‘কোভিড’ থেকে যদি উত্তরণ ঘটে, তার পর...
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ০৬ জুন ২০২১, ২০:৪৯
সংবাদপত্রের নিয়মিত আর সতর্ক পাঠক এবং অন্যান্য মিডিয়ার দর্শক-শ্রোতা নানা তথ্য আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকেন। তাই তাদের অগ্রসর মানুষ হিসেবে বিবেচনায় নিতে হয়। আজকে আমরা কিছুকাল পেছনের একটি বিষয় নিয়ে এই লেখার সূচনা করতে চাই। আমাদের বিশ্বাস আছে, মানুষের স্মৃতি এতটা দুর্বল নয় যে, বছর দেড়েক আগের একটি তথ্যকে তারা ভুলে গেছেন। সব মিডিয়ার কাছ থেকে তারা হালনাগাদ তাজা তথ্যটা পেতে চান। মাত্র বছর দেড়েক আগের তথ্যটি মূলত এই লেখা এগিয়ে নেয়ার জন্য ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ হিসেবেই ব্যবহার করতে চেয়েছি। সেই পুরনো তথ্যটি হচ্ছে চীনের উহান থেকেই ‘করোনাভাইরাস’-এর উৎপত্তি। পরে সেখান থেকেই গোটা চীনে এবং ধীরে ধীরে বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়েছে। এখানেই আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি শেষ।
চীনে তথ্যের অবাধ প্রভাব নেই। তাই এখন আর অতীতে কখনোই চীনের পুরো ঘটনাবলির সত্যটা জানা যায় না। আগে কোভিড সেখানে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল আর প্রকৃতপক্ষে কত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল তার সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারি ভাষ্য ছিল বটে কিন্তু মুক্ত বিশ্বে তাকে খুব একটা আমল দেয়া হয়নি। এটা ঠিক, চীনা কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করেছে। বর্তমানে সেখানে তথ্য-উপাত্তের ছিটেফোঁটা বেরিয়ে আসছে। তা ছাড়া চীন বেশ দ্রুততার সাথে কোভিড প্রতিরোধে দু’টি কার্যকর টিকা উদ্ভাবন করেছে এবং ব্যাপকভাবে সে দেশের মানুষকে দিচ্ছে। অবশ্যই এমন উদ্যোগ নেয়া চীনকে একটা ইতিবাচক অবস্থানে নিয়ে গেছে এটাই ধরে নিতে হবে। জানা যায়, চীন যে কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী হাসপাতাল জরুরি ভিত্তিতে গড়ে তুলেছিল ইতোমধ্যে সেগুলো গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। উহানে কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য শত শত চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মী চীনের বিভিন্ন স্থান থেকে আনা হয়েছিল। তারাও নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার সময় ক্যামেরার সামনে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ‘ভি’ চিহ্ন উচ্চকিত করে উহান থেকে বিদায় নেন। তার ছবি আমরা দেখেছি। কোভিডের কারণে চীনেও খাদ্যঘাটতির আশঙ্কার কথা ভেবে হোটেল রেস্তোরাঁয় এমন নির্দেশ ছিল যে, কাউকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার পরিবেশন করা যাবে না এ জন্য যে নির্দেশ, তা হয়তো এখন বলবৎ নেই। কোভিড-কালীন সেখানে লকডাউনসহ মানুষের চলাচলের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বলবৎ ছিল; তা তুলে নেয়া হয়েছে। চীনের এসব বিষয় উল্লেখ করছি একটা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া বিশ্বের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে যেসব সংস্থা তথ্য সংগ্রহ আর গবেষণা করে, তাদের কাছ থেকে এমন আভাস পাওয়া যায় যে, চীনের ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প উৎপাদন বেড়ে চলেছে ইতঃপূর্বে কোভিডের কারণে যা স্থবির হয়ে পড়েছিল। এ থেকে দুটো জিনিস বোঝা যায়: সেখানে মানুষ অসুস্থ থাকলে শিল্পের স্থবিরতা কাটত না। দ্বিতীয়ত চীনারা দূরদর্শী আর সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে। কোভিড-এর বর্তমান সময়ে ধীরে ধীরে তাদের অর্থনীতিকে পূর্বাবস্থায় নিয়ে যেতে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাস্তবতার আলোকে পরিকল্পনা গ্রহণ করার কারণেই তাদের অর্থনীতি গতি পাচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। তা ছাড়া, তাদের উদ্ভাবিত দু’টি টিকা প্রায় অর্ধশত দেশে রফতানি করে প্রভূত অর্থবিত্ত পাচ্ছে চীন। আন্তর্জাতিক বলয়ে টিকা উদ্ভাবনে সক্ষম হওয়ার কারণে তাদের ভাবমর্যাদাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
আসলে এসব বক্তব্য পেশ করার উদ্দেশ্য, আমাদের সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে রাখতে হবে কোভিড থেকে উত্তরণ সম্ভব হলে আমরাও যেন পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার যাত্রা শুরু করতে পারি। বুঝতে হবে কাজটা খুব সহজ নয়। আমাদের অবস্থান থেকে বলতে গেলে বিষয়টা অতীব কঠিন। এই কাজ সহজ করতে আমাদের কঠিন মনোবল, অদম্য সাহস আর পরিস্থিতিকে জয় করার ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তা থাকা চাই। সব দোদুল্যমানতা দূর করে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা আর একাগ্রতা থাকতে হবে। আমরা অনেক সময়ক্ষেপণ করি চিন্তার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে। এতে আনাড়িত্বের প্রকাশ পায়, যা কোনো পারঙ্গম প্রশাসনের প্রমাণ নয়।
যাই হোক, স্রষ্টার কাছে আজ এই প্রার্থনাই করব যাতে বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। মানুষ তার প্রাপ্ত জ্ঞান, অনুসন্ধান আর গবেষণার মধ্য দিয়ে যে উপায় উপাত্ত তথা কোভিডের টিকা নিয়ে হাজির হয়েছেন তা বিশ্ববাসীকে আশার আলো দেখাচ্ছে। এই আলো যাতে পুরো বিশ্ববাসীকে স্নাত আর উদ্ভাসিত করতে সক্ষম হয় সে আশায় চলুন, আমরা বুক বাঁধি। আসুন, প্রার্থনা করি সেই সব মানুষের জন্য, বিশ্বের যে প্রান্তেরই হোন, যিনি দুস্থ তারও যেন বেঁচে থাকার জন্য আশা মনে জাগে এই দুর্যোগের হাত থেকে নিরাপদ থাকতে। আমরা বাংলাদেশের মানুষও আজ ভাগ্যবিড়ম্বিত, আমরাও যেন বিপদমুক্ত হই এবং নতুন উপলব্ধি আর চেতনা নিয়ে পৃথিবীতে শান্তি-স্বস্তিসহকারে বিচরণ করতে সক্ষম হই। আমাদের যারা কাণ্ডারি তারা যেন নবচেতনা জাগ্রত করে নতুন উপলব্ধি আর বোধ বিবেচনায় সমৃদ্ধ হোন।
আমরা জানি, দেশের প্রশাসন কোভিড নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এবং গভীর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছে। তারপরও বুদ্ধি বোধ বিবেচনা যেন হতবিহ্বলতায় লোপ না পায়। কোভিডের বিষয়ে এ পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালন করা নিয়ে সাধারণের মধ্যে বিস্তর প্রশ্ন আর অনুযোগ রয়েছে। পত্রপত্রিকায় দেখা গেছে, দূরপ্রাচ্যের ভিয়েতনামসহ আরো কিছু দেশ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কোভিড পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। আমাদের চেয়ে তাদের অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা, চিকিৎসাসরঞ্জাম আর চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি বলে আমরা জানি না। কিন্তু ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দৃঢ়তা, একনিষ্ঠতা ছিল। তা ছাড়া দেশের মানুষকে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ মানতে সচেতন করতে তারা শতভাগ সফল হওয়ার কারণেই এই বিপদ আমাদের মতো তাদের পর্যুদস্ত করতে পারেনি। অতীতের বিচ্যুতির জন্য এখন আর অনুতাপ করে কোনো লাভ নেই বরং তাকে শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার পাথেয় করতে হবে। এসবকে ভিত্তি করে প্রস্তুত হতে হবে বর্তমান অবস্থা মোকাবেলা আর এই ব্যাধি থেকে উতরে যাওয়ার পর করণীয় নির্ধারণ করতে যেন কোনো গাফিলতি আর না হয়। অনেকে মনে করতে পারেন? এটা কি আগাম বলা হলো না। এর জবাব হচ্ছে, ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি সংগঠন অথবা প্রশাসন পরবর্তী করণীয় আগেই ঠিক করতে পারলে সময় এলে কাজে নামতে কোনো বিলম্ব হয় না।
অন্যরা যা করেছে তা তাদের দেশের প্রয়োজন আর বাস্তবতাকে সামনে রেখেই করেছে। তাই তাদের হুবহু অনুকরণ নয়। কেননা স্থানিক অবস্থাকে সামনে রেখে যদি কর্মপরিকল্পনা নেয়া না হয়, তবে সাফল্যের কথা চিন্তা করা যাবে না। কোভিড আমাদের অনেক দুর্বলতাকে চিহ্নিত এবং কিছু সম্ভাবনার পথও উন্মোচন করেছে। পৃথিবীর মানুষ এই ধরিত্রীর ওপর অনেক অত্যাচার করেছে। এখন প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে এবং নেবে বিজ্ঞজনরা তাদের অভিজ্ঞান থেকে এই অভিমতই ব্যক্ত করছেন। তাই কোভিড শেষ হলে নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যতে কোভিডের মতো বা তার চেয়ে কঠিন আরো ভয়ঙ্কর ব্যাধি আসতে পারে। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানে আর প্রযুক্তিতে দ্রুত উৎকর্ষ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের কিছু সক্ষমতা যে আছে তার স্বীকৃতি বাইরে থেকেও এসেছে। সম্প্রতি পত্রিকার খবরে প্রকাশ, বাইরের একটি খ্যাতিসম্পন্ন সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশের অন্তত দু’টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কোভিডের টিকা প্রস্তুত করতে সক্ষম। তবে এই স্বীকৃতি যেন আত্মপ্রসাদের কারণ না হয়।
কেননা অন্যের উদ্ভাবিত টিকা এখানে উৎপাদন করা যতই স্বস্তির হোক, আমরা নিজেরা যদি টিকা উদ্ভাবন করে উৎপাদনে যেতে পারতাম তবে সেটা হতো বেশি গৌরবের ও মর্যাদার। আর পরমুখাপেক্ষিতার থেকে পরিত্রাণের বিষয়। আমরা টিকা উৎপাদন করতে যাবো। এ ক্ষেত্রে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা নিয়ে যেন কোনো ঢিলেমি না হয় সেটার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এ ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া খুব সহজ তো নয়ই বরং অনেক চড়াই উতরাই অতিক্রম করতে হতে পারে। রাশিয়া বা চীনা টিকা এখানে উৎপাদন করার কথা শোনা যাচ্ছে। এসব নিয়ে দরকষাকষি করে ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছা সহজ নয়। আর টিকার প্রয়োজনটাও এত জরুরি যে, বিলম্ব ঘটলে সব কিছু বেসামাল হয়ে পড়বে। টিকা নিয়ে প্রশাসনের নিদারুণ দুর্বলতা অবলোকন করা গেছে, তা আগেই বলেছি। সম্মুখে যেন এমন কিছু না ঘটে সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে।
তা ছাড়া আমাদের প্রতিবেশী ভারত এখন খুব বিপর্যস্ত। তা গোটা বিশ্বের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেখানে কোভিড যেরূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে তা বাংলাদেশের জন্যও কঠিন বিপদের সঙ্কেত। ভারতের চিকিৎসাসরঞ্জাম ও চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক এবং বিদেশ থেকে সাহায্য সহযোগিতা প্রাপ্তি আর নিজস্ব টিকা থাকার পরও তাদের অবস্থা এতটা খারাপ যে, ভাবলে গা শিউরে উঠে। ভারতে কোভিড তার রূপ পাল্টে নিয়ে দানবে পরিণত হয়েছে। সেই দানব ইতোমধ্যে আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে। জানি না, আমাদের সার্বিক অবস্থার কারণে কী ধ্বংসলীলা এখানে ঘটাবে। বর্তমান অবস্থা মোকাবেলা করতেই আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা। এখন শুধু এই প্রার্থনাই করি, স্রষ্টা যেন আমাদের প্রতি সদয় হোন। আমরা যে বোঝা বইতে পারব না তা যেন আমাদের ঘাড়ে এসে না পড়ে।
এমন বিপদ মাথায় এসে পড়ার পর সমগ্র জাতির হুঁশজ্ঞান প্রখর হওয়াটাই জরুরি। কোভিড নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের সতর্কতার পরিবর্তে যদি অবহেলা করা হয় তবে তা শুধু ব্যক্তি নয় সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বনাশ ডেকে আনবে। কোভিড নিয়ে যেসব সতর্কতামূলক হুঁশিয়ারি দেয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে মানুষের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কোভিডের ভয়াবহতাকে নিয়ে নাগরিকদের বোধ আর ভয়ভীতি জাগ্রত হচ্ছে না। এমন আচরণকে বলতে হবে ‘অজ্ঞানতা’। কখনো কখনো মানুষের আচরণকে উন্মত্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার কাণ্ড বলে মনে হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, ক’দিন আগে কোভিডের টিকা সংগ্রহ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরাসরি অভিযোগ করেছে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির জন্যই টিকা সংগ্রহে বিলম্ব ঘটছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে সহযোগী অপর একটি মন্ত্রণালয়ের এমন গুরুতর অভিযোগ বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটা গুরুতর তা সবার বোধগম্য। নিশ্চয়ই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে এটা কোনো বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য নয় বরং বাস্তব বিষয়টাই উঠে এসেছে। তা ছাড়া এ যাবৎ টিকা সংগ্রহ নিয়ে যে মারাত্মক ঢিলেমি লক্ষ করা গেছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তাতে এটাই জনগণ মনে করছে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি। সরকারপ্রধান বহুবার জাতিকে আশ্বাস দিয়ে আসছেন, কোভিডের টিকা ক্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ মওজুদ রাখা হয়েছে। টাকা থাকার পরও এমন যে অবস্থা তা আসলে অথর্বতা। সরকারপ্রধান আরো জোর দিয়েছেন, দেশের প্রত্যেককে টিকা দেয়া হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে কচ্ছপগতিতে এখন চলছে তাতে সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করা সুদূর পরাহত হয়ে থাকবে।
আমরা কোভিড থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পর জাতীয় পুনর্গঠনের যে স্বপ্নের কথা বলছি তার জন্য আগে সবার টিকা পাওয়ার ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করছে। কোভিডের সংক্রমণ জারি থাকা অবস্থায় মানুষের নিরাপদ হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে হুমকি থাকবেই। তাই কোভিড থেকে উত্তরণের যাবতীয় কাজ নিয়ে হেলাফেলা করা গুরুতর অপরাধ। সেখানে সবাইকে সমান্তরালভাবে চলতে হবে। সেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এমন পিছিয়ে পড়ে থাকলে সব আশারই গুড়েবালি হবে; জাতি তাদের ক্ষমা করবে না।
কয়েকটি দেশ কোভিড থেকে উত্তরণের আলোর রশ্মি দেখতে পাচ্ছে। তবে এখনো বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে শয্যায় শায়িত আর শত শত কোটি মানুষ ভয় বিহ্বলতায় জড়োসড়ো হয়ে ভাবছে কখন কোভিডের টিকা পেয়ে তারা নিরাপদ হতে পারবে। অবাক এই পৃথিবী, কেউ এখন টিকা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর অগণিত মানুষ এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে থাকায় তাদের শ্বাসরুদ্ধ হতে চলেছে। আমাদেরও এমন এক পরিস্থিতির মধ্যেই দিন যাপন করতে হচ্ছে। কোভিড থেকে কিছুটা নিরাপদ থাকতে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরার ব্যাপারে শুধু গুরুত্ব আরোপ নয়, এটা অত্যাবশ্যক বলে সবাইকে সতর্ক করেছেন। তা ছাড়া সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মাস্ক ছাড়াই বের হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস হোয়াইট হাউজে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির মাক্স খুলে ফেলাটা তাদের সাফল্যের চিহ্ন হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। তবে বিশ্বের এক নম্বর শক্তি এবং অর্থনৈতিক জায়েন্ট তারা, তাদের কাছ সাধারণভাবেই মানুষ জানতে চাইবে, নিজেদের কোভিড থেকে নিরাপদ করতে পেরেছেন বটে। কিন্তু বিশ্বের মোড়ল হিসেবে পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষের প্রতি সে দেশের কি কোনো দায়িত্ব বা প্রতিশ্রুতি নেই? নিজেরা মাস্ক খুলেছেন; এই পর্যায়ে কী আর কারো নিরাপত্তার বিষয়টি হৃদয়ে উদয় হয়নি? এমনটা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে স্বার্থপরতার অভিযোগ তো উঠতেই পারে।
কোনো দেশকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে মানুষের জ্ঞান মেধার উৎকর্ষের প্রয়োজন অনেক বেশি। এটা চিরন্তন সত্য, মামুলি নীতি ভেবে তাকে কোনো অবস্থায় হালকাভাবে দেখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তা না হলে অহরহ আসা বিপদকে কারো পক্ষেই ঠেকানো সম্ভব হবে না। বিশ্বে তার অসংখ্য বাস্তব উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সত্যটির মর্মকথা উপলব্ধি করা গেছে; তা বোধ হয় না। কেননা অতীতেও দেখা গেছে বহুবার এখানে হটকারী কাজ করা হয়েছে। আমাদের তরুণদের মধ্যে সেই জ্ঞান গরিমার স্ফুরণ নেই। আর তা দেখা যাবেই বা কিভাবে? এমন উপলব্ধি জাগার অনুশীলন আর প্রশিক্ষণ কোথায়।
দেশের যখন যারা দিশারি ছিলেন বা আছেন তারা তো তরুণদের জ্ঞান সাধনার মনোবৃত্তি জাগানোর পরিবর্তে তাদের নিজেদের রাজনীতির অনুসারী করতে যতটা মনোযোগী ঠিক ততটাই উদাসীন তরুণদের শিক্ষা তথা জ্ঞান সাধনায় উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে। এটা নতুন কোনো সংযোজন নয়; যুগ যুগ ধরে এই ধারা বজায় রয়েছে। দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বহু। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাকার্যক্রমের মানে তো বিশ্ব মানের সাথে তুলনাই হয় না। আর দেশের সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণাকার্যক্রম নিতান্তই প্রতুল। তার মান নিয়েও বহু প্রশ্ন রয়েছে। তা ছাড়া এসব গবেষণাকার্যক্রমের মৌলিকত্ব নিয়েও অভিযোগও আছে। আর বিজ্ঞান প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে যৎকিঞ্চিৎ। তবে আমরা এ কথা বলব না যে, বিজ্ঞান প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করতে সক্ষম ব্যক্তি দেশে নেই। বরং এটাই সত্য, গবেষণার সাজসরঞ্জাম, উপযোগী পরিবেশ এবং সরকারি সহায়তার প্রচণ্ড অভাব বিদ্যমান। স্মরণ করা যেতে পারে, পাশ্চাত্যের এবং যুক্তরাষ্ট্রে বহু বিশ্ববিদ্যালয় কোভিড নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে যাচ্ছে। পৃথিবীর মানুষকে বহু তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তারা সাহায্য ও সতর্ক করছেন। অতীত থেকে আজ পর্যন্ত তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে গভীর নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে গবেষণা চালিয়ে নানা বিষয়ে মানবজাতির জন্য অবদান রেখে চলেছেন।
কোভিডের যে টিকা ‘কোভি শিল্ড’ আমাদের দেশে দেয়া হয়েছে। সেটার অন্যতম গবেষক যুক্তরাজ্যেরই শুধু নয়, গোটা বিশ্বের স্বনাম খ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী। গভীর অধ্যবসায় একাগ্রতার মাধ্যমে গবেষণা করার ফলেই অত্যন্ত দ্রুত কোভিডের টিকা উদ্ভাবন করা গেছে। মানবজাতির প্রতি গভীর ভালোবাসা মমতা আর প্রতিশ্রুতিই তাদের এই কাজকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করেছে।
তবে আমাদের দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা গবেষণা আর নিরলস পরিশ্রম করে কৃষি ক্ষেত্রে যে, অবদান রেখে চলেছেন, গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে তা স্মরণ করতে হবে। বাংলাদেশের সূচনাকালে এখানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ যা ছিল এখন তার পরিমাণ অনেক কমেছে। অথচ সে সময় জনসংখ্যা আজকের চেয়ে অনেক কম থাকা সত্ত্বেও খাদ্যঘাটতির পরিমাণ ছিল বিপুল। ছিল দেশে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। তাই দুস্থদের দিন কেটেছে অনাহারে বা অর্ধাহারে।
আজকে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ অনেক কমেছে। তা সত্ত্বেও খাদ্যশস্যের উৎপাদন বহুগুণে বেড়েছে। আগে যেখানে ছিল ৭ কোটি মানুষ আজ সেখানে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটির বেশি। তবুও দেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে। এর রহস্য হচ্ছে, কৃষিবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে খাদ্যশস্যের উন্নত এবং অধিক ফলনশীল বীজ উদ্ভাবন করেছেন। তারা বিরূপ প্রকৃতি পরিবেশ মোকাবেলা করে শস্য উৎপাদনের উপযোগী বীজ উদ্ভাবন করেছেন।
প্রশাসনকে এখন অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতি আয়ত্তে আনাটাই সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে সবাই এক দিকে ছুটবেন, তাও সঙ্গত নয়। একটি গতিশীল এবং সক্ষম প্রশাসন তার অনেক ‘অপশন’ রাখে এবং বিকল্প বিবেচনার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমরা মনে করি নিশ্চয়ই আমাদের প্রশাসন বিশ্বমানের না হলেও তৃতীয় বিশ্বের অনেকের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে উত্তীর্ণ হতে পারে। সে ভরসা আছে। তা ছাড়া একটা কথা আছে ‘ঠেকায় পড়লে’ বহু কিছুই শেখা হয়। সে বিবেচনায় কোভিড আমাদের অনেক কিছু রপ্ত করতে সাহায্য করেছে। সে অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই প্রশাসনকে অনেক দক্ষ হওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করছে। দেশের জনগণ ক্ষেত্রবিশেষে উচ্ছৃঙ্খল জনতায় পরিণত হয়, যা সম্প্রতি দেখা গেছে। তাকে ম্যানেজ করা বা নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে উপায় উপকরণের ঘাটতি আছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা পূরণ করতে হবে। ভূখণ্ডের পরিধির বিবেচনায় ভৌগোলিক দিক থেকে আমরা ছোট বটে; কিন্তু জনসংখ্যার নিরিখে আমাদের দেশকে ছোট বলা যাবে না। বিপুল সংখ্যক মানুষকে এখনো আমাদের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি; বরং তা ‘বোঝা’ আর ‘বিড়ম্বনা’ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এখন সময় এসেছে এই বিপুল জনসংখ্যাকে উৎপাদনমুখী করে তোলার জন্য কৃষি ও শিল্পসহ অন্যান্য সেক্টরকে সামনে রেখে পরিকল্পনা নেয়ার। জনতার যে বাঁধ ভাঙার প্রবণতা তার প্রথম কারণ তাদের পরিস্থিতি মূল্যায়নে অক্ষমতা। দ্বিতীয়, দেশের মানুষের এমন স্বভাব জানা সত্ত্বেও প্রশাসন যথাবিহিত পদক্ষেপ নিয়ে শৃঙ্খলা বিধান করতে সক্ষম হয়নি। বরং তাদের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতাও লক্ষ করা গেছে।
[বাকি অংশ আগামীকাল]
ndigantababor@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা