গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি : দায় কে বহন করবেন
- মীযানুল করীম
- ২১ নভেম্বর ২০২১, ২১:০৪
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এবং ড্যাফোডিল ভার্সিটির ডিন ড. শামসুল আলমের মতো দেশবাসীর প্রশ্ন, দুনিয়ার বাজারে যখন দাম কম ছিল, তখন দেশে জ্বালানির দাম কমানো হয়নি। তা হলে এখন বাড়ানো হলো কেন? জনমনে আগে জিজ্ঞাসা, দেশে নিত্যপণ্যের চড়া দামের মাঝে জ্বালানির দামও বাড়ল কী কারণে? এটা কি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ নয়? কেন ‘সমঝোতার ধর্মঘট’ আর কথিত চুক্তি? মনোভাবটা যেন, ‘মর ব্যাটা পাবলিক’। যত দোষ নন্দঘোষ। ভাড়া বাড়লেও ‘আমলা-কামলাদের’ কোনো চিন্তা নেই। কারণ, তাদের সরকারি গাড়ি আছে। কত লাগবে এর তেল? ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’ অথবা ‘সরকার কা মাল দরিয়ামে ঢাল।’ প্রতিপক্ষ পরিবহন নেতাদেরও বহন করার ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, যা বেসরকারি।
কিন্তু মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বিত্তহীনরা নিরুপায়। তাদের গণপরিবহন ছাড়া কোনো উপায় নেই। এমনকি ‘ঘন’ হয়ে মানে, ঠাসাঠাসি করে হলেও বাস-মিনিতে তাদের চড়তে হবে। এই মহানগরী ঢাকাতে ২০০৫-০৬ সালেও যাদের দেখেছি মতিঝিল থেকে আট টাকা দিয়ে বাসে মিরপুর যেতেন, সেসব নিম্নবিত্ত মানুষ এখন আর (৩৫X২) ৭০ টাকা খরচ করে মতিঝিল-মিরপুর রুটে চলাচল করতে পারেন না। কারণ প্রায় ৯ গুণ ব্যয় বৃদ্ধি। তাদের বেতন বা আয় তো সে তুলনায় বাড়েনি। ভাঙাচোরা রাস্তায় তাই তাদের বিরাট অংশ মিরপুর থেকে হেঁটে যান অন্তত ফার্মগেট অবধি। আগারগাঁও-তালতলার মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদেরও একই দুর্দশা। কারণ পাঁচ টাকার ভাড়া এখন চার গুণ হয়ে গেছে। অনেক ভোরে মর্নিং ওয়াকের সময় বাসা থেকে বাধ্য হয়ে বেরিয়ে যান দূরবর্তী অফিসে পৌঁছতে। তবে সেখানে যেতে যেতে অফিস শুরু হয়ে যায়। বেজে যায় সকাল ৯টার বেশি। আর রাস্তার অবস্থা হলো, হয়তো ফুটপাথ নেই নয়তো তা থাকলেও যেন ‘দীর্ঘ একটা টয়লেট’ যা মলমূত্রে পরিপূর্ণ থাকে হরদম। এ নিয়ে আমরা বাধ্য হয়ে সাধের ঢাকায় পড়ে আছি জীবন ভর।
গণপরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সাথে সাথে ‘গণে’র বা গণমানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ যেন ‘মরণফাঁদ’ আর ভাড়া বাড়ানোর ফাঁদে পা না দিয়ে যেন কারো উপায় নেই। তা-ও ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে অচল ছুতানাতায় এবং সম্পূর্ণ খোঁড়া অজুহাতে। আন্তর্জাতিক হিসেবে পরিবহন ভাড়া বাড়ানো যায় (যদি এতই জরুরি হয়) বড় জোর ৭ শতাংশ আগের তুলনায়; সরকার বলেছে, ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে আর বাস্তবে আদায় করা হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি। এ ক্ষেত্রে লাভের গুড়ের ওজন কেমন আর তা পিঁপড়ার খাওয়া সম্ভব কি না, সেটি সবার জানা। অন্য দিকে, সরকারি সংস্থা বিপিসি চুটিয়ে নিকট অতীতে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেও বলছে, ‘আমাদের লোকসান হয়েছে।’ বাংলাদেশে সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান সাধারণত লাভের মুখ দেখে না। সেখানে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা বিপিসি কম লাভ করেনি। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলেও এ দেশে কমানো হয় না। তবে মাত্র ১ শতাংশ বাড়লে একই যুক্তিতে কয়েক গুণ বেশি বাড়াতে আর তর সয় না।
এ দিকে এবার পরিবহন ভাড়া অন্তত ৪০ শতাংশ বাড়ানোর কয়েক দিন পর টিভির ব্রেকিং নিউজ : আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। গ্যাসের দাম কমেছে আরো অনেক বেশি। দাম কমার কথা জেনে সাধারণ মানুষের হার্টব্রেক হওয়ার উপক্রম।
যে দিন পরিবহন নেতাদের সাথে প্রশাসনের নেতাদের (অর্থাৎ ক্ষমতাধর আমলা) চুক্তির সে সময়ে একজন পরিবহন নেতাকে সেখানে দেখে অনেকেই হতবাক! তিনি ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা এবং সম্প্রতি এ দলের নমিনেশন চেয়েছেন ইলেকশনে। অবশ্য নিজে সিলেকশনে বর্তমানে নেতা। সোজা কথা, চুক্তির টেবিলে দু’পক্ষেই ক্ষমতাসীন মহল। এ দু’ধারী তলোয়ার থেকে রেহাই পাওয়া সহজ নয়। এটা যেন শাঁখের করাত -আসতেও কাটে, যেতেও....। দাম বেড়েছে ডিজেলের। তবে সব গাড়ির মালিক ভাড়া বাড়াতে চেয়েছেন। ডিজেলে কত শতাংশ যানবাহন চলে, জানি না।
ডিজেলের সাথে প্রধানত গরিবের কেরোসিনের দামও বেড়ে গেছে। তা নিয়ে কিন্তু এত হইচই নেই। কেন? ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বড় অভিঘাত আমাদের কৃষিক্ষেত্রে। বাংলাদেশ আজো কৃষিনির্ভর। এ দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে যতই ‘সাদা কলার বাড়ুক, কৃষি ‘নট’ তো সব কিছু স্টপ। অর্থনীতি এত বেশি কৃষিনির্ভর আজো।
ব্যক্তিগতভাবে পরিবহনে বর্ধিত ভাড়া দিয়েছি মুখবুজে। অন্যথায় ‘খবর’ থাকে বৈকি। তবে ভাড়া বেশি দিয়ে বেশি সময়ে অনেকেই অফিসে পৌঁছে। কারণ, গরিবের দেশে গরিবের উন্নয়নের জোয়ার। তাই রাস্তাঘাট ভেঙেচুরে একাকার; ফুটপাথও শেষ। উন্নয়ন জোয়ারে একবার ডুবা, একবার ভাসাই, বোধহয় এ জাতির নিয়তি। তবুও জনগণের কপাল পোড়ে। অথচ কপাল খুলে যায় হাতেগোনা কিছু ভাগ্যবানের।
এবার স্টিকার লাগানোর জন্য ‘মোবাইল কোর্ট’ বসেছিল রাজধানীতে। এটা লাগালে শাইন, না লাগালে ফাইন (জরিমানা) - এ নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। স্টিকারে লেখা থাকছে গাড়ি ‘ডিজেল চালিত’ কি না। এ উদ্যোগ ভালো তবে চালক-হেলপাররা আরো ‘সেয়ানা।’ সে দিন মতিঝিলগামী গাড়ি যানজটের কথা বলে গুলিস্তান বঙ্গভবন হয়ে হাটখোলা যেতেই মোবাইল কোর্টের বিষম ধাক্কা। তাই সিনেমা হলের বারান্দায় বসা সে কোর্ট এড়িয়ে আরো দক্ষিণে পৌঁছে গেল মিনিবাসটি। অতদূরে নেমে বাধ্য হয়ে অনেকপথ উল্টো হেঁটে অফিসে পৌঁছলাম। ভাড়া কিন্তু আগের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। নিজের কষ্টটা ৪০ শতাংশ বেশি না হলেই হলো - এই প্রবোধ নিজেকে দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু এভাবে কতদিন? পরিবহনে কে গৃহস্থ আর কে নয়, বুঝা কঠিন। তাই চুপ থাকাই উত্তম। তবে পেশার তাগিদে কলম না চালিয়ে উপায় নেই। তাই লেখা। মানি, এতে কিছু হবে না।
গত বুধবার ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাতে গেলে রাজধানীর মিরপুরে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ, স্বীয় স্বার্থেই সাধারণ যাত্রীদের পণবন্দী করা হয় পরিবহন শ্রমিকদের দিয়ে। এসব যাত্রীর বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত। তাদের অবস্থা এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। যা হোক, প্রমাণিত হলো, বর্তমান যুগে ‘মোবাইল’ই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। কারণ, মোবাইল কোর্টকে সাফল্যের সাথে ফাঁকি দিয়েছেন আরো মোবাইল বা গতিশীল, গণযানের চালাক চালক-হেলপাররা। খোদ রাজধানীতে অনেকেই সে দিন এসব ব্যাপার লক্ষ করেছেন। মোবাইল কোর্টের নামফলক প্রধান সড়কে রেখে কোথাও কোথাও কোর্ট অনেক দূরে বসেছিলেন। ফলে তাদের ফাঁকি দেয়া সহজ হয়ে যায়।
যারা ‘ডিজেল চালিত’ স্টিকার লাগান অনিচ্ছায়, বর্ধিত ভাড়ার তালিকা গাড়িতে লাগাতে চান না পথের সামান্য দূরত্বের জন্যও অনেক বেশি ভাড়া আদায়ে কোনো দ্বিধা করেন না, তাদের আটকানো সহজ নয়। যেখানে সেখানে গাড়ি না থামানোর জোরালো ঘোষণা দিলেও তারা তার বিপরীতটাই করে থাকেন হামেশা। এতে সাধারণ পাবলিকেরও অভ্যাস নষ্ট হয়ে যায়। তারাও সুযোগ পেয়ে যত্রতত্র হাত তোলেন যানবাহন থামাতে। অথবা গাড়ি তাদের দেখলেই কোলে করে হলেও তোলার জন্য থেকে যায়। মতিঝিল কিংবা গুলিস্তান রুটের অনেক গাড়ি মিরপুর যেতে আগারগাঁও পার হলেই আর যেন আইনকানুনের ধার ধারতে চায় না। তখন ‘ছাগলের মতো যাত্রী ঠেসে, গরুর গাড়ির মতো মিনিবাস চলে।’ এটা জনৈক বিক্ষুব্ধ যাত্রীর কথা। প্রতিদিন অবাধে চলছে এসব অবৈধ কারবার।
মিরপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত আগে ১০ টাকায় আসা যেত। পরে মিনিবাসগুলো ১৫ টাকা মাথাপিছু আদায় করতে শুরু করে দেয়। এখন ২০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে বর্ধিত ভাড়ার সুবাদে। অর্থাৎ এটা সমঝোতার পরিবহন ধর্মঘটের সুফল। তবে এ ফলের দায় মূলত প্রশাসনকে বহন করতে হবে। সবাই জানেন কারা ‘সর্প হইয়া দংশন করে; ওঝা হইয়া ঝাড়ে’। পরিবহন ব্যবসায়ীরা সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখার প্রমাণ দিয়েছেন এবার।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আর কত ভর্তুকি দেয়া যায়? সর্বমোট ৫৩ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির উল্লেখ করা হয়েছে। কথা হলো, এর দায় গরিব সাধারণ মানুষকে কেন বেশি টানতে হবে? যারা এর ভোগকারী, তারা অর্থাৎ মালিকপক্ষেরই মূলত দায় নেয়া উচিত। তাদের তো কেবল লাভ আর লাভ। নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরাট দায়িত্ব থাকে। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে বলে দেশেও দাম বাড়াতে হলো। কিন্তু বিশ্বের বাজারে যখন তেলের দাম কমেছিল, তখন তো দাম কমেনি। জ্বালানির বর্ধিত মূল্যের বিপুল অর্থ অন্য খাতে ভর্তুকি হিসেবে না দেয়াই উত্তম। কারণ এতে জনদুর্ভোগ বেড়ে যায়। এর প্রধান শিকার সীমিত আয়ের মানুষজন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা