২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

করোনা মহামারী ও ভবিষ্যদ্বাণী

করোনা মহামারী ও ভবিষ্যদ্বাণী - ছবি : সংগৃহীত

ভবিষ্যদ্বক্তা (Prophet) যাঁরা, তারা মহান সৃষ্টিকর্তার ‘বিশেষ ধরনের বান্দা’। এটি মানুষের নিছক ব্যক্তি প্রতিভার ফসল কিংবা কারো ব্যক্তিগত কৃতিত্ব নয়। ভবিষ্যদ্বাণী যাঁরা প্রদান করে থাকেন, তাঁদের কথা অনেক ক্ষেত্রে সত্যে পরিণত হলেও আগে থেকেই তাঁদের সব কথায় বিশ্বাস করা অনেকের জন্য কঠিন ও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তবে তাঁরা ব্যতিক্রমধর্মী হিসেবে গণ্য হন এবং স্মরণীয় হয়ে থাকেন নিঃসন্দেহে।

আসলে মানুষের পক্ষে ‘ত্রিকালদর্শী’ হওয়া কঠিন। ভবিষ্যদ্বাণী যাঁরা করেন, তাঁরাও মানুষ। তাঁদের কথা অনেক ক্ষেত্রে সত্য হয়, অনেক সময় হয় না। তাঁরা আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ সামর্থ্য বা ক্ষমতার অধিকারী কেন ও কিভাবে হয়ে থাকেন, সেটি এক রহস্য।

এখন সারা বিশ্বে চলছে মহামারীর তাণ্ডব। ‘কোভিড’ নামে এ অতিমারীর ব্যাপারে দুই যুগ আগে নাকি বলে গেছেন এক অন্ধ নারী। তাঁকে বলা হয়, ‘এ যুগের ও বলকানের নস্ট্রাদামুস।’ কারণ ফ্রান্সের নস্ট্রাদামুসের মতো তিনি অনেক কথা বলে গেছেন, যা পরে সত্য হয়েছিল।

বুলগেরীয় এই মহিলা ‘বাবাভাঙা’ নামে বহুল পরিচিতা হলেও তাঁর আসল নাম ভেঞ্জেলিয়া প্যানদেভা দিমিত্রোভা। বুলগেরিয়াতে ‘বাবা’ কথার অর্থ পিতা নয়, বরং দাদী বা জ্ঞানী নারী। এই নারীকে ‘আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী’ বলে মনে করা হতো। তাঁর জন্ম ১৯১১ সালের ৩১ জানুয়ারি আর মৃত্যু ৮৬ বছর বয়সে, ১৯৯৬ সালের ১১ আগস্টে। তাঁর শেষকৃত্যে বহু লোকের সমাবেশ ঘটে। তাঁরই অসিয়তে বা শেষ ইচ্ছা মোতাবেক তাঁর পেটরিকের বাড়িটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে। তা ২০০৮ সাল থেকে সবার জন্য খোলা রয়েছে। কথিত আছে, তিনি ৫০৭৯ সাল পর্যন্ত ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।

একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে- বাবাভাঙা তাঁর মৃত্যুর বছর করোনাভাইরাস প্রসঙ্গে বলেছিলেন। তাঁর সাথে প্রথম দেখা করে সম্প্রতি এক মহিলা বলেছেন, বাবাভাঙা দাবি করেছিলেন যে, করোনা মহামারীতে আক্রান্ত ও অসুস্থ হবে সবাই। ইংরেজিতে কথাটা নাকি ছিল, Corona will be all over us. বৃদ্ধা নেশকা স্তেফানোভা সে সময় এ কথার মানে ‘বোঝেননি’ বলেছেন। বর্তমানে দীর্ঘ সময় ধরে দুনিয়া কাঁপাচ্ছে করোনাভাইরাস ঘটিত ‘কোভিড-১৯’ রোগের মহাতাণ্ডব। গত দেড় বছরে প্রায় সব দেশের মানুষ এতে সংক্রমিত হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েক লাখ মানুষ মারা গেছে এবং করোনায় আক্রান্ত কয়েক কোটি বনি আদম। বুলগেরিয়ার ৭৩ বছর বয়সী মহিলা নেশকার দাবি, এখন মহামারীর সময়ে বাবাভাঙার সে কথা সবাইকে জানানোর দরকার বলে তিনি বোধ করেছেন।

করোনা মহামারীর ভবিষ্যদ্বাণী যিনি করেছেন, তিনি নিজের জীবন-মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেছেন কি না, জানা যায়নি। এমনকি তিনি ফিলিস্তিন, কাশ্মির, তালেবান, আইএস, ইরান, ইসরাইল প্রভৃতি জ্বলন্ত ইস্যু নিয়ে মুখ খুলেছিলেন কি না, তা-ও জানা যায় না।

বাবাভাঙার মতে, ২০১০ সালের দিকে দুনিয়াতে পরমাণু যুদ্ধ আরম্ভ হবে। অবশ্য বাস্তবে তা হয়নি। এর দু-এক বছর আগে-পরে যুদ্ধটির সূচনা হলেও না হয় একটি কথা ছিল। তাঁর অনেক কথাই পরে আর সত্য হয়নি।

বাবাভাঙা বলে গেছেন, ২০১৬ সাল নাগাদ ‘চরমপন্থী মুসলমান’রা ইউরোপে রাসায়নিক হামলা করবে এবং এতে মহাদেশটির মানুষ হ্রাস পেতে থাকবে। এমনকি তিনি বলেছেন, এর ফলে ইউরোপে কোনো প্রাণের অস্তিত্বই অবশিষ্ট থাকবে না! বাস্তবে ইসলামিক স্টেট (আইএস) কিংবা সে ধরনের কোনো মহল এমন সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারেনি এবং ইউরোপ যথারীতি বহাল রয়েছে।

এ মহিলার উত্তরসূরি নিয়েও প্রশ্ন। বাবাভাঙা মৃত্যুর আগে বলে যান, এক দশক পরে একজন ফরাসি অন্ধ বালিকা তাঁর মতো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং মানুষ অবিলম্বে তার পরিচয় জানবে। কিন্তু কার্যত এটি ঘটেনি এত দিনেও।

একজন ভাষ্যকার বলেছেন, বাবাভাঙা অনেক বিষয়েই নিজের আন্দাজ-অনুমান প্রকাশ করলেও তাঁর ভুল ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে কেউ কিছু বলতে চান না। এটি সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। মিডিয়াও বারবার শুধু তাঁর সে কথাই প্রচার করেছে, যা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। যা হোক, প্রমাণিত হয়েছে, সব ক্ষেত্রে তিনি ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন না।

কোনো কোনো পত্রিকা বাবাভাঙাকে নিয়ে মেতে উঠলেও স্বীকার করা হয়েছে, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর একাংশ মিলেছে। কিন্তু অপর অংশ সত্য হয়নি। দেখা যাক, তাঁর কোন কোন কথা ফলেনি। এটি অনস্বীকার্য, তাঁর সেসব কথা নিয়েই আলোচনা-পর্যালোচনা বেশি, যেগুলো সত্য হয়েছে অথবা প্রায় মিলে গেছে। তবে তাঁর কথা বহুবার ভুল বলে প্রমাণিত হলেও সেসব সম্পর্কে আলোচনা করা হয় কমই। কিন্তু সত্যকে লুকিয়ে রাখা যায় না এবং সত্য কখনো মিথ্যা হবে না। সংশয়বাদীরা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকেন আর বলেন, বাবাভাঙার মতো মানুষদের ভবিষ্যদ্বাণী এবং বাস্তব ঘটনাবলি নিয়ে সবচেয়ে বড় কথা, এগুলো কি অন্ধভাবে বিশ্বাস করা যায়, না করা উচিত? এটি কি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার ফসল অথবা নেহায়েত কাকতালীয় ব্যাপার?

বুলগেরিয়ার কুজহু পার্বত্য এলাকার রুপিটি নামের জায়গার বাসিন্দা ছিলেন বাবাভাঙা। তার যেসব কথা সত্য হয়নি, তার কিছু উল্লেখ করা হলো। বাবাভাঙা বলেছিলেন, ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনলে যে দুই দেশ খেলবে, তাদের নামের আদ্যাক্ষর হবে ‘বি’, অর্থাৎ নামের প্রথম ধ্বনিটি হবে ‘ব’ বোধক। এ ক্ষেত্রে একটি দেশের নাম ‘ব্রাজিল’ হলেও অন্যটির নামে পয়লা বর্ণ ‘বি’ ছিল না। বরং তাঁর দেশ ‘বুলগেরিয়া’ সেমিফাইনালেই হেরে যায় যদিও এর নামের শুরুতেই ‘ব’ ধ্বনি রয়েছে। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীটি সত্য হয়নি।

একটি পত্রিকা সমালোচনা করে লিখেছে, বলা হয়ে থাকে- বাবাভাঙার ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর ৮০ শতাংশই পুরো মিলে গেছে। কিন্তু এ দাবিটির কোনো ভিত্তি নেই। এটি সত্য, তিনি বেশ চমৎকার কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যেগুলো সত্য হয়েছে। তবে এর প্রায় ৮০ শতাংশই মিলে যাওয়ার দাবি ঠিক নয়। এই প্রচারণা পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক ও একপক্ষীয় ব্যাপার। অন্ধ ভক্তরা এ তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছেন নতুবা বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব তথ্য সত্য বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ বাবাভাঙার যেসব কথা ফলেনি, সেগুলো একদমই মুখে আনা হয় না। সংশ্লিষ্ট অনলাইন ভিডিও বা পোর্টালের বেশির ভাগই একপেশে ও অতিরঞ্জিত।’ বাবাভাঙা ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ কিভাবে করতেন- এ সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। তিনি নিজে দাবি করেছেন, ভিন্ন গ্রহের প্রাণী বা এ ধরনের সত্তা ভবিষ্যৎ দেখা কিংবা অতীন্দ্রিয় কিছু বোঝার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করে থাকে। বাস্তবতা হলো তিনি এত বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন যে, উত্তর ইউরোপের বাল্টিক সাগর তীরবর্তী এলাকাসহ বিশ্বের বহু জায়গার মানুষ তাঁর কাছে আসতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি। বুলগেরিয়ার ‘জার’ কেবল নন, অধুনাবিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়ার পূর্বসূরি) এককালীন প্রধান কমিউনিস্ট শাসক লিওনিদ ব্রেশনেভ পর্যন্ত বাবাভাঙার সাথে দেখা করতে গেছেন। তাঁর প্রভাব কত বেশি ছিল, তার প্রমাণ এটি। স্বদেশের রাজ পরিবারের সাথে বাবাভাঙার সুস্পর্ক ছিল। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বুলগেরিয়ায় ‘সমাজতন্ত্র’ কায়েম করে বস্তুবাদী কমিউনিস্টরা অদৃষ্টবাদী এই রহস্যময় মহিলাকে তাদের পরামর্শদাত্রী বানিয়েছিলেন। বলা হয়, বাবাভাঙার কথিত ক্ষমতা কাজে লাগানোর এ উদ্যোগ ছিল বামপন্থীদের কৌশলগত এবং এ কারণে তাঁর খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন জাগে, তিনি কি অলৌকিক শক্তিধর ছিলেন, নাকি কমিউনিস্টদের হাতের পুতুল? যা হোক, আজো বিশ্বের কৌতূহলী মানুষের কাছে তিনি আলোচনার একটি প্রধান বিষয়।

বাবাভাঙা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১১ সালের ৩১ জানুয়ারি তদানীন্তন তুর্কি উসমানীয় (অটোম্যান) সাম্রাজ্যের মেসিডোনিয়ার স্ট্রোমিকা নামক স্থানে। এটি প্রথম বলকান যুদ্ধকালে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বুলগেরিয়ার। বাবাভাঙার ‘স্বাস্থ্য জটিলতা’ ছিল শৈশব থেকেই। জানা গেছে, জন্মের পর দীর্ঘ সময় তাঁর কোনো সাড়া ছিল না। তখন প্রথা ছিল, ‘মৃত’ শিশুর নাম রাখা হতো না। যাক, পরে ভেঞ্জেলিয়ার (বাবাভাঙা) কান্না শুনে তাঁর ধাত্রী রাস্তায় এসে (রীতি অনুসারে) অপরিচিত লোককে অনুরোধ জানান এ শিশুর নাম রাখতে। লোকটি নাম রাখেন ‘অ্যান্ড্রোমাহা’। তবে গ্রিক নামের সাথে বেশি মিলে যাওয়ায় তা গৃহীত হয়নি। আরেক অপরিচিত আগন্তুক ভেঞ্জেলিয়া নাম প্রস্তাব করেছিলেন। এ নামটির গ্রিক নামের সাথে মিলে যায়। তবে ‘বুলগেরীয় ভাব’ থাকায় তা গ্রহণ করা হয়। তার নীল চোখ ও সোনালি চুল ছিল আকর্ষণীয়। মেয়েটির বাবা ছিল মেসিডোনিয়ার বিপ্লবী। তিনি বুলগেরিয়ার সৈন্য ছিলেন প্রথম মহাযুদ্ধে। ভেঞ্জেলিয়ার মা তাঁর শিশুকালে মারা যাওয়ায় বাবা আবার বিয়ে করেন। তাই সৎ মায়ের কাছেই তাঁকে বড় হতে হয়।

কথিত আছে, ১২ বছর বয়সে এক দিন ভেঞ্জেলিয়া বন্ধুদের নিয়ে খেলার সময়ে প্রচণ্ড ঝড়ে তিনি অনেক দূর উড়ে যান। কয়েক দিন পরে তাকে পাওয়া গেলেও দুই চোখের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। অক্ষিকোটরে ধুলাময়লা ঢুকে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। দরিদ্র পরিবার তাঁর চিকিৎসা করাতে না পারায় তিনি অন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হলেন। তখন তার অদ্ভূত ক্ষমতার সূচনা। অন্ধ হওয়ার পর তিনি দাবি করলেন, ঝড় উড়িয়ে নিয়ে তাকে দিব্যদৃষ্টি দিয়ে গেছে; যদিও বাহ্যিকভাবে তিনি দৃষ্টিশক্তিবিহীন। তাঁর নাকি ছিল শুধু স্পর্শের দ্বারা সুস্থ করে তোলার ক্ষমতা। তিনি বিদ্যালয়ে তিন বছর ব্রেইল পদ্ধতিতে পাঠ গ্রহণ করেন। সেখানে শিক্ষা নেন পিয়ানো বাদন, রান্না, বুনন ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়েও। তখন তিনি সৎমাকে হারিয়েছিলেন। তিনি ৫০৭৯ সাল পর্যন্ত ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement