শহীদ হলেন পাহাড়ের ‘খাব্বাব’
- ড. এ কে এম মাকসুদুল হক
- ০৪ জুলাই ২০২১, ২০:২৩, আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২১, ১৫:১৮
আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ’ বছর আগে ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সময় হজরত খাব্বাব ইবনুল আরাত নামের একজন সাহাবি ছিলেন। নওমুসলিম হওয়ার কারণে তিনি অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছেন। তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হতো এবং কখনো কখনো মারতে মারতে বেহুঁশ করে ফেলা হতো। কিন্তু তিনি কিছুতেই আত্মসমর্পণ করেননি। বরং তিনি মক্কার ঘরে ঘরে গিয়ে ইসলাম প্রচার করতেন এবং নওমুসলিমদের দ্বীনের শিক্ষা দিতেন। পরে তিনি রাসূল সা:-এর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করেন এবং ইসলামের সব যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন। তিনি ৭২ বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে ইন্তেকাল করেন। আমাদের দেশেও এমন একজন বীর মুজাহিদের আবির্ভাব ঘটেছিল নীরবে। তার নাম ওমর ফারুক ত্রিপুরা। ২০১৪ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে পাহাড়ের দুর্গম পল্লীতে সন্ত্রাসীদের সমস্ত হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করছিলেন। কিন্তু কিছু দিন আগে তিনি পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন।
বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকার এক নিভৃত গ্রাম তুলাছড়িতে বাস করতেন পুর্ণেন্দু ত্রিপুরা। নিঝুম-নিরালায় সবার অলক্ষ্যে সদাতৎপর খ্রিষ্টান মিশনারি এনজিওর মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন সনাতন ধর্মাবলম্বী পুর্ণেন্দু ত্রিপুরা। এরপর এক বন্ধুর মাধ্যমে ইসলামের আলোর দাওয়াত পান তিনি। তার জন্য অপেক্ষা করছিল হৃদয় আলো করা হেদায়েতের নূর এবং আরো পরে শাহাদতের অতুলনীয় সম্মান ও মর্যাদা। ফলে বন্ধুর দাওয়াতে পুর্ণেন্দু ত্রিপুরা খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার নাম হয় ওমর ফারুক ত্রিপুরা। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন তার মধ্যে দিয়েছিলেন হজরত ওসমান রা:-এর মতো দানশীলতার গুণ, হজরত ওমর রা:-এর মতো নেতৃত্বের যোগ্যতা এবং হজরত খাব্বাব রা:, আম্মার রা:-এর মতো মনোবল ও সাহসিকতা। নওমুসলিম হওয়ার পর ওমর ফারুক ত্রিপুরা নিজের জমির কিয়দংশ ওয়াক্ফ করে দিয়ে তাতে মসজিদ নির্মাণ করেন। সেই সাথে দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ৩২টি ত্রিপুরা পরিবারের প্রায় ১৫০ জন মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। আর নিজেই এই সমস্ত নওমুসলিমদের দ্বীনের তালিম দিতে থাকেন এবং নিজের তৈরি করা মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি স্ত্রী নওমুসলিম রাবেয়া বেগম, তিন মেয়ে এবং এক ছেলে রেখে গেছেন। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ঢাকায়। বাকি দুই মেয়ে ও এক ছেলে কক্সবাজারে একটি মাদরাসায় লেখাপড়া করছে। সাংবাদিক এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক মেহেদী হাসান জানান, ‘ইসলাম গ্রহণের কারণে দীর্ঘ দিন যাবৎ সন্ত্রাসীরা মুসলমানদেরকে হুমকি দিয়ে আসছিল। তারই জেরে নওমুসলিম ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে শহীদ করা হয়েছে।’ (নয়া দিগন্ত, ২৪ জুন ২০২১) স্থানীয়দের বর্ণনায় ওমর ফারুক ত্রিপুরা অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাকে প্রায়ই হুমকি দেয়া হতো এবং ধর্মপ্রচার থেকে বিরত থাকতে শাসানো হতো। কিন্তু তিনি এসব হুমকি-ধমকির তোয়াক্কা না করে আপন মনে দ্বীনের খেদমতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গত ১৮ জুন রাতে এশার নামাজ পড়ে ওমর ফারুক ত্রিপুরা ঘরে ফিরলে সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করে। তার মেয়ে আমেনার (১৬) সামনেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। চারজন সন্ত্রাসী আগ্নেয়াস্ত্রসহ এসে ওমর ফারুককে ঘর থেকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে বাড়ির উঠানে নিয়ে যায়। আমেনা সাহায্যের জন্য চিৎকার করলে ভয়ে গ্রামের কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। সন্ত্রাসীরা তাকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে শাসাচ্ছিল। কিন্তু তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে তাদের হুমকি তাচ্ছিল্য করে নিজ ধর্মের ওপর অটল থাকার ঘোষণা দেন। সন্ত্রাসীরা তখন চিৎকার করে বলছিল, কেন মুসলমান হয়েছিস? কেন মসজিদ বানিয়েছিস? এসব বলতে বলতে তারা তার বুকে ও মাথায় তিনটি গুলি করে। আর্তচিৎকার করে ওমর ফারুক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহাদতের পেয়ালা পান করে মহান রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পারো না।’ (সূরা বাকারা-২:১৫৪)। কিছু দিন আগে ওমর ফারুক ত্রিপুরা একটি ইউটিউব ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, ‘আমাকে আল্লাহ আহ্বান জানিয়েছেন, তাই আমি হেদায়েত পেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি।’ ২০১৪ সালে ইসলাম গ্রহণ করার পর পরই তিনি ইসলাম প্রচারের জিহাদে নেমেছিলেন। শুধু নামাজ-রোজার বন্দেগির মধ্যেই জীবন সীমিত রাখেননি, বরং ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন মৃত্যুর হুমকি মাথায় নিয়ে। সত্যিকারার্থেই তিনি একজন সফল দায়ী এবং দ্বীনের মুজাহিদ ছিলেন।
প্রায় ২০ বছরের বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধের পর ১৯৯৭ সালে সন্ত্রাসীরা একটি পার্বত্যচুক্তির মাধ্যমে শান্তির পথে আসতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। চুক্তি মোতাবেক অনেক সেনাক্যাম্প বাংলাদেশ সরকার গুটিয়ে নিয়ে এলেও প্রকৃত অর্থে সন্ত্রাসীরা শান্তি বাস্তবায়ন করছে না। বরং তারা একটি মাফিয়াচক্র কায়েম করেছে পাহাড়ে। তাদের নেতারা নিরীহ পাহাড়িদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে মাসিক, সাপ্তাহিক এবং কৃষি উৎপন্ন পণ্যের ওপর নির্ধারিত চাঁদা আদায় করে নিজেরা ভোগ-বিলাসে জীবন কাটাচ্ছে। এ ব্যাপারে পাহাড়ি জনগণ একেবারেই অসহায়। এই নেতাদের সাথে পাহাড়িদের খ্রিষ্টানিকরণ প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত এনজিওদের একটি যোগসাজশ তৈরি হয়েছে। পাহাড়ি লোকদের ধর্মান্তরিত করার বিনিময়ে অর্থের মোটা অংশই নেতাদের পকেটস্থ হয়। এদের সাথে আবার আমাদের দেশের কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দলের যোগসাজশ রয়েছে। পাহাড়িদের খ্রিষ্টানিকরণের সাথে সাথে তাদেরকে বাম রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। এ জন্য দেখা যায়, ওই সমস্ত বাম ঘরানার নেতা এবং বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই দেশের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের পক্ষে সরব থাকেন এবং পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে তারস্বরে চিৎকার করে দেশে-বিদেশে হইচই ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওমর ফারুক ত্রিপুরার হত্যাকাণ্ড তারা শুধুই নীরবে দেখেছেন। এভাবে পাহাড়িরা এই অসাধু সিন্ডিকেটের কাছে কৃতদাসের মতো জীবন-যাপন করছেন।
পাহাড়ের মহিলারাই যাবতীয় পারিবারিক কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকেন। পুরুষরা আগে বন-জঙ্গলে শিকার করতে বের হতো। এখন জুম চাষের বদৌলতে বন-জঙ্গল পশুশূন্য হওয়ায় পশু শিকারের কাজ কমে যাওয়ায় পুরুষদের আর তেমন কোনো কাজ নেই। ফলে পুরুষদের অনেকেই বাড়িতে অলস বসে থেকে নেশা করে আর মহিলাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। অন্যরা বাঙালি কমিউনিটির সাথে মিশে বাঙালি মুসলমানদের জীবনাচারে আকৃষ্ট হচ্ছে। কাজেই পাহাড়ি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাহাড়ে বিরাজমান দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আশায় ইসলাম ধর্মের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই অবস্থাটা পাহাড়ের মাফিয়াচক্রের নেতারা এবং খ্রিষ্টান মিশনারিরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তারা পাহাড়ে ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে একটা ভয়ের সংস্কৃতি জারি রেখেছে। সুতরাং কেউ মুসলমান হলে তার রক্ষা নেই। পুরুষ হলে নির্যাতন এবং মারধরের শিকার হয়। আর নওমুসলিম নারী হলে গণধর্ষণের শিকার হয়। এভাবে সন্ত্রাসী চক্র এবং মিশনারিরা মুসলমানদের থেকে দূরে রাখার জন্য একটি বাঙালি বিদ্বেষ সৃষ্টি করে রেখেছে। বাঙালিরা পাহাড়ের জমি গ্রাস করে ফেলছে, তাদেরকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করছে ইত্যাদি অপপ্রচার চালিয়ে পাহাড়ে ঘৃণা সৃষ্টি করছে। এমনকি কোনো পাহাড়ি ছেলে-মেয়েকে যদি স্কুল-কলেজের বাঙালি সহপাঠীদের সাথে একসাথে আসা-যাওয়া করতে দেখা যায় তাতেও সন্ত্রাসীরা তাদের ধমকি ও নির্যাতন করে থাকে। অন্য দিকে গ্রামের পর গ্রাম মিশনারিদের হাতে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১২ হাজারের অধিক পাহাড়ি পরিবার খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে বলে জানা যায়। আর বিগ-বাজেটের মিশনারিদের বিশাল অঙ্কের অর্থ পাহাড়ি মাফিয়া চক্রের নেতাদের হস্তগত হচ্ছে।
এই ফারুক ত্রিপুরা হত্যাকাণ্ডে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ এবং বাম ঘরানার সাথে আরো একটা পক্ষকে জাতি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছে। বরাবরের মতোই আমাদের ভাইব্রেন্ট মিডিয়া জগৎ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত এই বিষয়টিতে শীতলতা প্রদর্শন করেছে। বেশির ভাগ মিডিয়াই নীরব রয়েছে। শুধু ধর্মবিশ^াসের কারণে এই হত্যাকাণ্ডে মানবাধিকারের যে চরম লঙ্ঘন হয়েছে তা গণমাধ্যমের নজরে আসতে পারেনি। অন্য দিকে বাংলাদেশে এতগুলো মানবাধিকার সংস্থাকে সদা তৎপর দেখা গেলেও রহস্যজনক কারণে তারাও নিশ্চুপ রয়েছে। অর্থাৎ তাদের কাছে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তা হয়ে যায় ধর্মনিরপেক্ষতামূলক সমর্থনযোগ্য ইস্যু!
ওমর ফারুক ত্রিপুরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ তৎপর রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে দুর্গম পাহাড়ে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই সেনাবাহিনী পৌঁছেছে ঘটনাস্থলে। পুলিশ মামলা গ্রহণ করছে। সন্ত্রাসীদের আটকের চেষ্টা চলছে। এই ঘটনা রাতে ঘটায় এবং দুর্গম-গহিন পাহাড়ে হওয়ায় খুনিদেরকে খুঁজে বের করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়বে। তা ছাড়া ভীতির সংস্কৃতির কারণে কেউ হয়তো মুখ খুলবে না। কাজেই আমাদের কর্তব্য হলো, ওমর ফারুকের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। তাদের নিরাপত্তা, সাংসারিক আয়রোজগারের এবং তার তিন সন্তানের লেখাপড়ার বিষয়ে বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে একটি ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্ট গঠন করে তাদের সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে। পাহাড়বাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এ যাবৎ গুটিয়ে ফেলা আর্মি ক্যাম্পগুলো পুনঃস্থাপন এবং গহিন-দুর্গম অঞ্চলগুলোতে আরো ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। এ বিষয়ে পূর্ব তিমুর এবং দক্ষিণ সুদানের মূল ভ‚খণ্ড মুসলিম দেশ থেকে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। কাজেই বিশেষ করে খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোকে নজরদারিতে রাখতে হবে। যেন তারা বাঙালি মুসলমানবিরোধী ঘৃণা প্রচার করতে না পারে। আমরা চাই, সবাই অবাধে নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের সুযোগ পাক। ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টিও পাহাড়ি জনগণের ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
ওমর ফারুক ত্রিপুরার রেখে যাওয়া কাজ এবং আদর্শ আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, পার্বত্য অঞ্চলের অখণ্ডতার একমাত্র রক্ষাকবচ হলো ইসলামাইজেশন। অন্যথায়, আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল কেবল পূর্ব তিমুর এবং দক্ষিণ সুদানের পরিণতির দিকেই নিয়ে যাবে। হ
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা