২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পরিবহন মালিক ও অর্ধেক ভাড়া

পরিবহন মালিক ও অর্ধেক ভাড়া-ঢাকায় তুমুল আন্দোলন
-

২৯ নভেম্বর সোমবার ঢাকায় তুমুল আন্দোলন গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার দাবিতে। ক্ষমতাসীন দলের দু’নম্বর নেতা এবং সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও দাবি জানালেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া রাখার জন্য। এ বিষয়ে ঢাকার দুই মেয়রেরও অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। কিছু টিভিতে একজন মেয়রের বক্তব্য এলো কেবল রাজধানীর ঘাটারচর-ডেমরা রুটের পরিবহনগুলোর ‘র‌্যাশনালাইজেশন’ সম্পর্কে।

মালিকদের অসহযোগিতায় এ উদ্যোগ পয়লা ডিসেম্বর থেকে পেছানোর কথা জানানো হলো। যেখানে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক, মিডিয়াকর্মীসহ সবার আগ্রহ গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার বিষয়ে, সে ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে শুধু রুট র‌্যাশনালাইজেশনের কথা বলা যে কত বড় র‌্যাশনাল বা অযৌক্তিক অথবা কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাপার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। টিভিতে আরো বলা হলো ড্রাইভারদের লাইসেন্স এবং যানবাহনের রুট পারমিট নিয়ে। কিন্তু আসল কথাটাই জানা হলো না। অর্থাৎ গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার কী হলো? সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। কারণ এটাই ছাত্র-ছাত্রীদের প্রধান দাবি। মূল এ দাবি কিন্তু মালিকপক্ষ সারা দেশে করার কথা মানেনি এবং সরকার পক্ষ এ বিষয়ে সুকৌশলে পার পেতে চাচ্ছে।

পরিবহন মালিকদের একগুঁয়েমি এবং প্রশাসনের অতি চালাকির পরিণাম ভালো হওয়ার কথা নয়। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, প্রমাণিত হয়েছে যে, গণপরিবহন মালিকদের প্রতি সরকারের সমর্থন রয়েছে। একজন পরিবহন বিশেষজ্ঞের ভাষায়, ‘এ মালিকরা সরকারের চেয়ে অধিক শক্তিশালী।’ পরিবহনের মালিকপক্ষ শিক্ষার্থীদের জন্য ভাড়া কনসেশনের দাবির বিপরীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সেশন চার্জ থেকে নিজেদের প্রাপ্যতার অধিকারের উল্লেখ করেছে। এটা যে, প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার কৌশল, তা স্পষ্ট। প্রশাসন এ নিয়ে কিছু বলেনি। অথচ মুখখোলা তাদের দায়িত্ব ছিল। জেনেশুনেই মালিকরা সে দাবি তুলেছেন।

নভেম্বর মাসের শেষ দিন মঙ্গলবার। পরিবহন শ্রমিকরা ২৫ তারিখ থেকেই কেন যেন হঠাৎ নমনীয় হয়ে পড়েছেন। ভাড়ার বিষয়ে ৩০ তারিখে তাদের এই ‘নমনীয়তা’ অব্যাহত ছিল। এদিন সকালে মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী একটি মিনিবাসে নটর ডেমের জনৈক ছাত্র থেকে পুরো ভাড়া দাবি করা হলে সে তা দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তার কথাই জিতে যায়। তার কাছ থেকে আগের রেটেই ভাড়া নিতে হলো। বিকালে একই রুটে তালতলার একজন মহিলার কাছে বেশি ভাড়া চাইলে তিনি গাড়ির চার্টের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন পরিবহনকর্মী লা-জবাব। বোঝা গেল, যাত্রীদের মুখ খুলেছে এতদিনে এবং অবশেষে তাদের ঐক্য ও সাহস বেড়েছে।

দোসরা ডিসেম্বরও যাত্রীদের চোখ ছিল বর্ধিত ভাড়ার চার্টের প্রতি। অনেক গাড়িতে তা লাগানো হয়েছে। আবার অনেকে লাগায়নি যা আইনের পরিপন্থী। এদের সবাইকে শাস্তি দেয়া উচিত। একই দিনে দেখা গেছে, পরিবহন কর্তৃপক্ষের ভাড়ার চার্টে দূরত্ব হিসাব করা হয়েছে মিরপুর পল্লবী থেকে। সে মোতাবেক, কাজিপাড়া পর্যন্ত মিনিবাস ভাড়া ১০ টাকা দেখিয়ে এর পরই ফার্মগেট পর্যন্ত ভাড়া ১৮ টাকা দেখানো হলো। অর্থাৎ, শেওড়াপাড়া, তালতলা আর আগারগাঁওয়ের বিরাট এলাকা গায়েব। যা হোক, গণপরিবহনের গাড়িগুলো মিরপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দুই টাকা করে মাথাপিছু বেশি রাখছে ভাড়া। তার মানে, ভাড়া দিতে হচ্ছে ২০ টাকা করে। তা হলে যাতায়াতে হাফ ভাড়া দিলেও গণপরিবহনের লোকসান হওয়ার কথা নয়। কারণ, প্রতিটি মিনিবাসের নির্ধারিত সিট অন্তত ২৬টি। দাঁড়ানো বহু যাত্রী এবং অতিরিক্ত আসনের কথা সবার জানা। মিনিবাসে ২৬টি আসনের যাত্রীদের অনেকেই রুটের মাঝপথে নেমে যান পুরো ভাড়া দিয়েই এবং তখন তাদের খালি সিটে আবার পুরো ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রী তুলতে দেখা যায়। ২৬ সিটে দুই টাকা করে বেশি নেয়া হলে কেবল মতিঝিলের প্রতি ট্রিপে (একমুখী) নেয়া হচ্ছে ৫২ টাকা বেশি। প্রত্যেক মিনিবাস দিনে কয়েক ট্রিপ দেয়। সে হিসাবে সব রুট মিলিয়ে তাদের অতিরিক্ত ‘আয়ের পরিমাণ’ও অধিক হওয়ার কথা দাঁড়ানো বহু যাত্রীসহ। অতএব, শিক্ষার্থীর হাফ ভাড়া দিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এটাই বাস্তবতা।

পত্রিকার খবর মতে, পরিবহন শ্রমিকরা এখনো সুযোগ পেলেই বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। যেমন, দোসরা ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দু’জন শ্রমজীবী মানুষ ফার্মগেট থেকে তালতলার ভাড়া ১৫ টাকা করে দিলেন, যা অতিরিক্ত। কিন্তু কন্ডাক্টর দাবি করলেন পুরো ২০ টাকা দিতে হবে (অর্থাৎ ফার্মগেট থেকে পল্লবী পর্যন্ত ভাড়ারও বেশি)। কিন্তু সে দু’যাত্রী দিতে অস্বীকার করলে নতিস্বীকার করতে হয় পরিবহন কর্মচারীকে।

আর পাঁচ টাকা না রাখার পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিগুলো খেলনা নয়। এর বিপক্ষে বলা হচ্ছে, সরকারের সাথে করা গণপরিবহন চুক্তি মোতাবেক ন্যূনতম ভাড়া পাঁচ টাকা নয়, ১০ টাকা এবং অগ্নিমূল্যের বর্তমান বাজারে পাঁচ টাকা প্রায় মূল্যহীন হয়ে গেছে। তবে পাঁচ টাকার পক্ষে ছাত্রছাত্রীরা বলছে, ‘১০ টাকার অর্ধেক পাঁচ টাকা। অতএব, এটাই আইনসম্মত ও যৌক্তিক। তাই পাঁচ টাকা ভাড়া নিতে হবেই।’ তা নিয়ে নিয়ত ঝগড়াবিবাদ ঘটছে যানবাহনে।

আমাদের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের পূর্বসূরি হচ্ছে ’৬৯-এর সুমহান গণঅভ্যুত্থান যার চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রদের ১১ দফা। এর মধ্যে ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থাপিত ৬ দফাও অন্তর্ভুক্ত। ১১ দফার জোর গণআন্দোলনের ধাক্কায় এক দশকের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ক্ষমতার মসনদ টুটে যায় এবং সরকার জনগণের বহু দাবি মানতে বাধ্য হয়। মুজিব মুক্তি পেয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত হলেন এবং সারা দেশে যানবাহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া দেয়ার অধিকার সরকারের স্বীকৃতি লাভ করে। তেমনি আবার ১১ দফা দাবিতে এখন দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে রত। এসব দফায় আছে, এবার রাজধানীতে গণপরিবহনে চাপা পড়ে নিহতদের হত্যার বিচার এবং তাদের পরিবারের যথার্থ ক্ষতিপূরণ, সারা দেশে শিক্ষার্থীর হাফ ভাড়ার অধিকার মেনে নিয়ে অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি, গাড়িতে হাফ পাসের সময়সীমা বাতিল করা, গণপরিবহনে বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার, সর্বত্র সরকারি বা বিআরটিসির গণপরিবহন বাড়ানো, নারীদের জন্য পরিবহন নিরাপদ করা, পরিবহনকর্মীদের সদাচরণ, অবৈধ যানের মালিক ও অদক্ষ চালকের নিয়োগদাতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ, সরকারি সংস্থা বিআরটিএর দুর্নীতি অনিয়ম রোধ, সারা দেশে নিরাপদ সড়ক সৃষ্টি, ট্রাফিক পুলিশ বৃদ্ধি করা এবং পুলিশের দুর্নীতিদমন, ‘একরুটে একবাস’ নীতিগ্রহণ এবং গণপরিবহনের আয় সব মালিকের মধ্যে যথাযথভাবে বিলিবণ্টন, পরিবহন শ্রমিকের নিয়োগ ও পরিচপয়পত্র, বিশ্রামাগার ও টয়লেট ছাড়াও তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ করা, পরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো প্রভৃতি।


আরো সংবাদ



premium cement