প্রবণতা রোখা প্রয়োজন।

দেশের বিভিন্ন নামকরা স্কুলের সামনে সব বেলায় গিয়ে দাঁড়ালেই সামাজিক বৈষ্যম্য প্রকট কত বেশি তা বোঝা যায়। কমবেশি সব শিশুই আসে গাড়িতে করে। কারো মার্সিডিজ, কারো টয়োটা, কেউ বা সাধারণ সিএনজিতে চড়ে আসে। দেখা যায়, কোনো শিশুর ব্যাগ একজন ধরে আছে, আরেকজন খাবারের পাত্র নিয়ে শিশুকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো শিশু হেঁটে বা রিকশা থেকে নেমে ক্লাসে প্রবেশ করছে যদিও তাদের পোশাক এবং সিলেবাস অভিন্ন। স্কুলে আসার পর তাদের ভেতর আলোচনা হয়; কার গাড়ি কোন মডেলের, কার গাড়ির দাম কত, কার গাড়ি কোন কোম্পানির। এখানে মর্যাদা নির্ধারণ হয় গাড়ির আবহে আর পারিবারিক সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে। এটা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। কারণ এতে শিশুদের ভেতরে একটা বৈষম্য তৈরি হয়। বৈষম্য নিয়ে তারা বড় হয়ে ওঠে। তাদের কাছে সামাজিক সুবিচার ও সমতার প্রত্যাশা কিন্তু জাতি করতে পারে না।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই একক শিক্ষাব্যবস্থা ও একক সিলেবাসের বিধান রয়েছে; ইংরেজি মিডিয়ামে হোক অথবা সাধারণ মিডিয়ামে হোক কিংবা ন্যাশনাল কারিকুলামে হোক। সব জায়গায় ন্যাশনাল কারিকুলাম; কিন্তু বাধ্যতামূলক। ব্যতিক্রম শুধু আমরাই। মাদরাসা শিক্ষায় আমরা সাধারণ কারিকুলামকে একীভ‚ত করেছি। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাগুলোতে আমরা করতে পারিনি। এটা করার জন্য সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা এবং সিলেবাস প্রচলন করা প্রয়োজন। আরো মজার ব্যাপার হলো- ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে যেসব বই থেকে পড়ানো হয় তার বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। এটা একটা আমদানিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা। এখান থেকে আমরা জাতিপ্রেমে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠী প্রত্যাশা করতে পারি না। অপর দিকে আরো একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে- এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ফি’র কথা শুনলে আঁতকে উঠার মতো অবস্থা। কোথাও দুই লাখ, কোথাও পাঁচ লাখ পর্যন্ত টাকা গুনতে হয়। একটা শিশুকে একটি স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে তার ভর্তি ফি যদি এক লাখ, দুই লাখ কিংবা পাঁচ লাখ হয় তাহলে খরচের জোগান অভিভাবকরা কোত্থেকে সংগ্রহ করবেন? সেই অভিভাবকদের কী অবস্থা? তা কি আমরা ভেবে দেখছি? এসব স্কুলের বেতন দেশের সাধারণ নাগরিকের বার্ষিক আয়ের চেয়ে অনেক বেশি। এই বৈষম্য নিয়ে শিশুরা বড় হচ্ছে। এই বৈষম্য সামাজিক ভারসাম্যহীনতার দেয়াল তৈরি করছে। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম, সামাজিক ভারসাম্য এবং সমতার বিধান কার্যকর করা।

আধুনিক বিশে^র উন্নত দেশগুলোর অভিভাবকরা শিশুদের নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সমবেত হন। সেখান থেকে স্কুলের গাড়ি শিশুদের স্কুলে নিয়ে যায়। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে স্কুল ক্যাম্পাসে আসার কোনো সুযোগ নেই। কারণ একটাই। ‘বাড়িতে তোমার অবস্থা যা-ই থাকুক স্কুলে তুমি সমমানের।’ অর্থাৎ একপর্যায়ের। এসব স্কুলে ছাত্রছাত্রী পরিবহন করার জন্য বড় বাস রয়েছে। এগুলোকে ‘মাংকি বাস’ বলা হয়। এগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়। বাসে চড়ে সবাইকে একই পোশাক পরে একই সাথে স্কুলে যেতে হয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- শিশুদের ভেতরে যেন সহমর্মিতার মানসিকতাবোধ জাগ্রত হয়। আমাদের দেশে এই নিয়ম চালু করা প্রয়োজন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- এসব নামকরা স্কুলের সামনে সকাল-বিকাল অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হয়। অথচ সচেতন হলে এই যানজট এড়ানো যায়। চেষ্টা করলেই শিশুদের একটি চমৎকার মানবিক পরিবেশে নিয়ে আসা যায়। এ ব্যাপারে আমার মনে হয় আমাদের যারা শিক্ষাবিদ আছেন, শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন এবং শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন তাদের কাজ করার, ভাববার একটি বিরাট ক্ষেত্র রয়েছে। আমরা চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠুক দেশপ্রেমের স্বকীয়তায় ও জাতীয় পরিচয়ে এবং একটা ভারসাম্যমূলক সামাজিক চিন্তাচেতনায়। এখন যে শিক্ষা চলছে সেটি হচ্ছে সামাজিক বিভাজনের শিক্ষা। এই সামাজিক বিভাজন দিয়ে আমরা শিশুদের আর কতদিন লালন করব?

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ রিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement