২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গণমাধ্যম দলনে আরো আইন ও নীতিমালা

- ছবি : সংগৃহীত

শাসকদল হিসেবে এই রাষ্ট্রের প্রাথমিক অবস্থা থেকে এ পর্যন্ত তারা নিজেদের গণমাধ্যমবান্ধব প্রমাণ করতে পারেনি; বরং কালো আইনের পর কালো আইন প্রয়োগ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। প্রণীত সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স-১৯৭৩ প্রণয়ন করে। অবশেষে ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রবর্তনের মাধ্যমে পুরো গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের সরাসরি আওতায় নিয়ে আসে। এটা সবারই জানা কথা যে, সে সময় চারটি দৈনিক সংবাদপত্র বাদে সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়। ওই চারটি সংবাদপত্রও সরকারের অধীনে নতুন ব্যবস্থাপনায় প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয়। সে সময় সংবাদপত্র সর্বাত্মকবাদের কবলে পড়েছিল বললে অতিরিক্ত হয় না। এই জাতির দুর্ভাগ্য, ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পরে যখন তারা আবার ক্ষমতায় এলো তখনো তাদের নিষিদ্ধ মানসিকতার এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। সে সময় প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক বাংলা বন্ধ করে দেয়া হয়। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ নিজস্ব মালিকানায় প্রকাশিত হলো। দৈনিক বাংলা সাংবাদিকরা প্রকাশ করতে চাইলেও সে অনুমতি দেয়া হয়নি। আবারো যখন ২০০৮ সালের নীল নকশার নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতাসীন হয়, তখন থেকে নতুন করে গণমাধ্যম দলন শুরু হয়। বিএনপির পত্রিকা ‘আমার দেশ’ বেআইনিভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। একপর্যায়ে হেফাজতে ইসলামের রক্তাক্ত অধ্যায়কে কেন্দ্র করে ইসলামিক টিভি ও দিগন্ত টিভি বন্ধ করে দেয়া হলো। প্রায় সব গণমাধ্যমকে ছলে বলে কলে কৌশলে দল ও সরকারের জি হুজুরে পরিণত করা হয়।

ডিজিটাল ব্যবস্থায় যখন প্রযুক্তিগত কারণে মানুষ একটু স্বাধীনতা ভোগ করার প্রয়াস পায়, তখন ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়। সাংবাদিক তথা জনগণের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছিল, এটি সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না; কিন্তু দুই বছর পরে আমরা লক্ষ করছি যে, আসলে এটির উদ্দেশ্য ছিল সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ করা। আইনটির যত্রতত্র যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলা করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা, পাতি নেতা ও সিকি নেতারা। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৮৯০। মামলার বিবাদি হলেন সাংবাদিক, শিক্ষক, এনজিও ও মানবাধিকারকর্মী। রাজনীতিবিদরা পাইকারি হারে অভিযুক্ত হন। সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী বিশেষত আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে আইনটি খড়গহস্ত হিসেবে প্রায়োগিক দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক একটি গবেষণায় অতিসম্প্রতি এসব তথ্য জানা গেছে। গবেষণায় গভীরে যেসব তথ্য পরিবেশিত হয় তা রীতিমতো ভীতিকর। বোঝা যায় যে, সমগ্র সমাজে এই আইনের মাধ্যমে একটি ভীতির রাজত্ব তৈরি করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন কিছু ধারা আছে যা কেবল নাগরিক অধিকার খর্বই করে না; বরং সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। আইনটির সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ হলো, এর বেশির ভাগ ধারা অজামিনযোগ্য। গত কয়েক মাসে বেশ কিছু নামী-দামি ব্যক্তি ও সাংবাদিক খুবই করুণভাবে এই আইনের দ্বারা দণ্ড ও কষ্ট ভোগ করেছেন। পাইকারিভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার জন্য, অপমান করার জন্য এই আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হয়েছে। মার্কিনিদের ঠ্যালায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও এ কথা গলাধঃকরণ করেছেন। ‘খলের আশ^াস বাক্য কে করে বিশ্বাস’। অনেকবার আশ্বাস দেয়া হয়েছে; কিন্তু এর দাড়ি-কমাও বদলায়নি।

এই আইনের প্রয়োগ অপপ্রয়োগ শেষ হতে না হতেই আরেকটি ‘গণমাধ্যমকর্মী আইন’ রামদার মতো ধেয়ে আসছে গণমাধ্যম দলনে। প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন বিচারব্যবস্থা, শিল্প আইন ও বাংলাদেশ শ্রম আইনের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করে গণমাধ্যম ও সংবাদপত্র পক্ষ। ২০১৮ সালের অক্টোবরে এ আইনটির খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ জানান, সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে তারা আইনটি বিল আকারে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আইনটিতে সাংবাদিকদের বেতনভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ছুটিসহ নানা বিষয়ের সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এই আইনটি পাস হলে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, রেডিও ও অনলাইন মিডিয়ায় যারা কাজ করেন তাদের সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সাংবাদিক নেতারা বলছেন, আইনটি তাদের অজ্ঞাতেই করা হয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত করার সময় তাদের সাথে আলোচনাও করা হয়নি। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের এক অংশের সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, এই আইনটি করার জন্য কোনো ধরনের কোনো কমিটিতে সাংবাদিকদের রাখা হয়নি। যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়, যেমনÑ গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড এগুলো আগেও ছিল। তিনি আরো বলেন যে, এই আইনটির ফলে সাংবাদিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার হারাতে পারেন। ফলে দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য তারা আন্দোলন করতে পারবেন না। সাংবাদিকরা শ্রম আইনের সুবিধা পাবেন না। ফলে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান মনে করেন, এখন পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু তথ্য জানা গেছে। এতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং অধিকার আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন থাকতে হবে। এটা না থাকলে সাংবাদিকদের ক্ষতি হবে। আর টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানরা কলাকুশলী নয়; এদের সাংবাদিকের মর্যাদা দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, সাংবাদিকদের পেশাগত আইনি সুরক্ষাও দরকার। সেটিও আছে কি না তা স্পষ্ট নয়। ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল মন্তব্য করেন যে, অংশীজনের সাথে আলোচনা না করে এ আইন করা ঠিক হবে না। তিনি জানান, ২০১৮ সালে সাংবাদিকদের সব ইউনিয়ন থেকেই আমরা কী চাই তা লিখিতভাবে দিয়েছি; কিন্তু এরপর যখন সচিব কমিটি হয় তখন সেখানে আমাদের কাউকে রাখা হয়নি। এখন আইনের চূড়ান্ত খসড়াটিও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেয়াও হয়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে আমরা জানি না। আমরা হয়তো সংসদে ওঠার পর সংসদীয় কমিটিতে গিয়ে মতামত দিতে পারব। তখন কী হবে জানি না, কারণ সংসদীয় কমিটি নিয়ে অতীতে আমাদের ভালো-খারাপ দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমাদের মতামত গ্রহণ করা হয়নি; কিন্তু তথ্য অধিকার আইনে আমাদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি উপসংহার টানেন এভাবেÑ আইন নাই, এটা একটা কষ্ট। কিন্তু আইন করতে গিয়ে যেন খারাপ কিছু না হয়। এ দিকে প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন সংবাদপত্রের বিকাশ সঙ্কুচিত করবে বলে বিবৃতি দিয়েছে নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ‘নোয়াব’। সংগঠনটি বলছে, এই আইন পাস হলে স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্তসহ সংবাদপত্রের বিকাশকে সঙ্কুচিত করবে। বিবৃতিতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবাদকর্মীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষেত্রে একধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। এর ওপর প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন পাস হলে শিল্প হিসেবে সংবাদপত্র আরো বেশি রুগ্ণ হবে। একই সাথে সাংবাদিকদের জন্য তা হবে মর্যাদাহানিকর। গত ২৮ মার্চ জাতীয় সংসদে ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি আইন)-২০২২’ উত্থাপন করা হয়। বিলটি ৬০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী আইন নামে নতুন কোনো আইনের প্রয়োজনীয়তা নেইÑ উল্লেখ করে নোয়াব বলছে, প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইনে দেনাপাওনা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এক বা একাধিক বিভাগীয় এলাকার জন্য গণমাধ্যম আদালত স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। এই আদালতের একজন চেয়ারম্যান এবং দু’জন সদস্য থাকবেন। কর্মরত জেলা জজদের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান হবেন। দুই সদস্যের একজন হবেন গণমাধ্যমের মালিক ও আর একজন গণমাধ্যমকর্মী। উল্লেখ্য, সংবাদকর্মীদের দেনাপাওনা এবং যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শ্রম আদালত রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির মাধ্যমে গঠিত বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল বাংলাদেশের সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ ও বাক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কাজ করে আসছে। একই সাথে সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার মান বজায় রাখা ও সংশোধন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই সংস্থাটি কাজ করে থাকে। কাজেই প্রচলিত শিল্প আইন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, প্রেস কাউন্সিল এবং চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদফতরের মাধ্যমেই সংবাদপত্রের সব কার্যক্রম তদারকি করা সম্ভব। বিবৃতিতে বলা হয়, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশে সংবাদপত্র শিল্প বিকাশে নোয়াব গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে আসছে। নোয়াবের ধারাবাহিক দাবির কারণে সরকার ২০১৪ সালে সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছে; কিন্তু শিল্প সম্পর্কিত প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা সংবাদপত্র পাচ্ছে না। নোয়াবের বিবৃতির উপসংহারে বলা হয়, আমাদের জাতীয় ইতিহাস আর ঐতিহ্য সংবাদপত্র আর সাংবাদিকতা যে আজকের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তা হয়তো কেউ ভাবতে পারেনি। অথচ ৫০ থেকে ৭০ দশকের স্বাধিকার আর স্বাধীনতার সংগ্রামে পূর্বাপর অবিস্মরণীয় ভ‚মিকা রয়েছে আমাদের সংবাদপত্রের। ৯০-এর দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এমনিতেই সাংবাদিকতা পেশা অন্য আর দশটি পেশার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবাদকর্মীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে একধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। এর ওপর প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন পাস হলে শিল্প হিসেবে সংবাদপত্র আরো বেশি রুগ্ণ হবে। একই সাথে সাংবাদিকদের জন্য তা হবে মর্যাদাহানিকর। এ দিকে সাংবাদিকরা যাতে সত্য লিখতে না পারেন সে জন্য সরকার নিবর্তনমূলক আইন করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর আক্রমণ করেছে। এখন গণমাধ্যমকর্মী ও মালিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন আইন পাস করতে যাচ্ছে।

গণমাধ্যমকর্মী আইন পাস হলে দেশে নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন পাকাপোক্ত হয়ে যাবে। মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, যাতে দেশে কারো বাকস্বাধীনতা না থাকে, সরকারের বিরুদ্ধে কেউ যাতে কথা বলতে না পারে। তিনি গণমাধ্যমকর্মী আইন প্রত্যাহারের দাবি জানান।

অপর দিকে সামাজিক মাধ্যমের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণীত হতে যাচ্ছে বলে সংবাদপত্রে আর একটি প্রতিবেদন বেরিয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যম আর ওটিটি প্লাটফর্মের জন্য বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি নতুন একটি নীতিমালার খসড়া প্রকাশ করেছে। প্রস্তাবিত এই নীতিমালা নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বিটিআরসি বলছে, হাইকোর্টের নির্দেশে সামাজিক মাধ্যম এবং অনলাইন প্লাটফর্মের কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে এই নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। অনেকেই এই নীতিমালায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এতে আরো সঙ্কুচিত হবে। কারণ এখানে অপরাধের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় আইনপ্রয়োগকারীরা এটার অপব্যবহার করতে পারেন। তবে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, এই নীতিমালা নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। নীতিমালা বিটিআরসি বা তথ্য মন্ত্রণালয় নিজের উদ্যোগে করেনি। এটা হাইকোর্ট তাদের করতে বলেছে।

অপরাধের সংজ্ঞাগুলো অনেক বিস্তৃত। এর ফলে নানা ব্যাখ্যা করে নীতিমালাটি অপপ্রয়োগ হতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, কোনো একটি নতুন বিষয়কে আইনের আওতায় আনার জন্যই অপরাধের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত রাখা হয়েছে। নীতিমালায় অনলাইন প্লাটফর্মগুলো এবং এর ব্যবহারকারীদের জন্য অনেক নিয়ম-কানুন প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য এবং খবর প্রচার করলে বা পোস্ট করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হেয় করে কোনো মন্তব্য বা কটূক্তি করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, এমন কিছু করা যাবে না। রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হয় এবং আমাদের দেশের সাথে বন্ধু দেশগুলোর সম্পর্কের ক্ষতি হয় এমন মন্তব্য ও খবর সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা যাবে না। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এখানে অপরাধের সংজ্ঞা অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। সে কারণে এই নীতিমালার অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকছে। এই নীতিমালার পরিধি এতটাই ব্যাপক যে, কোনো কাজ যদি আপাতত অপরাধ না হয়ে থাকে, সেটিকেও নির্বাহী বিভাগ অপরাধ বলে গণ্য করতে পারবে। তারা এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের উদাহরণ দেন তারা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনাও কাজ করছে। এই প্রবিধানটা যদি শেষ পর্যন্ত অনুমোদিত হয়, তাহলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারও খর্ব হবে।

প্রস্তাবিত গণমাধ্যম আইন-২০২২ এবং সামাজিক মাধ্যমের জন্য যে নতুন নীতিমালার কথা বলা হয়েছে, তার আলোচনা-পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এত শত আইনের পরও সরকার নাগরিকদের জন্য সামান্য ‘স্পেস’ রাখতেও রাজি নয়। প্রস্তাবিত আইনের ভাষা পাকিস্তান আমলের সামরিক আইনের সাথে তুলনা করা যায়। সেখানে আকারে-প্রকারে ও বক্তব্যে ইঙ্গিতে বিরোধিতার জন্য কঠোর শাস্তির কথা বলা হতো। এমনিতেই ২০১৫ সালে সংশোধিত পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের কিছু মৌলিক নীতিমালাকে ‘অলঙ্ঘনীয়’ বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন ও নীতিমালার বিষয়ও একই রকম। যখন দেশের সর্বোচ্চ আইনে ওই রকম নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে, তখন এসব খুচরো আইন ও তথাকথিত নীতিমালার প্রয়োজন ও প্রয়োগ সীমাবদ্ধ হয়ে আসার কথা। তবুও সরকার সম্ভবত আইনের এমন ফাঁকফোকরও বজায় রাখতে চায় না, যার মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের স্ব স্ব স্বাধীনতার যথেচ্ছ প্রয়োগ ঘটাতে পারেন। বলা বাহুল্য, এসব আইন গদি রক্ষার জন্য; জনগণের জন্য নয়। আইন যদি জনগণের জন্য না হয় তাহলে সেটি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে ওঠে। সরকার কি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবে?
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement