২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গবেষণাকে উন্নয়ন সহযোগী করতে হবে

- ফাইল ছবি

[গতদিনের পর]

আমাদের সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থার কথা বিশেষ করে গবেষণা সম্পর্কে হতাশাজনক পরিস্থিতির পাশে যদি বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হয়, তবে বলতে হবে, সেটা মৌলিক গবেষণা ও উদ্ভাবনের এক অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশের অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষিবিষয়ক যত গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো নানা প্রতিক‚লতার মধ্য দিয়েও কৃষিসংক্রান্ত শিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করাসহ গবেষণাকার্যক্রম চালিয়ে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের কৃষি তথা খাদ্যশস্য, শাকসবজি, ফলমূল ও মৎস্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ঘটিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। এসব বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাকার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি অর্জন করতে পেরেছে। তাছাড়া জাতীয় উন্নয়নে প্রশংসনীয় অবদান রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষির যে উন্নতি ক্রমবর্ধমান তার কারণ এটাই।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে হবে, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে কৃষি খাত। জাতীয় উন্নয়নের যে স্বপ্ন আমাদের রয়েছে সেখানে কোনো সংশয় ছাড়াই বলতে হবে, কৃষিকে অবশ্যই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে কিছুমাত্র অবহেলা করা হবে আত্মঘাতী।

মান্ধাতা আমলের সনাতনী কৃষিপদ্ধতি থেকে সরে এসে সেখানে উন্নয়ন হচ্ছে ক্রমাগত। এখন কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, নানামুখী কৌশলে রোগবালাই দমন, কৃত্রিম উপায়ে শাকসবজি ও মাছচাষ, ছাদ কৃষি, প্রভৃতির মাধ্যমে অভ‚তপূর্ব উন্নতি হয়েছে। এই খাতে বেশির ভাগ অবদান রাখছে ময়মনসিংহে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’। কেননা, কৃষি ক্ষেত্রে যত ধরনের উদ্ভাবন ও নতুন জাত তৈরি করছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা, তাদের বেশির ভাগই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। এজন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে কৃষিবিদ তৈরির আঁতুড়ঘর বলা হয়।

কৃষি ক্ষেত্রে গৌরবজনক সাফল্যের পেছনে রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কৃষিবিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনা ও বিস্তর গবেষণা। ১৯৬১ সাল থেকে দক্ষ ও মানসম্পন্ন কৃষিবিদ তৈরি করে যাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ৫৮ বছরে গৌরবোজ্জ্বল পথ চলার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সাফল্য। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্য ও ফসলের নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং নানামুখী শস্যের জাত উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছেন। এখনো বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রম চলমান। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার মতো, এখানে যত সব নতুন উদ্ভাবন হয় তা দ্রুত মাঠপর্যায়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াই।

আমন, আউশ ও বোরো মওসুমে ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বে ধানের গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন। আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন।

এমন সব ইতিবাচক অগ্রগতি দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ আশাবাদী করবে। কিন্তু মুদ্রার একটি পিঠ রয়েছে, যা বেদনাদায়ক ও হতাশাজনক। যে দেশের প্রাণ কৃষি, সেখানে সরকারি কর্তৃপক্ষের নজরটা থাকা কত বেশি জরুরি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কর্তৃপক্ষের এ ক্ষেত্রে উদাসীনতা অপরিসীম। ভ‚মি জরিপ বিভাগের তথ্যানুসারে ১৯৭১ সালে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল দুই কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। আর এখন তার পরিমাণ অনেক কমেছে অপরিকল্পিতভাবে ভ‚মির ব্যবহারের কারণে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দুই কোটি এক লাখ ৫৭ হাজার একর বা মাত্র ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। কী নিদারুণ ভাগ্য। কৃষিজমি কিভাবে হাত ছাড়া হচ্ছে এটাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছরই এখানে এক শতাংশ হারে কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কমছে প্রায় ২১৯ হেক্টর আবাদি জমি। আবাদি জমি কমার এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশে মোট কৃষিজমির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাবে; দেশে উৎপাদনশীল খাত বন্ধ করে যে আমদানিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার ষড়যন্ত্র চলছে, তা পূর্ণতা লাভ করবে; নানামুখী সঙ্কট সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে স্বাভাবিকভাবে নস্যাৎ করে দেবে। সরকারের উচ্চমহলের কাছে অবশ্যই এসব নেতিবাচক পরিসংখ্যান রয়েছে, তার কিছুটা পর্যালোচনা হবে আশা করি।

১৯৭১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি ৯০ লাখ। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটির মতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়া সাপেক্ষে খাদ্যঘাটতি প্রায় নেই বললেই চলে। অবাক হওয়ার বিষয়, আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমা সত্তে¡ও উৎপাদন বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৬৬ দশমিক ৩৫ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে। এই কৃতিত্ব কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রাপ্য। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ উপরে বলা হয়েছে বটে; তবে কৃষির জন্য সম্মুখে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তা হয়তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এখনো আঁচ করতে পারছি না। এসব সঙ্কটের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টির কারণে আবহাওয়া ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। অথচ বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা অনেকটাই জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। তাই জলবায়ুর তারতম্য ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই কৃষি বিপদে পড়বে। দেশে সেচের জন্য পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ভ‚-পৃষ্ঠের পানির যেসব উৎস রয়েছে, যথা- খাল বিল নদী নালার পানি শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। একই সাথে ভ‚গর্ভে পানির যে মজুদ, তাও হ্রাস পাচ্ছে। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমাগত কমছে, তার পরিসংখ্যান পূর্বেই পেশ করা হয়েছে। আর জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের কারণে তার উর্বরতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ফলে ফসলের উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। ইউরোপে বিশেষ করে ডেনমার্কে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বহুলাংশে কমিয়ে সেখানে জৈবসারের ব্যবহার বৃদ্ধি করা হয়েছে। জৈবসারের ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতাই শুধু ঠিক থাকছে না, ফসলের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সেই সাথে জনগণ বিষমুক্ত শস্য খেতে পারছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১১ কোটি মানুষ গ্রামে বাস করে। তাদের জীবনমান বৃদ্ধির জন্য, কৃষির পরিকল্পিত উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। দেশের বেশির ভাগ মানুষকে পেছনে রেখে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement