২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অভিবাসীদের সুযোগ ও বিড়ম্বনা

-

বলতে গেলে পরিণত বয়সে আমি বাবা ও মাকে হারিয়েছি। বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে। তারও ১০ বছর পর মাকে হারাই। বাবার অভাব অনেকটা পূরণ করেছে মায়ের স্নেহে। গত ৩০ জুলাই ছিল আমার মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। সন্তানের জন্য তার বাবা-মা অনেক বড় সম্পদ। মৃত বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করতে কুরআন আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে- ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা’ অর্থ-হে আমার পালনকর্তা তাদের (বাবা-মা) উভয়ের প্রতি রহম করুন, যেমনিভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন। শুধু মৃত বাবা-মায়ের জন্যই নয়, জীবিতদের জন্যও এই দোয়া করতে বলা হয়েছে।

এক মাসের কিছু বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে কয়েক দিন আগে দেশে ফিরেছি। আমি প্রবাসে বসে আগের লেখাটি লিখেছি। তাতে প্রবাস জীবনে বাঙালিদের, বিশেষ করে বাংলাদেশী মুসলমানদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কিছু সমস্যার প্রতি আলোকপাতের চেষ্টা করেছি। যারা বিদেশে গিয়ে, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র নয় এমন কোনো দেশে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস বা দীর্ঘদিন থাকার কথা ভাবছেন তারা পরিবার ও সন্তান লালনের ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যায় পড়েন, শেষ জীবনের একাকিত্ব, তখন কেন দেশে ফেরার পথ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে... এসব অতি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করেছি। বিশ্বের যে কয়েকটি অমুসলিম দেশে বাংলাদেশী ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভ‚তের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি তার একটি যুক্তরাষ্ট্র। এই তালিকায় যুক্তরাজ্যও রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ আরো অনেক অমুসলিম রাষ্ট্রে অনেক বাংলাদেশী কর্ম, শিক্ষা, ব্যবসায়সহ বিভিন্ন সূত্রে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আরো অনেকে এসব দেশে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাঙালিরা স্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী বসবাসের জন্য সাধারণত ইংরেজিভাষী দেশগুলোকে দেশকে বেছে নেয়। তাছাড়া নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টিও থাকে। সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশী থাকলেও দেশটি সাধারণত বিদেশীদের নাগরিকত্ব দেয় না। ইংরেজিভাষী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় বাঙালি কমিউিনিটি অনেক বড় এবং প্রভাবশালী। তারা স্থানীয় প্রশাসন, রাজনীতি এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। এই প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। যুক্তরাজ্যের বাইরে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানিতে বড় মুসলিম কমিউনিটি রয়েছে এবং এসব দেশে অনেক বাংলাদেশী রয়েছেন। ইংরেজিভাষী নয় এমন দেশগুলোতে অভিবাসীদের জন্য ভাষা কিছুটা সমস্যার কারণ হয়। ভাষা কর্মসংস্থানের পথে বাধা হয়। আমেরিকা একদিকে ইংরেজিভাষী, অন্য দিকে একে বলা হয় ‘অভিবাসীদের দেশ’। সারা দুনিয়া থেকে মানুষ গিয়ে এই দেশটিকে গড়েছে। প্রথম দিকের ইউরোপিয়ান অভিবাসীরা গিয়ে আমেরিকান আদিবাসী ‘রেড ইন্ডিয়ানদের’ একরকম নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। ইউরোপিয়ানদের বর্বরতার স্মারক এখনো সেখানে আছে। ইউরোপিয়ানরা গিয়ে যখন দেখে কাজ করার লোক নেই তখন শুরু হলো ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর দাসব্যবসায়। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে আসা হলো। এদের ঘাম ও রক্তে আবাদ হলো মহাদেশের সমান বিশাল এই দেশ। শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে থাকা ইউরোপিয়ানরা বিশাল এই দেশের অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগায়। তারা গবেষণা ও উদ্ভাবনের পেছনে বিপুল সম্পদ ব্যয় করে। দেশটির বর্তমান সমৃদ্ধির পেছনে ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের অবদান বিপুল। তাই অভিবাসীদের জন্য দেশটির আইন-কানুন বেশ সহজ। ফলে অভিবাসী হতে ইচ্ছুক লোকজনের পছন্দের তালিকায় আমেরিকা শীর্ষে।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। এরা যেখানে গিয়েছে সেখানেই সাধারণত নিজেদের ধর্মীয় স্বকীয়তা বজায় রাখতে চেয়েছে। বিশেষ করে যারা ধর্মীয় অনুশীলন বজায় রাখতে চেয়েছে তাদের এই চাওয়া বেশি। তারা বাঙালি না হোক অন্তত মুসলিম কমিউনিটির আওতায় থাকতে চেয়েছে। যারা ধর্ম-কর্মে তেমন কম মনোযোগী ছিল তাদেরকে এক পর্যায়ে এ জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এদের অনেককে দেখেছি শেষ বয়সে ভুল বুঝতে পারলেও তখন করার কিছু ছিল না। বিশেষ করে সন্তান লালন নিয়ে তাদেরকে আক্ষেপ করতে দেখেছি। তারা শেষ জীবনে এসে বুঝতে পারে, প্রবাস জীবনে সন্তানদের যেভাবে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বড় করা ও শিক্ষা দেয়ার দরকার ছিল সেটা দিতে না পারায় অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। এরা মূলত প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী। তবে এখন থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদেরই দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসীদের ধর্মীয় অনুশাসন মানায় অনেক বেশি অগ্রসর হতে দেখেছি।

বাংলাদেশীরা কেন অভিবাসী হতে চায় সেটা একটি প্রশ্ন। আবার কেন অভিবাসী হওয়া উচিত বা উচিত নয়- সেই প্রশ্নও আসে। এ নিয়ে অনেকের সাথে কথা হয়েছে। প্রতিটি প্রশ্নের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি আছে। সাধারণত গরিব দেশ থেকে মানুষ ধনী দেশে অভিবাসী হয়। উন্নত জীবন পাওয়ার আশায় মানুষ উন্নত দেশে পাড়ি জমায়। শুধু বাংলাদেশী নয়, ভারত, পাকিস্তান, আফ্রিকান বা তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশের বেলায় এই কথা সত্য। আমি মনে করি, একজন মুসলমান পৃথিবীর যেকোনো স্থানে গিয়ে বসবাস করতে পারে এবং কোনো দেশকে সে শত্রু দেশ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে না। সব দেশই আল্লাহর সৃষ্টি, সব মানুষ আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। তবে একজন মুসলমানকে এমন জায়গায় গিয়ে থাকার চেষ্টা করা উচিত যাতে তিনি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে পারেন এবং সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে পারেন। মুসলিম মা-বাবার জন্য এটা অনেক বড় দায়িত্ব। আমি বিদেশে গিয়ে থাকলাম, অর্থকড়ি রোজগার করলাম, কিন্তু সন্তানদের ইসলামী অনুশাসনে শিক্ষিত করতে পারলাম না। সে ইসলাম থেকে বিচ্যুত হলে এ জন্য আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। একজন ভালো মুসলমানকে এটা অবশ্যই ভাবতে হবে। ইসলামী পরিবেশে সন্তানদের বড় করা যাবে কিনা সেই চিন্তা তার থাকতে হবে।

তবে আমার মনে হয়েছে, আগের চেয়ে বর্তমান প্রজন্মের অভিবাসীরা ধর্মীয় অনুশীলনে অনেক এগিয়ে। প্রথম দিকে যারা অভিবাসী হয়েছেন তারা ধর্মীয় অনুশীলনে মনোযোগী না হয়ে বরং ‘আধুনিক’ হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা হয়তো মনে করেছেন যে, পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে মিশে গেলে বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। পরে যারা গেছে তারা তুলনামূলক শিক্ষিত এবং তাদের আদর্শিক প্রতিশ্রুতিও অনেক ভালো। যুক্তরাজ্যে প্রথম দিকে যারা গেছে তারা ততটা শিক্ষিত ছিল না। তখন যুক্তরাজ্যের রেস্টুরেন্ট ব্যবসার বড় অংশ ছিল বাংলাদেশীদের নিয়ন্ত্রণে। এরা ছিল মূলত সিলেট অঞ্চল থেকে যাওয়া লোকজন। এগুলো ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’ নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর ভারত শাসন করেছে। তাই তারা ইন্ডিয়ান শব্দের সাথে বেশি পরিচিত। নামে ইন্ডিয়ান হলেও এগুলোর মালিকদের ৯০ শতাংশ ছিল বাংলাদেশী। পরবর্তীকালে ওই অবস্থা থাকেনি। পরবর্তী প্রজন্ম ‘ক্যাটারিং শিল্পে’ ততটা উৎসাহ দেখায়নি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে একবার ডিনদের বৈঠকে ক্যাটারিংয়ের ওপর কোর্স চালু করা যায় কিনা তা নিয়ে কথা ওঠে। বলা হয়, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে এর বেশ চাহিদা রয়েছে।

এই কয়েক দশক আগেও পশ্চিমা দেশগুলোতে হালাল খাবার পাওয়া অনেক কঠিন ছিল। আমি ১৯৭৮ সালে প্রথম যখন পিএইচডি করতে ইংল্যান্ডে যাই তখন ‘হালাল মিট’ পাওয়ার জন্য আমাকে পাকিস্তানি দোকান খুঁজে বের করতে হতো। তখন অনেক বাংলাদেশী মুসলমানকে তেমন হালাল-হারাম বাছবিচার করতে দেখিনি। কোনো বাসায় গিয়ে আমি যখন বলতাম আমাকে হালাল গোশত খাওয়াতে হবে। তখন অনেকে হাসাহাসি করত। বলত আমরা তো ‘বিফ’ খাচ্ছি, পর্ক তো খাচ্ছি না। কিন্তু আমি বলতে চাইতাম এটা হালাল রীতিতে জবাই করে খাবারের টেবিলে হাজির করা হয়েছে কি-না। অনেকে আবার সহযোগিতা করে হালাল খাবারের তালিকা তৈরি করে দিত। যেমন- বেকারি আইটেমে শুকরের চর্বি থেকে তৈরি তেল জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা হতো। সেগুলো খেতাম না। খাবারের উপাদানের মধ্যে শর্টেনিং আছে কিনা সেটা যাচাই করতাম। এটা কিছুটা অপ্রচলিত পরিভাষা। এর মানে যেকোনো ধরনের চর্বি। তখন কোনো বাসায় গেলে বিস্কুট খেতে দিলে আগে এর মোড়কের গায়ে লেখা উপাদানের তালিকা পড়ে নিশ্চিত হতাম। তখন খাবার নিয়ে আমাদেরকে বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। এর আট বছর পর আবারো আমি সেখানে পোস্ট-ডক্টরেট করতে যাই। তখন দেখি পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। হালাল খাবার বেশ সহজলভ্য। বাংলাদেশ থেকে যারা যাচ্ছে তারা সবাই হালাল খাবার খাচ্ছে। আরেকটি বিষয় আমি লক্ষ করেছি। সেটা হলো- বিশ্বের যেখানেই গেছি সেখানে দেখেছি মুসলমানদের মধ্যে মদ জাতীয় পানীয় গ্রহণের প্রবণতা খুব একটা নেই।

আমি বলতে চাচ্ছি যে, প্রথম প্রজন্মের বাংলাদেশী মুসলিম অভিবাসীদের চেয়ে নব্বই পরবর্তী সময়ের অভিবাসীরা ধর্মীয় অনুশাসন মানার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। এখন সবখানে হালাল খাবার পাওয়া যায়। তা ছাড়া ভারতীয় অভিবাসীদের একটি বড় অংশ নিরামিষভোজী। এতে হালাল খাবার পাওয়া আরো সহজ হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত দেখেছি প্লেনে টিকিট কাটার সময় বলে দিতে হতো হালাল মিট বা খাবার দিতে হবে; কিন্তু ২০০০ পরবর্তী সময়ে আমাকে আর এটা বলে দিতে হয়নি। মালয়েশিয়ান, কাতার, সৌদি, ইত্যাদি মুসলিম দেশগুলোর বিমান সংস্থা তো বটেই, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, থাই এয়ারওয়েজের মতো অমুসলিম দেশের বিমান সংস্থাও হালাল খাবার সরবরাহ শুরু করে। এখন পৃথিবীর সব দেশ ‘হালাল’ শব্দটির সাথে সুপরিচিত।

হালাল খাবারের প্রতি মুসলমানদের আকুতি এবং হারামের প্রতি অনীহার কারণে দেশে দেশে এই পরিবর্তনটি ঘটে গেছে। আমার অনেক ছাত্র জাপানে পিএইচডি করতে গেছে। একসময় তারা বলত, তারা যে শহরে থাকছে সেখানে হালাল গোশত পাওয়া যায় না। শুধু টোকিওতে পাওয়া যায়। তখন তারা একসাথে বেশি পরিমাণে হালাল চিকেন বা বিফ কিনে এনে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিত। সেখান থেকে বাঙালি বা অন্য মুসলমানরা নিয়ে যেত। এখন জাপানের সব বড় শহরেই হালাল ফুডের দোকান রয়েছে। বিশ্বের যেকোনো অমুসলিম দেশ বা শহরে মুসলমানরা গেছে, তারা সেখানে হালাল খাবারের দোকান চালু করেছে। এটা কোনো ছোট অর্জন নয়। কেএফসিসহ বিশ্বের নামকরা ফুড ব্র্যান্ডগুলো এখন হালাল খাবারের জন্য আলাদা আউটলেট চালু করেছে।

ইংরেজিভাষী দেশগুলোতে পাড়ি জমানো বাংলাদেশীদের মধ্যে শিক্ষিতদের সংখ্যা বেশি। এমন শীর্ষ চারটি দেশ হলো- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। ডিভি লটারির সুবাদে আমেরিকাতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই গেছে। আমেরিকা অনেক বড় দেশ। অস্ট্রেলিয়াও বড় দেশ। সেখানকার বাঙালি কমিউনিটিও বেশ বড়। অস্ট্রেলিয়ার জনবসতিগুলো উপক‚লীয় এলাকায় হওয়ায় সেখানকার আবহাওয়া আমাদের জন্য সহনীয়। তবে এখানে লেখাপড়া না জানা অদক্ষ মানুষের কাজের সুযোগ নেই। কাজের জন্য শিক্ষিত হতে হবে। অস্ট্রেলিয়ায় আমার মেয়ে থাকার কারণে দেশটির কয়েকটি শহরে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সেখানে অনেক বাঙালি পরিবারের সাথে মতবিনিময় হয়েছে। তবে যেকোনো দেশের চেয়ে আমেরিকায় স্থায়ী অধিবাসীর পাসপোর্ট পাওয়া সহজ। যদিও সেখানে যাওয়া কঠিন। যেতে পারলে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ হয়ে যায়।

ইতোপূর্বে অনেকবার আমেরিকায় গেলেও তখন অ্যাকাডেমিক পরিমণ্ডলের বাইরে মেলামেশার তেমন সুযোগ হয়নি। এবার সেটা হয়েছে। এবার বোস্টনে বেশ কিছু বাঙালি পরিবারের সাথে আলাপচারিতা হয়। আমি কয়েক দিনের জন্য মিশিগানেও গিয়েছিলাম। এবার বোস্টনে ঈদ উদযাপনের সুবাদে অনেক বাঙালি পরিবারের দেয়া দাওয়াতে অংশ নিতে হয়েছে। এ দেশ থেকে যারা আমেরিকায় পিএইচডি করতে যায় তারা সাধারণত থেকে যাওয়ার চেষ্টা করে। জাপানেও অনেকে পিএইচডি করতে যায়। কিন্তু ভাষাগত সমস্যার কারণে পরে এরা কেউ দেশে ফিরে আসে অথবা ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমায়। আমেরিকায় গিয়ে বাংলাদেশীদের মধ্যে যে প্রবণতা দেখেছি সেটা হলো- তারা ভিনদেশী সংস্কৃতি গ্রহণ করলেও মুসলিম পরিচয়টি ভুলে যায়নি। অনেকে হয়তো বাংলায় কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করছে। তাই বলে ইসলাম থেকে দূরে সরে যেতে চায় না। তারা বসবাসের জন্য এমন জায়গা বেছে নেয় যেখানে অন্তত মসজিদে যাওয়া যাবে, হালাল খাবার পাওয়া যাবে। আমিও মনে করি যারা প্র্যাকটিসিং মুসলিম এবং বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হতে চান তাদের উচিত হবে সেখানকার মুসলিম কমিউনিটির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া। তারা বাঙালি কমিউনিটির সাথে থাকতে পারলে ভালো। না পারলে অন্তত মুসলিম কমিউনিটির সাথে থাকা উচিত। এতে তাদের পক্ষে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুসলিম চেতনায় গড়ে তোলা সহজ হবে। আসলে পরিবেশ একটি বড় কথা।

আমেরিকায় গিয়ে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, বাড়ি গাড়ি করেছেন, সন্তানরা বড় হয়ে গেছে তারা সাধারণ আর দেশে ফিরতে চান না। এদের কথা, দেশে গিয়ে কী করব? কোনো পরিবারের ছেলেমেয়েরা যখন বিদেশে স্কুলে যাওয়া শুরু করে এবং কয়েক ক্লাস ওপরে উঠে যায় তখন এরা দেশে এসে খাপ খাওয়াতে পারে না। আমাকে অনেক বাঙালি পরিবার বলেছে, তারা আসতে চাইলেও ছেলেমেয়েদের জন্য পারছে না। ওখানে বড় হয়েছে এবং ১৮-১৯ বছর বয়স হয়ে গেছে এমন কোনো ছেলেমেয়ের পক্ষে বাংলাদেশে এসে থাকার কথা কল্পনা করা কঠিন। পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামী জীবনাচারের ক্ষেত্রে পর্দা বা হিজাবের সমস্যাটিকে আমার কাছে অনেক বড় সমস্যা বলে মনে হয়েছে। পশ্চিমারা উলঙ্গপনাকে সংস্কৃতির অনুষঙ্গ বানিয়ে নিয়েছে। সেখানে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ। এই পরিবেশে মুসলিম মা-বাবার জন্য সন্তানদের বড় করা অনেক কঠিন। এখানে টিনএজ বয়সী ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়েরা সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। এই বয়সে ছেলেমেয়েদের বিশেষ হরমোন তৈরি হয়। এ বয়স খুবই স্পর্শকাতর। এ সময় ছেলেমেয়েরা বিচ্যুত হলে তাদের ফেরানো কঠিন। এই বয়সটিকে সামাল দিতে পারলে এরপর বাবা-মায়ের তেমন দুশ্চিন্তা থাকে না। এ জন্যই আমি মুসলিম পরিবারগুলোকে মুসলিম কমিউনিটির সাথে যুক্ত থাকার পরামর্শ দেই।

আমি আমেরিকায় দেখেছি বাঙালিদের মধ্যে মসজিদ করার প্রবণতা আছে। ইসলামী পরিবেশের বিস্তারে সেখানকার মুসলিম কমিউনিটিগুলো অনেক কাজ করছে। মসজিদের সাথে ইসলামিক সেন্টার এমনকি মাদরাসাও করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্য এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। তারা সরকারি ও ইসলামী কারিকুলাম মিলিয়ে ইসলামিক স্কুলে শিক্ষা দিচ্ছে। কেউ যদি বিদেশে গিয়ে ইসলামিক পরিবেশ বেছে নিয়ে তার আওতায় ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে পারে তাহলে তার পক্ষে ইহকাল ও পরকাল দুই জীবনেই সফলতা রয়েছে। যারা এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে না তাদের দেশে থেকে যাওয়া উচিত বলে মনে করি।

আমেরিকার ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা হলো- একবার সেখানে যাওয়ার পর বেশির ভাগের পক্ষে আর দেশে ফেরা সম্ভব হয় না। তারা সেখানে যে আর্থিক সুবিধা ও কাজের সুযোগ পাচ্ছে এখানে সেটা পাবে না। ওখানে বয়স্ক লোকও সরকারি কাজ করতে পারে। সেখান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছেন এমন কারো পক্ষে বাংলাদেশে এসে শিক্ষকতা করতে পারা কঠিন। আমেরিকায় যেকোনো অড জব করে মাসে তিন-চার হাজার ডলার আয় করা যায়। এখানে সেটা সম্ভব নয়। কোভিডের সময়ে অনেক রাজ্য অধিবাসীদের পাঁচ-ছয় হাজার ডলার করে ভাতা দিচ্ছে। সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা কম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো। সবচেয়ে বড় কথা, এসব দেশে হালাল উপার্জনের ব্যবস্থা রয়েছে। কম শিক্ষিতরাও তাদের আয় দিয়ে একটি বাড়ি কেনা, গাড়ি কেনা, এমন দৈনন্দিন চাহিদাগুলো ভালোভাবে পূরণ করতে পারে। সেখানে অফিস আদালতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয় না। আমাদের চেনা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নেই। আগে কিছু বৈষম্য থাকলেও এখন অনেক কম। অনেক দেশে বাঙালিরা পার্লামেন্টে পর্যন্ত যাচ্ছেন, অনেক উঁচু পদে মুসলমানরা রয়েছেন।

আমি কারো বিদেশে যাওয়ার বিরোধী নই। কিন্তু যারা দেশে অবদান রাখতে পারবেন তাদের না যাওয়াই ভালো। এ দেশ থেকে ডাক্তাররা বিদেশে কম যান। কারণ তারা দেশে ভালো আয় করতে পারেন। আমি মনে করি, যারা বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হতে চান তারা যদি অন্তত বাংলা ভাষা না ভোলেন এবং ইসলামী পরিমণ্ডল তৈরি করতে পারেন তাহলে তাদের সেটাই করা উচিত।

লেখক : ফেলো, বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স এবং সাবেক ডিন ও অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল : cmhasan@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement