২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে মাস্ক সহজলভ্য ও বাধ্যতামূলক করা উচিত

কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে মাস্ক সহজলভ্য ও বাধ্যতামূলক করা উচিত - ছবি : সংগৃহীত

বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ বলতে গেলে এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই অগ্রাধিকার। এ নিয়ে গত দুই বছর ধরে অনেক আলোচনা, পর্যালোচনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কোভিড-১৯ আমাদের দেশকেও গুরুতরভাবে আঘাত করেছে। আমি মহামারী বিশেষজ্ঞ নই। তবে যেহেতু আমি একজন ফার্মাসিস্ট এবং ফার্মেসি বিভাগ স্বাস্থ্য খাতেরই অংশ, বিধায় এই মহামারী নিয়ে কিছু কথা অসমীচীন হবে না বলে আমার মনে হয়।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। তাই এর নামকরণ করা হয় ‘কোভিড-১৯’।

ভাইরাসজনিত এই রোগ ‘নোভেল করোনাভাইরাস’ নামেও পরিচিত। চীনের একটি প্রদেশ থেকে এর বিস্তার শুরু। পরে ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত প্রায় ৪২ লাখ মানুষ এই মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছে। ইউরোপের বিশাল একটি অংশ এই ভাইরাসে সংক্রামিত হয়। সেখানকার প্রবীণ জনগোষ্ঠী এর বড় শিকার। এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসকে আক্রমণ করে। যাদের নিউমোনিয়াজনিত সমস্যা থাকে তারা সহজে এর শিকার হতে পারে। এটা মানুষের ফুসফুসের অক্সিজেন শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কখনো কখনো হৃদযন্ত্রের ওপরও এর প্রভাব পড়ে। ফুসফুসের অক্সিজেন শোষণ মাত্রা কমে গেলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গের ওপর এর প্রভাব পড়ে। তবে শ্বাসযন্ত্র অকার্যকর হওয়াই করোনাভাইরাসে মৃত্যুর প্রধান কারণ। বয়স্ক মানুষের ফুসফুস এমনিতেই দুর্বল থাকে; তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম।

ইউরোপ-আমেরিকায় ওল্ডএজ হোমগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে সেখানে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। এখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। এরপর জনগণও তাতে সাড়া দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারকেই প্রথমে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

কোডিভ-১৯-এর বিস্তার যখন শুরু হয় তখন এর কোনো প্রতিষেধক ছিল না। যে কারণে এটা দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্যানডেমিক বা মহামারীতে রূপ নেয়। এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার ছাড়া কোনো পথ ছিল না। একটি নতুন ওষুধ আবিষ্কার এবং মানবদেহে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা তথা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করে চূড়ান্ত ফল পেতে অন্তত ১০ থেকে ১২ বছর লাগে। কিন্তু মহামারী পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯-এর টিকা নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে এটা করতে হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রথম ইউরোপে এর টিকা অনুমোদন দেয়া হয়। পরে আমেরিকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টিকা উদ্ভাবন করে এবং সেগুলো অনুমোদন পায়। চীনও এর টিকা উদ্ভাবন করেছে। এসব টিকা মানবদেহে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও তা গুরুতর কিছু নয়। ব্যাপক হারে টিকা দেয়ার পর এখন পরিস্থিতি কিছুটা ভালো।

তবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে প্রথম দিকে আমাদের দেশের দায়িত্বশীল অনেকে তেমন গুরুত্বের সাথে নেননি। কারো কারো মুখ থেকে ‘আমরা কোভিডের চেয়ে শক্তিশালী’ শোনা গেছে। কথা বলে কিন্তু কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঠেকানো যায়নি এবং তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, গরম আবহাওয়ায় কোভিডের প্রকোপ কমবে। সেটি ভুল প্রমাণিত হয়। টিকা আবিষ্কারের আগে নানাভাবে ভাইরাসটি প্রতিরোধের চেষ্টা করা হলেও কোনোটাই সফল হয়নি।

ভাইরাস ট্র্যাকিং করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার, ইত্যাদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাংলাদেশে ততটা সফলভাবে কার্যকর করা যায়নি। লকডাউন নিয়ে হ-য-র-ব-ল অবস্থা আমরা দেখেছি। এক দিকে লকডাউন, অন্য দিকে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি খোলা- এরকম আরো অনেক কিছু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। তা ছাড়া লকডাউন খুব সুসংগঠিতভাবে আরোপ করা হচ্ছে বলে আমার কখনোই মনে হয়নি। আমাদের মতো ঘন জনবসতির দেশে এই ব্যবস্থা কার্যকর করা যে কঠিন হবে তা সরকারের আগেই বোঝা দরকার ছিল। এর নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবও বিশাল হওয়াই স্বাভাবিক। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাদের রক্ষার্থে যেসব কর্মসূচি নেয়া দরকার ছিল সেটি হয়নি। যেটুকু নেয়া হয় সেটুকুও ভালোভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। সরকার কিছুটা সহায়তা করছে, বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনও চেষ্টা করেছে। কিন্তু এগুলো পর্যাপ্ত নয়। তাই মানুষ পেটের তাগিদে বের হচ্ছে। আমাদের এখানে দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন না দিয়ে স্বল্পমেয়াদি কিন্তু কঠোর, লকডাউন দেয়া হলে সুফল পাওয়া যেত বলে মনে করি।

বিভিন্ন দেশে সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিরোধী দলগুলোকে সাথে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। এখানে সেরকম কিছু আমরা দেখিনি। এর ফল আমাদের জন্য ভালো হয়নি। প্রথম দিকে সাধারণ মানুষও উদাসীন ছিল। তারা মনে করেছে সবল দেহে করোনাভাইরাস আক্রমণ করতে পারবে না। আমি অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে ‘ইনশা আল্লাহ কিছু হবে না’ ধরনের মনোভাব দেখেছি। অথচ ইসলামের শিক্ষা এটা নয়। ইসলামে রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অথবা রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলাম আল্লাহর ওপর ভরসা করার পাশাপাশি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছে। ‘কিছু হবে না’ ধরনের মনোভাব নিয়ে যারা চলেছে তারাও আজকের এই অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী।

করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কাটি ততটা ক্ষতি না করলেও ‘দ্বিতীয় ধাক্কা’ সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলে প্রমাণিত হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাসের দিকে দ্বিতীয় ধাক্কাটি লাগে। এর জন্য করোনাভাইরাসের ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’কে দায়ী করা হচ্ছে, যা এই ভাইরাসের ধরনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ২১ হাজারের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে মারা গেছে। তবে এর আগে পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সরকার বেশ সময় পায়। যেহেতু এই মহামারী মোকাবেলায় টিকা ছাড়া উপায় নেই তাই সরকারের পর্যাপ্ত টিকা সংগ্রহে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল। প্রথম পর্যায়ে শুধু ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা আমদানি করে সরকার। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে দেশটি টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয়। এতে আমাদেরকে সমস্যায় পড়তে হয়। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো শুরু থেকেই এই ভাইরাসকে অত্যন্ত ভয়াবহ হিসেবে সতর্ক করে আসছিল। তাই সরকার টিকা সংগ্রহের ব্যাপারে আরো বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে পারত। শুধু একটি দেশের ওপর নির্ভর করা ঠিক হয়নি। এখন বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ টিকা আবিষ্কার করার পরপরই সরকারের টার্গেট হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে পর্যাপ্ত ডোজ সংগ্রহ করা। আমাদের জনসংখ্যা অনুযায়ী অন্তত আট কোটি টিকা সংগ্রহ করা উচিত এবং প্রথম থেকে এই লক্ষ্য অর্জনে মনোযোগী হওয়া দরকার ছিল। টিকা নিলে দেহে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হয়। তখন ভাইরাসের প্রকোপও কমে যায়।

করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কাটি ছিল শহরকেন্দ্রিক। এতে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের মনে ভুল ধারণা জন্মে যে, গ্রামের মানুষের তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কায় তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমবার উত্তরবঙ্গের যেসব এলাকায় করোনাভাইরাস দেখা যায়নি দ্বিতীয়বার সেসব এলাকাতেও সংক্রমণ ঘটেছে। বর্তমানে ভাইরাসের যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ দেখা দিয়েছে তা নিয়ে সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটিও বারবার সতর্ক করেছে। সরকারি মহল যদি শুরু থেকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখত তাহলে আমাদের হয়তো এত মৃত্যু দেখতে হতো না। করোনাভাইরাসের ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ ভারত থেকে এসেছে বলা হচ্ছে। শুরু থেকে আমাদের সীমান্তে লোকজনের চলাচল বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল। আমার মনে হয় শুরু থেকে দেশের পশ্চিম সীমান্তের জেলাগুলোতে ১৫-২০ দিন কঠোর লকডাউন আরোপ করতে পারলে এ ধরনের পরিস্থিতি হতো না।

করোনাভাইরাস নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় দুর্যোগ। আন্তর্জাতিক দুর্যোগও বটে। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর শিকার। কে কোন দল করে সেটি দেখে করোনাভাইরাস আক্রমণ করেনি। সরকার ও বিরোধী দলসহ সবাই যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করা দরকার ছিল সেটি আমরা দেখিনি। বিরোধী দলগুলোকে তেমন আমলে নেয়নি সরকার। দুর্যোগ মোকাবেলায় অন্যের সহযোগিতা ও পরামর্শ না নেয়া গর্বের কোনো বিষয় নয়।

আমাদের এখন প্রথম টার্গেট হওয়া উচিত সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়া। আমার হিসাবে এর জন্য অন্তত আট কোটি টিকা সংগ্রহ করা প্রয়োজন। সরকার গণহারে টিকা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু মানুষ টিকা নিতে যেভাবে ভিড় করছে তাতে নতুন করে ভাইরাসটির সংক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং মানুষ ততটা সচেতন না হওয়ায় সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ পরস্পর থেকে অন্তত ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করার নিয়ম কার্যকর করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে সর্বোত্তম বিকল্প হলো মাস্ক পরিধান। সবাইকে টিকা দিতে চাইলেও দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে তা সম্ভব নয়। টিকা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়ায় সময় লাগবে। তাই এই সময়ে মানুষকে মাস্ক ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে যারা পাবলিক প্লেসে আসবে তাদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত। জনগণ যদি সচেতন হয় এবং সরকার যদি এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে কড়াকড়িভাবে নির্দেশ দেয় তাহলে তা ফলপ্রসূ হতে পারে। এ জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনকেও উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে অনেক কথা বললেও জনগণ শুনছে না। দেশের মানুষের আইন না মানার প্রবণতা রয়েছে।

এক মাসের কিছু বেশি সময় আমেরিকার বোস্টনে ছিলাম। গত মাসের শেষ দিকে ফিরেছি। যখন সেখানে যাই, দেখি সবাই মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করছে। কিন্তু ১ আগস্ট থেকে সেখানে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমেরিকার যেসব রাজ্য পুরোপুরি দিতে পারেনি টিকা সেখানে কোভিড সংক্রমণ বেড়েছে। ফলে সে দেশে এখন সব জায়গায় মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক। আমাদেরও পুরো জাতিকে টিকা দেয়ার আগ পর্যন্ত মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে মাস্ক সরবরাহ করতে হবে। মাস্কের দাম যেন সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে সে উদ্যোগ নিতে হবে। মাস্ক সস্তা ও সহজলভ্য করা গেলে এবং মাস্ক ব্যবহার কঠোরভাবে মানতে পারলে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা কমে আসবে।

লেখক : ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স এবং সাবেক ডিন ও অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল : cmhasan@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement