২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গণতন্ত্রের বাংলাদেশী অনুশীলন

-

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বানে শতাধিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি সমন্বয়ে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্তি হয়নি অর্থাৎ বাংলাদেশকে ওই সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য দাওয়াত করা হয়নি। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করাই বাংলাদেশ সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি। সংবিধানের এক অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র যাহা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে পরিচিত।’ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে দৃশ্যমান যে, ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি প্রকারান্তরে অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ। কারণ ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ‘গণতন্ত্র’ নামক অসহায় শব্দটিকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে প্রয়োগ করে ক্ষমতার মজা গ্রহণ করেছে।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সামরিক জান্তা ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খান বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশ শাসন করেছেন গণতন্ত্রের নামে। তখন তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ বা বেসিক ডেমোক্র্যাসি। আইয়ুবি গণতন্ত্রের সংজ্ঞানুসারে ৮০ হাজার বিডি মেম্বারের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা হয়। তখন দেখা গেছে যে, বিডি মেম্বাররা কোরবানির গরুর হাটের মতো বিভিন্ন হাটে বিভিন্ন দরে বিক্রি হয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে। সফল কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রবক্তা লেনিন বলেছেন যে, “আসলে ‘বর্জুয়া গণতন্ত্র’ শুধু শোষণকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে। যে পর্যন্ত ভ‚মি এবং অন্যান্য উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে, সে পর্যন্ত সবচেয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অবশ্যই হবে বুর্জোয়া একনায়কত্ব এবং গুটিকয় ধনীকের হাতে থাকবে বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি মানুষের নিষ্পেষণের যন্ত্র।”

বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর দেশের চলমান গণতন্ত্রকে পর্যবেক্ষণ করে গণমানুষের হৃদয়ের স্পন্দন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নাম দিয়েছিলেন ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’। অর্থাৎ এ ধরনের গণতন্ত্র হলো এমন একটি পদ্ধতি, যা শুধু কর্তৃপক্ষের বা শাসকদের নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতাসহ সব মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত থাকবে। সংবিধানে রাষ্ট্রের নামকরণ করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।’ ফলে রাজতন্ত্র বা ঔপনিবেশিক ভাবধারায় যদি রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তবে রাষ্ট্রের নামের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল থাকে না। আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেছেন যে, ‘For the People, by the People and of the people।’ অর্থাৎ মানুষের জন্য মানুষের দ্বারা মানুষের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের প্রতিফলন ঘটানোর যে পদ্ধতি তা হলো নির্বাচন। বাংলাদেশে নির্বাচন পদ্ধতি আজ যে অবস্থায় চলে গেছে তা পর্যালোচনা করলে গণতন্ত্রের অবস্থান কী অবস্থায় আছে, তা কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে? সরকার সমর্থিত একটি পক্ষ বলে বেড়াচ্ছে যে, ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’, যদি তাই হয় গণমানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রয়োগ বিধি কোন পর্যায়ে আছে? বা এটিকে কি কোনো ভাবে বিবেচনা করা যায়?

গণতন্ত্রের অনুশীলনের অন্যতম পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন। ‘নির্বাচন’ হলো একজন ভোটার বা নাগরিক তার ইচ্ছামতো কাক্সিক্ষত ব্যক্তিকে নির্ভয়ে নির্বাচিত করার একটি পদ্ধতি। সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচনের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রে নির্বাচন পদ্ধতি কোন অবস্থায় চলে আসছে তা পর্যালোচনার প্রয়োজন পড়ে না, কারণ বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই নির্বাচনপদ্ধতির বর্তমান পরিস্থিতির ভিকটিম।

সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়ে গেল। চর দখলের নির্বাচন হয় বলে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ঘোষণা দিয়েই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারি দল বনাম ‘স্বতন্ত্র ব্যানারে সরকারি দল’ নির্বাচনে অর্ধশতাধিক মানুষ হত্যা হয়েছে। আওয়ামী সরকার ২০০ বছরের ট্রাডিশনকে বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় নমিনেশন পদ্ধতি চালু করেছে। এ পদ্ধতিতে সরকারি দল তাদের নমিনেশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, ফলে তাদের দলেই গৃহদাহ হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীরাই জয়লাভ করেছে। এটি আওয়ামী সরকারের জন্য একটি অশনি সঙ্কেত।

সংবিধান রাষ্ট্রের প্রধান ও সবচেয়ে শক্তিশালী আইন। কিন্তু সংবিধান ও রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। সংবিধানের তৃতীয় চ্যাপ্টারে নাগরিকদের যে অধিকার দেয়া হয়েছে, সে অধিকার প্রাপ্তি থেকে জনগণ বঞ্চিত। শুধু ভোটাধিকার নয়, বরং বাকস্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের অধিকারসহ নাগরিক ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ফলে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, সুপার নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র, রাষ্ট্র অধিকর্তারা তাকে যতটুকু অধিকার বা অনুমতি দেয় সে ততটুকু ভোগ করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করে গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিধায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারের জন্য এ লজ্জা ঢাকার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমনটিই বলেছেন, এতে যুক্ত রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে না।

রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র কাম রাজনীতি দীক্ষা লাভ করার একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে নৈতিকতা সম্পন্ন নিষ্ঠাবান নেতাকর্মী তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ফলে আদর্শিক নেতাকর্মী তৈরি হওয়ার পরিবর্তে সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগীরা প্রাধান্য বেশি পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের পদপদবিতে পদায়ন ও নমিনেশন প্রাপ্তির পদ্ধতি সম্মানজনক অবস্থান উন্নীত হয় নেই, বরং অনৈতিক তদবিরই কাক্সিক্ষত পদপদবি ও নমিনেশন পাওয়ার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে বলে একটি পাবলিক পারসেপশন রয়েছে। জবাবদিহিতার প্রশ্নে দলগুলো সার্বিক বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। ‘জবাবদিহিতা’ একটি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক চালিকাশক্তি। রাষ্ট্রীয়ভাবে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস করা অত্যন্ত জরুরি।

দলগুলো রাজনৈতিকভাবে মোটিভেটেড করার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতাই মুখ্য বিষয় বলে মনে করে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো যখন ১/১১-এর মতো বিপর্যয়ে পড়ে সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী নেতাকর্মীরা ছিটকে পড়েন, দলে থেকে যান নীতিবান নেতাকর্মীরা। কিন্তু দল যখন ঘুরে দাঁড়ায় তখন সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগীদের সাথে কনটেস্ট করেই আদর্শিক নেতাকর্মীদের দলে টিকে থাকতে হয় এবং এটিই গণতন্ত্রের প্রাথমিক বিপর্যয়ের মূল কারণ।

সন্ত্রাসবাদ কী, এ বিষয়ে ৩০ বছর গবেষণা করে জাতিসঙ্ঘ এখন পর্যন্ত কোনো সংজ্ঞা দিতে পারেনি, যদিও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন একটি সংজ্ঞা দিয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী কর্তৃক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (হালে স্বাধীন বাংলাদেশ) যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তাকে গণহত্যা বা মবহড়পরফব হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ‘গণতন্ত্রের’ প্রকৃত রকম ও প্রকারভেদ কী ও কত প্রকার তা শাসনকর্তাদের ইচ্ছামাফিক সময়ে সময়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও মার্জনা করা হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের স্বাদ নিরীহ নিপীড়িত ও নীতিবান আদর্শিক নাগরিকরা ভোগ করতে পারেনি। গণতন্ত্রের ব্যানারে স্বেচ্ছাচারিতা এখন একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। কমউনিস্ট পার্টি নৈতিকতার কথা বলে, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নে তারাও স্বৈরাচার। মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মতোই কিছু মেরুদণ্ডহীন মানুষ ক্ষমতায় উচ্চ শিখরে বসে আছে। তাদের দায়িত্ব বিবেকের সাথে ক্ষমতার প্রয়োগ করা। কিন্তু বিবেকের প্রয়োগের পরিবর্তে তারা শুধু উপরস্থ কর্মকর্তাকে খুশি রাখার নিমিত্তে দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বর্ণিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রতিবাদ করতে পারে না, প্রতিবাদ করলে আরো বিপদে পড়তে হয় এবং গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ার এটাও অন্যতম নমুনা।

নৈতিকতা ও স্বার্থবাদিতা একই সাথে সমান্তরাল অবস্থায় চলতে পারে না, যা চলছে এখন রাজনৈতিক দলসহ সর্বত্র। বিত্তশালী ব্যক্তিরা এখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। পাশের রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে বিত্তশালী লোকেরা রাজনৈতিক দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। বিত্তশালীরাই নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে বিধায় আদর্শ ও নৈতিকতা ধোপে টেকে না। ফলে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকে ব্যবসাই মনে করে সেভাবেই রাজতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে আদর্শের পরিবর্তে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে জনগণ হয়রান বটে, প্রতিকারের উপায় নেই; কারণ ‘গণতন্ত্র’ এর মতো ‘জনগণও’ অসহায়। প্রতিকারের জন্য আদর্শিক নেতাকর্মীদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পন্থা নেই।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement