ইসরাইল-রাশিয়া সম্পর্ক ও মধ্যপ্রাচ্য
- মাসুম খলিলী
- ১৪ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:৩৪
রাশিয়ান ফেডারেশন ক্রমেই মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠছে। গত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-কৌশলগত পরিস্থিতি পাল্টে দেয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভ‚মিকা রেখেছে রাশিয়া আর এ দেশটার দীর্ঘ সময়ের নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে রাশিয়ার সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক, গতি প্রকৃতি ও গভীরতা অনুধাবন মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলির গতি উপলব্ধি করার জন্য বিশেষ প্রয়োজন।
ইসরাইলের সৃষ্টি এবং এর নিরাপত্তার ব্যাপারে সব সময় কৌশলগত মিত্র ছিল ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলো। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও ইসরাইল আমেরিকান বলয়ের অংশ ছিল। কিন্তু ইসরাইলি সমাজ ও রাষ্ট্রে রয়েছে রুশ বংশোদ্ভ‚তদের প্রভ‚ত প্রভাব। ইসরাইলে হিব্রæ ও আরবির পর প্রধান ভাষা হলো রুশ। দেশটির নির্বাচনেও রুশ ভাষাভাষীদের রয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রভাব। ইসরাইলের এক-চতুর্থাংশ নাগরিক রুশ বংশোদ্ভ‚ত। ইসরাইল ও রাশিয়ার দ্বৈত নাগরিকদের প্রভাব বিস্তার করার মতো ভ‚মিকা রয়েছে দুই দেশেই।
মধ্যপ্রাচ্যে বহু বছর ধরে, ইসরাইল রাশিয়ান ইহুদিদের গুরুত্বপূর্ণ বসতিকেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইসরাইল ও রাশিয়া পরস্পরবিরোধী পক্ষ ছিল। তবে ২০০০ দশকের গোড়ার দিকে ইসরাইল ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হতে শুরু করে। এটি বিশেষভাবে হয়েছে দু’দেশের নেতৃত্বে ভ্লাদিমির পুতিন ও অ্যারিয়েল শ্যারনের নির্বাচনের মাধ্যমে।
ইসরাইল হলো রুসোফোন বা রুশ বংশোদ্ভূতদের বসবাসের রাষ্ট্রগুলোর একটি। আর সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর বাইরে বিশ্বের একমাত্র রুসোফোন দেশ হিসেবে বিবেচিত। রুশ ভাষা হিব্রু এবং আরবির পরে ইসরাইলে তৃতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা। এক লাখেরও বেশি ইসরাইলি নাগরিক রাশিয়ায় বাস করে, এর মধ্যে ৮০ হাজার ইসরাইলি মস্কোতে বসবাস করে, অন্য দিকে ১৫ লাখের মতো স্থানীয় রুশভাষী ইসরাইলে বসবাস করে।
সম্পর্কে সা¤প্রতিক উন্নয়ন
সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার রাষ্ট্র রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে ভ্লাদিমির পুতিন অধিষ্ঠিত হওয়ার পর দু’দেশের সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসে। পুতিনকে মনে করা হয় রাশিয়ার নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইসরাইলবান্ধব। অন্য দিকে অ্যারিয়াল শ্যারনকে মনে করা হতো সবচেয়ে রুশবান্ধব ইসরাইলি নেতা। এই দুই নেতার আমলে রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় সেটিকে ‘অনন্য এক উচ্চতায়’ নিয়ে যান ইসরাইলের দীর্ঘকালের ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু।
এর ফলস্বরূপ বিগত বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ভূমিকার সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন হয়েছে। ইরান ও ইরাক সম্পর্কে রাশিয়ার এখনো নিজস্ব অ্যাজেন্ডা রয়েছে। এটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে যুক্তিযুক্ত যে, ইরানের ক্ষেত্রে, রাশিয়ার প্রেরণা যতটা অর্থনৈতিকভাবে চালিত, ততটাই কৌশলগত দিক থেকে পরিচালিত। তবে রুশ-ইরান সম্পর্কের যদি একটি কৌশলগত দিক থেকে থাকে, তবে অবশ্যই এর মূলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তে মধ্য এশিয়ার বিবেচনা রয়েছে মুখ্যভাবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বৈশ্বিক পর্যায়ে আমেরিকার সাথে যে গভীর বোঝাপড়া হয় তার নেপথ্য স্থপতি মনে করা হয় নেতানিয়াহুকে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি প্রভাবকে সর্বাত্মক রূপ দিতে যে সহযোগিতা ট্রাম্প প্রশাসন করেছে তা নিকট অতীতে কোনো মার্কিন প্রশাসনের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। নেতানিয়াহুর সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনারের যেমন গভীর সখ্য ছিল, তেমনি ছিল পুতিনের সাথেও। নেতানিয়াহুর এই সম্পর্ক দুই বিপরীত বলয়ের নেতার ওপর এতটা গভীর ছিল যে, বৈশ্বিক পর্যায়ে কোনো টানাপড়েন হলে নেতানিয়াহু ট্রাম্প ও পুতিন এর মধ্যে মধ্যস্থতাও করতেন। তার আমলে ইসরাইল কোনো দিনই রাশিয়ার ওপর বিধিনিষেধকে মান্য করেনি। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার ওপর ওবামা প্রশাসনের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা নমনীয় করার ক্ষেত্রেও ট্রাম্প প্রশাসনে গোপন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন নেতানিয়াহু।
এর প্রতিদান পুতিনের কাছ থেকে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে। ইসরাইলের প্রতিটি নির্বাচনে নেতানিয়াহুর পক্ষে রুশ বংশোদ্ভ‚তদের প্রভাবিত করেন পুতিন। অন্য দিকে, পুতিনের নির্বাচনে ইসরাইলের রুশ দ্বৈত নাগরিকদের যে ভোট গ্রহণ করা হয় তার ৮০ শতাংশই পান ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন ইসরাইলে তার দূতাবাসকে তেলআবিবে এবং কনস্যুলেট হাইফাতে রেখে দিয়েছেন এ কথা সত্যি, কিন্তু তিনি পশ্চিম জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেন। পুতিনের আমলে ভিসামুক্ত ভ্রমণ থেকে শুরু করে বিমান ও প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তি সর্বত্র দু’দেশের সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়। পুতিনের আমলে রাশিয়ার যে সন্ত্রাসবাদী তালিকা রয়েছে তার মধ্যে আলকায়েদা আইএস-এর সাথে মুসলিম ব্রাদারহুড ও তালেবানের নামও রয়েছে।
সা¤প্রতিক কিছু ঘটনায় ইসরাইল-রাশিয়া সম্পর্কের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন লক্ষ করা যায়। ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইসরাইলকে সিরিয়ায় বোমাবর্ষণের পরিবর্তে সম্ভাব্য হুমকি সম্পর্কে রাশিয়াকে অবহিত করা উচিত এবং রাশিয়া ইরানের উপস্থিতি থেকে ইসরাইল যে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে তাকে নিবৃত্ত করার জন্য সিরিয়ায় পদক্ষেপ নেবে।
এরপর ২০২১ সালের জুনে ইসরাইলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইজ্যাক হারজোগের বিজয়ের পরে এক অভিনন্দন বার্তায় পুতিন রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ রয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘দুই দেশের জনগণের মৌলিক স্বার্থে আন্তর্জাতিক বিষয়ে মিথস্ক্রিয়াসহ বহুমুখী ও গঠনমূলক দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আরো উন্নয়ন করার ইচ্ছা আমাদের রয়েছে।’
২০২১ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ শুরু হওয়ার পর পুতিন নাফতালি বেনেতকে অভিনন্দন বার্তায় একই ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করেন। পুতিন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকেও একটি ধন্যবাদপত্র পাঠান। এতে পুতিন নেতানিয়াহুর প্রশংসা করে বলেন, ‘আমাদের দুই জাতির মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য (তিনি) অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছেন আর নেতানিয়াহুর ক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতা সর্বদা একটি সম্পদ হবে।’ চিঠিটি পাওয়ার পর, নেতানিয়াহু রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভিক্টোরভকে বলেছিলেন ‘প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বলুন যে, আমি শিগগিরই ক্ষমতায় ফিরে আসব’। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ দুই নেতার মধ্যে দীর্ঘ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
নেতানিয়াহু যুগের উষ্ণ রাশিয়া-ইসরাইল সম্পর্কের ধারাবাহিকতার নীতি অনুসরণ করার জন্য বেনেত সরকারকে আহ্বান জানান পুতিন। ২০২১ সালের অক্টোবরে তাদের প্রথম বৈঠকের পর, বেনেত পুতিনকে ‘ইহুদি জনগণের সত্যিকারের বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন যে, তিনি এবং পুতিন ‘ইসলামী মৌলবাদের মোকাবিলা করার উপায়’ নিয়েও আলোচনা করেছেন। এই বৈঠকের সময়, পুতিন সিরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জন্য বেনেতের ক‚টনৈতিক সহায়তা চান। সিরিয়ায় ইরানের অর্থনৈতিক প্রভাব হ্রাস করার একটি উপায় হিসেবে তিনি এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন।
রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে জোরালো এই সম্পর্ক হঠাৎ করেই হয়েছে এমনটি মনে হয় না। ইসরাইলের জন্মের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কের ধারাবাহিকতার ওপর নজর রাখলে সেটি স্পষ্ট হবে। সামরিক সহযোগিতা থাকা দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ১৯৯১ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ইসরাইলকে তার মিকয়ান মিগ-৩১ বিমান এবং এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়, যদিও চুক্তিটি পরে বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ২০০৪ সালে ইসরাইল, রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে একটি ত্রিমুখী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় ইসরাইল ভারতীয় বিমানবাহিনীকে ১.১ বিলিয়ন ডলারের রাডার সরবরাহ করে রাশিয়ার ইলিউশিন ইল৭৬ প্ল্যাটফর্মে লাগানোর জন্য। ২০১০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাশিয়া এবং ইসরাইল পাঁচ বছরের এক সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ডিসেম্বর ২০১৯ সালে, ইসরাইল প্রকাশ করে যে দেশটি রাশিয়ার সাথে ইউক্রেন এবং জর্জিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার জন্য একটি চুক্তি করেছে। এর বিনিময়ে রাশিয়া ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা থেকে বিরত থাকে।
এপ্রিল ২০০৯ সালে, রাশিয়া ইসরাইল থেকে ড্রোনের প্রথম প্যাকেজ কিনে। এই চুক্তির মূল্য ছিল ৫৩ মিলিয়ন ডলার। একই বছরের শেষে দ্বিতীয় চুক্তিতে রাশিয়া ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অতিরিক্ত ৩৬টি ড্রোন ক্রয় করে ইসরাইল থেকে। অক্টোবর ২০১০ সালে তৃতীয় চুক্তিতে রাশিয়া ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে অতিরিক্ত ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ড্রোন ক্রয় করে। ইসরাইলি ড্রোন রাশিয়াতে যৌথভাবে উৎপাদনের ব্যবস্থাও করা হয়। রাশিয়ান-ইসরাইলি ড্রোনের উৎপাদন ২০১২ সালে শুরু হয়, ২০১৪ সালে তা রাশিয়ান সামরিক বাহিনীকে সরবরাহ করা হয়। ২০১৫ সালে, ইউক্রেনের ডোনেতস্ক শহরের কাছে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী এ ধরনের একটি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছিল বলে জানা যায়। সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী ইসরাইল থেকে ড্রোনের আরো ৩০০ মিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ ক্রয় করে, এটি ছিল চতুর্থ ইসরাইলি ড্রোন ক্রয়।
সামরিক সহযোগিতা ছাড়াও ২০০৮ সালে, ইসরাইল এবং রাশিয়া ভিসামুক্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক ভিসামুক্ত ভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। রাশিয়া এবং ইসরাইলে বসবাসরত যৌথ নাগরিকরা তাদের বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের সাথে দেখা করার সহজ সুবিধা ভোগ করে।
সহযোগিতা ও আঞ্চলিক সমীকরণ
ইসরাইলের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কের ক্রমোন্নতির একই সময়ে সৌদি আরব, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরাইলের বিশেষ বোঝাপড়ার জোট তৈরি হয়। তারা তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগানের সূচিত পদক্ষেপের অভিন্নভাবে বিরোধিতা করে। উভয় দেশ তুরস্কের সাথে প্রক্সি লড়াই করছে ককেশাস, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের বিরুদ্ধে ইসরাইল মূলত রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে, বিশেষ করে তুরস্ক-সমর্থিত জাতীয় চুক্তি সরকারের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও ইসরাইল কিভাবে খলিফা হাফতারকে সমর্থন করেছে, তা দেখা গেছে। তুরস্কের বিরোধিতার পরও সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের প্রতি ইসরাইলের নীরব সমর্থন ছিল; যদিও ইসরাইল শক্তিশালী তুর্কি মিত্র আজারবাইজানের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে।
২০১৮ সালে, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি ইসরাইলও পরামর্শ দিয়েছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচিত রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নত করা এবং ইউক্রেন সঙ্কট সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা, কারণ ইউক্রেন তুরস্কের মিত্র যদিও পুতিন এরদোগানের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছেন।
২০২০ সালে যখন সার্বিয়া এবং কসোভোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তখন রাশিয়া এবং ইসরাইল খোলাখুলিভাবে এই চুক্তিকে সমর্থন করে যার সাথে সার্বিয়া জেরুসালেমে দূতাবাস স্থানান্তর এবং কসোভোর ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের শর্ত থাকে। ২০২০ সালের আগস্টে ‘আব্রাহাম চুক্তি’র পর ইসরাইল আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলে রাশিয়া চুক্তিটিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেনি তবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ইসরাইলের প্রচেষ্টাকে নীরবে অনুমোদন করে; যদিও তুরস্ক উভয় পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে।
ইরান এবং তুরস্ক উভয়ের সাথেই রাশিয়ার শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের বিশেষ সম্পর্কের বিষয়ে রাশিয়া সন্দেহ পোষণ করে চলেছে। রাশিয়া ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের জন্য দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান সমর্থন করে এবং বেশ কয়েকটি ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দলের সাথেও সম্পর্ক রাখে। রাশিয়া হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে না এবং তাদের সাথে ক‚টনৈতিকভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান, রাশিয়া এবং তুরস্ক সবাই জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে যাতে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ‘অকার্যকর’ ঘোষণা করা হয়। রাশিয়া তার কৌশলের অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের মিত্র ও প্রতিদ্ব›দ্বী উভয়ের সাথেই বহুপাক্ষিক সম্পর্কের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে এটি করে থাকতে পারে।
সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ ও অব্যাহত উপস্থিতিকে মধ্যপ্রাচ্যের ‘গেম চেঞ্জার ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রাশিয়ান বিমান হামলায় যত সিরিয়ান বেসামরিক নাগরিক নিহত ও স্থাপনা ধ্বংস হয় তার নজির নিকট ইতিহাসে বিরল। কিন্তু রহস্যজনক বিষয় হলো, রাশিয়ার সিরিয়ায় এই সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ইরান ও আসাদ সরকারের আমন্ত্রণের পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরাইল ও সৌদি আরবের সবুজ সঙ্কেতের কথা জানা যায়। দৃশ্যত মধ্যপ্রাচ্যের পরস্পরবিরোধী এ শক্তিগুলো কেন সিরিয়ায় রাশিয়ান হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানাল সে এক জটিল রহস্যের বিষয়।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তারের যে কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি করেছে তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার। সিরিয়ায় ইরানপন্থী সরকার থাকলে লেবাবনে হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের মিত্রদের সাথে সামরিক ও কৌশলগত সংযোগ রক্ষা করা যায়। ইয়েমেনে হুথি আনসারুল্লাহর সাথে সংযোগ রক্ষার ক্ষেত্রেও এটি পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। এ কারণে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ইরান সিরিয়ায় তার মিত্র সরকারকে রক্ষায় রাশিয়ার ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব সিরিয়ার আসাদ বিরোধীদের রাস্তায় নামানো ও সশস্ত্র করার ক্ষেত্রে ইন্ধন দিলেও এক পর্যায়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যে রাজতন্ত্রের ক্ষমতার সামনে ব্রাদারহুডকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে। জানা যাচ্ছে, এই বিবেচনাতেই ইসলামিস্টদের দমনের জন্য সিরিয়ায় তারা সবুজ সঙ্কেত দেয় ক্রেমলিনকে।
প্রশ্ন হলো, ইসরাইল কেন তার দোরগোড়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতিকে কাম্য মনে করল? যারা আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির ভেতরের খবরাখবর রাখেন তারা জানেন, ইসরাইলের সার্বভৌম ও ভৌগোলিক অস্তিত্বের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট নেতাদের বিশেষ কমিটমেন্ট সব সময় ছিল। এ কারণে ১৯৬৭ বা ১৯৭৩ সালে যখন আরব ইসরাইল যুদ্ধ হয় তখন মিসর ও সিরিয়া সোভিয়েত বলয়ে থাকার পরও সর্বাত্মক সামরিক সহায়তা ক্রেমলিন থেকে পায়নি। ফলে এসব যুদ্ধে ইসরাইল জয়ী হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর রাশিয়ান নেতাদের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আদর্শবাদের পরিবর্তে জাতিবাদী স্বার্থ মুখ্য বিবেচিত হয়। এ ছাড়া বৈশ্বিকভাবেও দুই দশক রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সঙ্ঘাত দেখা যায়নি। এ সময়টাতে ইসরাইল-রাশিয়া সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার হয়।
দুই দেশের ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের বাইরে ব্যক্তিগত বোঝাপড়াও তৈরি হয়। এই বোঝাপড়ার কারণে প্রকাশ্যে ইসরাইলের সাথে ইরানের বৈরিতা যতই বাড়তে দেখা যাক না কেন, এ ব্যাপারে রাশ টেনে ধরতে মস্কো ইরানের ওপর তার প্রভাবকে কাজে লাগায়। ইসরাইলের সাথে হিজবুল্লাহর উত্তেজনা মাঝে মধ্যে বাড়তে দেখা গেলেও তা যুদ্ধের পর্যায়ে যায়নি রাশিয়ার হস্তক্ষেপে। ইসরাইল অভিযোগ করে যে, হিজবুল্লাহ রাশিয়ার তৈরি অস্ত্রসজ্জিত হয়েছে। এই অভিযোগের পর রাশিয়ান কর্মকর্তারা সিরিয়ার সমরাস্ত্র মজুদ পরীক্ষা করে এটি নিশ্চিত করেন যে, রাশিয়ান অস্ত্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
ইসরাইল ও রুশ নেতৃত্বের মধ্যে এই ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার কিছুটা ব্যত্যয় হয় বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর ইসরাইলে সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার পর। নেতানিয়াহু পুতিনের কাছে বার্তা দিয়েছেন যে, তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে ইসরাইলের ক্ষমতায় ফিরে আসছেন। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের কারণে সেটি এখনো বাস্তব হয়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ার কারণে ইসরাইলের নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালির সাথে পুতিন বৈঠকে বসেন। অবশ্য ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাফতালি নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভারই সদস্য ছিলেন। তিনি সামগ্রিকভাবে নেতানিয়াহুর অ্যাজেন্ডাগুলোকে সামনে এগিয়ে নিতে চাইছেন। বর্তমান সরকার অব্যাহত থাকলে তার মেয়াদের দুই বছর ইসরাইলি নীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন নাও আসতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে রুশ ভূমিকায় পরিবর্তন হবে?
মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাশিয়ান ভ‚মিকায় কি কোনো পরিবর্তন আসবে। বিগত হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের সময় জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও অন্যান্য ফোরামে রাশিয়া-চীন ইসরাইলের পক্ষ সমর্থন করেনি। বরং যুদ্ধ বন্ধে চাপ তৈরি করেছে। দেশ দুটি এ ভ‚মিকা এমন এক সময় নেয় যখন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সাথে চীন-রাশিয়া স্নায়ুদ্ব›দ্ব নতুন করে চাঙ্গা হয়। আর এ সময় ওয়াশিংটন কৌশলগত ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সব ধরনের সম্পর্ক রাশিয়া ও চীনের সাথে বিচ্ছিন্ন করতে চাপ দেয় ইসরাইলকে। এ চাপের মুখে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা থেকে ইসরাইল সরে আসে।
এখনো চীন-রাশিয়ার সাথে ইসরাইলের সম্পর্কের মধ্যে টানাপড়েনের কিছু উপাদান রয়ে গেছে। তবে এই উপাদানগুলো ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পর্ককে কিছুটা উষ্ণ করলেও ইসরাইলের সাথে বড় ধরনের দূরত্ব সৃষ্টির মতো কখনো হবে না। এর কারণ হলো দুই দেশের মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক। ইসরাইলের রাশিয়ার প্রতি খুব বেশি ভালোবাসা নেই, তবে ইসরাইলে রাশিয়ান বংশোদ্ভূত কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ইহুদি রয়েছে। বেশ কিছু ইসরাইলি বিখ্যাত ব্যক্তিও এই রাশিয়ান ইহুদিদের বংশধর।
দৃশ্যত রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে খুব বেশি শত্রæতা না থাকলেও তারা খুব একটা ঘনিষ্ঠ নয় বলে মনে হয়। সহজ কথায় বলা যায়, ইসরাইল রাশিয়ার তুলনায় ভিন্ন এক নীতি অনুসরণ করে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো, রাশিয়ারও অনেক আরব মিত্র রয়েছে আর এই মিত্ররা রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত থাকলে তারা ইসরাইলের সাথে রাশিয়ানদের বিশেষ সম্পর্কের কারণে তেলআবিবের স্বার্থের বিশেষ ক্ষতি করার সাহস করবে না বলে বিশ্বাস করে তেলআবিব।
পুতিন ইসরাইলকে সবচেয়ে শক্তিশালী রুশবাসীর বসবাসের দেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রাশিয়া যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে তখন রাশিয়ার অর্থনীতিকে রক্ষা ও উন্নয়ন-অর্থায়নে সহায়তা করার জন্য অনেক ইসরাইলি রাশিয়ায় ফিরে যায়। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এমন যে, একজন রাশিয়ান ইহুদি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসলেও আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না বলে মনে করা হয়।
রাশিয়ার সাবেক প্রোপাগান্ডা এক্সিকিউটিভ দিমা ভোরোবিভের বক্তব্যটি এ প্রসঙ্গে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। তিনি বলেছেন, ‘ওভারল্যাপিং রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ইরান ও সিরিয়া আমাদের বন্ধু। তাদের বহুবর্ষব্যাপী অ্যান্টি-আমেরিকানবাদ তাদেরকে আমাদের অস্ত্রের ক্রেতা এবং জাতিসঙ্ঘে আমাদের সমর্থক করে তোলে। কিন্তু ইসরাইলের মতো তাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধন খুব বেশি গভীর নয়। তারা সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের থেকে অনেক দূরে। পিটার দ্য গ্রেটের যুগ থেকে, আমাদের অভিজাতরা তাদের উত্তরাধিকারী ইসলাম ধর্ম এবং মধ্যপ্রাচ্যের রীতিনীতিকে বিশেষভাবে মঙ্গলকর নয় বলে মনে করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইতোমধ্যে, ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে স্ট্যালিনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নীতির শিশুতে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন না থাকলে ইসরাইলিরা শুরুতেই তাদের আরব প্রতিবেশীদের দ্বারা পরাস্ত হতে পারত। তাদের মধ্যে অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসা অভিবাসী বা এই অভিবাসীদের সন্তান। রাশিয়ান ভাষা এবং সংস্কৃতি তারা ধারণ করে। অন্য দিকে, গত ১০০ বছরে ইহুদিরা আমাদের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, গণমাধ্যমে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।’
বলা হয়ে থাকে ইসরাইল-রাশিয়া সম্পর্ক এমন এক গভীর বন্ধন যদি কোনো কারণে সরকারি পর্যায়ে রাশিয়া এবং ইসরাইলের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে তবুও শক্তিশালী সম্পর্ক পারস্পরিক দৈনন্দিন আকর্ষণ স্তরে বজায় থাকবে। সিরিয়া এবং ইরানের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কে এই জৈব গভীরতা নেই।
১৫ জানুয়ারি ২০২০-এ, এশিয়া টাইমসের একটি প্রতিবেদনে ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, রাশিয়া সিরিয়ায় ইসরাইলি বিমান হামলা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার বিনিময়ে সিরিয়ার সরকারের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটাতে ইসরাইলি ক‚টনৈতিক সহায়তা আশা করেছিল। টাইমস অব ইসরাইলের মতে, একটি ইসরাইলি সংস্থা হাদাসাহ এমন একটি প্রচেষ্টার সাথে জড়িত ছিল যার ফলে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের সময় রাশিয়ার ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছিল, পুতিন রাশিয়াকে প্রথম দেশ হিসেবে সফল অ্যান্টি-কোভিড ভ্যাকসিন তৈরির ঘোষণা করার পরপরই এটি হয়। ২০২০ সালের নভেম্বরে, ইসরাইলের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু রাশিয়ার তৈরি করা স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন কেনার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। হাদ্দাসাহ মেডিক্যাল সেন্টার তারপর ১৫ থেকে ৩০ লাখ ডোজ টিকার জন্য একটি বাণিজ্যিক স্মারক স্বাক্ষর করে।
এ দিকে ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ২০২০ সালে ইসরাইল ও বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের প্রশংসা এবং এটিকে ‘ইতিবাচক ঘটনা’ হিসাবে তিনি বর্ণনা করেন। একই মাসে, ইসরাইলে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আনাতোলি ভিক্টোরভ ইসরাইলের ‘ইসরাইল-আরব এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবে অসম্মতি’ এবং হিজবুল্লাহ লেবানন থেকে ভূগর্ভস্থ টানেল তৈরি করেছে বলে ইসরাইলি দাবির বিরোধিতা করার পরে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এ ব্যাপারে ইসরাইলের প্রতিক্রিয়াকে ‘অতি সংবেদনশীল’ বলে বর্ণনা করেন। তবে তিনি নিশ্চিত করেন যে, রাশিয়া ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ইসরাইলের নিরাপত্তা উদ্বেগকে বিবেচনায় নিয়ে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, আরব-ইসরাইল দ্ব›েদ্বর বিষয়ে রাশিয়া আজ মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থিতাবস্থার শক্তি, স্থিতিশীলতায় আগ্রহী, অচলাবস্থায় নয়। বর্তমানে ইসরাইলে কেউ কেউ ইরান এবং ইরাকে রাশিয়ার জড়িত থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন; যদিও ইসরাইল-আরব শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার লেভারেজ সীমিত, তবে রাশিয়ার জন্য অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা এখনো যথেষ্টভাবে কম বলে মনে করা হয়। গত দশকেও রাশিয়ার নীতি ধারাবাহিকভাবে স্থিতিশীলতা এবং মার্কিন শান্তি প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে।
বর্তমান রাশিয়ান নীতিগুলো আরবদের আপেক্ষিক দুর্বলতা এবং ইসরাইলের আপেক্ষিক শক্তির একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়নও প্রতিফলিত করে। সোভিয়েত নীতিগুলো একদিকে দৃশ্যত আরবের সামরিক শক্তিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ইসরাইলের শক্তিকে আমেরিকান শক্তির আউটপোস্ট এবং স¤প্রসারণের জন্য দায়ী হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। বর্তমান রাশিয়ান চিন্তাধারা আরব সামরিক বিকল্পগুলোর জন্য যেকোনো সমর্থন থেকে সরে যায় এবং ইসরাইলের সামরিক, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক প্রান্তের তথ্যগুলোকে তার অস্তিত্বের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
একটি ভিন্ন স্তরে, যৌথ ইসরাইল-রাশিয়ান প্রতিরক্ষা এবং শিল্প সহযোগিতার দিকগুলো পশ্চিমা প্রযুক্তি এবং বাজারগুলোর পথ খুলে দিয়েছে যেখানে রাশিয়ার সহজ অ্যাক্সে ছিল না। একটি নতুন অ্যাটাক হেলিকপ্টার (রাশিয়ান হার্ডওয়্যার, ইসরাইলি এভিওনিক্স) এর যৌথ বিকাশ উন্নয়নশীল সাধারণ কৌশলগত অ্যাজেন্ডার একটি উদাহরণ মাত্র। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এবং এই স্বার্থের কথা মাথায় রেখে, রাশিয়ার যেকোনো ঘোষণামূলক অবস্থান যা ইসরাইলের সমালোচনামূলক বলে মনে হয় তা অবশ্যই আসলে বিপরীতমুখীই হবে।
২০০০ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাকের মস্কো সফরের সময়, পুতিন তাকে ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটি যৌথ বিবৃতি জারি করতে রাজি করার চেষ্টা করেছিলেন। বারাক নিরুৎসাহিত হয়ে পুতিনকে একান্তে বলেছিলেন যে ইসলামিক-অনুপ্রাণিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অপারেশনাল সহযোগিতা ইসরাইল ও রাশিয়ার (এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যে একটি সুস্পষ্ট যৌথ অ্যাজেন্ডা হলেও, চেচনিয়া একটি রুশ অভ্যন্তরীণ বিষয় যা একটি জাতীয় সঙ্ঘাত থেকে বেড়েছে। চেচনিয়ায় উত্তেজনা সৃষ্টির ব্যাপারে আমেরিকান অ্যাজেন্ডা থাকার বিষয়টি জানা ছিল বলেই হয়তো বারাক এ ব্যাপারে সাড়া দেননি। আর চেচনিয়ার যুদ্ধ রাশিয়ার নীতিকে পরবর্তীতে অনেক বেশি ইসরাইলমুখী হতে সহায়তাই করেছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার নির্মম সামরিক হস্তক্ষেপের পেছনেও পুতিনকে চেচনিয়ার ভয় তাড়া করেছে বলে অনেকে মনে করেন।
বলাবাহুল্য, চেচেন যুদ্ধ অবশ্যই আরব ও ইসলামিক অবস্থানের সমর্থনে রাশিয়ার আগ্রহকে হ্রাস করেছে এবং আরব জনমতের তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলেছে রাশিয়াকে। তার চেচনিয়া নীতির একটি অপ্রত্যাশিত পরিণতি হিসাবে, রাশিয়াকে এখন আরব এবং ইসলাম বিশ্বে অনেক ক্ষেত্রে শত্রæ হিসাবে দেখার ভারী মূল্যও দিতে হচ্ছে মস্কোকে। এই উন্নয়ন মধ্যপ্রাচ্য সঙ্ঘাতে রাশিয়ার সহানুভূতিকে আরো ভিন্ন দিকে সরিয়ে দিচ্ছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় ১০ লাখ রুশভাষী গত ১২ বছরে অভিবাসী হয়েছেন ইসরাইলে। তারা ইসরাইলের ইহুদি জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ এবং তারা দেশের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। তাদের প্রভাব শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ নয়, বরং ইসরাইল সম্পর্কে রাশিয়ার ধারণা এবং তাই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং পারস্পরিক উপলব্ধিও পরিবর্তন করেছে।
ফলে পুতিনের রাশিয়া আরবদের সাথে যত ধরনের সম্পর্কই বজায় রাখুক না কেন ইসরাইলের নিরাপত্তার ব্যাপারে পুরোনো অঙ্গীকারের কোনো ব্যত্যয় করবে না। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সমর্থনের উপর ভিত্তি করে কোনো পরিবর্তনের চিন্তা করা অবাস্তব ভাবনাই হবে। বরং সিরিয়ায় যেভাবে রাশিয়া নির্বিচারে সামরিক শক্তি ব্যবহার করেছে তেমন ব্যবহার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও ঘটে থাকলে বিস্মিত হবার কিছু থাকবে না। এ ধরনের কিছু আমেরিকার সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে হলে বিপদের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়া তথা আগুনে ফুঁ দেয়ার কাজটি করতে পারে ইসরাইল। রাশিয়ার উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা ইরানের মতো দেশের চেয়ে ইসরাইলের অনেক বেশি।
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা