স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়?
- ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:২২
‘স্বাধীনতা’ কি তৃপ্তিসহকারে পোড়া মরিচ দিয়ে ভোরে কৃষকের খাওয়া পান্তা (পানিযুক্ত) ভাত? নাকি মধ্যবিত্তের কোরমা-পোলাও? অথবা উচ্চবিত্তের জাফরানের সুরভী ভরা নানা রসনা? বা রাতের আকাশের মায়াবী চাঁদ? এমনকি রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশের তেজোদ্দীপ্ত সূর্য? হয়তো বা যেকোনোটি অথবা সব ক’টি। জানি না, তবে এটি জানি যে, স্বাধীনতা কারো বিলিয়ে দেয়া বা কুড়িয়ে পাওয়া উপহার নয়। রীতিমতো সব কিছু উথাল-পাতাল করে বের করে আনা এক অনাবিল তৃপ্তির পাওয়া। স্বাধীনতা কী যে কাক্সিক্ষত আর কী মধুমাখা তা আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশীদের চেয়ে আর কে ভালো জানে? কী চেতনা, কত সংগ্রাম, কত রক্ত, কত জীবন বিসর্জন! দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ঊর্র্ধ্বাকাশ থেকে ছিনিয়ে আনা লাখো শহীদের রক্তে ভেজা লাল-সবুজে মোড়ানো স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাই আমরা বুঝি স্বাধীনতার কী মূল্য, এর হীনতায় কী যন্ত্রণা আর বিড়ম্বনা এবং এর অর্জনে কী প্রশান্তি।
অথচ আজ পৃথিবীর দেশে দেশে কত জনগোষ্ঠী খাদ্য নয়, বস্ত্র নয়- শুধু একটুখানি নিজের মতো করে থাকতে, বাঁচতে, স্বাধীনতা ভরা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে কত না যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদের বিশ্রী তকমা কপালে এঁটে শাসকদের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে রক্তে রাজপথ ভাসিয়ে দিচ্ছে। একসময় হয়তো নিজ জনগোষ্ঠীর কাছে মহান সংগ্রামী বীরের স্মারকে বরিত হচ্ছেন। আসলে আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে এ পৃথিবীটির মালিকানা মহান স্র্রষ্টার, মানুষের নয়। সুতরাং এ এলাকাটি আমাদের, অন্যরা এখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী এ কথাটা বলার আগে একটু ভেবে দেখা উচিত। কোনো অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যদি স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে নিজের জন্মস্থানে নিজের মতো করে থাকতে চায় অর্থাৎ স্বাধীনতা চায় তবে সেটি বোধ হয় তার অধিকার, তার প্রাপ্য। পৃথিবীতে এতগুলো দেশ, ১৯২টি জাতিসঙ্ঘ সদস্য এমনি এমনি হয়নি। স্বাধীন জাতি হিসেবেই এ মর্যাদা লাভ করেছে। পশ্চিম এশিয়া, সেন্ট্রাল ও পূর্ব ইউরোপের ১৫-২০টি স্বাধীন দেশ নিয়ে একসময়ের পরাশক্তি টঝঝজ ১৯২২ সালে গঠিত হওয়ার পর ৭০ বছর টিকে ছিল। এরপর ১৯৯১ সালে আবার ভেঙে ১৫-১৬টি স্বাধীন রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম হয়। রাশিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, কাজাখস্তান, আজারবাইজান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের মতো দেশ যেমন হয়েছে, তেমনি এসতুনিয়া, লিথুনিয়া, আর্মেনিয়া, লাটভিয়া প্রভৃতি অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশেরও অভ্যুদয় ঘটেছে। একইভাবে একসময়ের পরাক্রমশালী যুগো¯স্লোভিয়া ভেঙে আজ সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কসোভো, ¯স্লোভেনিয়া, ম্যাসিডোনিয়া ও মন্টিনিগ্রোর মতো কয়েকটি স্বাধীন জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এমনকি পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্র চেকো¯স্লোভাকিয়া থেকে স্বাধীন চেক ও ¯স্লোভাক প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। আবার ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুরকে এবং সুদান উত্তর-দক্ষিণকে ভাগ করে দু’টি দেশের স্বাধীনতা দিয়েছে।
কঙ্গো ভেঙে ব্রাজাভিল আর কিনসাসা কেন্দ্রিক স্বাধীন দেশের মর্যাদা পেয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রোডেশিয়া তথা আজকের জিম্বাবুয়ে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এসব দেশের কর্তৃপক্ষ যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে আরো দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করত তা হলে শুধু অশান্তিই ঘটে চলত। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে শুধু বিশৃঙ্খলা আর ধ্বংসই জিইয়ে রাখা হতো। নানা অজুহাতে এমনটিই চলছে আজ পৃথিবীর নানা প্রান্তে। নতুন দেশটি টিকবে না এমন অজুহাতে স্পেন কাতালোনিয়াকে, আর রাশিয়া ক্ষুদ্র চেচনিয়াকে ও বাশকোরতোস্তানকে দখল করে রেখেছে। কাতালোনিয়ার মানুষ গণভোটে রায় দেয়ার পরও স্পেন শক্তির দম্ভে সে দেশটি দখলে রেখেছে এবং চেচনিয়া ও বাশকোরতোস্তান স্বাধীনতা লাভ করার পরও তা রক্ষার নামে রাশিয়া সেসব দেশে সেনা ঢুকিয়ে কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে। আবার একই রাশিয়া স্থানীয় ও বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে শক্তির জোরে ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়াকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কী দুঃখজনক। আধুনিক যুগেও নাকি ‘জোর যার মুল্লুক তার’ চলে।
এমন আরো কত উদাহরণ পৃথিবীর নানা অঞ্চলে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সময় ভারত উপমহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশীয় রাজ্য ও স্বশাসিত অঞ্চলকে পরিকল্পনার বাইরে রেখে বলা হয়েছিল তাদের ইচ্ছামতো তারা স্বাধীনও থাকতে পারে অথবা পাকিস্তান-ভারতের অন্তর্ভুক্তও হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাদেরকে সে সুযোগ পাকিস্তান ও ভারত কেউই দেয়নি। পাকিস্তান যেমনি কয়েকটি ছোট ছোট দেশীয় রাজ্যকে দখল করে নিয়েছিল ভারতও তা করেছিল। ভারত সবচেয়ে বড় দু’টি আগ্রাসন চালিয়েছিল। তার একটি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী শাসক বলে পরিচিত নিজামের হায়দারাবাদ রাজ্য আক্রমণ। বিশাল ভারতীয় সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী হায়দরাবাদকে দখল করে নেয় পাক-ভারত স্বাধীনতা লাভের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে। অথচ হায়দরাবাদ ছিল জাতিসঙ্ঘভুক্ত একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। তার ছিল নিজাম, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, পার্লামেন্ট ও একটি সেনাবাহিনীও। অত্যন্ত সচ্ছল ও প্রধানত মুসলমান অধ্যুষিত সেই হায়দরাবাদ এখন ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত আর দশটি তেলেগু অঞ্চলের মতোই একটি। কী দুর্ভাগ্য!
এমন আরেকটি নজির হলো পশ্চিমবঙ্গের পাশে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভ‚মি-সিকিম। এটি ছিল এক স্বাধীন রাষ্ট্র। তার ছিল নিজস্ব পার্লামেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারও। এ দেশটি ভারতের স্বাধীনতার পর ২৮ বছর পর্যন্ত একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে ছিল। তার পরই নেমে এলো তার পরাধীনতা। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের অজুহাতে দেশটিতে ভারতীয় বাহিনী ঢুকে সোজা গ্যাংটকের রাজপ্রাসাদ ঘেরাও করে ফেলে এবং রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কেন? এটি কি কোনো বিদেশী বাহিনীর দায়িত্ব? অথচ সে অবৈধ নজিরবিহীন আগ্রাসী কাজটিই তারা নির্বিবাদে করে ফেলল। এরপরের কাজ আরো সহজ। তার পর সে সময়কার সিকিমের প্রধানমন্ত্রী কাজী লেন্দুপ দর্জিকে বুঝিয়ে ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে যোগদানের পক্ষে ১৯৭৫ সালে সিকিম পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেয়। এভাবে দু-দু’টি জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার সুখ-স্বপ্ন আগ্রাসী দৃষ্টির লেলিহান শিখায় অঙ্কুরেই জ্বলে ভস্ম হয়ে গেল। শতবর্ষী লেন্দুপ দর্জি তার জীবনসায়াহ্নে আজ গ্যাংটকের নির্জন বাড়িতে বসে বিদেশী গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারে অশ্রুসজল নয়নে বর্ণনা করেন কিভাবে একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতাকে তিনি বিকিয়ে দিয়েছিলেন ব্যক্তিগত লোভে পড়ে।
দীর্ঘ দিন ধরে অশান্ত পৃথিবীর বুকে আরো কতগুলো দগদগে ক্ষত সবাইকে কষ্ট দিচ্ছে। সেগুলো হলো- তিব্বত, কাশ্মির আর ফিলিস্তিন। তিব্বতের নেতা দালাইলামা প্রথম দিকে বেশ লম্ফঝম্ফ করে ব্যর্থ হয়ে এখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তিব্বতকে চীনের হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি ভারতে মোটামুটি আয়েশে নির্বাসন জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু কাশ্মির আর ফিলিস্তিনের জনগণ দীর্ঘ ক্লেশহীন স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়েই যাচ্ছে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময় কাশ্মিরের অপশন ছিল স্বাধীনতা বা কারো সাথে যোগ দেয়া। কাশ্মিরের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণ চেয়েছিল স্বাধীনতা। কিন্তু হিন্দু ডোগরা রাজা যোগ দিলো ভারতের সাথে। আর এ সুযোগে অতর্কিত আক্রমণ করে পাকিস্তান এর ক্ষুদ্র একটি অংশ দখল করে নাম দিলো আজাদ কাশ্মির। যদিও তা আজাদ নয়, বরং পাকিস্তানের দখলভুক্ত। বর্তমানে ভারতের অন্তর্ভুক্ত কাশ্মির রাজ্যটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ১৯৪৭ থেকে দীর্ঘ ৭৪ বছর ধরে নিরলস সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
প্রথম দিকে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মির ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং পরে কংগ্রেসেসহ অন্যান্য দল নিয়ে রাজ্য বিধান সভার মাধ্যমে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেয়া বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের অধীনে কাশ্মিরে এক ধরনের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চলছিল। তবে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী জনগণ এটি মেনে নিতে পারেনি। তাই শুরু থেকে অসন্তোষ লেগেই ছিল। কাশ্মির যে অশান্ত তা বাইরে থেকে বেশ বোঝা যায়। কাশ্মিরে মাঝে মধ্যেই ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাতে হয় স্বাধীনতাকামী বিক্ষোভকারীদের। প্রায়ই মুক্তিকামী মানুষের রক্তে কাশ্মিরের রাজপথ-সড়ক-প্রান্তর রঞ্জিত হচ্ছে। বন্ধ্, অবরোধ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সেখানে নৈমিত্তিক ঘটনা। ভারত সরকারও কঠোর হাতে এসব প্রতিহত করে চলেছে কাশ্মির তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ দাবি করে। সম্প্রতি নিভু নিভু প্রদীপের সলতের তলার শেষ তেলের ফোঁটাটিও নিঃশেষ হয়ে গেল। কাশ্মিরিদেরকে দেয়া ন্যূনতম যে মর্যাদা ছিল ৩৭০ অনুচ্ছেদ মুছে ফেলে ভারত সরকার সেটিও আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। অবশ্য তাতে খুব একটা কিছু আসে-যায় না কাশ্মিরিদের। স্বাধীনতাপিপাসু লোকগুলো নাছোড়বান্দা, শুধু অবিরাম বুকের রক্ত ঢেলেই চলেছে, যদিও জানে না এর শেষ কোথায়। তবে লক্ষ্য অর্জনে বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা। পর্যটকরা সেখানে গেলেই তাদের কণ্ঠে শুনতে পান ‘একদিন আমরা স্বাধীন হবোই’। শুধু কাশ্মির, হায়দরাবাদ বা সিকিমই না, নানা ছুতানাতায় ভারত গোয়া-দমন-দিউ বা অতি ক্ষুদ্র লাক্ষাদ্বীপও তার সেনাবাহিনী ঢুকিয়ে কব্জা করে নেয়।
আর এক হতভাগ্য স্বাধীনতাহারা জাতির নাম ‘ফিলিস্তিন’। একটি পাখিরও বাসা আছে। কিন্তু হাজার হাজার বছরের প্রাচীন এ জাতিটির কোনো আবাসভ‚মি নেই। শুধু যে স্বাধীনতাহারা তা নয়, তারা তাদের হাজার বছরের পুরনো পৈতৃক ভিটে থেকেও বিতাড়িত। বিগত সাড়ে চার হাজার বছরের ইতিহাসে একাদশ শতাব্দীতে মাত্র ৮৮ বছরের খ্রিষ্টান শাসন ছাড়া বাকি পুরো সময়ই এ দেশ মুসলিম শাসনে ছিল, কোনো দিন এখানে ইহুদি আধিপত্য ছিল না। অথচ পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় সেই ইহুদিরাই এখন এ ভ‚মিতে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত। এটি এখন ইহুদি রাষ্ট্র। যে ইহুদি জনগোষ্ঠী পুরো দেশের মাত্র ৫ শতাংশ তারা প্রথমে কৌশলে ভ‚মি কিনে পরে সন্ত্রাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে এবং সর্বশেষ ১৯৪৮ সালে এবং পরে আবার ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ-মার্কিন আধিপত্যবাদী শক্তির সহায়তায় অতর্কিত সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে জর্দান নদীর পশ্চিম তীর এবং গাজা ও সিনাই উপত্যকার বিস্তৃত এলাকাসহ পুরো ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। ইতিহাসের প্রথম ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিরা এসে জবরদখলের এ ভ‚মিতে বসতি গড়তে লাগল। আর প্রাচীন ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষ মাতৃভ‚মি থেকে বিতাড়িত হয়ে এশিয়া, ইউরোপ আর আমেরিকার দেশে দেশে অভিবাসী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে লাগল। এর মধ্যেও যারা শত নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মাটি কামড়ে পড়ে আছে তারা হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতাটি ছিনিয়ে আনার জন্য নিত্যদিন রক্তভেজা সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
দীর্ঘ পিচ্ছিল সংগ্রামের পথ পেরিয়ে আজ পিএলওর নেতৃত্বে একটি অর্ধস্বীকৃত ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’ পেয়েছে। দেশটি জাতিসঙ্ঘের পূর্ণ সদস্য পদ পায়নি, পেয়েছে পর্যবেক্ষকদের মর্যাদা। তাদের ভ‚খণ্ডটি এখনো হানাদার ইসরাইলের নজরদারি আর বিধিনিষেধের জাঁতাকলে। দেশের দু’টি অংশ পশ্চিম তীর আর গাজা ইসরাইলি ভ‚খণ্ড দ্বারা পৃথক করা। মসজিদুল আকসায় জুমার নামাজ আদায়ে ভীতসন্ত্রস্ত ফিলিস্তিনিদের যেতে হয় ইসরাইলি সেনাদের তদারকি পেরিয়ে, কখনো বিক্ষোভ করে আর কখনো গুলি খেতে খেতে। এটি কেমন দেশ? দেশ না জেলখানা অথবা যুদ্ধক্ষেত্র? কবে তারা নিজের মতো করে একটু মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতে পারবে? হঠাৎ গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার ভয় থাকবে না?
আজকের পৃথিবীতে অবশ্য জাতিসঙ্ঘসহ অনেকেরই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতার দাবিতে নতিস্বীকার করার বিষয়ে ঘোর আপত্তি। তাদের বক্তব্য হলো- এভাবে চলতে থাকলে অনেক দেশ ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে, বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আর ছোট জাতিগোষ্ঠীগুলো টিকতেও পারবে না। কথাটি যেভাবে বলা হয় সেভাবে বোধ হয় সঠিক নয়। অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ টিকবে না। কিন্তু আজ সেই বাংলাদেশ শুধু টিকেই থাকেনি- অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে মূল দেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে নেই। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের অন্য কোনো অংশে তো গত ৫০ বছরে বিচ্ছিন্নতার কোনো দাবি বা আন্দোলন হতে দেখা যায়নি। একইভাবে ক্ষুদ্র পূর্বতিমুর বেরিয়ে যাওয়ার পর তো ইন্দোনেশিয়াতেও তেমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। একসময় অস্ট্রিয়া, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের ও পরে জার্মানির অংশ ছিল। অস্ট্রিয়া পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর কি জার্মানির অন্য কোনো অংশ বিচ্ছিন্ন হয়েছে? হয়নি তো। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন বা রাশিয়ার মতো বিশাল ভ‚খণ্ডের দেশগুলো তো বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছে, কোনো বিচ্ছিন্নতার বিন্দুমাত্র দাবি তো সেসব দেশে নেই; কারণ দেশগুলো যথেষ্ট যড়সড়মবহবরঃু এবং উন্নয়নের ধারা রক্ষা করে চলছে।
আবার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার অবাধ ও অবারিত অধিকারসহ ব্যক্তিজীবন খুবই মসৃণ। তাই তো একসময়ের স্বাধীনতাকামী যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বা কানাডার কুইবেক অঞ্চলের কোনো মানুষের এখন আর সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আসলে বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতার আন্দোলন যখন তখন যেকোনো স্থানে মাথা চাড়া দেয় না। একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, গোষ্ঠী শাসনের কবলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকারের ক্ষেত্রগুলো যখন খুব সঙ্কুচিত হয়ে আসে অথবা আঞ্চলিকতার যথেষ্ট উপাদান থাকে তখনই স্বায়ত্ত শাসন বা স্বাধীনতার দাবি ওঠে। এখানে ভ‚খণ্ডের আয়তন খুব একটি বড় বিষয় নয়। তাই যারাই স্বাধীনতা চায় তাদের সে অধিকার স্বীকার করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আটকে রাখা ঠিক নয়, বছর হোক আর শতাব্দী পরে হোক এ স্বাধীনতা দিতেই হয়। তাই স্বাধীনতার অনাবিল প্রশান্তি ভোগ করার অধিকার সবাইকেই দেয়া উচিত; কারণ স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়?
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা