২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হযবরল রাজনীতির নয়া ধারাপাত

- ছবি : নয়া দিগন্ত

পুলিশ বিভাগে কর্মরত রাষ্ট্রের দু’জন কর্মচারীর কথাবার্তা নিয়ে ইদানীংকালে বেশ সরব ও মুখরোচক আলোচনা চলছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর যারা আশা করেছিলেন যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকচারীরা সম্ভবত দলীয় লেজুড়বৃত্তি করবে না এবং ঘুষ-দুর্নীতি-টাকা পাচারের ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে সতর্ক আচরণ করবে, যারা আরো আশা করেছিলেন যে, জনগণের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকা দিয়ে যাদের বেতন দেয়া হয় তারা জনগণের সাথে বেঈমানি করে সেসব লোকের সাথে হাত মেলাবে না যারা জনগণের হক নষ্ট করে। আশাবাদী লোকজনের আশার গুড়ে বালি দিয়ে হাল আমলে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা তাদের কথাবার্তা-আচার-আচরণ, অঙ্গভঙ্গি এবং চিন্তাচেতনায় এমন কতগুলো মৌলিক পরিবর্তন এনেছে, যা সরকারি চাকরিবিধি বা রুলস অব বিজনেসের ধারাপাতই বদলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীরা এখন মহাকালের শ্রেষ্ঠতম সময় পার করছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর কোনো দেশের সরকারি কর্মচারীরা বাংলাদেশের বর্তমান জমানার কর্মচারীদের মতো এতটা স্বাধীন-সার্বভৌম, সুখী ও সমৃদ্ধিশালী ছিল না। সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের চেহারা ও সুরতে যে লাবণ্য ফুটে উঠেছে এবং বিত্ত ও বৈভবের কারণে তাদের পোশাক-আশাকে এতটা চমক এসেছে যার ফলে একজন নাবালকও চোখ বুজে বলে দিতে পারে যে লোকটি সরকারি দফতরের কর্মচারী। মেহনতি মানুষের ঘামের গন্ধ, ব্যবসায়ীদের চিন্তাক্লিষ্ট ও হতাশাজনক মুখমণ্ডল এবং অন্যান্য শ্রোণপেশার মানুষের জীবনযুদ্ধের গ্লানির যে চিহ্ন তা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নেই। বরং বাজারের সবচেয়ে ভালো মুলোটা-কলাটা-মাছ-গোশত-দুধ-ডিম তাদের দেখলে যেভাবে আয় আয় সোনামণি বলে ডাকতে থাকে তাতে অন্য শ্রেণিপেশার লোকজন লজ্জা-ভয়-আতঙ্কে বাজারমুখী হওয়ার আগে শতবার চিন্তা করে থাকে।

সরকারি কর্মচারীদের সাম্প্রতিক বিবর্তনের কারণে আমাদের দেশের রাজনীতির ধারাপাতও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আগেকার দিনে যাদের মধ্যে নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলি ছিল কেবল তারাই রাজনীতি করত। আর এখনকার রাজনীতির নয়া ধারাপাত হলো তুমি কোন সরকারি কর্মচারীর খালু-মামু-ভাগিনা, শ্যালক, ভগ্নিপতি অথবা ভাই-ব্রাদার তার ওপর নির্ভর করছে তোমার রাজনীতির খোশনসিব। তা ছাড়া তুমি দুর্নীতি, জুয়া, ক্যাসিনো, অর্থপাচার, নারী কেলেঙ্কারি, গুম-হত্যা-ধর্ষণ ইত্যাদি কুকর্মের মুখপাত্ররূপে নিজেকে কতটা জাহির করতে পারো তার ওপরও তোমার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে। ফলে রাজনীতির যে ঐতিহ্য অর্থাৎ মাঠে ময়দানে গিয়ে গণমানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা এবং জনগণের সেবা করার জন্য রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এখন রীতিমতো অতীতকালের ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানকালের বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছাই হলো রাজনীতির চূড়ান্ত পরিণতি। তারা যদি বলে দেয় ওমুক লোক মুক্তিযুদ্ধ করেনি। ব্যস! তাতেই কেল্লা ফতে। আবার তারা যদি সার্টিফিকেট দেয় ওমুকে ১৯৭১ সালে কলকাতার ধর্মতলা-পত্মীতলায় ছিল না। সে ওমুক স্থানে বটগাছের ডালে বসে মেশিনগান দিয়ে ৩৩ জন রাজাকার, ১৩ জন খান সেনাদের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে তবে সেই কাহিনী অস্বীকার করার হিম্মত গাঙেয় বদ্বীপে নুরা পাগলাও দেখাতে পারবে না। তারা পদ্যকে গদ্য বানাতে পারে আবার গদ্যকে পদ্য বানিয়ে জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত করতে পারে। তারা গাইতে পারে-নাচতে পারে এবং ইচ্ছেমতো নাচাতেও পারে। তারা অদ্ভুতভাবে তুড়ি বাজাতে পারে এবং তুড়ি মেরে গভীর রাতে গায়েবি ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্সে বিপ্লব ঘটাতে পারে। তারা উন্নয়নের মহাকাব্য রচনা করে সেই কাব্যের সুর লহরীতে জাদুময়তা সৃষ্টি করে মানুষকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে মনের আনন্দে জিডিপির হিসাব কষতে কষতে টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছোটার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের উল্লেখিত সাতকাহন এখন মহাবিশ্বের জন্য রীতিমতো রোলমডেলে পরিণত হয়েছে। কর্মচারী এবং তাদের অনুকম্পায় যারা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে অথবা রাজনীতি করার সৌভাগ্য লাভ করেছে তা কিভাবে পরস্পরের পরিপূরকরূপে দিনকে দিন শক্তিশালী হয়ে পড়ছে এবং তাদের শত্রুদের মুখে ছাই মেখে কিভাবে তারা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার এবং আধ্যাত্মিক খানকাগুলোতে নিরলস গবেষণা শুরু হয়েছে। দুনিয়ার সব লাজ-লজ্জা, ভয়-ভীতি, পরিণাম ইত্যাদি উপেক্ষা করে একজন সুবিধাভোগী কিভাবে পরস্পরের জন্য নিজেদের সঁপে দিতে পারে সেই রহস্য জানার জন্য বিশ্বের অনেক দেশ এখন বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রীয় কর্মচারী এবং তাদের তাঁবেদার রাজনীতিবিদদের নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের মধ্যে এখনো যারা সৎ ও যোগ্যরূপে কোনো মতে টিকে আছেন তারা প্রায় প্রতিদিনই ঘরে-বাইরে এতটা বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে সময় কাটান যার ফলে তাদের অস্তিত্ব অনাগত দিনে আদৌ থাকবে কি না তা এখনই বলা মুশকিল। অন্য দিকে যারা রাজনীতির ময়দানে ন্যায়নীতির কথা বলেন, একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড ও আচার অনুষ্ঠানে সৎ ও যোগ্য লোকের অংশগ্রহণের কথা প্রচার করেন তারা চলমান দুর্নীতির রাহুগ্রাসের দাপটে অক্সিজেন-শূন্য হয়ে মূলধারার রাজনীতির বাইরে ছিটকে পড়তে বাধ্য হয়েছেন।

আমাদের বাংলাদেশে একসময় হাবসিদের শাসনব্যবস্থা ছিল। পরপর চারজন হাবসি ক্রীতদাস সুবে বাংলার সিংহাসনে বসে দেশবাসীকে হাতে কলমে শিখিয়ে গেছে যে, কিভাবে ক্রীতদাস হয়ে প্রথমে মালিকের ওপর প্রভুত্ব করা যায় এবং সুযোগ বুঝে কিভাবে মালিককে হত্যা করে ক্ষমতার মসনদ দখল করা যায়। ১৪৮৭ সাল থেকে ১৪৯৪ সাল পর্যন্ত মোট আট বছর ধরে আফ্রিকা থেকে কিনে আনা ক্রীতদাসরা কিভাবে বাংলা শাসন করেছিল সেই কাহিনী ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই খুব ভালো করে জানেন; কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ ঘটনার নেপথ্য কাহিনী নিয়ে মাথা ঘামান না। অর্থাৎ কেউ প্রশ্ন করেন না যে, কেন আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস এনে রাজপ্রাসাদ ও রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাহারাদার নিয়োগ করা হয়েছিল এবং সেসব পাহারাদার কিভাবে অতি দ্রæততার সাথে পদোন্নতি লাভ করে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদপদবিগুলোতে নিয়োগ লাভ করেছিল। ইতিহাসের খুব অল্পসংখ্যক পাঠকই এই প্রশ্ন করে থাকেন যে, তৎকালীন সুলতান কেন তার যোগ্য উজির-নাজির, কোতোয়াল, সেনাপতি ও আমির ওমরাহদের বাদ দিয়ে হাবসি ক্রীতদাসদের কথা শুনতেন এবং কেন অন্ধের মতো তাদের বিশ্বাস করে তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন।

সুবে বাংলার হাবসি শাসনের ইতি ঘটেছে ১৪৯৪ সালে। কিন্তু সেই শাসনের কলঙ্ক আমাদের ভূখণ্ডকে প্রায়ই গ্রাস করে ফেলে এবং আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য, গণতন্ত্র, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুকে সময় ও সুযোগ পেলে কালবৈশেখীর তাণ্ডবে তছনছ করে দেয়। তারপর কয়েক যুগ ধরে মেহনতি মানুষের রক্ত, মেধাবীদের আত্মত্যাগ, নেতাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের সমন্বয়ে যখন সবাই একটু আলোর মুখ দেখতে শুরু করে আর তখনই দূর থেকে ভেসে আসে অশুভ শক্তির পিলে চমকানো আওয়াজ, যা কিনা এই জনপদের রাজনীতির ব্যকরণ বারবার তছনছ করে দেয়।
সুবে বাংলার রাজনীতির হাজার বছরের উত্থান-পতনের সব ইতিহাস ছাপিয়ে হাল আমলে যে নতুন ধারাপাত রচিত হয়েছে তা শেষপর্যন্ত কতদিন টিকবে এবং এই ধারাপাতের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত আমাদের কোন গন্তব্যে নিয়ে যাবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ এখানে বিভেদ ও বিসম্বাদের রাজনীতির কারণে ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে এবং ক্ষমতার বাইরে থেকে রাজনীতির নামে হাপিত্যেশ করা এবং জুলুম নির্যাতন ভোগ করা আরেকটি গ্রুপ ক্রমেই মানবেতর দুর্যোগ দুর্দশার মধ্যেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে বিস্ময়কর সফলতা দেখিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের অনুকম্পায় যারা রাজনীতি করে তাদের মধ্যেও তিনচারটি শ্রেণী রয়েছে। ক তফসিলভুক্ত সুবিধাভোগীরা মোটামুটি আনন্দ-ফুর্তির মধ্যেই দিন কাটাচ্ছে। খ তফসিলভুক্তরা রাষ্ট্রীয় পদপদবি ছাড়া কেবল দলীয় পদপদবি ব্যবহার করে টেন্ডার, ব্যবসাবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, মাস্তানি ইত্যাদি করে সময় কাটাচ্ছে এবং মাঝে মধ্যে নিজ তফসিলভুক্ত লোকজনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে কখনো নিজেরা মরছে কি অন্যকে মারছে।

সুবিধাভোগী রাজনীতির গ তফসিলভুক্তরা সীমাহীন অপমান লাঞ্ছনা বঞ্চনা এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়ে কতটা মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে তা তাদের কথাবার্তা আচার আচরণে ফুটে ওঠে। তারা প্রায়ই অভিযোগ করে যে, ক তফসিলভুক্তরা তাদেরকে দাসী-বান্দীর মতো মনে করে, অন্য দিকে যেসব রাষ্ট্রীয় কর্মচারীর বদান্যতায় ক্ষমতার ডালপালা নড়াচাড়া করে এবং ক্ষমতার ফসলের মাঠে আগাছা পয়দা হয় সেই সব কুশীলব গ তফসিলভুক্তদের কী হিসেবে মূল্যায়ন করে তা অবশ্য তফসিলভুক্ত হরিজনরা আর্তচিৎকার করে পাবলিককে জানায়নি।

উল্লিখিত অবস্থায় দেশের রাজনীতির যে হযবরল পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে তার ফলে সরকারি কর্মচারীরা প্রকাশ্য সভামঞ্চে মন্ত্রীদের বসিয়ে সগর্বে বলতে পারছে যে, আওয়ামী লীগ জানে না কিভাবে কথা বলতে হয় এবং কিভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে হয়। তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা প্রতিদ্বন্দ্বীদের বেইজ্জতি করার জন্য এবং তাদের রাজনৈতিক মাঠ থেকে বিদায় করার জন্য কী করা উচিত এবং কী বলা উচিত সে ব্যাপারে নাতিদীর্ঘ নসিহত যেভাবে উপস্থাপন করেছে তার ফলে মনে হচ্ছে আমাদের দেশ কাল হয়তো রাজনীতির নয়া ধারাপাতের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার অতিসত্বর নির্বাচন হওয়া দরকার : আমীর খসরু জেলখানায় হত্যা : শেখ হাসিনা ও জেল সুপারসহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন ডিএসইসি সদস্যদের জন্য ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত জবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক হিমেল, সদস্যসচিব আরেফিন এমন একটি দেশ চাই যাকে কেউ ভাগ করতে পারবে না : জামায়াত আমির কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় আটক ৫ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে হাসপাতালে রিজভী জাতীয় ফুটবল দলকে আওয়ামীকরণ করে ধ্বংস করা হয়েছে : মেজর হাফিজ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের নতুন ডিজি আবু সুফিয়ান আ’লীগের মতো অপকর্ম করব না, বাংলাদেশ গড়ব : পিন্টু

সকল