০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

আলেমদের ঐক্য সময়ের অপরিহার্য দাবি

আলেমদের ঐক্য সময়ের অপরিহার্য দাবি। - ছবি : সংগৃহীত

গণ কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্র দেখলে বোঝা যায়, এ দেশের সব ঘরানার ওলামায়ে কেরামকে এতে যুক্ত করা হয়েছে। মোটকথা, এ দেশে যারা ইসলামকে ফোকাস করেন ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার করেন তাদের সবাইকেই টার্গেট করা হয়েছে। দেওবন্দি, আলিয়া, জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই, বেরলভি, আহলে হাদিস ও জৌনপুরী কাউকেই বাদ দেয়া হয়নি। গণকমিশনের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সব মাসলাকের আলেমদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এখন অস্তিত্বের প্রশ্ন। দলীয় বা গোষ্ঠীয় সঙ্কীর্ণতা পরিহার করতে হবে এবং হৃদয়কে করতে হবে বড় ও প্রসারিত। ‘ইত্তেফাক মাআল ইখতিলাফ’- মরহুম হজরত কায়েদ সাহেব হুজুরের এই নীতিমালাকে সামনে রেখে একে অপরের কাছে আসতে হবে। ইখতিলাফ ও ভিন্নমত থাকবে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। অপরের মত, পরামর্শ, ধ্যান-ধারণার প্রতি ইসলাম সবসময় শ্রদ্ধাশীল। গঠনমূলক সমালোচনাকে ইসলাম সবসময় স্বাগত জানায়।

ভিন্নমতের প্রতি ইসলামের আচরণ সহানুভ‚তিপূর্ণ। সহিষ্ণুতা নিঃসন্দেহে মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এবং সামাজিক মূল্যবোধ নির্মাণের তাৎপর্যপূর্ণ বুনিয়াদ। অপরের কথা, বক্তব্য, মতামত, পরামর্শ ও জীবনাচার যতই বিরক্তিকর ও আপত্তিকর হোক না কেন, তা সহ্য করার মতো ধৈর্য ও স্থৈর্য যদি মানুষের মধ্যে না থাকে তা হলে সমাজে নৈরাজ্য, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে বাধ্য। ইখতিলাফ বা ভিন্নমত নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্য গড়ে তোলা যায়। নিয়মতান্ত্রিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আইনের পথে লড়াই করতে হবে। পাতানো ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। জোশকে নিয়ন্ত্রণ করে হুঁশকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে- ঐক্যই শক্তি, বিভেদে পতন। আগামীতে আরো বড় ধরনের বিপর্যয় আঘাত হানতে পারে।

বিভিন্ন ঘরানার আলেমদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, তারা ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টির পক্ষে কিন্তু তাদের একটি অংশ মারাত্মকভাবে অহংবাদী, হিংসাশ্রয়ী ও কলহপ্রিয়। নিজেদের সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত উচ্চধারণা, যশোলিপ্সা, পদমোহ ও কাউকে না মানার একটি বেদনাদায়ক প্রবণতা তাদের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। একে অপরের প্রতি উদারতার অভাব এত তীব্র যে, নিজেদের দলীয় বৃত্ত, মাসলাকি চেতনা ও তরিকার বলয়ের বাইরে তারা কাউকে চিন্তা করতে পারেন না। এ অনুদার মানসিকতা বৃহত্তর ঐক্যের পথে বড় অন্তরায়। এ দেশে আলেম, পীর, মাশায়েখ ও মুরশিদের সংখ্যা প্রচুর। তাদের গণভিত্তি বেশ মজবুত। সাধারণ জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক গভীর। মাদরাসা শিক্ষা ও ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ দ্বীনে ইসলামের আলো পাচ্ছে। ওয়াজ ও নসিহত হাজার বছরের বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি। আলেমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহ তৈরির জন্য জনগণকে আহ্বান করে থাকেন। ওলামায়ে কেরাম মাহফিলে মাদক, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, যৌতুক, ধর্ষণ, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, খুন-খারাবি, ব্যভিচারসহ নানা সামাজিক অপরাধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে জনগণকে সচেতন করে যাচ্ছেন। ইসলামের নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করা, ইহজীবনে সমৃদ্ধি, পরকালে মুক্তি এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ওয়াজের মূল সূর। ওয়ায়েজ ও আলেমদের শেকড় মজবুত। তৃণমূল পর্যায়ে রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। তারা সামাজিক শক্তির প্রতিভ‚। ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় ভাবাবেগ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের গভীরে প্রোথিত। কিন্তু আফসোস! মাসলাক ও ফিরকাবন্দির সঙ্কীর্ণ গণ্ডি থেকে তারা বের হতে পারেননি। ফলে এর প্রভাব পড়েছে তাদের ছাত্র, শিষ্য ও অনুরক্তদের ওপর।

আলেমদের অপর একটি গ্রুপ মারাত্মক চরমপন্থী ও অসহিষ্ণু, যারা অন্য দল, তরিকা বা মাসলাকের অনুসারীদের মুসলমানই মনে করেন না অথবা গোমরাহ ভাবেন। অন্তর্মুখী মানসিকতা তাদেরকে বহির্মুখী করতে পারেনি। ওয়াজ, মিলাদ ও তাফসির মাহফিলে অপরাপর চিন্তাধারার লোকদের বিরুদ্ধে সমালোচনা, বিষোদগার ও গালমন্দ করা তাদের চিরবৈশিষ্ট্য। ছোটখাটো ইখতিলাফি মাসায়েল নিয়ে এত বেশি পারস্পরিক ঘৃণা ছড়ানো হয় যে, স্থায়ী বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। আলেমদের বিভেদের সুযোগ নিয়ে বৈরী শক্তি ও কায়েমি স্বার্থবাদীরা সবসময় চক্রান্তের জাল বুনেছে এবং আগামীতেও বুনবে। মাওলানা এহসান এলাহি জহির, মাওলানা নওয়াব ছিদ্দিক হাসান ভ‚পালি, মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরি, মাওলানা শামসুল হক আজিমাবাদী ও মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফি আল কুরায়শির মতো উদারমনষ্ক আলিম বাংলাদেশে আহলে হাদিসের মধ্যে এখন আর নেই। আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভি, মুফতি মুহাম্মদ শফি, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা যফর আহমদ উসমানি ও খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদের মতো ওয়াহাদাতে উম্মতের চেতনায় বিভোর মানুষ বাংলাদেশী দেওবন্দিদের মধ্যে এখন আর দেখা যায় না। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, কাজী হোসাইন আহমদ, অধ্যাপক গোলাম আযম ও সাইয়েদ মুনাওয়ার হাসানের মতো অ্যাকোমোডেটিভ মানসিকতাসম্পন্ন নেতা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে আর অবশিষ্ট নেই। পাকিস্তানের বেরলভিদের নেতা মুফতি শফি উকাড়ভি, মাওলানা শাহ আহমদ নূরানি, মুফতি মুনিবুর রহমান ও মাওলানা ড. তাহের আল কাদেরির মতো উদার ব্যক্তি বাংলাদেশী বেরলভিদের মধ্যে অনুপস্থিত। এটি নিঃসন্দেহে বহুমুখী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের শূন্যতা।

বিভিন্ন মতাদর্শের আলেমরা এক দিন নিজেদের ভেদাভেদ ও বিভেদ ভুলে গিয়ে একক প্লাটফর্মে আসতে বাধ্য হবেন। তবে এর আগে একটি প্রচণ্ড ঘূর্ণিবাত্যার তাণ্ডব প্রয়োজন। তীব্র ঝড়ো হাওয়ার আঘাত-অভিঘাতে যখন সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে তখন তারা একে অপরের হাত ধরে বাঁচতে চাইবেন। তখন হয়তো দেরি হয়ে যাবে। সময়ের ও যুগের চ্যালেঞ্জ ওলামা-মাশায়েখদের ঐক্যবদ্ধ করেছে, ইতিহাসের পাতায় রয়েছে তার বহু প্রমাণ। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তির পর পাকিস্তানের ওলামা-মাশায়েখরা যখন ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার দাবি তুললেন তখন শাসকচক্র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন ‘কোন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করব? দেওবন্দির ইসলাম? বেরলভির ইসলাম? মওদূদীর ইসলাম? শিয়ার ইসলাম? আহলে হাদিসের ইসলাম?’ এ চ্যালেঞ্জ পেয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের বিভিন্ন মত ও পথের আলেমরা ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হন। ১৯৫১ সালে বিভিন্ন মতাদর্শের ৩১ আলেম করাচিতে হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভীর বিখ্যাত খলিফা আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভীর সভাপতিত্বে মিলিত হয়ে ঐতিহাসিক ২২ দফা প্রণয়ন করেন। চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুফতি মুহাম্মদ শফি, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, মাওলানা যফর আহমদ ওসমানি, মাওলানা আতাহার আলী, মাওলানা শফি উকাড়ভি, মাওলানা শামসুল হক আফগানি, মাওলানা আবদুল হামিদ কাদেরি বাদায়ুনি, মাওলানা ইদরিস কান্ধলভি, মাওলানা দাউদ গজনভিসহ দু’জন শিয়া মুজতাহিদ। ফলে রচিত হয় ১৯৫৬ সালের ইসলামী সংবিধান। ভারতে নানা পথ ও মতের আলেমদের মধ্যে ঐক্যের একটি বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক সম্মেলনে তারা একে অপরকে অতিথি হিসেবে দাওয়াত দেন।

ইসলামী শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির বিরুদ্ধে দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃক আহূত সর্বভারতীয় সম্মেলনে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে আহলে হাদিস, আহলে সুন্নাত বেরলভি জামায়াত, শিয়া ওয়াকফ বোর্ড, দিল্লি ও আজমিরের দরগাহের মুতাওয়াল্লি বক্তব্য রাখেন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ কর্তৃক দিল্লি, মুম্বাই, আজমির, কলকাতা ও হায়দরাবাদে আয়োজিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী ও জাতীয় সংহতি সম্মেলনে মুসলমানদের বিভিন্ন চিন্তাধারার আলেমদের পাশাপাশি উদারপন্থী হিন্দু সাধু ও সন্তরাও বক্তব্য পেশ করেন। ২০১৮ সালে জমিয়তে আহলে হাদিসের উদ্যোগে দিল্লির রামলীলা ময়দানে আয়োজিত ‘বিশ^ শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও মানবতা সংরক্ষণ’ শীর্ষক ৩৪তম জাতীয় সম্মেলনে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম হিন্দের সভাপতি মাওলানা আরশাদ মাদানি অতিথি হিসেবে অংশ নেন এবং বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অতি সম্প্রতি গত ২৮ ও ২৯ মে ভারতের উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দে ওসমাননগর ঈদগাহ ময়দানে দেশটির মুসলমানদের সর্ববৃহৎ পুরনো সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের দুই দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মাদানির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানি, দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাসেম নোমানি, আসাম রাজ্যের লোকসভার সদস্য মাওলানা বদরুদ্দিন আজমল, জামায়াতে ইসলামী হিন্দের আমির সাইয়েদ সাআদাতুল্লাহ হোসাইনি, মাওলানা আহমদ রেজা খান বেরলভির দৌহিত্র বেরলভি নেতা মাওলানা তাওকির রেজা খান। আহলে হাদিসের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ড, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডসহ ভারতের বৃহৎ বৃহৎ মুসলিম সংগঠনের প্রতিনিধিরাও গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। সম্মেলনে জ্ঞানবাপি মসজিদ, মথুরা ঈদগাহের শাহী মসজিদ, দিল্লির কুতুব মিনারসহ ভারতে মুসলিমদের বিভিন্ন চলমান সঙ্কট বিষয়ে আলেম, বুদ্ধিজীবী ও মুসলিম প্রতিনিধিরা মতবিনিময় করেন। ভারতে ‘কোনোভাবেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে মত দিয়েছেন দেশটির শীর্ষ আলেমরা। তারা বলছেন, এর বাস্তবায়ন ইসলামে হস্তক্ষেপের শামিল। আলেমরা বিজেপি সরকারের নেয়া পরিকল্পনা- ইউনিফর্ম সিভিল কোড তথা ‘অভিন্ন নাগরিক নীতি’র তীব্র বিরোধিতা করেন। মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মাদানি বলেন, ভারতে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি এমনটি ঘটে, তা হলে দেশের নিরাপত্তা ও ভ্রাতৃত্ববোধ হুমকির মুখে পড়বে (নয়া দিগন্ত, ঢাকা, ৩০ মে, ২০২২)।

১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে দ্বীনি শিক্ষা, ইসলামী রাজনীতি ও মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে যখন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন তখন পাকিস্তানের সব চিন্তাধারার আলেম জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের আমির মাওলানা ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে ‘মুত্তাহিদা মজলিসে আমল’ নামক ঐক্যমঞ্চ গড়ে তুলতে বাধ্য হন। জামায়াতে ইসলামীর আমির কাজী হোসাইন আহমদ আলেমদের একতাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। মাওলানা ফজলুর রহমান ছিলেন তখন পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সম্মিলিত বিরোধী দলের নেতা। এ কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে, বাংলাদেশের মাটি, পরিবেশ, জনমানস ইসলামী আন্দোলনের সফলতার অনুক‚লে; কিন্তু আলেমদের দলাদলি, ইসলামী দলগুলোর দুর্বল নেতৃত্ব, সঙ্কীর্ণতা ও অনৈক্য এ উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে অনিশ্চিত করে দিয়েছে। নেতা ও কর্মীরা ইসলাম, ইসলামী শাসন ও ইকামাতে দ্বীনের কথা বললেও জনগণের ব্যথা-বেদনা, অভাব-অভিযোগ ও হাসি-কান্নার কথা বলেন খুব কম। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কাকে বসালে রাষ্ট্রের উন্নতি হবে, আইনের শাসন কায়েম হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে ও ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে, সাধারণ মানুষ তা জানে ও বোঝে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির তীব্রতা অনেক সময় ইসলামপন্থীদের মন ও মানসকে এতই আচ্ছন্ন করে রাখে যে, অন্য প্লাটফর্মের মানুষের প্রতি সম্মান দেখাতে কুণ্ঠিত হন। ভিন্নতার মাঝে ঐক্য (Unity in diversity) ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হওয়া অপরিহার্য, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।

এ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ এ জেড এম শামসুল আলমের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যও ইসলামী আন্দোলনের বহু নেতা একসাথে এক দলে কাজ করতে পারেন না। নিজের নেতৃত্ব স্বীকৃত না হলে উপদল করবেন বা ক্ষুদ্র সংগঠন করবেন। কিন্তু কোনো পুরনো দলে যোগ দেবেন না। ইসলামী আন্দোলনকারী বহু নেতার মধ্যে নাফসানিয়ত, খাহেশাত, আমিত্ব ও অহঙ্কারবোধ এত বেশি যে, অদূর ভবিষ্যতেও তাদের মধ্যে এ মারাত্মক ব্যাধির চিকিৎসার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। আন্দোলনের উদ্দেশ্য লিল্লাহ (আল্লাহর জন্য) বলা হলেও আন্দোলন তারা করে থাকেন লিন্নাফস (নিজের জন্য) এবং নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। এটি অনেকের মনে সচেতনভাবে থাকে, অনেকের মনে থাকে অবচেতনভাবে। অবচেতন খায়েশ সচেতন খায়েশ অপেক্ষা মারাত্মক; কারণ অবচেতন খায়েশকারীর মনে কোনো Guilt Feeling বা অপরাধবোধ থাকে না। কিন্তু ফল একই। ইসলামী সংগঠনগুলো মধ্যে কোনো ঐক্য নেই, অথচ ধর্মবিরোধী শিবিরে ঐক্যের ঐকতান লক্ষণীয়। ধর্মনিরপেক্ষ কোনো বিরাট দল পার্টির স্বার্থে এক থাকতে পারে, অথচ তুলনামূলকভাবে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ডানপন্থী দল ইসলামের স্বার্থে এক থাকতে পারে না। এ অবস্থায় তারা কিভাবে জনগণের আস্থা দাবি করতে পারে? ইসলামপন্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মান্ধ। চোখ থেকেও তারা অন্ধ। চোখের সম্মুখে তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, ইসলামবিরোধী হওয়া সত্তে¡ও বামপন্থীদের সভা-সমিতিতে জনগণ জমায়েত হয়। কারণ বামপন্থীরা যুগ-যন্ত্রণার কথা বলে। অর্থনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক সমাধান নির্দেশ করে। একই বক্তব্য যদি ইসলামপন্থীরা পেশ করতে পারে তাদের সভায় তো লোক আরো বেশি হওয়ার কথা। কারণ তাদের থেকে জনগণ শুধু যে যুগের সমস্যার সমাধান পাবে তা নয়; বরং জীবনজিজ্ঞাসার জবাবও পাবে। এ সাধারণ সত্য বোঝার জন্য দার্শনিকের দরকার হয় না। ইসলামপন্থীরা কি তা বোঝেন?’ (ইসলামী প্রবন্ধমালা, পৃষ্ঠা : ৪৮৪-৪৯৮)।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্যোগের ঘনঘটা লক্ষ করা যাচ্ছে এবং অশুভ শক্তির অশনি সঙ্কেত স্পষ্ট হতে চলেছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইসলামোফোবিয়া বিশেষত উপমহাদেশীয় ঘটনাপ্রবাহ ও ভূরাজনীতির বাস্তবতাকে ভুললে চলবে না। ৫০ বছরেও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি এ দেশে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সংঘর্ষের পথে এগোচ্ছে দেশ। মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর ক্রমোর্ধ্বগতি, নিম্নমুখী রিজার্ভ, শেয়ারবাজার লোপাট, বিদেশে পুঁজিপাচার, দুর্নীতির মহোৎসব, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট সফলতার সম্ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মইনুল ইসলামের মতে, ‘আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে তিন হাজার কোটি ডলার ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। প্রতি বছর ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ কোটি টাকায়’ (প্রথম আলো, ৩১ মে, ২০২২)। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একটি ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। এ ঘূর্ণিঝড় আশীর্বাদও হতে পারে। হতে পারে অভিশাপও। এ দেশের আম ইসলামী জনতা ঘূর্ণির প্রলয়-নৃত্য ও ঘূর্ণি-পরবর্তী বেঁচে থাকার সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করার জন্য অপেক্ষমাণ। সেই সংগ্রাম হতে হবে নিশ্চিতভাবে ঐক্যনির্ভর।


লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement