২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বাংলাদেশ কৌশলগত সঙ্কট কিভাবে পার হবে?

- ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ এক চরম কৌশলগত সঙ্কট সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে। ‘কারো সাথে শত্রুতা নয় সবার সাথে বন্ধুত্ব’- এ কিতাবি পররাষ্ট্র কৌশল এখন আর কাজ করছে না। বড় শক্তিগুলোর বৈশ্বিক স্বার্থগত দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যেসব পক্ষের সাথে ন্যূনতম ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষাও আর সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের জন্য এ সঙ্কট সাধারণ বিষয় হিসেবে হাজির হয়েছে, তবে ভূ-কৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর জন্য সমস্যা অধিকতর জটিল আকার নিয়েছে। বাংলাদেশ এমনিতে বঙ্গোপসাগরীয় বদ্বীপ অঞ্চলের এমন এক অবস্থানে রয়েছে যার তিন দিকে ভারত ও মিয়ানমার আর ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি দূরত্বে চীনের সীমানা। এই অবস্থানের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত ভারত-মিয়ানমারের অঞ্চল নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষমতাধর একটি পক্ষের বাফার স্টেট করার স্বপ্ন বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা
একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি জনসংখ্যা, অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও শিক্ষা আর প্রতিরক্ষা সক্ষমতা সামগ্রিকভাবে শক্তিমত্তা নিরূপণ করে। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা যার ৯৫ ভাগই একই ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করে-তা রাষ্ট্রের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ গত পাঁচ দশকে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। অর্থনীতিতে কৃষির ওপর ব্যাপক নির্ভরতার পর্ব পার হয়ে শিল্প ও সেবা খাতের ভিত্তি ব্যাপকতর হয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ছয়-সাত শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। মানবসম্পদের সূচকগুলোতেও অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। রফতানি ও রেমিট্যান্স এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, যা দিয়ে আমদানির ঘাটতি পূরণ করেও চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকছে। সার্বিক বিবেচনায় অর্থনীতি স্বল্পোন্নত তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হতে চলেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিরক্ষা বাহিনীর পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করলেও সশস্ত্রবাহিনীর বিস্তার ও অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে মূলত সত্তরের দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে। গতির কম-বেশি হওয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের শাসনকালের এ পর্যন্ত সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। তবে প্রতিবেশী মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তানের মতো অনুপাতে জাতীয় সম্পদ বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। ফলে জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের চেয়ে অনেক শক্তিমান হওয়ার পরও সামরিক শক্তির বিবেচনায় মিয়ানমার যেখানে বিশ্বে ৩৯ নম্বরে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৬-এ।

জ্ঞান প্রযুক্তি ও গবেষণায় বাংলাদেশের অগ্রগতি মিশ্র। বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক বিস্তার ঘটেলেও শিক্ষার মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। ফলে কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক শিক্ষিত বেকারত্ব ও যোগ্য ব্যক্তির অভাব দু’টিই লক্ষ্যণীয়। কৃষি বিশেষত খাদ্যশস্যে নতুন জাত উদ্ভাবনে সাফল্য এসেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এর পথ ধরে দেশের প্রয়োজনের প্রায় পুরো চাল স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে। বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো শিল্পজাত পণ্যও বাংলাদেশে অনেক খাতে তৈরি হচ্ছে। গত পাঁচ দশকে মৌলিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এর মধ্যে কাঠামোগত বিবেচনায় বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি সামরিক আমলাতন্ত্রের বিকাশও উল্লেখযোগ্যভাবে ঘটেছে। এই কাঠামোকে সুশাসন ও গণতন্ত্র চর্চার জন্য ব্যবহার করা হলে তা উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়ার মতো। কিন্তু এক দশকে গণতন্ত্র চর্চা থেকে বিচ্যুতি ও কর্তৃত্ব পরায়ণ প্রবণতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই মৌলিক কাঠামোর সক্ষমতাকে বিঘ্নিত করেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এ কথা একইভাবে প্রযোজ্য বলে মনে হয়।

সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সম্ভাবনার এক ভালো সময়ে এখনো আছে। তবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতা সেই সম্ভাবনাকে সামনে এগিয়ে নেবে না। এ কারণে বাংলাদেশ এখন যে পরিস্থিতির সম্মুখীন তাতে সতর্কভাবে সামনে এগোতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অবস্থায় এসে হাজির হয়েছে। এর মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশ-চীন, বাংলাদেশ-রাশিয়া, বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক। এর বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসি দেশগুলোর সাথে সম্পর্কেরও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বাংলাদেশের জন্য। তবে এটাকে আগের মহাশক্তিধররা অনেক প্রভাবিত করতে পারে।

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ডিনামিক্স
চীন বাংলাদেশের সাথে গত সাড়ে চার দশক ধরে কৌশলগত মৈত্রী বজায় রাখছে। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান অংশীদার চীন। ভারতের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত ও কৌশলগত বিরোধের কারণে মধ্যবর্তী ভ‚খণ্ড হিসেবে চীনের কাছে ঢাকার গুরুত্ব অপরিসীম। আর ১৭ কোটি মানুষের বাজার ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশ হিসেবেও চীনের কাছে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ উত্তর চীনা নীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে তাতে দেশটি আদর্শগত সাযুজ্যের চেয়েও রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের হিসাব-নিকাশকে পররাষ্ট্র কৌশল নিরূপণে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বেইজিং যেকোনো দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে তাদের বোঝাপড়া তৈরি করতে চায়। কোনো সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করে। বেইজিংয়ের বিবেচনায় গণতন্ত্র মানবাধিকার ইত্যাদি লালনকারী সরকারের সাথে একদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে বিশেষ মৈত্রী তৈরি হয়, অন্য দিকে এ ধরনের সরকারগুলো নানামুখী জবাবদিহিতার কারণে প্রকল্প বা অর্থনৈতিক বিষয় সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে বিলম্ব করে।

এ বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এক কেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় চীনারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরবর্তী দুই মেয়াদে সরকারের সাথে বেইজিং বিশেষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্মাণ করে। এ ধারায় মাঝে মধ্যে প্রতিবেশী ভারত ও পশ্চিমের আপত্তির কারণে ব্যত্যয় সৃষ্টি হয় তবে মৌলিকভাবে তা অব্যাহত রয়েছে এখন পর্যন্ত।

বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্কের বিশেষ দিক
রাশিয়ার পূর্বসূরি রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এক সময়কার বাংলাদেশের কৌশলগত মিত্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বফোরামে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপকভাবে সমর্থন করে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। বিশেষত বাংলাদেশের অন্যতম কৌশলগত মিত্র চীন ও ভারতের সাথে রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক থাকার কারণে প্রাকৃতিকভাবে মস্কো-ঢাকা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে এই সম্পর্কে বিশেষ ভিত্তি তৈরি হয় মিগ-২৯সহ কিছু প্রতিরক্ষাসামগ্রী কেনা দিয়ে। দ্বিতীয় মেয়াদে এটি অগ্রসর হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিশাল বিনিয়োগ চুক্তিকে কেন্দ্র করে।

পশ্চিমা বলয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ইউরোপীয় কোনো দেশের সাথে চুক্তির পরামর্শ দিয়েছিল ঢাকাকে। ভারতের সমর্থন ও অংশীদারিত্বে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সাথে এ বিনিয়োগ চুক্তি সম্পন্ন হয়। এর বাইরে রাশিয়া ও তার মিত্র দেশ বেলারুশ থেকে কিছু প্রতিরক্ষা সামগ্রীও বাংলাদেশ সংগ্রহ করেছে। আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের ঝুঁকি সৃষ্টি হওয়ার মুখে রুশ-ঢাকা সম্পর্ককে নতুনভাবে দেখা হচ্ছে। ভেনিজুয়েলা-কাজাখস্তান-মিয়ানমারের সরকার রক্ষার জন্য মস্কোর সমর্থনকে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। বড় ধরনের আন্তর্জাতিক চাপে চীন-রাশিয়া বলয় বড় ধরনের সমর্থন সৃষ্টি করতে পারে বলে ভাবা হচ্ছে।

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের টানাপড়েন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে আমেরিকান বিরোধিতার বিষয়টি বেশ প্রচারিত হলেও নানা তথ্য-উপাত্ত ও পুরনো দলিল প্রকাশে স্পষ্ট যে হেনরি কিসিঞ্জারসহ সে সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের গভীর ক্ষমতা বলয়ের একটি অংশ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র বলয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেয়। ৭০-এর দশকের মধ্যবর্তী সময়ের পটপরিবর্তনের পর এ সম্পর্ক নতুন মাত্রা নেয় ঢাকার সরকার বহুদলীয় গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ নতুনভাবে গ্রহণের মধ্য দিয়ে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর এ সম্পর্কে আরো নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করে। বলা হয়, ২০০৭ সালের পরবর্তী বাংলাদেশের ক্ষমতার পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের এজেন্ডা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রগুলোতে উপেক্ষিত থেকে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি উদ্বেগ হলো বহুদলীয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষামূলক শাসন ধারা থেকে সরে আসার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট দেশটির চীন-রাশিয়ার বলয়ের সাথে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা দেখা দেয়। দেখা যায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক সহায়তা ও রফতানি বাজারে পাশ্চাত্যের সুবিধা গ্রহণ করলেও নীতি প্রণয়ন ও কৌশলগত বিনিয়োগ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায় গত দশকটিতে। ২০১৮ সালে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে যে পরামর্শ ও প্রক্রিয়া পশ্চিমা বলয় শুরু করেছিল তার অনুসরণের পরিবর্তে ‘দিনের ভোট রাতে করে ফেলার মতো’ প্রক্রিয়া আমেরিকা ও তার মিত্রদের কাছে ভিন্ন সঙ্কেত পাঠায়।

এ সবের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতিক্রিয়ার প্রথম প্রকাশ ঘটে র‌্যাব ও এর বর্তমান-সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেন ইঙ্গিত দিয়েছেন, একই উৎস থেকে আরো বড় আঘাত আসতে পারে। এতে সামাজিক গণমাধ্যমে র‌্যাবের ওপর জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশন বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ অথবা অন্যান্য বাহিনী পর্যন্ত এর বিস্তৃতির ব্যাপারে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা বাস্তবে ঘটছে বলে সন্দেহ হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ধারাবাহিক সংলাপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটি যে খুব সহজ কোনো বিষয় হবে না তা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেই অনুমান করা যায়।

বাইডেন প্রশাসনের সাথে যেকোনো সমঝোতার দু’টি দিক থাকবে বলে মনে হচ্ছে। প্রথমটা হলো, মুক্ত অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে একটি নিষ্পত্তিমূলক সমাধান হতে হবে। দ্বিতীয়ত. কৌশলগত বিনিয়োগ নিয়েই একটি সমঝোতা হতে হবে। এর মধ্যে আমেরিকান একটি জায়ান্ট কোম্পানি মহেশখালীর স্বর্ণদ্বীপে ৫০০ একরজুড়ে বৃহদাকার একটি রিফাইনারি প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে যেখান থেকে বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক জ্বালানির পুরো চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। এই প্রস্তাবটি বাংলাদেশের সাথে আমেরিকান কৌশলগত সম্পর্ক পুনঃসংযোগ স্থাপনে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হতে পারে। মিয়ানমারের অদূরে আমেরিকান এই বিনিয়োগ প্রস্তাবকে চীন কিভাবে নেবে সেটি অবশ্য একটি বড় প্রশ্ন হতে পারে।

একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিরূপণে বাইডেন প্রশাসন এখন ভারতীয় চশমা দিয়ে না দেখে নিজস্বভাবে এখানকার বিষয়গুলো নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে বলে মনে হয়। নেপালের ক্ষেত্রেও ওয়াশিংটন সেটিই করেছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন সন্ধিক্ষণ
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসা ও থাকার ব্যাপারে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। ২০০৭ সালের শাসন ক্ষমতার ‘প্যারাডাইম শিফটে’ ওয়াশিংটনের পাশাপাশি দিল্লি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০১৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সে ভূমিকা বেশ খানিকটা একক ছিল বলে ধারণা করা হয়। এ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ উত্তর-পূর্ব ভারতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসন এবং ভারতের কানেকটিভিটি চাহিদা পূরণে সক্রিয়তাবাদী পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরবর্তী সরকার ভারতের চাহিদা ও উদ্বেগগুলোকে অ্যাড্রেস করার পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য চীনের সাথে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে থাকে।

এর ধারাবাহিকতায় পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে বড় বড় অনেক প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ হতে থাকে। ২০১৬ সালে চীনা নেতা শি জিন পিন বাংলাদেশে সফরে এসে ২৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়। ভারত এই পরিবর্তনে তার রাডার থেকে বাংলাদেশ সরে যাওয়ার আশঙ্কা করতে থাকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আয়োজন শেষ হওয়ার পর সবার আগে স্বর্ণের নৌকা নিয়ে অভিনন্দন জানাতে হাজির হন ঢাকায় নিযুক্ত চীনা দূত। দূতাবাসের নিজস্ব অনুষ্ঠানের ব্যানারে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান সাঁটিয়ে দেয়া হতে থাকে শাসকদলের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের মতো।

চীনাদের সাথে অতি মাখামাখির এই দৃশ্য এবং ২০১৮ সালের ক্ষমতা নবায়নে অতিমাত্রায় বেইজিং নির্ভরতা দিল্লির নীতিপ্রণেতাদের সংশয়ে ফেলেছে। এক দিকে তারা ভারতবান্ধব দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না, অন্য দিকে চীনের অতিশয় প্রভাব বৃদ্ধিকে ঝুঁকি হিসেবে দেখছে। এ অবস্থায় ভারতের নীতিপ্রণেতারা বাংলাদেশে মূল নেতৃত্ব পাল্টে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আরেকটি সরকার চায় বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

বিকল্প কী?
বড় বড় ক‚টনৈতিক অংশীদারদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও রশি টানাটানিতে বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নিতে পারে? কিভাবে এর স্বল্প মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পররাষ্ট্র কৌশল সাজাতে পারে। এই প্রশ্নের সরল উত্তরের মধ্যে প্রথমত রয়েছে, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির স্বার্থকে সবার আগে স্থান দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত. স্বাধীনতার মূল ঘোষণাপত্রে যেখানে সাম্য শোষণ মুক্তি ও গণতন্ত্রের অঙ্গীকার রয়েছে, সেটিকে সবার আগে স্থান দিতে হবে।
তৃতীয়ত. সরকারবিশেষের ক্ষমতাকে বজায় রাখতে গিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ বানানো যাবে না।
চতুর্থত. একক কোনো শক্তির কাছে সব কিছু সমর্পণ না করে যথাসম্ভব ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করতে হবে।
পঞ্চমত. শাসনতান্ত্রিক বৈধতাকে গুরুত্ব দিতে হবে, যা বৈশ্বিক দরকষাকষিতে রাষ্ট্রকে শক্তিমান রাখে। এ জন্য নব্বইয়ের ক্ষমতার পর্ব পরিবর্তনের মতো বিশেষ কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন হলে তা নিয়ে ভাবতে হবে। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ গ্রহণ এবং প্রকল্প নির্ধারণে রাষ্ট্রের স্বার্থ ও অর্থনৈতিক লাভালাভকে অগ্রাধিকার দিতে হবে যাতে দেশ ঋণফাঁদে পড়ে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম না হয়। সবশেষে, ক্ষমতার জন্য রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানকে বিপন্ন করা যাবে না কোনোভাবেই, যার মধ্যে বেসামরিক প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তাব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে এক মহাখাদের দিকে ধীরে ধীরে যেতে থাকবে ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্নের এই দেশটি। আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা হয়তোবা তার সূচনা।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement