২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দখলের রাজনীতি এবং বিপর্যস্ত পরিবেশ

দখলের রাজনীতি এবং বিপর্যস্ত পরিবেশ - ফাইল ছবি

সভ্যতার এই চরম ঔৎকর্ষের সময়ে বিধ্বস্ত পৃথিবী দেখে আঁতকে উঠতে হয়। পৃথিবী বিধ্বস্ত তাদেরই হাতে যারা এর কারিগর। কোটি কোটি বছর ধরে মানবজাতির নির্মাণ এই সভ্যতা। চন্দ্র বিজয়ের পর মানবজাতি মঙ্গল অভিযানে পা বাড়িয়েছে। কম্পিউটার যুগ অতিক্রম করে ডিজিটাল উন্নয়নের শীর্ষে অবস্থান করছে। অথচ এই সময়ে যে ধরিত্রীতে তাদের বসবাস, নিজেদের জ্ঞাতসারে অথবা অজান্তেই তারা একে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। মানবসৃষ্ট অনাসৃষ্টিতে পৃথিবী যেমন ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত, ঠিক তেমনি ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের দখলদারি আর লোভ-লুণ্ঠনে পৃথিবীর এই অংশ- তথা বাংলাদেশ বিপর্যস্ত। শিল্প-বিপ্লব মানব সভ্যতাকে ধাপে ধাপে সমৃদ্ধির সোপানে স্থাপন করেছে। কিন্তু শত শত বছর পর এই শিল্প-বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া আমাদের যাপিত জীবনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্প উৎপাদনের নিঃসরিত কার্বন যা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘সি ও টু’ পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। পাশ্চাত্যে অথবা প্রাচ্যে শুধু শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যে সীমাহীন কার্বন নিঃসরিত হয় তা গোটা পৃথিবীর সব মানুষের সমূহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর নাম ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা’। কেউ বলছেন, গ্রিন হাউজ এফেক্ট বা সবুজ শিল্প প্রতিক্রিয়া। বিগত সত্তরের দশকে এটি বিজ্ঞানীদের নজরে আসে। বৈজ্ঞানিক এই বাদানুবাদ বা শিল্পোন্নত বিশ্ব বনাম অনুন্নত বিশ্বের এই বিতর্ক ‘গ্রিন পলিটিক্স বা সবুজ রাজনীতি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। শুধু কার্বন নিঃসরণজনিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নয়- সামগ্রিক বৈশ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশ সম্পর্কেও ধারণাটির সম্প্রসারণ ঘটে। বিজ্ঞানীদের তৎপরতার ফলে ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে স্টকহোমে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর ‘৫ জুন’ দিনটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই সম্মেলনের দুই দশক পর ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে পরিবেশ সম্পর্কিত দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ‘আর্থ সামিট’ বা ধরিত্রী সম্মেলন হিসেবেও পরিচিত। এরই ধারাবাহিকতায় বিশেষত কার্বন নিঃসরিত ‘জলবায়ু পরিবর্তন’-এর প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটোতে অনুষ্ঠিত হয় ৩৮টি শিল্পোন্নত দেশের একটি বিশেষ সম্মেলন। এরপর ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম কার্যকর হয় এই চুক্তিটি। বর্তমানে এই চুক্তিতে ১৯২টি দেশ দায়বদ্ধ রয়েছে। কিয়োটো প্রটোকলটি ২০১২ সালে দোহা রাউন্ডে সংশোধিত হয়। কিয়োটো সম্মেলনের আইনি কাঠামোটি ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্যারিসে অনুমোদিত হয়। সম্মেলনে নীতিগতভাবে কার্বন নিঃসরণ বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এটি ‘কিয়োটো প্রটোকল’ নামে অভিহিত হয়। পরবর্তীকালে পরিবেশ আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার জন্য আরো অনেক বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র হিসেবে ওই দু’টি প্রক্রিয়া অর্থাৎ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন কার্যক্রম এবং দেশজভাবে বিশ্ব পরিবেশ আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত। টেকসই উন্নয়নের আমরা যে দ্বিতীয় পর্যায় অতিক্রম করছি, পরিবেশ উন্নয়ন তার অন্যতম অনুষঙ্গ। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম প্রকৃতি সমৃদ্ধ জনপদ। প্রাচীনকাল থেকে ‘সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা’ প্রত্যয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে উচ্চারিত হয়ে আসছে। কবির এ কথা মিথ্যে নয় যে, ‘সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি’। বাংলাদেশের মতো সবুজ, নদী বিধৌত সমভূমি পৃথিবীতে বিরল। বাংলাদেশের দক্ষিণে সাগর আর উত্তর থেকে ক্রমাগত ঢালু পলিময় মাটি সাগর মোহনায় সমর্পিত। ভূগোল ও পরিবেশবিদরা বলছেন, সাগর থেকে বাংলাদেশের ভূমির উচ্চতা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক নিচু। এই জনপদ জালের মতো নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও নালা-ঝিলে বিস্তৃত। এখানে রয়েছে জীববৈচিত্র্য। হরেক রকম পাখপাখালির বসবাস এখানে। নানা ধরনের গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ এই দেশ। সুন্দরবন আমাদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। প্রাণিজ সম্পদেও ভরপুর এই দেশ। এখনো অকৃপণ হাতে আল্লাহ বর্ষা বাদল দিয়ে নদীর ধারা প্রবাহিত রেখে বাংলাদেশের মানুষকে অকৃপণভাবে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু মানুষ কতই না অকৃতজ্ঞ। সে আল্লাহর দেয়া এই অফুরন্ত সম্পদকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। সেই সাথে রাষ্ট্রিক বিভাজন এই দেশ-জাতির জন্য অভিশাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় সব নদীর উৎসমূল প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রে অবস্থিত হওয়ার কারণে আমাদেরকে বৈরী পরিবেশ অতিক্রান্ত করতে হচ্ছে। মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ আছে। আরো আছে তিস্তা, টিপাইমুখ, মুহুরী ইত্যাদি নদীর বাঁধ। প্রতিবেশীর শত্রুতার সাথে পাল্লা দিয়ে এ দেশের একশ্রেণীর ভূমিদস্যু দেশের মানুষের সাধারণ সম্পত্তি দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। তারা পাহাড় কাটছে। জেগে ওঠা চর, হাওর-বাঁওড় ও নদীতীর দখল করছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ সব গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে নদী তীরভূমি দখল করছে। শহরে অথবা গ্রামে পতিত জায়গা বলে এখন আর কোনো জায়গা নেই। মাঝে মধ্যে কোনো কোনো সরকার দখল বেদখলের চেষ্টা করেছে। এক-এগারোর সরকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অবশেষে তারা শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দিয়েছে। এমন এক সরকারের কাছে ক্ষমতা সমর্পণ করেছে, যারা গোটা দেশটাকে তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি মনে করে। সেই থেকে ক্ষমতাসীনরা যে যেখানে পারে সে সেখানে ভূমি দখলের চেষ্টার কসুর করছে না। গণমাধ্যমে কখনো কখনো দখলের সংবাদ প্রকাশিত হলে সরকার দালানকোঠা ভাঙার মহড়া দেখায়। কিন্তু কয়েক দিন পরে আবার তা বেদখল হয়ে যায়। অপ্রতিরোধ্য তাদের ক্ষমতা। ক্ষমতাসীনরা বিগত ১২ বছরে আইনি ও বেআইনিভাবে বাংলাদেশ মানচিত্রের বেশ খানিকটাই দখল করে নিয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের সহায় সম্পত্তি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেদখল হয়ে গেছে। এই অবাধ প্রতিযোগিতায় আওয়ামী লীগের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯ নম্বর সদস্য থেকে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা বাদ যাননি।

সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা উল্টালে এর প্রমাণ মিলবে। যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য তারা অনেক মায়াকান্না করেন, তারাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাদাদের সম্পত্তি বেহাত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের বিবৃতি স্মরণীয়। ক্ষমতাসীনদের দাপটে বিনাশ হয়ে যাচ্ছে বন, উধাও হয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। তাহলে বলতেই হয়, আজকে আমরা যে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছি তা মানবসৃষ্ট বিশেষত ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট- বিধাতার সৃষ্টি নয়। বাংলাদেশের এসব ভূমিদস্যু আইন-কানুন, রীতি-রেওয়াজ কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না। কোর্ট কাচারি এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও এদের দমাতে পারে না। আইন ও শৃঙ্খলা বাহিনী প্রকারান্তরে এসব লুটপাটকারীকে বেআইনি সহায়তা দেয়। তাই সৃষ্টি হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

প্রকৃতিও আমাদের প্রতি সদয় নয়। বৈশ্বিক জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষণায় বলা হচ্ছে- বাংলাদেশের উপকূলের বেশ খানিকটা অংশ ধীরে ধীরে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তখন এটি বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ সঙ্কট সৃষ্টি করবে। আর সবাই আমরা জানি, গোটা পৃথিবীতে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিত। এমন কোনো বছর বাকি থাকে না, যেখানে ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন বাংলাদেশকে স্পর্শ করে না। এ ছাড়া অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এসব। অপর দিকে অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে সহজেই প্লাবিত হয় রাজধানীসহ বড় শহরগুলো। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয় নাগরিকদের ও সরকারের নানা ধরনের কার্যকলাপ। এসবের মধ্যে রয়েছে- পানি ও বায়ুদূষণ, শিল্প কারখানার দূষণ, অননুমোদিত প্রযুক্তির ব্যবহার ও নানা ক্ষেত্রে ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার। এ দেশের মানুষের জীবন এতটাই অসহায় যে, খাবার খেয়ে আমরা বেঁচে থাকি তাও নিরাপদ নয়। প্রাকৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ সীমিত সম্পদ, বিপুল জনসংখ্যা, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও শাসক গোষ্ঠীর দুর্নীতির মধ্যে বসবাস করছে। দৃশ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবেশ উন্নয়নের কর্মসূচি, প্রকল্প ও পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ তার সুফল লাভ করতে পারছে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’কে যেভাবে রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে প্রচার করেছে, বাস্তবতার সাথে তার কোনো মিল নেই। বৈশ্বিক জলবায়ু ফোরামের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকার দাবি করা হলেও এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন সীমিত। মূলত বাংলাদেশ পরিবেশ রক্ষায় যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে তা এ রকম- ১. রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব; ২. দুর্নীতি; ৩. ক্ষমতার অপব্যবহার; ৪. আইনের যথার্থ প্রয়োগ না করা; ৫. স্বার্থের দ্বন্দ্ব; ৬.পরিবীক্ষণের অভাব; ৭. তথ্যের অপ্রাপ্তি; ৮. গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থ; ৯. স্থানীয় নেতৃত্বের অপারগতা ও ১০. অর্থ, পেশি ও গণমাধ্যমের শক্তি। এসব কারণে বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট বিজনেস বা ভূমি দখল ব্যবসায় বাণিজ্যিক সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছে।

বৈশ্বিক ও দেশজ উভয় পর্যায়ে আজকে জলবায়ু পরিবর্তন তথা পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সপ্তাহে একটি জার্মান পরিবেশ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত গবেষণায় বাংলাদেশের নাজুক অবস্থানের কথা বেরিয়ে এসেছে। এদের সমীক্ষায় গোটা পৃথিবীতে বাংলাদেশ হচ্ছে সপ্তম জলবায়ু দুর্যোগ আক্রান্ত দেশ। প্রাকৃতিক বিষয়াবলির কারণে এই যখন আমাদের অবস্থান তখন রাজনৈতিক লুটেরাদের অপ্রতিহত দখল পরিবেশকে অসম্ভব সংবেদনশীল করে তুলেছে। সন্দেহ নেই, বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি এবং জটিল। যদি ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে দেশ ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তখন মরুভূমিকরণ ও অরণ্য বিনাশের দিকে দেশ ধাবিত হবে। জাতিসঙ্ঘ গৃহীত কার্যক্রমের সাথে সাথে জাতীয় কর্মসূচির সমন্বয় সাধিত হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও দেশজ পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব। আবার কোনো কিছুই সম্ভব নয়, যখন দুর্বিনীত, দুর্নীতিবাজ ও লোভীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ অক্ষুণ্ন থাকে। হয়তো এদের উদ্দেশেই মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাজ এনাফ ফর এভরি ওয়ানস নিড, বাট নট এনাফ ফর এভরিওয়ানস গ্রিড’।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement