২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

প্রতিমন্ত্রীর বিদায় ও সরকারের হালচাল

ডা: মুরাদ হাসান - ছবি : সংগৃহীত

প্রতিমন্ত্রী বিদায় নিলেন। সরকারেরও আপাতত মুখ রক্ষা পেল। ‘আপদ পাদুকা’ যথাসময়ে খুলে ফেলতে হয়। তা না হলে তার সমস্যা, সবার ঝামেলা। সামাজিক মাধ্যমে এই প্রতিমন্ত্রীর অসামাজিক আচরণ নিয়ে ঝড় তুলেছিল। তিনি দেরি না করে পদ ছেড়েছেন; দল ছেড়েছেন (কিংবা দলই তাকে ছেড়েছে); শেষাবধি তড়িঘড়ি দেশকেও ছেড়ে গেছেন। পদত্যাগের পর আরো কী কী ত্যাগ করতে হয়, সে দুশ্চিন্তায় হয়তো দূরে চলে যাওয়ার বিকল্প তার ছিল না।

তবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা: মুরাদ হাসানের পদত্যাগ ও স্বদেশ ত্যাগের সাথে কয়েকটি জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজছেন অনেকে। যেমন- ক. তার মন্ত্রিত্ব হারানোর সাথে তারেককন্যার নামে কুরুচিপূর্ণ অশালীন অশ্রাব্য বক্তব্যের সম্পর্ক কতটা? খ. তিনি নির্বিঘ্নে বিদেশে পাড়ি দিতে পেরেছেন। এর অর্থ কি এটি যে, বর্তমান সরকার তাকে ‘চলে যেতে দিয়েছে’? গ. প্রতিমন্ত্রীর অন্যায় কাজগুলোর বিচার এখন আর হবে কি? ঘ. তার মতো বিতর্কিত লোক প্রতিমন্ত্রী হতে কিংবা এত দিন সে পদে থাকতে পারলেন কী করে? ঙ. শপথ ভঙ্গ, নারীবিদ্বেষ, সংবিধানের অবমাননা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা প্রভৃতি বড় বড় অভিযোগের বিচার করা না হলে তা কি তার দল ও এই সরকারের ইমেজের অনুকূল হতে পারে? চ. শুধু জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার ছেলে বলেই কি প্রতিপক্ষ সংগঠন একসময় করেও তিনি এ সরকারের প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন? এ জন্য তার রাজনৈতিক যোগ্যতা কী কী?

এমন বহু প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খেলেও জবাব মিলছে না। অনেকেই বলে থাকেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভেদ হলো, একটি দল ক্রাইসিস ক্রিয়েট করতে পারে একের পর এক; আবার তা ম্যানেজও করে ফেলে কৌশলে (যদিও এটি কোনো স্থায়ী সুরাহা নয়); অপর দল তা পারে না, বরং নিকটাতীতে তারা দু-একটি ক্রাইসিসেই কুপোকাত! এবার মুরাদকাণ্ডে প্রমাণিত হবে, এ কথা কতটা সত্য। মুরাদ তো দুবাই চলে গেলেন; কিন্তু তার দলটি এসব অপকাণ্ড সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করতে পারবে কি? কারণ সব কিছুর শেষ আছে। অতি চালাকদেরও এক দিন ধরা খেতে হয়। এটি অনিবার্য।

ডা: মুরাদ হাসান সম্পর্কে আমরা জানি না; কারণ তিনি যেমন সব কিছু গোপন রেখেছিলেন, তেমনি সংশ্লিষ্ট অন্যরাও কিছু ফাঁস করেননি। কেন করা হয়নি, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তিনি ‘পরিবারতন্ত্রের ফসল’ ও ‘সুবিধাবাদী’- এসব অভিযোগের চেয়েও বড় কথা, প্রথমে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে মাফ চাইতে দৃঢ়তার সাথে তার অস্বীকৃতি। মুরাদ বলেছেন, ‘যা কিছু করেছি, প্রধানমন্ত্রীর জ্ঞাতসারেই হয়েছে।’ এর সত্যতার প্রমাণ সদ্য বিদায় হওয়া প্রতিমন্ত্রীকেই দিতে হবে প্রথমে। সরকারপ্রধানকে তিনি জড়াতে চাইলেও শেষাবধি পারেননি। উল্টো নিজেই ‘আউট’ হয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তার মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগের নির্দেশ মেনে নেয়া ছাড়া সাংবিধানিকভাবে গত্যন্তর ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়ে ধন্যবাদার্হ নিঃসন্দেহে।
এ দিকে কথা উঠেছে, সদ্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদের ফোনালাপ ফাঁস হলো কিভাবে? নাকি এটি ‘বিশেষভাবে’ ফাঁস করে দেয়া হলো? হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, দুই বছর আগের ঘটনা কে-ই-বা জানতে পারবে? তবে প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তার পেছনে গোয়েন্দা আছে এবং যে কারো ফোনালাপ যে এখন প্রকাশ পেতে পারে, তা তার অজানা থাকার কথা নয়।

অন্য দিকে তিনি প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীর নাতনীকে নিয়ে যেসব অনৈতিক, বাজে ও নোংরা কথাবার্তা বলেছেন, তা নিন্দনীয় হলেও ক্ষমতাসীন দলের ক’জন এর প্রতিবাদ করেছেন? কেন করেননি? নারীর অবমাননা এটিতেও হয়েছে বৈকি! একজন অভিনেত্রীর চেয়ে একজন রাজনীতিক বা তার পরিবারের লোকজন কম গুরুত্ব রাখেন না। তারেক রহমান রাজনীতি করতে পারেন; কিন্তু তার মেয়ে জাইমা রাজনীতির লোক বলে কারো জানা নেই। অথচ তিনিও রাজনৈতিক সমালোচনা থেকে বাঁচতে পারেননি। তারও বিশ্রী বিরোধিতা করা হয়েছে, যা অন্তত একজন মন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশিত নয় মোটেও।

মুরাদ হাসানের পদত্যাগে বিভিন্ন এলাকায় দলের নেতাকর্মীরা আনন্দ মিছিল ছাড়াও মিষ্টিমুখ করেছেন। তাকে জেলা আওয়ামী লীগের পদ এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্যপদ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এমপিগিরিও যায় যায়। কিন্তু তার ওপর নিজ দলের হাইকমান্ড নাখোশ না হলে কি তাদের কেউ মুখ খুলতেন? এ ব্যক্তি রাষ্ট্রধর্মের মতো অতীব গুরুত্ববহ সাংবিধানিক বিষয়ে লাগামছাড়া ও আপত্তিকর মন্তব্য করলেন সম্প্রতি। তখন কেন স্ব দলের তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি? অথচ দলীয় কোনো ফোরামে রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। মুরাদ হাসান দৃশ্যত গায়ে পড়ে রাষ্ট্রধর্মের বিপক্ষে গিয়ে অতি প্রগতিবাদী সাজতে চেয়েছেন কেন?

তখন এহেন অবিমৃষ্যকারিতার জোর প্রতিবাদ করা হলে তার মুখে নারীকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা হয়তো শোনা যেত না কিংবা তার ফোনালাপ ফাঁস করার দরকার হতো না। যা হোক, কেবল এক ব্যক্তির ওপর নির্ভরতা কিংবা হাইকমান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকা গণতন্ত্র নয়। বরং এতে ব্যক্তিপূজা, পরিবারতন্ত্র, ব্রুট মেজরিটি, জনতুষ্টিবাদ, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, অতি স্বাদেশিকতা প্রভৃতির উদ্ভব ঘটতে পারে।

এ দেশের রাজনীতিতে অশ্লীলতা বিষয়ে প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা মনে পড়ল। ১৯৯০ সালে সম্মিলিত বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারের পতন ঘটে ৬ ডিসেম্বর। দু-এক দিন পরই ‘এরশাদের দালাল’দের নামে অশালীন প্রপাগান্ডার সূচনা। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই এই প্রচারাভিযানের শিকার। কারা তা করেছেন সেটি অস্পষ্ট হলেও গণতন্ত্রকামী বিক্ষুব্ধ জনতার কাছে ওই সব বিশেষণ তখন ‘প্রিয়’ ছিল বলা যায়। অথচ এটি গণতন্ত্রের সাথে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অচিরেই শুরু হলো বাংলাদেশের প্রধান দু’টি দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা- কে কাকে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে আয়োজিত প্রথম জাতীয় নির্বাচনে হারাতে পারে। এটি করতে গিয়ে দুই দলই নেতিবাচক প্রচারণায় মেতে ওঠে। ওই সব প্রচারণা করতে গিয়ে উভয় দলের চরিত্র উন্মোচিত হয়ে যায় দেশবাসীর কাছে। তাদের কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে বিকৃত রুচির অনেককে তৃপ্তি দিলেও গণতন্ত্রের কোনো উপকার কিংবা জাতির কোনো কল্যাণ হয়নি এতে। কয়েক দিন পরই সেসব চাপা পড়ে যায়।


আরো সংবাদ



premium cement