২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট তেলিয়াপাড়া

মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট তেলিয়াপাড়া - ছবি : সংগ্রহ

সেদিন (৪ এপ্রিল ’৭১) যদি জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী, নির্ভীক, নিখাদ দেশপ্রেমিক তরুণ বাঙালি অফিসাররা সম্মিলিত হয়ে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে বৈঠক করতে না পারতেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নেতৃত্ব হয়তো ইন্ডিয়ান আর্মির হাতে চলে যেত বলেই আমার বিশ্বাস এবং বাংলাদেশের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যতীত ইন্ডিয়ার পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা এত সহজসাধ্য কখনো হতো না। দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে একসময় ধৈর্যহারা হয়ে যেকোনো পক্ষ রণেভঙ্গ দিয়ে পিছপা হতো এবং জাতি হিসেবে আমরা কোন অবস্থায় থাকতাম তা কেবল মহান সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।

তাই, হে আমাদের অগ্রজ দুঃসাহসী, নির্ভীক, নিখাদ দেশপ্রেমিক সেনা অফিসাররা! অজস্র শ্রদ্ধা, সম্মান, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা তোমাদের প্রতি। তোমাদের তথা সেনাবাহিনীর সে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আত্মত্যাগের ঋণ এ জাতি কোনো দিন শোধ করতে পারবে না। মহান আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তায়ালা তোমাদেরকে ইহজগতে ও পরকালের জীবন পরম সুখে-শান্তিতে ভরপুর রাখুন, আমিন।

পাকিস্তানি শাসন-শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার আকাক্সক্ষা তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়া শুরু করল ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর। রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ছাত্র ও রাজনীতিবিদরা, সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বেগবান করে যাচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা যার নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদ ও কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। এ দু’জন পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের বিভিন্ন গোপন খবর গোপনে জানতে পারছিলেন পাকিস্তানে অবস্থানরত সিনিয়র বাঙালি জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিনের কাছ থেকে। তারা গোপনে গোপনে বহু বৈঠক করে যাচ্ছিলেন এবং অবসরপ্রাপ্তদের ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেছিলেন সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। জেনারেল মজিদ ও কর্নেল ওসমানী যখন বুঝতে পারলেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের বৈঠক কেবল পাকিস্তানিদের সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সময় ক্ষেপণের পন্থা, ২৩ মার্চ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর প্লাজায় তারা অবসরীদের নিয়ে আয়োজন করলেন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিশাল এক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। দু’জনের জ্বালাময়ী বক্তব্যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো সবার মধ্যে। উল্লেখ্য, এ দু’জন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যও ছিলেন। দেশ স্বাধীন করার দৃপ্ত শপথের পর তারা মার্চপাস্ট করে রওনা দিলেন ৩২ নম্বর রোড, ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের উদ্দেশে। বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিলেন স্বাধীনতার তরবারি। এরপর পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হলেন জেনারেল ইশফাকুল মজিদ। কোনো রকমে গ্রেফতার এড়িয়ে ২৫ মার্চ রাতে ওসমানী পালিয়ে গেলেন কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় এবং সেখান থেকে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভারতের আগরতলা।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ ঘোষণা : ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ চালায় নিরীহ জনগণের ওপর এবং শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা। এ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আটটি ব্যাটালিয়নের মধ্যে মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের লাহোর, করাচিতে ছিল তিনটি ব্যাটালিয়ন, বাকি পাঁচটির অবস্থান ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এ পাঁচটি ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়কদের মধ্যে দু’জন ছিলেন বাঙালি। বাকি তিনজন পাকিস্তানি উর্দুভাষী অবাঙালি। বাকি দুই ব্যাটালিয়নের দুই অধিনায়কই পাকিস্তানিদের কাছে প্রচণ্ড চাপে আত্মসমর্পণ করেন এবং বহু সদস্য পাকিস্তানিদের হাতে শহীদ হন। কিন্তু বাকি বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের নিয়ে এ পাঁচটি ব্যাটালিয়নই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল, ২৮ মার্চ সৈয়দপুরে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান বীর উত্তম (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাঁচটি ইউনিট পাঁচ স্থানে। যুদ্ধ তো এত সহজ বিষয় নয়। একটি শক্তিশালী দানবের মতো, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ তো বিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাওয়া যায় না। সফলকাম হওয়া বা শত্রুকে পরাজিত করার অদম্য লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য একক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করার ভীষণ প্রয়োজন ছিল সে সময়ে। তদুপরি, যুদ্ধের ময়দানে তখন পাঁচটি ইউনিটের কমান্ডই ছিল মেজর ও ক্যাপ্টেনদের হাতে। তাদের জন্য মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে সে সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। জেনারেল ইশফাকুল মজিদ গ্রেফতার হওয়ার ফলে তখন সর্বজ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার ছিলেন কর্নেল ওসমানী যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কাশ্মির যুদ্ধ ও ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কমান্ডার। তিনি ও অন্য সব অফিসার একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ৪ এপ্রিল একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

২৫ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে থেকেই সব রাজনীতিবিদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শুরু করেছিলেন। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর পুরো জাতিই নেতৃত্বশূন্য হয়ে এক মহা-অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এমনই এক পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহর রহমত নাজিল হয় বাংলাদেশের ওপর।

ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়ার ঐতিহাসিক দিন : ২৫ মার্চের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল ৪ এপ্রিল ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল তেলিয়াপাড়া। এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মাধবপুর থানা বা উপজেলার অন্তর্গত, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক কিংবা তেলিয়াপাড়া রেলস্টেশন থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার অভ্যন্তরে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা স্থানে অবস্থিত, তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজার বাংলো। এ বাংলোয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বৈঠক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ম্যানেজারের নাম মুহাম্মদ আবদুল করিম এবং আরেকজন করিৎকর্মা ব্যক্তি ছিলেন মুহাম্মদ আবদুর রফিক (যার ছেলে এম এ মোনায়েম বর্তমানে পদ্মা সেতুর কন্সালট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার) যিনি কো-অর্ডিনেটরের ভূমিকা পালন করেন। এখানে উপস্থিত হন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাসহ ২৭ জন বীর সেনানী, যারা ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগঠক অকুতোভয় সিপাহসালার। এ সভা অনুষ্ঠিত না হলে এবং জেনারেল ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক ও প্রবাসী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া না হলে মুক্তিযুদ্ধ একটি বিশৃঙ্খল যুদ্ধে পরিণত হতো নিঃসন্দেহে।

আগে থেকেই এখানে অবস্থানরত মেজর খালেদ মোশাররফ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান আশ্রাফ আলীকে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাওয়ার মতো একটি রাস্তা তৈরি করার নির্দেশ দেন। নির্দেশমতো চা-বাগানের শ্রমিকদের দিয়ে জঙ্গল কেটে রাস্তা নির্মাণ করা হয়। প্রথম ২ এপ্রিল কর্নেল ওসমানী সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় পৌঁছেন। চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ তার সদর দফতর প্রথমে মাধবপুর ডাকবাংলায় স্থাপন করেন। সেখান থেকে পূর্ব যোগাযোগের ভিত্তিতে সীমান্ত এলাকায় তেলিয়াপাড়া বিওপির কাছে, ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সাথে তার সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়। উভয়পক্ষের আলোচনায় ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের একটি সমন্বয়সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। তিনি ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সহযোগিতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত সেনা কর্মকর্তা ও ভারতীয় সরকারের প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রথমে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর কে এম শফিউল্লাহ ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া এসে চতুর্থ বেঙ্গলের সাথে যৌথভাবে সদর দফতর স্থাপন করেন। এরই মধ্যে তেলিয়াপাড়ায় কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সমবেত হন।

১ এপ্রিল বিকেলে ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে তেলিয়াপাড়া হেড কোয়ার্টারে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা, মেজর কে এম শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা করে কর্নেল ওসমানীর সীমান্ত অতিক্রম এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমানের রামগড়ে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংবাদ দেন। ২ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া সীমান্তের ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’ বিএসএফের আইজি এবং আগরতলার ডিসি মি. সায়গল এসে মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়াত জামিলের সাথে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেন। ৪ এপ্রিল সকালের মধ্যেই সেনা কর্মকর্তাদের সবাই তেলিয়াপাড়া বাংলোতে উপস্থিত হন। ১০টার দিকে ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উমেষ সায়গল বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে সাথে নিয়ে তেলিয়াপাড়াস্থ সেনা সদরে এসে উপস্থিত হন। বেলা ১১টায় শুরু হয় ঐতিহাসিক সভার কার্যক্রম।

ঐতিহাসিক ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন কর্নেল ওসমানী, এমএনএ, লে. কর্নেল (অব:) এম এ রব, এমএনএ, লে. কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন আবদুুল মতিন, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, লে. হেলাল মোর্শেদ খান, লে. নাসিরউদ্দিন, লে. মাহবুব, লে. আনিস, লে. সেলিম, লে. সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রমুখ। এ ছাড়াও এখানে উপস্থিত ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার)। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে, ব্রিগেডিয়ার শুব্রমানিয়ম ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উমেষ সায়গল। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মৌলানা আসাদ আলী, এমএনএ, মোস্তফা আলী, এমএনএ, মানিক চৌধুরী, এমএনএ, এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, এমএনএ।

সভার কার্যক্রম শুরু হলে এর লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ। ঐতিহাসিক এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা ছিল নিম্নরূপ-
১. অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ : সভায় উপস্থিত সেনা কর্মকর্তারা সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য
ব্রিগেডিয়ার পান্ডের কাছে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রেশন সরবরাহের আবেদন জানান। এ ব্যাপারে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতিসাপেক্ষে সীমিত আকারে হালকা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের আশ্বাস দেন।
২. সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি : মুক্তিকামী হাজার হাজার ছাত্র ও যুবকের সামরিক প্রশিক্ষণদানের লক্ষ্যে সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ ব্যাপারে সভায় উপস্থিত আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্র্রেট সায়গল ভারতীয় ভূখণ্ডে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও শরণার্থী শিবির স্থাপনের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

৩. সর্বাধিনায়ক হিসেবে কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে নির্বাচিত করা ও একক কমান্ড চ্যানেল প্রতিষ্ঠা : সভায় বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যদের একটিমাত্র কমান্ড চ্যানেলে এনে সমম্বিত প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও সর্বাধিক অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের (ঈড়সসধহফবৎ রহ ঈযরবভ) দায়িত্ব দেয়া হয়।
৪. মুক্তিযুদ্ধ মনিটরিং সেল গঠন : ব্রিগেডিয়ার পান্ডে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় যুদ্ধরত বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কোথায় কী ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চলছে তা নিয়মিত মনিটরিং করার দায়িত্ব নেন। তিনি সীমান্তবর্তী বিএসএফের কর্মকর্তাদের বিদ্রোহী বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সাহায্যের নির্দেশ দেবেন বলেও আশ্বাস দেন।

৫. চারটি সামরিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা : উপস্থিত বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তারা এ দিনের কনফারেন্সে দেশটিকে চারটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একজন করে সেনা কর্মকর্তা নির্বাচিত করেন।
৬. কমান্ডার নিয়োগ ও দায়িত্ব বণ্টন : বৃহত্তর চট্টগ্রাম,পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে। বৃহত্তর কুমিল্লা, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফকে। বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর শফিউল্লাহকে। বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে।

৭. জিয়াউর রহমানের সৈন্য বৃদ্ধি : চট্টগ্রাম বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমানের সাহায্যার্থে ওই দিনই ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানি ও ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি রামগড়ের উদ্দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ওই রাতেই বিএসএফের গাড়ি দিয়ে এ দু’টি কোম্পানিকে ভারতীয় এলাকা হয়ে রামগড়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেন।
৮. প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তাব : ওই সভায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সেনা সদস্যদের বিদ্রোহকে আইনানুগ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সীমান্ত অতিক্রমকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়। এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

৯. কর্নেল ওসমানীকে রাজনৈতিক সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব অর্পণ : সভায় সর্বসম্মতিক্রমে কর্নেল এম এ জি ওসমানী একজন নির্বাচিত এমএনএ বিধায় তাকে শিগগিরই সীমান্ত অতিক্রমকারী অন্যান্য গণপ্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করে একটি সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তমজি, ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ ব্যাপারে কর্নেল ওসমানীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বলে জানান।

১০. পরবর্তী পর্যালোচনা বৈঠকের সিদ্ধান্ত : কনফারেন্সে আলোচ্য বিষয়গুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনার জন্য ১০ এপ্রিল একই স্থানে আরেকটি কনফারেন্স অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের আগে। তাই নিকটাতীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উদাহরণ বিশ্লেষণ করে সভার লিখিত আকারে কোনো সিদ্ধান্ত সংরক্ষণ করা হয়নি। মৌখিকভাবে বাহিনীর সংগঠন, নেতৃত্ব ও যুদ্ধ পরিচালনার যে সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন পায়। ১১ এপ্রিল নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণে এ সভার সিদ্ধান্তের কিছু অংশ উচ্চারিত হয়েছিল। পরে এ সভার সিদ্ধান্তগুলোকে পরিবর্ধন, পরিমার্জন, সংশোধন, সংযোজনের মাধ্যমে আরো সময়োপযোগী করে তোলা হয়। এ সভা আমাদের বাহিনীকে সাংগঠনিক ধারণা দেয় এবং তা ‘মুক্তিবাহিনী’ পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
ওসমানী কর্তৃক পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা : ওই বৈঠক শেষে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। দেশকে স্বাধীন করার শপথবাক্যও সবাইকে পাঠ করান তিনি। ওই সভাতেই একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার সরিয়ে নেয়া হয়।

তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় সেনা বৈঠক : ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সভায় উপস্থিত প্রায় সবাই ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ সভাটি প্রথম সভার সিদ্ধান্ত মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। ওই সভার সিদ্ধান্ত ছিল-

সভার শুরুতেই গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠনের ব্যাপারে তিনি কতদূর অগ্রসর হয়েছেন, তা জানাতে কর্নেল এমএজি ওসমানীর কাছে অনুরোধ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়টি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রমকারী বেশ কিছুসংখ্যক এমএনএ এবং এমপিএর সাথে আলোচনা হয়েছে। বেশির ভাগ গণপ্রতিনিধিই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন। তাজউদ্দীন আহমেদ শিগগিরই একটি বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেছেন।

সভায় ভারতীয় প্রতিনিধিরা জানান যে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র ও যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিতে শুরু করেছে। এদের জন্য এরই মধ্যে অস্থায়ীভাবে বেশ কিছু ক্যাম্পও স্থাপন করা হয়েছে। শরণার্থীদের জন্যও ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিএসএফের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বিএসএফের সেনারা বিদ্রোহী বাহিনীর সহযোগিতায় অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরপরই ভারতীয় পক্ষ থেকে সাহায্যের পরিমাণ বাড়বে বলে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে সবাইকে অবহিত করেন।
চরম দুর্দশাগ্রস্ত দেশের ক্রান্তিকালে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে অনুষ্ঠিত সেই সভা দু’টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে কেবল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রথম সমন্বয় সভাই নয়, বরং মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক ভিত রচনার ক্ষেত্রে প্রথম মাইলফলক হিসেবেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তরুণ সেনা অফিসারদের অত্যন্ত দূরদর্শী ও ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত দেশকে স্বাধীন করার জন্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই তেলিয়াপাড়া চা-বাগান মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিসাক্ষী ও টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চির উজ্জ্বল করবে ইতিহাসের পাতাকে।

সূত্র : রণাঙ্গণের সম্মুখসারির মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার ও তাদের রচিত গ্রন্থ।
লেখক : সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

hoque2515@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement