ফের ‘মুক্ত-স্বাধীন’ আফগানিস্তান!
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১৭ আগস্ট ২০২১, ২০:১৭
আপনি যদি আফগানিস্তানে ঢুকতে চান তাহলে সেটা বেশ সহজ। কিন্তু যখন বেরিয়ে আসতে চাইবেন তখন সেটা খুব কঠিন হয়ে যাবে। এরকম একটা কথা কে বলেছিলেন মনে পড়ে? বলেছিলেন ‘বিশ্ববিজয়ী’ মহাবীর আলেকজান্ডার। কথাটা তিনি সাধারণ পর্যটকদের জন্য বলেছেন এমন নয়, বলেছেন, যারা গায়ের জোরে দেশটি দখল করতে চায় তাদের উদ্দেশে। কথাটা ছিল ঠিক এরকম, “It's impossible to conquer the Afghans”...
এই গ্রিক বীর কথাটি বলেছিলেন, দু-চার বছর বা দুই একশ বছরের মধ্যে নয়। বলেছিলেন, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে। সেই সময়ে আফগানিস্তান ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ। পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আলেকজান্ডার আফগানিস্তানে ঢুকেছিলেন। তার হাতে দারিয়ুসের বিশাল বাহিনী পরাস্ত হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের পতনেরও সূচনা হয় বলে অনেকে মনে করেন। পরে ভারত আক্রমণ করে আলেকজান্ডার ব্যর্থ হয়েছেন। আরো পরে পারস্যের পূর্বপ্রান্তের প্রদেশ আফগানিস্তানে একটি গ্রিক রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের অংশ মিলিয়ে প্রতিষ্ঠিত সেই রাষ্ট্রের নাম ছিল ব্যাক্ট্রিয়া। আলেকজান্ডারের অন্যতম সেনাপতি যার নামটি একটি বিস্ময়বাক্যের মধ্যে (‘সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!) অমর হয়ে আছে সেই সেলুকাসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্ট্রিয়ায় গ্রিকরা পরবর্তী তিন শ’ বছর ধরে শাসন জারি রাখে।
আজও আফগানিস্তানের কোনো কোনো প্রত্নখননে যে গ্রিক শহরের অবিকল নমুনা উঠে আসে তার কারণ ব্যাক্ট্রিয়ায় এই গ্রিক শাসন। আফগানিস্তানের কিছু শহরের নামে এখনো আলেকজান্ডার বেঁচে আছেন; যেমন কান্দাহার। শব্দটির উৎপত্তি ইস্কান্দাহার থেকে। যেটি আলেকজান্ডারের ফারসি উচ্চারণ ইস্কান্দার থেকে উদ্ভূত। আমাদের এই আলোচনার উদ্দেশ্য আফগানিস্তানের ইতিহাস পর্যালোচনা করা নয়। আমরা বলতে চাইছি, আলেকজান্ডারের উক্তির তাৎপর্য। এই দেশটিকে তিনি বলেছিলেন ‘অপরাজেয়’। দেশটির আরো একটি ‘ডাকনাম’ আছে। সেটি হলো, সাম্রাজ্যসমূহের গোরস্তান বা ‘graveyard of empires.’ এই নামটিও যথার্থ। কারণ যত বড় বড় বীর এই দেশটি দখল করতে গেছেন তাদের প্রায় কেউই অক্ষত ফিরতে পারেননি। দখলে রাখা তো দূরের কথা। সেই আলেকজান্ডারের সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত অসংখ্য বহিঃশক্তি আফগানিস্তান দখল করেছে বা করার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু আলেকজান্ডার যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন সেটি কেউই মনে রাখেনি। একের পর এক তারা আফগানিস্তান দখল করতে গেছে। এই ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে শোচনীয় ও করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল ব্রিটিশদের। তারা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেপরোয়াভাবে নাক গলাবার চেষ্টা করলে যুদ্ধ শুরু হয় ১৮৩৯ সালে। ১৮৪২ সালে কাবুলে ব্রিটিশের সৈন্যসামন্ত ও তাদের পরিজন মিলিয়ে ছিল ১৬ হাজারের মতো মানুষ। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বেঈমানির কারণে এরা আফগানদের হাতে আক্রান্ত হয়। আফগানরা তাদের তাড়া করে খাইবার পাসের দুর্গম রাস্তায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৬ হাজার মানুষের মধ্যে সাড়ে চার হাজার সৈনিক ছাড়া বাকিরা ছিল বেসামরিক মানুষ, শিশু, নারী। কিন্তু আফগানরা কাউকে ক্ষমা করেনি। মাত্র একজন সৈনিক ডাক্তার ব্রাইডেন ঘোড়ার পিঠে ঝুলতে ঝুলতে জালালাবাদ শহরে তাদের ঘাঁটিতে ফিরতে পেরেছিলেন। তা-ও সম্ভব হয়েছিল সম্ভবত আফগানদের ইচ্ছাতেই। তারা চাইছিল, অন্তত একজন ব্রিটিশ যেন ফিরে গিয়ে তাদের করুণ পরিণতির কথা ব্রিটিশদের কাছে রিপোর্ট করতে পারেন।
এগুলো পুরনো দিনের কথা। ব্রিটিশ জাতির সেই করুণ ইতিহাসও সাম্রাজ্যবাদীদেরকে কোনো শিক্ষা দিতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত সেনাবাহিনীও আফগানিস্তান দখল করে। তাদের শোচনীয় পরিণতি আমাদের জানা। আফগানদের সর্বশেষ শিকার বর্তমান বিশ্বের একক পরাশক্তি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি তার সামরিক মিত্রদের নিয়ে (ন্যাটো) একটি বৃহৎ জোট গঠন করেছিল। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর পর ২০ বছর ধরে পৃথিবীর সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থশক্তি দিয়ে দেশটিকে পদানত করার চেষ্টা করে আমেরিকা। তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে একটি দেশ দখলের সেই চেষ্টা অনেক আগেই ব্যর্থ হয়ে যায় যখন ২০১১ সালে দেশটি আফগান প্রতিরোধযোদ্ধা তথা তালেবানের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সূচনা করেন তালেবানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের আত্মসমর্পণের নতুন অধ্যায়ের। ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে উভয়ের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। আর এর মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হয়ে যায় যে, তালেবানের সম্ভাব্য বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানে তার দেশের নিশ্চিত পরাজয়টি আর প্রলম্বিত করতে চাননি। তিনি এখান থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ার আগেই তালেবানের অগ্রাভিযান জোরদার হয়। কোনো কোনো এলাকায় আফগান সরকারি বাহিনী যুদ্ধ না করে পাশের দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন কোনো কোনো পর্যবেক্ষক এমনকি মার্কিনিদেরও কেউ কেউ বলেছিলেন যে, পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে তালেবানের অন্তত ছয় মাস লাগবে। অথচ এর মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায় গত ১৫ আগস্ট তালেবানের হাতে রাজধানী কাবুলের পতন ঘটে যায়।
কাবুলের পতনের পর মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকারের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন হেলিকপ্টার ভর্তি টাকা নিয়ে। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আফগানিস্তানের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব দৃশ্যত এতটাই ‘উতলা’ হয়েছে যে, মনে হচ্ছে, দেশ থেকে দখলদার বিদেশী শক্তিকে উৎখাত করে তালেবান মহা ‘অপরাধ’ করে ফেলেছে। এখন তালেবানরা যাতে প্রতিশোধ না নেয়, বিদেশী আগ্রাসী শক্তির লোকজন এবং তাদের দালালদের যেন হত্যা না করে, সেটাই যেন বিশ্বের দেশগুলোর মূল চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। যারা এত বছর ধরে আমেরিকার নির্বিচার হত্যা, খুন, জখম, ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ করেননি, তারাই এখন তালেবানের কাছে শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল আচরণের প্রত্যাশা করছেন। আমেরিকার জবরদখলের কারণে আফগানিস্তানে গত ২০ বছরে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ড্রোন হামলা চালিয়ে নারী-শিশুসহ অসংখ্য বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে তারা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে আফগানিস্তানের মানুষের ওপর। কত মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে মার্কিন সৈন্যরা তার কোনো লেখাজোখা নেই। কূটনীতিতে নয়, কোনো অপকৌশলে নয়, তৃতীয় কোনো দেশের সেনাসমর্থনেও নয়, সম্পূর্ণরূপে নিজের শক্তিতে-সামর্থ্য, সম্মুখযুদ্ধে দখলদারদের পরাস্ত করে বিজয়ী হয়েছে তালেবান। অদম্য মনোবলের ওপর ভর করে দীর্ঘ দুই দশকের নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের পর নিজেদের দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে তারা। এই বিজয় নিঃসন্দেহে গর্বের। কারণ আবারও ‘স্বাধীন’ হলো আফগানিস্তান।
বিজয়ী তালেবান আমেরিকার দালালদের গুলি করে মেরে ফেলতে পারত, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে পারত, আমেরিকা ও তার মিত্র ন্যাটো জোটের দূতাবাস দখল করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারত। কিন্তু তারা এসব করেনি। বরং ধৈর্য ধরেছে। বিদেশীদের দূতাবাস থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার এবং বিমানে করে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এমনকি যেসব মার্কিন দোসর ২০ বছর ধরে তালেবানের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, ষড়যন্ত্র করেছে, মানুষ হত্যায় দখলদারদের সহযোগিতা করেছে তাদেরও পাকড়াও করেনি তালেবান। প্রাণের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ওই ব্যক্তিদের মধ্যে দেশ ছেড়ে যাবার প্রাণান্ত চেষ্টা দেখা গেছে কাবুল বিমানবন্দরে। বিমানে ওঠার প্রতিযোগিতায় সৃষ্ট বিশৃঙ্খলায় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সাতজন প্রাণ হারায়। তালেবান যে সহনশীল আচরণ করছে এটাই লক্ষ করার বিষয়।
তালেবানের বিজয়ে একটি সাধারণ উদ্বেগ হলো, তারা আবার ২০ বছর আগের মতে গোঁড়া শরিয়াহ আইন চালু করে কিনা। নারীর অধিকার পুরোপুরি কেড়ে নেয় কিনা। কিন্তু ২০ বছর আগের তালেবান আর নেই। এখন তারা দৃশ্যত আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি মেনে চলতে প্রস্তুত। তারই প্রতিফলন ঘটে কাবুলে উপস্থিতির দিনেই তালেবানের উপ-প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বারাদারের ঘোষণায়। তিনি বলেন, তালেবানের মূল লক্ষ্য আফগানিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন করা।’ তবে তারা এখনো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী। ১৬ আগস্ট কাতারের দোহা থেকে দেয়া বিবৃতিতে বারাদার বলেন, তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চায় না। তালেবান মনে করে, আফগানিস্তানের সব শ্রেণীর মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান।
তিনি বলেন, ইসলামী অনুশাসনের আওতায়, সব আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি, মানবাধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, নারী অধিকার এবং বাকস্বাধীনতার প্রতি তালেবান সম্মান প্রদর্শন করে। এ ছাড়া, তালেবান নারীর শিক্ষা, চাকরি, সম্পদের মালিকানা ও ব্যবসা করার অধিকার প্রদান করবে। এসব হবে ইসলামী আইন ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললে নয়। কোনো দেশের মানুষ নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে, এটাই আন্তর্জাতিক বিশ্বের স্বীকৃত রীতি।
আফগানরা সেই অধিকারবলে ইসলামকে তাদের আদর্শ হিসাবে নিলে কারো কিছু বলার থাকতে পারে না। আমরা কেবল এটুকু বলতে পারি, শরিয়াহ আইনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষকে যেসব অধিকার দেয়া হয়েছে তার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হলো কিনা।
সবশেষে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনের উল্লেখ করে এ আলোচনার সমাপ্তি টানছি। আমেরিকার বিখ্যাত পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, আফগানিস্তানের ৯৯ শতাংশ মানুষ শরিয়াহ আইন চায়। পিউ রিসার্চের ওয়েবসাইটে ঢুকে যে কেউ পুরো রিপোর্টটি দেখে নিতে পারেন। তাতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মানুষের কত শতাংশ একই ধরনের আইন চায়, তারও হদিস পাবেন। এখন আমাদের দেশের ‘প্রগতি’শীলদের পিঠ যতই চুলকাক, আফগানরা যুদ্ধ করে নিজেদের মুক্ত করেছে, নিজেরাই নিজেদের আদর্শ ঠিক করবে। বাইরে থেকে কারো নাক না গলানোই বোধ হয় সম্মানজনক। আমেরিকার লজ্জাজনক পৃষ্ঠপ্রদর্শনের পর অন্যদের এ নিয়ে মাথা না ঘামানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ই-মেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা