২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পোষাতে করোনার ক্ষতি শিক্ষায় চাই নতুন গতি

-

করোনা তছনছ করে দিয়েছে আমাদের সাজানো পৃথিবী। রাজনীতি সচল হবে। অর্থনীতি উদ্ধার করা যাবে। সংস্কৃতি পাবে নতুন দ্যোতনা; কিন্তু যে ক্ষতি হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থায় তা পুষিয়ে নেয়া কঠিন। এই বিপদ আপদের মধ্যেও পৃথিবীর অন্যত্র শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু আমাদের এখানে শাসককুলের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে লেখাপড়ার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশে করোনার আঘাত একসাথে সবসময় সর্বত্র অনুভূত হয়নি। গ্রাম আর শহরে ব্যবধান থেকেছে। উপকূল আর পাহাড়ে করোনা দেখা দেয়নি একসাথে। অথচ সরকার টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাকে তারা ক্ষমতার পরিপূরক ভেবেছে। তাই, সিদ্ধান্ত নিতে তুঘলকি কারবার করেছে বারবার। সব ভালো যার শেষ ভালো। এখন সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘লেট বেটার দ্যান নেভার’।

এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার পর নতুন চিন্তা ও চেতনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। যে ক্ষতি হয়েছে ইতোমধ্যে সে ক্ষতি পোষাতে বাড়াতে হবে গতি। এই উপলব্ধি শিক্ষকদের, শিক্ষাব্যবস্থাপকদের এবং অভিভাবকদের। এই লক্ষ্যে তিন শক্তিকে একযোগে একসাথে কাজ করতে হবে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, একটি সর্বব্যাপী এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বিগত করোনাকালে শিক্ষাক্ষেত্রে তিন ধরনের ক্ষতি হয়েছে। প্রথমত অ্যাকাডেমিক রেকর্ড বা সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে, দ্বিতীয়ত বাস্তব লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এবং তৃতীয়ত সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে। এ ধরনের ত্রিমাত্রিক ক্ষতি আর কোথাও হয়নি। ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে বাংলাদেশ হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বিতীয় দেশ। আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় শিক্ষা মানেই সশরীরী উপস্থিতি। স্বাভাবিক অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে; অস্বাভাবিক অবস্থায় শিক্ষা গ্রহণে আমাদের শিক্ষার্থীরা অভ্যস্ত নয়। সে জন্যই অনলাইন ক্লাস সফল হয়নি আর দূরশিক্ষণ সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। করোনাকালে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেনি; হেলায় খেলায় কাটিয়েছে সময়। অনলাইন গেমে আসক্তি বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা - এটি পুরনো প্রবাদবাক্য। ছাত্রছাত্রীরা এই অলস সময় সব কিছুই করেছে পড়াশোনা বাদে। ইতোমধ্যে অনেকে নেমেছে উপার্জনে। বাল্যবিয়ে বেড়েছে গ্রামগঞ্জে। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়েছে নগরবাসী। করোনাকালে এসব ক্ষতির চেয়ে আরো স্থায়ী ক্ষতি হয়েছে সরকারি নির্বোধ সিদ্ধান্তে। অটো পাসের অক্টোপাস সারা জীবন ধরে তাড়িয়ে বেড়াবে শিক্ষার্থীদের। সিলেবাস সঙ্কুচিত করতে করতে তলানিতে ঠেকেছে। শিখেনি কিছুই অথচ ঠেলে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে উপরের ক্লাসে। যে ছেলেটি ২০২০ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত তাকে এখন পড়তে হচ্ছে সপ্তম শ্রেণীতে। সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে তিনটি ধাপে চেষ্টা করতে হবে। এক. শিক্ষার্থীর পড়ার সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। দুই. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অথচ এখন শোনা যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছুটি দু’দিন হবে। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে সময় দেবে? এটি আরেকটি সর্বনাশের সিদ্ধান্ত। তিন. অভিভাবক তথা নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্রই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ রয়েছে। সেসব যথাযথ কর্তৃপক্ষকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত দিয়ে দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে। অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তা হলো, বেশি বেশি হোম টাস্ক প্রদান, বেশি বেশি ক্লাসের সময় এবং বেশি বেশি পরীক্ষা নেয়ার মাধ্যমে এগিয়ে থাকার। এসব ক্ষেত্রে খুব দ্রুতই গৃহীত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। স্থান কাল পাত্র ভেদে এ ধরনের ব্যবস্থার রকমফের হতে পারে। আরো বৃহত্তর পরিসরে ভাবতে গেলে মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদফতরগুলো, বোর্ডগুলো এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের উন্নয়নমুখী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেমন, প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষা বা বৃত্তি পরীক্ষা না নেয়া। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষা সাময়িকভাবে বাতিল হয়েছে। এটি যেন আর ফিরে না আসে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যত্র অর্থাৎ মাদরাসা ও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার ক্ষেত্রেও এই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হতে পারে। যদিও কষ্টকর, প্রতিটি স্কুল প্রতিটি ছাত্রের ব্যাপারে যদি পৃথক পৃথক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়। ইতোমধ্যে এ ধরনের সবল ও দুর্বল বিভাজনের পরামর্শ এসেছে। গ্রুপ করে প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের বিষয়ানুগ এবং শ্রেণিভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে পারে। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত ফি নিতে পারে। এমনিতেই প্রচলিত ব্যবস্থায় যেমন এসএসসি পরীক্ষার আগে বিশেষ ক্লাস বা কোচিং করানো হয়। মনে রাখতে হবে, ‘নো মোর অনলাইন ক্লাস’। অনলাইন ক্লাসে অমনোযোগিতা, অনুপস্থিতি ও ফাঁকি দেয়ার সুযোগ রয়েছে। এটি আমাদের কালচারে মানায় না। তা ছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের অনগ্রসরতা রয়েছে। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস গ্রহণ করতে পারে না। বিগত ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে পাঠ্যসূচিও পরিবর্তন করা যায়; সঙ্কোচন নয়। মৌলিক বিষয়ে সঙ্কোচন কাম্য হতে পারে না। তবে অনাবশ্যক ও অতিরিক্ত বিষয়টির ক্ষেত্রে চিন্তা করা যায়। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষকদেরকে অতিরিক্ত প্রণোদনা দেয়া উচিত। সরকার করোনাকালের প্রণোদনা অনেক ক্ষেত্রেই দিয়েছে। পরে শিক্ষা কার্যক্রম যাতে করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে সে জন্য বিভিন্ন স্তরভিত্তিক পারিতোষিকের ব্যবস্থা করা যায়। এ ক্ষেত্রে স্তরক্রমটা হতে পারে - প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্রিক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার প্রণোদনা থাকতে হবে। এটা আশার কথা যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কী কার্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় - তা নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করছে।

যেকোনো বিষয় সফলতা পেতে হলে প্রয়োজন আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, পরিকল্পনা ও সমন্বয়শীলতা। আমরা আগেই বলেছি, করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষার্থী, নীতিনির্ধারক তথা শিক্ষাব্যবস্থাপক ও শিক্ষকদের আন্তরিকতা, পরিকল্পনা ও সমন্বয়শীলতা প্রয়োজন; বিশেষত শিক্ষকদের ওপর এর সফলতা অনেকাংশেই নির্ভরশীল। আমরা আশা করব, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরে করোনাকালের শিক্ষা ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার অনিবার্যতা অনুভ‚ত হবে। সবাই মিলে শিক্ষাই যে জাতির মেরুদণ্ড, এই আপ্তবাক্য সফল করবেন - এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement