ছাত্রদের অর্ধেক ভাড়ার দাবি পূরণ হোক
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১৯:৩৬
শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহনের ভাড়ায় ছাড় দেয়ার বিষয়টি সেই পাকিস্তান আমল থেকেই চলে আসছে। বিশেষ করে বাস সার্ভিসে এটি এখনো অনেক রুটে চালু। কিন্তু সম্প্রতি এ নিয়ে সমস্যা দেখা দিচ্ছে যখন পরিবহন শ্রমিকরা বাসে শিক্ষার্থীদের ভাড়ার ক্ষেত্রে ছাড় দিতে অস্বীকার করছে। এ নিয়ে রাজধানীসহ দেশের অনেক জায়গায় শিক্ষার্থীরা দাবি জানাচ্ছে। আন্দোলনে নেমেছে। আর তাতে বাড়তি উত্তেজনা যোগ করছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। জনগণের যে কোনো দাবি বা আন্দোলন অঙ্কুরেই নির্মূল করতে পুলিশের পাশাপাশি সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ছাত্রলীগের ভূমিকা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বহু বছর ধরেই। নিরাপদ সড়ক চাইসহ শিক্ষার্থীদের সব আন্দোলনই মাস্তানি কায়দায় লগি বৈঠা হাতুড়ি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে সরকারি ছাত্রসংগঠনটি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাসের (অর্ধেক ভাড়া) দাবিতে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীতে ছাত্রদের যে আন্দোলন চলছে তাতে হামলা করেছে ছাত্রলীগ। তারা মহাখালী আমতলীতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। এতে তিতুমীর কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়।
এদিকে পরিবহন শ্রমিকদের মাস্তানি আরো ভয়াবহ। সংঘবদ্ধ এই শ্রমিকদের ব্যবহার করে যখন তখন সড়কে যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ফেলে পরিবহন মালিকরা। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘটনায় এমনই ঘটনা ঘটেছে। মানুষকে জিম্মি করে পরিবহন ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছেন মালিকরা। এক লাফে ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর ঘটনা বিশ্বের কোথাও হয়তো ঘটে না। কিন্তু এটি বাংলাদেশ। এখানে সবই সম্ভব। জ্বালানির দাম বাড়ানোর বা সমন্বয়ের জন্য একটি জাতীয় কমিশন আছে, যেটিকে বলা হয় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। কিন্তু দেখা গেল, সেই কমিশনকে পাশ কাটিয়ে তাদের সাথে কোনো রকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই তেলের দাম রাতারাতি বাড়িয়ে দিলো পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। এমন ঘটনা তো কেবল বাংলাদেশেই হতে পারে। আবার তেলের দাম বাড়ার সাথে সাথে হুট করে ধর্মঘটে চলে গেল পরিবহন মালিকরা। বলল, হয় তেলের দাম কমান, নাহলে ভাড়া বাড়ান। কোনো রকম আলাপ আলোচনা, আগাম ঘোষণা, কর্মসূচি ছাড়া পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে কোনো সেক্টরের লোকেরা এভাবে জনগণকে জিম্মি করতে পারে বিশ্বাস করা কঠিন। সরকার যেভাবে তড়িঘড়ি করে তাদের দাবি মেনে নিলো সেটা দেখেও মনে হলো, সরকার এটা করার জন্য যেন প্রস্তুতই ছিল।
কে না জানে, পরিবহন মালিকদের প্রায় সবাই সরকারি দলের সাথে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট? কেউ মন্ত্রী, এমপি, কেউ নেতা, কেউ বা কর্মী-সমর্থক। এরা বিরোধী দলের রাজপথের কর্মসূচি নস্যাৎ করতে তৎপর হয়ে ওঠেন, জনসভায় যাতে জনসমাগম হতে না পারে সেজন্য যেকোনো অজুহাতে যানবাহন বন্ধ করে দেন এমনকি বাস-ট্রাক রেখে পথও অবরোধ করেন। সুতরাং এদের আবদার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলেই মনে হয়। আর সেই দায়িত্বই তারা পালন করেছেন। তেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ, আর যানবাহনের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হলো ২৭ শতাংশ। কোভিড-১৯ মহামারীতে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়া জনগণের ওপর এই বাড়তি ভাড়ার বোঝা কতটা পীড়াদায়ক হবে সেই বিষয়টি বিবেচনার অবকাশ কারোরই নেই।
যাই হোক, ভাড়া বাড়ানোর কারণে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে। তারা ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদ করেনি, কোনো ওজর আপত্তিও তোলেনি। তারা কেবল বলেছে, বাসে স্টুডেন্টস কনসেশন অর্থাৎ অর্ধেক ভাড়া নেয়া হোক। এ নিয়েই তারা দাবি তুলেছে, আন্দোলনে নেমেছে। এটা এমন কোনো জটিল বিষয় নয়। কিন্তু জটিল করে তোলা হচ্ছে। ছাত্রদের হাফ ভাড়ার আন্দোলন ঘিরে পরিস্থিতি চরম নোংরামির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করার কারণ ঘটেছে। ভাড়া নিয়ে তর্কের জেরে তরঙ্গ প্লাস পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়েছে। সোমবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে এ ঘটনা ঘটে। রামপুরা থেকে কলেজে যাচ্ছিলেন ওই ছাত্র। বেশি ভাড়া চাওয়ায় প্রতিবাদ করেন তিনি। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে তাকে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় পরে তরঙ্গ পরিবহনের দুটি বাস আটক করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পুলিশ বাস দুটি ছেড়ে দেয়।
ওই ঘটনার দু’দিন আগে ভাড়া নিয়ে বিবাদের এক পর্যায়ে এক পরিবহন শ্রমিক ধর্ষণের হুমকি দেয় বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে। গত ২০ নভেম্বর সকালে ওই শিক্ষার্থী শনির আখড়া থেকে বদরুন্নেসা কলেজের উদ্দেশে বের হয়। পথে বাসের কন্ডাক্টরের সাথে ভাড়া নিয়ে বাগি¦তণ্ডা হয় তার। বাস থেকে নামার সময় কন্ডাক্টর তাকে বলে, একা পেলে দেখে নেবে এবং খারাপ কাজ করার কথা বলে। ‘খারাপ কাজ করার কথা বলে’ এটা হলো আমাদের রুচিবান পুলিশের ভাষ্য। তারা এভাবেই অভিযুক্ত ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে। এর একপর্যায়ে অজ্ঞাত কন্ডাক্টর অসৎ উদ্দেশে ওই শিক্ষার্থীর ওড়না ধরে টানও দেয়। একজন অশিক্ষিত পরিবহন শ্রমিকের এই ঔদ্ধত্য শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, ভয়ঙ্কর উদ্বেগেরও কারণ। তবে এটি অপ্রত্যাশিত নয়। সমাজে মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে ক্ষমতার আশ্রয়ে থাকা প্রতিটি ব্যক্তির মুখের বুলি ও শরীরী ভাষা যদি হয় মাস্তানির তাহলে সুসংগঠিত পরিবহন শ্রমিকরা লাই পাবে না তো আর কে পাবে? বদরুন্নেসার শিক্ষার্থী হেনস্থায় জড়িত ঠিকানা বাসের চালক ও হেলপারকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। একদিনের পুলিশ রিমান্ডও মঞ্জুর করেছেন আদালত। হয়তো তারা বলবে, ভুল হয়ে গেছে; হয়তো ক্ষমা চাইবে। তাদের ক্ষমা করে দেয়া হবে অথবা ন্যূনতম কোনো শাস্তিও হতে পারে। যে দেশে বাস চাপা দিয়ে মানুষ মেরে ফেলার কোনো প্রতিকার নেই সেখানে একজন ছাত্রীকে শুধু হুমকি দেয়ার কী শাস্তি হবে তা না বোঝার মতো কোনো বিষয় নয়। কিন্তু বিষয়টি অন্য কারণে উদ্বেগের। সেটি সামাজিক কারণ। সমাজে যার যার অবস্থানে থেকে নিজের জন্য মানানসই আচরণ করাই কাক্সিক্ষত। শিক্ষার্থী যদি শিক্ষকের মতো হুমকি ধমকি দেয় সেটা বেমানান হয়। ছাত্রলীগের কর্মী যদি মানুষের সাথে পুলিশের মতো আচরণ করে সেটাও বেমানান। বাসের কন্ডাক্টর যদি যাত্রীদের সাথে অসদাচরণ করে সেটাও। আর এসবই সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে। সমাজ টালমাটাল হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আমাদের সামাজিক ভারসাম্য টাল খেয়ে গেছে সেটা চিন্তাশীল মানুষমাত্রই স্বীকার করবেন।
এক লাফে ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর পরও পরিবহন মালিকরা কিন্তু সন্তুষ্ট নন। তারা এখনো সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকেও বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন এবং সেটা মাস্তানি করেই। বাস বন্ধ করে দিচ্ছেন যখন তখন। সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। আর ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের যে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেটিও বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের সমস্যা নয়। সাধারণ মানুষেরই সমস্যা। কারণ শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ব্যয় অভিভাবককেই বহন করতে হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তাদের দাবি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ জন্য টাস্কফোর্সও গঠনের কথাও বলেছেন। এখন পর্যন্ত তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ঠিক একই রকম আন্দোলনের মুখে ২০১৫ সালে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, রাজধানীতে চলাচলরত বিআরটিসির পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেবে। না নিলে সংশ্লিষ্ট পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ মন্ত্রীদের এসব ঘোষণা যে বাচ্চার হাতে লেবেঞ্চুস ধরিয়ে দিয়ে তাকে বুঝ দেয়ার শামিল তা বুঝতে এখনো কারো বাকি আছে বলে মনে হয় না।
কিন্তু এটি হওয়া উচিত না। কারণ এটি এখন পাকিস্তানিরা শাসন করছে না। পাকিস্তানিদের হটিয়ে যারা স্বাধীনতা এনেছেন তারাই এখন ক্ষমতায়।
পাকিস্তানি শাসকরা কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের দাবি মেনে নিয়েছিলেন অথবা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ছাত্রদের ঐতিহাসিক ‘১১ দফা’ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হাফ ভাড়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখিয়ে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ‘কন্সেশনে’ টিকিট দেওয়া, মাসিক টিকিটে ‘কন্সেশন’ দেয়া এবং দূরবর্তী অঞ্চলে বাসে যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেশন’ দিতে হবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেশন’ দিতে হবে এ কথাও ছিল ১১ দফায়। আইয়ুব খানের মতো এক ঔপনিবেশিক শাসক যেসব দাবি পূরণ করেছিলেন সেগুলো তো স্বাধীনতার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়ন করার কথা। কেন করা হয়নি সেই প্রশ্ন মনে জাগছে আজকের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং মন্ত্রীদের আচরণ দেখে। সহযোগী একটি দৈনিকে একজন কলামিস্ট মন্তব্য করেছেন, ‘যে অধিকার শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আদায় করেছে, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সেটির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই, এর চেয়ে লজ্জার কী আছে। সরকারের মন্ত্রীরা নানা সময়ে বক্তব্য নিয়ে সেটিকে আরো তামাশার বিষয় বানিয়ে ফেলেছেন।’
গণপরিবহনে ছাত্রদের জন্য হাফ ভাড়ার আইনগত ভিত্তি এখনো নেই। কিন্তু এটি যে শিক্ষার্থীদের অধিকার তা তো আওয়ামী লীগই প্রতিষ্ঠা করে গেছে ১১ দফার অনুমোদন দিয়ে। তাই সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, এই বিষয়টি নিয়ে আর কোনো চাল-চালিয়াতির আশ্রয় নেয়া উচিত নয়। অবিলম্বে দাবি মেনে নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক। এটি শুধু ছাত্রদের জন্য নয়, সব অভিভাবকের জন্যও সামান্য হলেও স্বস্তির কারণ হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা