২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পর্যটন নিয়ে ঢনঢন

হাওর পাড়ের মানুষের সহজ-সরল জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের। - ছবি : সংগৃহীত

সারা বিশ্বের মতো গত সোমবার বাংলাদেশেও পালিত হলো বিশ্ব পর্যটন দিবস। যথারীতি সরকারের বিশেষ করে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে উন্নয়নের নানা ফিরিস্তি। ঘোষিত হয়েছে এ খাতের উন্নয়নে নানা অঙ্গীকার, যেমনটা তারা প্রতি বছর করে থাকেন দিবসটি ঘিরে। বাস্তবে দিবসটি পালনের আগে সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এই খাতে ঠিক এ মুহূর্তে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। পৃথিবীর অন্য যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এরকম সমস্যা জিইয়ে রেখে বক্তৃতার মঞ্চে উঠে কথার ফুলঝুরি ফোটাতে ইতস্তত করতে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ সে ক্ষেত্রে জবাবদিহির বিষয়টি উঠে আসবে। বাংলাদেশে সেসবের বালাই নেই। ফলে সরকারকে বাড়তি চাপ নিতে হয় না।

বাংলাদেশের পর্যটন খাতে এ মুহূর্তে যে সমস্যা বিরাজমান সেই প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। করোনাজনিত মহামারীর কারণে দেশের পর্যটন খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সম্ভবত শিল্প খাতের পরেই ক্ষতির দিক থেকে এ খাতের অবস্থান। মহামারীর সময় শিল্প-কারখানা বিশেষ করে তৈরী পোশাক কারখানা আংশিক হলেও খোলা ছিল। কিন্তু পর্যটন খাত পুরো সময়ই ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। করোনার প্রকোপ কমে আসার পর শিল্প খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার বিপুল অর্থ বরাদ্দ করে যা প্রণোদনার আকারে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প-কারখানা মালিকদের দেয়া হচ্ছে। সেই অর্থ দেয়া হচ্ছে নামমাত্র সুদে, মাত্র ৪ শতাংশ হারে। পর্যটন খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এখন পর্যন্ত এ খাতের একজন উদ্যোক্তাও প্রণোদনার এক টাকাও পাননি। আর এ সমস্যার সমাধান না করেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পালন করেছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। বাংলায় ‘লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে’ বলে একটি বাগধারা আছে। এখন বোধ হয় সেটির অবলুপ্তি ঘটেছে। কারণ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কোনো স্তরে, কোথাও ‘লজ্জা-শরম’ আছে বলে মনে হয় না।

সবার জানা, পৃথিবীতে যত শিল্প আছে তার মধ্যে পর্যটন হলো একক বৃহত্তম শিল্প। বাংলাদেশের বাজেটে পর্যটন খাতে অর্থ বরাদ্দের ‘হাস্যকর’ পরিমাণ দেখলেই যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন খাতটি কতটা অবহেলিত। একনজরে দেখে নেয়া দেতে পারে বাজেটে খাতটিকে কেমন গুরুত্ব দেয়া হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন খাতে বরাদ্দ করা হয় চার হাজার ৩২ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর আগের বছর সংশোধিত বাজেটে এ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল দুই হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা।

গত কয়েক বছরের বরাদ্দের ধরনটিও দেখে নিই এ সুযোগে। ২০১৩-১৪ সালে পর্যটন খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০৭ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ সালে ১৫৯ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ সালে ৩৭১ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ সালে ৬৮৬ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ সালে ৬৮৬ কোটি টাকা এবং ২০১৮-১৯ সালে এক হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল তিন হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এখানেও কিন্তু আলাদা করে জানার বিষয় আছে। প্রতি বছর পর্যটন খাতের বরাদ্দটা আসে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। সেই বরাদ্দের পরিমাণ খুব বেশি হলে ৫০-৬০ কোটি টাকা। বাকি টাকা ব্যয় হয় বেসামরিক বিমান পরিবহনে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পর্যটন খাত বাংলাদেশে বছরের পর বছর ধরেই অবহেলিত। সামান্য এই অর্থে কোনো উন্নয়ন করা আদৌ সম্ভব কিনা ভেবে দেখার মতো। অথচ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। বিশ্বজুড়ে পর্যটকের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়ায় সঙ্গত কারণে অন্যান্য দেশে এমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ১৯৫০ সালে বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র আড়াই লাখ; যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২৩ কোটি ৫০ লাখে। সাম্প্রতিক সময়ে সেটি বেড়ে ১৪০ কোটির কাছে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। মহামারীর কারণে হয়তো কিছু কমতে পারে। তবে খুব বেশি হেরফের হওয়ার কারণ নেই। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে, গত ৬৭ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বেড়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণও বেড়েছে সমভাবে।

পর্যটনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে বিশ্বজুড়ে পর্যটকরা ভ্রমণ খাতে ব্যয় করেন ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার। একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। এ পরিসংখ্যান থেকে পর্যটনের অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও গুরুত্বটা বুঝে নেয়া সম্ভব, যেটা আমাদের সরকার বুঝতে পারছেন বলে মনে হয় না বাজেট বরাদ্দের ধরন দেখে।

২০২০ সালের মার্চ থেকে বাংলাদেশে মহামারীর সংক্রমণ শুরু হয়। ১৬ এপ্রিল পুরো দেশকে ‘সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা এবং ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত চলে সাধারণ ছুটি। বন্ধ করে দেয়া হয় সব পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, বিনোদনকেন্দ্র, আকাশ, সড়ক, রেল ও নৌপথ। তখন থেকেই পর্যটন খাতে বিপর্যয় নেমে আসে। এরপর দফায় দফায় বাড়তে থাকে লকডাউন। সংক্রমণ রোধে ঈদের সময়ও বন্ধ রাখা হয় পর্যটন এলাকা। এভাবে টিকে থাকলেও চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে খাতটি। বন্ধ হয়ে যায় অসংখ্য ট্যুর ও ট্র্যাভেলস প্রতিষ্ঠান।

এখন পর্যন্ত এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৮ লাখ জনবলের মধ্যে চার লাখই কর্মচ্যুত হয়েছেন বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে। মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না অনেকে। যারা বছরের পর বছর ধরে বিকাশমান খাতটি এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন, তাদের অনেকে পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন। কর্মচ্যুত কর্মীদের পাশাপাশি তাদের ওপর নির্ভরশীল কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হলেও উল্লিখিত নানা কারণে এখনো গতি পায়নি পর্যটন খাত। অথচ সরকারি বেসরকারি সব মহল থেকে বড় গলায় পঞ্চমুখে বলা হয়, বাংলাদেশ হলো পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দেশ। কথাটা অসত্য নয়। ঐতিহাসিক স্থান, স্থাপনা, প্রাচীন নগর-বন্দরের কোনো অভাব নেই এ দেশে। সেই সঙ্গে আছে প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যের এক অফুরান ভাণ্ডার, যার সৌন্দর্যের কোনো জুড়ি মেলা ভার। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের অকৃত্রিম নৈসর্গিক সৌন্দর্য, সিলেটের সবুজ অরণ্যসহ আরো অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর একমাত্র দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত, যা আর পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতে কোথাও কাদামাটির অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমুদ্রসৈকতের চেয়ে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে কক্সবাজার ঘিরে নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ আরো বাড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার। তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। প্রতি বছর এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে বলা হচ্ছে।

তবে আমরা এ খাতে অর্থ বরাদ্দের যে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছি তাতেই বোঝা যায় গোটা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ কেন এ শিল্পে চরমভাবে পিছিয়ে। তাছাড়া বলতেই হবে যে, এ খাত নিয়ে যে যত কথাই বলুন না কেন, প্রকৃত উন্নয়নের বিষয়ে কেউ তেমন কিছু করেননি। প্রতি বছর কতজন পর্যটক এ দেশ ভ্রমণ করেন তার কোনো হিসাব পর্যন্ত নেই কারো কাছে। অনুমান করে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ বিদেশী পর্যটক ভ্রমণ করেন। আর সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান এমন দেশীয় পর্যটকের সংখ্যা বলা হয় প্রায় চার কোটি। এরও কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান কারো কাছে আছে বলে আমাদের জানা নেই। আমাদের দেশের এমন অনেক জায়গা আছে যেগুলো হতে পারে বিশ্ববাসীর কাছে বিস্ময়কর আকর্ষণের কেন্দ্র। যেমন, আমাদের হাওরাঞ্চল। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ সাত জেলার সাত লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। হাওরাঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশি এক অপরূপ মহিমায় ছড়িয়ে আছে। বিশ্বজুড়ে প্রচার করা হলে এটি নায়েগ্রা জলপ্রপাতের চেয়েও বেশি মানুষ আকৃষ্ট করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ, হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় ভেসে বেড়াতে পারেন। কাশ্মিরের ডাল লেকের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে আমাদের হাওর। এর কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, হাওর-বাঁওড়ের হিজল, করচ, নলখাগড়া বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজ প্রাণী আর হাওর পাড়ের মানুষের সহজ-সরল জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের। কিন্তু আমরা এসব সুযোগ কাজে লাগাতে পারছি না। সম্ভবত আমাদের উদ্ভাবনী শক্তির ঘাটতি আছে। মালয়েশিয়ায় ধানের চাষ কিভাবে করা হয় সেটিও পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা হয় বলে একটি ভ্রমণকাহিনীতে পড়েছি। আমাদের মাথায় তেমন আইডিয়া খেলে না। না খেলুক, কিন্তু অন্যদের দেখেও কি শেখা যায় না?

আসলে আমাদের পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব আছে। যথাযথ পরিকল্পনার অভাবেই আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। ঠিকঠাক কর্মপরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু সেটি কে করবে? মানুষ তো অনেকই আছে। একটি মন্ত্রণালয় আছে, মন্ত্রী আছেন, সচিব আছেন, একটি করপোরেশন আছে, এগুলোর বিপুল লোকবল আছে। কিন্তু বাস্তবে প্রয়োজনীয় কাজটা হয় না। দুঃখ করা ছাড়া আর কী করার আছে তাও আমাদের বোধে আসে না। আফসোস!

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement