হাজী শরীয়তুল্লাহর লড়াই
- মুসা আল হাফিজ
- ০১ নভেম্বর ২০২১, ১৯:১০
(দ্বিতীয় কিস্তি)
আরবি ফারাইজ হচ্ছে ফরিজাতুনের বহুবচন। ফারিজা বা ফরজ মানে হচ্ছে অবশ্য পালনীয়। ফরায়েজী আন্দোলন মূলত ইসলামের অবশ্যপালনীয় কর্তব্যে মুসলিমদের অনুশীলন নিশ্চিত করতে জোর দিচ্ছিল। প্রধান কর্তব্য হলো- কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত। প্রধান বিষয়গুলো উপেক্ষা করে ইসলামে অস্বীকৃত কিংবা ইসলামবহির্ভূত বিষয়াবলিকে ইসলাম হিসেবে পালনের প্রথা পরিহারে উদ্বুদ্ধ করেন ফরায়েজীরা। ইসলামের সত্যিকার অনুশীলনে ফিরে যাওয়া এবং মুসলিম সমাজের পরিশুদ্ধি ছিল তাদের প্রয়াসের মর্মমূলে। তাওহিদের বিশুদ্ধতার প্রতিষ্ঠাদান, সুন্নাহর অনুসরণ ও প্রসারের নিশ্চয়তা বিধান, তাওবার প্রক্রিয়ায় পাপ থেকে ফিরে এসে ধর্মনৈতিক শুদ্ধাচারে কল্যাণী জীবন-অনুশীলন ইত্যাদিকে এ আন্দোলন গুরুত্ব দেয়। অন্যান্য মুসলমানের চেয়ে কড়াকড়ি নৈতিকতা অবলম্বন করতেন তারা। তাওহিদের সাথে সঙ্গতিশীল নয়, এমন বিষয়াবলি পরিহারে মুসলিমদের উদ্বুদ্ধ করেন। এ আন্দোলন মুসলিম সমাজে বর্ণবাদকে রুখে দাঁড়ায়, অনুসারীদের বংশীয় পদবি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। খাবার-দাবার, পোশাকাদি, আচার-আচরণকে ইসলামের বিধান ও সংস্কৃতির অনুগত করতে সচেষ্ট হয়। অতএব ধুতি নয়, লুঙ্গি-পাজামা, বংশীয় শ্রেষ্ঠত্ব নয়, মানুষে মানুষে সমতা, কোনো সৃষ্টির সমীপে পূজা নয়, নিরঙ্কুশ তাওহিদ, এমনকি গরুর গোশত নিষিদ্ধ হতে পারে না...
বিকাশের ধারায় এ আন্দোলন বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের সাথে হয় অবিচ্ছেদ্য। ইসলামী পুনরুজ্জীবনবাদে উদ্বুদ্ধ করার পথে মুসলিম কৃষক শ্রেণীর ধর্মীয় জীবনাচারে চেপে বসা অনৈসলামিক বিশ্বাস ও আচারকে সে সংশোধনের প্রয়াস জারি রাখে। এ প্রক্রিয়ায় এ আন্দোলনের সূচনা হলেও অচিরেই বৃহত্তর আরেক রণাঙ্গনে তাকে অবতীর্ণ হতে হয়, যা প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই। ব্রিটিশ শোষণের অক্টোপাসী বেষ্টনী গণজীবনকে চেপে ধরেছিল সব দিক থেকে। নবোত্থিত জমিদার শ্রেণী মূলত ছিল হিন্দু। যাদের প্রধান অংশ ছিল ঘোরতর সাম্প্রদায়িক ও মুসলিম নিপীড়নে উৎসাহী। তাদের অনেকেই ছিল হিংস্র, দেবী সিংহের মতো ডাকাত; জমিদার হয়ে যিনি রাজা-মহারাজা উপাধি ধারণ করেন। কিন্তু উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য হয়ে উঠেন জীবন্ত যমদূত!
জমিদাররা কালীপূজা, দুর্গাপূজা, রথযাত্রা ইত্যাদির জন্য কর নিত- কী হিন্দু থেকে, কী মুসলিম থেকে। জমিদার সন্তানের অন্নপ্রাশন, বিয়ে বা ‘জামাই খরচা’ ইত্যাদির নামে লেগেই থাকত বাড়তি খাজনার দাবি। ১৮৭২ সালে ফরিদপুরে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটের এক তদন্তে দেখা যায়, কৃষকদের ওপর জমিদারদের আরোপিত অবৈধ করের সংখ্যা ২৩-এর কম নয়। কোনো মুসলিম দাড়ি রাখলেও কর দিতে হতো। নিজেদের এলাকায় তারা কোরবানি বন্ধ করে, আজান নিষিদ্ধ করে, গরু জবাই ও গোশত খাওয়ার ওপর জারি করে নিষেধাজ্ঞা। যখন তখন তাদের নিপীড়ন নেমে আসত নিঃস্ব প্রজার ওপর। তারা লাঠিয়াল বাহিনী পুষত এবং প্রতিকারের জন্য জনগণের সামনে কোনো রাস্তা ছিল না। আদালত বস্তুত ছিল তাদের নাগালের বাইরে। উৎপীড়ক জমিদার ও নীলকরদের থাবা থেকে কৃষক-জনতাকে রক্ষার লড়াই করে ফরায়েজী আন্দোলন। এসব অত্যাচারকে চ্যালেঞ্জ করে এবং কৃষক ও মজলুম প্রজার অধিকারের পক্ষে দাঁড়ায় শক্তভাবে। বাড়তি ট্যাক্স দিতে অস্বীকার করে কৃষককে রুখে দাঁড়ানোর পটভূমি ও শক্তি জোগান দেয়, ঐতিহ্য তৈরি করে। ব্রিটিশ শাসক ও জমিদার শ্রেণীর সর্বময় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে সংগঠিত এ আন্দোলন। গণজীবনে এর প্রভাব ও আবেদন তৈরি হয়। পূর্ব বাংলা-আসামের গ্রামেগঞ্জে, লোকজীবনে সে একাত্ম হয়, নিপীড়িতের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়, তাদের সরবরাহ করে জীবনীশক্তি।
দেশের ভেতরে সামাজিক শাসনের বিকল্প শৃঙ্খলা তৈরি করে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে আপন কর্তৃত্বে নিয়ে নেন ফরায়েজীরা। গড়ে তোলেন বিচার, নিরাপত্তা ও সমাজনৈতিক নিজস্ব পরিকাঠামো। জেমস ওয়াইজের মতে, পূর্ব বাংলার পঞ্চায়েতগুলো জনগণের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং ফরায়েজী গ্রামগুলোতে সংঘটিত হিংসাত্মক বা মারামারির কোনো ঘটনা কদাচিৎ নিয়মিত আদালত পর্যন্ত গড়াত। ফরায়েজীপ্রধান ঝগড়া-বিবাদ নিষ্পত্তি করতেন, তাৎক্ষণিকভাবে বিচারকাজ সম্পন্ন করতেন এবং যেকোনো হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিষ্টান তার পাওনা আদায়ের জন্য ফরায়েজী নেতার কাছে অভিযোগ পেশ করতেন। জমিদারদের বিরুদ্ধে ফরায়েজীদের সহায়তা লাভের জন্য এ আন্দোলনে যোগ দেন বিপুলসংখ্যক হিন্দু ও দেশীয় খ্রিষ্টান।
ফরায়েজী এ সাংগঠনিকতাকে বিকল্প রাষ্ট্রের আয়োজন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে জমিদার শ্রেণী। ১৮৩৭ সালে তারা শরীয়তউল্লাহকে তিতুমীরের মতো স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগঠনের উদ্যোগের জন্য অভিযুক্ত করে। ফরায়েজীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় অসংখ্য মামলা। ইউরোপীয় নীলকররা তাদের সহায়তা করে। কিন্তু ফরায়েজী প্রচেষ্টাগুলো ছিল সুচিন্তিত। রাষ্ট্র ও প্রচলিত আইনকে সরাসরি লঙ্ঘন করছিল না তাদের প্রয়াস। দিন শেষে অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। আদালত তা খারিজ করে দেন। হান্টার উল্লিখিত গ্রাম পোড়ানো, প্রজা হত্যা ইত্যাদির অভিযোগও হাজী শরীয়তুল্লাহর বিরুদ্ধে ছিল না। যদিও উত্তেজনা বিস্তারের দায়ে কিছুদিন তাকে পুলিশি হেফাজতে রাখা হয় অন্য এক মামলায়। শরীয়তুল্লাহ পরবর্তী ফরায়েজী নেতা মুহসেন উদ্দীন দুদু মিয়ার নেতৃত্বে জমিদারবিরোধী প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের ওপর মূলত হান্টারের এ আরোপ।
দুদু মিয়া অত্যাচার থামাতে কানাইপুরের কুখ্যাত শিকদার পরিবার ও ফরিদপুরের ঘোষদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। জমিদার মদন ঘোষ নিহত হন এক লড়াইয়ে। ১১৭ জন ফরায়েজী আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন এবং তাদের মধ্যে ২২ জন দায়রা জজ কর্তৃক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
জমিদার-নীলকররা তার বাড়িতে হামলা করে। তার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। প্রতাপশালী নীলকর এন্ড্রু ডানলপ ছিলেন এর নেতৃত্বে। তার গোমস্তা ছিলেন কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলাল। ১৮৪৬ সালের অক্টোবর মাসে পাঁচ্চরের হিন্দু বাবুদের সাথে মিলে আনুমানিক সাত-আট শ’ লোক নিয়ে কাঞ্জিলাল বাহাদুরপুরে দুদু মিয়ার বাড়ি আক্রমণ করেন। তারা তার ঘরের সামনের দরজা ভেঙে ফেলেন, চারজন পাহারাদারকে হত্যা করেন এবং অন্যদের মারাত্মকভাবে জখম করে নগদ অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ কেড়ে নেন। হান্টারের বিবরণে এ হত্যা ও আক্রমণ হত্যা হয় না, এ অন্যায় জায়গা পায় না তার বিচারে। হান্টার কি একে ন্যায্য মনে করতেন, যেমনটি করেছিল তখনকার স্থানীয় প্রশাসন। তারা কাঞ্জিলালের সাথে সংঘর্ষের জন্য গ্রেফতার করেছিল দুদু মিয়া ও তার সাথীদের। যদিও পরবর্তী বিচারে তিনি ও তার সাথীরা বেকসুর খালাস পান।
আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গণমানুষের লড়াই-সংগ্রামে ইসলামের অবশ্যম্ভাবী ভূমিকাকে প্রতিফলিত করতে সক্রিয় থাকে ফরায়েজী আন্দোলন। সেই কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখায়, যাদের মানবসত্তাকে পদাঘাত করছিল ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের দেশীয় অনুচর জমিদার গোষ্ঠী। তারা কৃষিজ উৎপাদন করবে। কিন্তু লাভবান হবে শুধু শোষক শ্রেণী। এমনকি ধান-পাট ইত্যাদির বদলে কৃষককে বাধ্য করবে নীল চাষে। যার সাথে কৃষকের বিন্দুমাত্র স্বার্থ জড়িত নেই, আছে কেবল নীলকর ও কলোনি শাসকদের স্বার্থ। কৃষক শ্রম, অর্থ ও জীবন বিনিয়োগ করবে, পাবে না কিছুই। সবকিছুর রক্ত-মাংস শুষে নেবে কোম্পানি ও জমিদারি। আবাদ করবে যে কৃষক, তার স্থান হালের বলদের অধিক নয়। আপন স্বার্থ ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করতে সে রাজি না হলে সব ধরনের অত্যাচার তার জন্য অপেক্ষা করবে, এমনকি মৃত্যু!
সেই কৃষকদের নিয়ে জমিদারদের কালচারকে, আচারকে, প্রত্যাখ্যান করে স্বকীয় আচার ও সংস্কৃতির পুনরোজ্জীবন আদতেই ছিল প্রবল এক বিদ্রোহ। হান্টার এর মূল্য ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব জানবেন না, তা তো নয়। অতএব ঔপনিবেশিক কেরানি হিসেবে ঠিকই তিনি একে বিপজ্জনক আখ্যা দেন। কারণ জানা যায় স্বয়ং হান্টারের ভাষ্যে। লড়াকুদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও সক্ষমতার প্রসঙ্গ হাজির করেন তিনি। জানান, ‘দক্ষ সংগঠনের মাধ্যমে তারা মুরিদদের তাকিদে যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই আস্তানা স্থাপন করতে পারত। প্রত্যেক জেলাতেই একজন করে প্রচারক নিযুক্ত হয়। ভ্রাম্যমাণ মিশনারিরা মাঝে মধ্যে এসব জেলা সফরকালে সেখানকার স্থায়ী প্রচারকদের উদ্যম জাগ্রত রাখতে থাকে।’
‘অর্থ সংগ্রহ ব্যবস্থাটা সহজ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। গ্রামগুলোকে বিভিন্ন আর্থিক এলাকায় বিভক্ত করে প্রত্যেক এলাকার জন্য একজন করে প্রধান ট্যাক্স আদায়কারী নিয়োগ করা হয়। যে গ্রামের জনসংখ্যা খুব বেশি, সেখানে একাধিক আদায়কারী নিয়োগ করা হয় এবং তার মধ্যে একজন মৌলবি থাকতেন যিনি সমাজে ইমামতি করতেন। একজন জেনারেল ম্যানেজার রাখা হয়, যিনি মুসলমানদের দুনিয়াবি কাজের তদারক করতেন। এ ছাড়া একজন অফিসার থাকতেন, তার কাজ ছিল বিপজ্জনক চিঠিপত্র বিলিবণ্টন ও রাজদ্রোহমূলক খবরাখবর আদান-প্রদান করা।...’
ব্রিটিশ কলোনির স্থানীয় লাঠিয়াল ছিল জমিদার শ্রেণী। তাদেরকে, তাদের শোষণ ও স্বেচ্ছাচারকে সবলে ‘না’ বলার মানে ছিল গোটা ব্রিটিশ কলোনিকে না বলা। অতএব হাজী শরীয়তুল্লাহ এ দেশকে দারুল হারব তথা শত্রুকবলিত দেশ বা যুদ্ধভূমি হিসেবে আবদুল আজিজ দেহলবীর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করলেন। এর স্পষ্ট দাবি ছিল শত্রু তাড়ানো। মানে স্বাধীনতা।
কলোনি শাসক ও তার শিখণ্ডিদের চাপিয়ে দেয়া ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আত্মপরিচয়ভিত্তিক নিজস্বতার সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূগোল নির্মাণ করে ফরায়েজী আন্দোলন এদেশে গণজীবনে সত্যিকার ইসলামের প্রতি অভিমুখের নবযুগ ও নবসক্রিয়তা কেবল আনেনি, বরং বৃহত্তর আত্মসত্তা ও স্বাধীনতার পথে জাতিগত প্রস্তুতির নতুন যুগের উদয় ঘটিয়েছে। ১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তার ছেলে মোহসেন উদ্দিন দুদু মিয়ার হাত ধরে ফরায়েজী আন্দোলন আমাদের আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা এবং সত্যিকার ধর্মজীবনের উত্থানের প্রয়াসের পাশাপাশি স্বাধীকারচেতনার নতুন জমি তৈরি করে দেয়, যার ওপর পা রেখেছে কৃষিপ্রধান বাঙালি মুসলমানের পরবর্তী অগ্রগতি!
লেখক : কবি, গবেষক
ই-মেইল: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা