২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞান আত্মস্থ করা জরুরি

অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞান আত্মস্থ করা জরুরি - ছবি : নয়া দিগন্ত

দূর অতীত থেকে আজ অবধি বারবার সব স্মরণীয় দুর্যোগ আর দুর্বিপাকে দুর্ঘটনা বিশ্বকে এটা উপলব্ধি করতে শিখাতে চেয়েছে যে এই ব্রহ্মাণ্ডে টিকে থাকতে প্রজ্ঞা অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞানকে আত্মস্থ করা এবং সময় উতরে যাওয়ার পূর্বে তাকে আরো শাণিত করে উদ্ভাবনে লাগাতে না পারলে সমূহবিপদের মুখে পড়তে হবে এবং শেষে বিলীন হওয়ার আশঙ্কাও থাকবে অনেক। বিশ্বব্যাপী আজ কোভিডের যে ভয়াবহ তাণ্ডব, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার যে নিরন্তর প্রচেষ্টা, সেটাই আসলে মানুষ তার প্রজ্ঞা অভিজ্ঞান যা স্রষ্টা তাকে দিয়েছেন, কাজে লাগিয়ে বেঁচে থাকার উপায় উদ্ভাবনের জন্য নিরন্তর চেষ্টা করছে। বেঁচে থাকার এই নিরন্তর সংগ্রামে সব দেশই এক কদমে চলতে পারছে না।

যারা এগিয়ে আছে তারা এর মাধ্যমে বাণিজ্য করে, উপার্জন আর কিঞ্চিত মানবতা রোধের তাগিদে পিছিয়ে থাকাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। এর সাথে আরো স্বার্থ যোগ করতে হবে, আজ তারা যদি এতটুকু না করে তবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মানুষ যাদের সংখ্যা কম নয়, তারা যদি গভীর খাদে পড়ে শেষ হয়ে যায়, তবে তাদেরও তো ভবিষ্যতের বাণিজ্যের ক্ষেত্রগুলোও শেষ হয়ে যাবে। আর ভবিষ্যতে আজকের ঘটনার ইতিহাস রচিত হবে তাতে হাজার বছর পরও পৃথিবী জানবে, সে সময় মানুষ মানুষের সহায়তায় ছিল না, চরম স্বার্থপরতা দেখিয়েছে। আজকে কোভিড যে শিক্ষা বিশ্বকে দিয়ে যাচ্ছে আত্মরক্ষার জন্য, অনেক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তথা হাজারো ধরনের মারণাস্ত্র তৈরি করেছে, সীমান্ত রক্ষার জন্য লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে বটে; কিন্তু ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র একটা জীবাণুর কাছে তারা এখন কত দুর্বল আর অসহায়। তা থেকে রক্ষা পেতে কী পেরেশানিতেই না আছে যার রূপ রূপান্তরিত হচ্ছে। অবশ্যই একে নিয়ে গভীর ভাবনায় আছে তারা। নিয়ত বহু গবেষণা চালিয়েও জানতে পারছেন, এই মহা শক্তিধর জীবাণুটার উৎস কোথায় এবং কিভাবেই এর উৎপত্তি। আর ক্ষণে ক্ষণে তার স্বরূপ ও শক্তির রূপান্তর ঘটছে। বিস্মিত হয়ে এ নিয়ে গভীর ভাবনায় রয়েছেন বিশ্বের হাজারও চিকিৎসা বিজ্ঞানী, আর গভীর উৎকণ্ঠার শেষ নেই। পৃথিবীর দুই শতাধিকের বেশি রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের ব্যয় হচ্ছে বিপুল অঙ্কের টাকা। সবার মধ্যে এই বোধ সৃষ্টি হয়েছে যে, মানবজাতি সার্বিকভাবে কত দুর্বল, অসহায়, তাদের শক্তি সামর্থ্যরে কী চরম সীমাবদ্ধতা। তা থেকে বিশ্বের সবাইকে আজ বুঝতে হবে, সেই পরম সত্তার কাছে আত্মসমর্পণ করার কথা।

শত সুরক্ষিত ব্যবস্থা ভেদ করে কত সহজে সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে কোভিডের এই জীবাণু। লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ মৃত্যুবরণ করছে, মৃত্যুর এই মিছিল থামানো যাচ্ছে না। পৃথিবীতে এ যাবৎ যত দুর্যোগ মানব জাতির ওপর এসেছে, এটা বোধ করি স্মরণকালের ইতিহাসের ভয়াবহতম। এমন আশঙ্কায় খোদ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে গভীর অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলা হচ্ছে কবে বা কতকাল পরে কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, না আদৌ তা করা সম্ভব, সেটা তাদের জানা নেই। মানুষ চন্দ্র ও মঙ্গল জয় করে দারুণ অহমিকায় ভুগছিল। আজ এটা পরিষ্কার যে, এ মানুষের পক্ষে অহমিকায় ভোগা কোনো সুবুদ্ধির নিদর্শন নয়। তা ছাড়া এটা মনে রাখার মতো যে, বিশ্বের অর্থনীতি প্রযুক্তি আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক, অর্থাৎ সব দিক থেকে এগিয়ে থাকা দেশটি কোভিডের কাছে তুলনামূলকভাবে সব চেয়ে বেশি নাস্তানাবুদ হয়েছে। অথচ বহু দরিদ্র ও সামর্থ্যহীন দেশ এতটা বিপদগ্রস্ত হয়নি। এর গূঢ় রহস্যটা খোলা মন নিয়ে সবারই ভাবা উচিত। বিশ্বে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ই বেশি, তাই তাদেরই অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে আজকের বিশ্বের পরিস্থিতিটা বিবেচনা করে দেখা দরকার। বিশ্বাসীদের দৃষ্টিকোণ সাধারণের চেয়ে পৃথক, সে জন্য আমরা তাদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বর্তমান দুর্যোগটা নিছক বস্তুবাদীদের মতো করে যেন ব্যাখ্যা না করেন। সুদূর অতীত থেকে আজ অবধি মানুষ ভয়াবহ যত দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে, তার বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় সব সময় বিভ্রান্ত হয়েছে বিশ্ববাসী। সব দুর্যোগ দুর্ঘটনার পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ অবশ্যই নিহিত আছে। কিন্তু এসব কারণের পরও যে গূঢ় ব্যাপার থাকতে পারে সেটা কখনো ভাবে না বস্তুবাদীরা। সেই বিষয়টা না ভাবার কারণে মানুষের উপলব্ধিতে ভিন্ন চেতনা দোলা দেয়নি। ফলে সেসব ঘটনা থেকে সবার সম্যক উপলব্ধি ঘটেনি। অথচ যেকোনো অকল্পনীয় দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে নতুন বোধ বিবেচনার উন্মোচন ঘটাই ছিল বাঞ্ছনীয়; বিশেষ করে যাদের মধ্যে কিঞ্চিত হলেও স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস আছে। তাদের বুঝতে হবে আমরা কী সীমালঙ্ঘন করে যাচ্ছি, যে কারণে সীমার বলয়ের মধ্যে থাকার জন্য হুঁশিয়ারি আসছে। মানুষও কিন্তু অধীনস্থদের তার দেয়া সীমা অতিক্রম করলে অসহ্য হয়ে পড়ে। ব্যক্তিজীবনে এসব বিষয় নিয়ে ভাবলে চেতনার দুয়ার খুলে যাবে।

কোভিড গোটা বিশ্বের মানুষকে যে করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে, তা থেকে বাংলাদেশ বাদ পড়েনি। নানা ভোগান্তির মধ্যে এখনো পড়ে আছে এ দেশ। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বহু দুর্বলতা লক্ষ করা গেছে এবং যাচ্ছে। তা নিয়ে সামান্য আগে এই কলামে লেখা হয়েছে। তাই সেসব নিয়ে আর কিছু বলার থাকলেও দ্বিরুক্তি হবে বলে কিছু বলতে চাই না। তবে আশা করি, সংশ্লিষ্ট সবার এ ব্যাপারে আত্মউপলব্ধি ঘটবে। দূর অতীতে বিশ্ব যতটা সহজ এবং জটিলতা মুক্ত ছিল এখন আর তা নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে অনেক কিছুই মানুষের জন্য সহজ হয়েছে বটে কিন্তু সেই সাথে এটাও অনুভব করা উচিত যে, সবই মানুষের নিয়ন্ত্রণে আসছে না কখনই আসবে না। বাংলাদেশকেও এটা বিবেচনা করতে হবে, কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বরং এমনটাই বিবেচনায় রাখতে হবে। বিশ্ব নানা দিকে যতটা এগিয়েছে আমাদের অন্তত তার কিছুটা কাছাকাছি যেতে হবে। আমাদের মেধার প্রতিযোগিতা করা না হোক, মেধার চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ আর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রাখতে হবে। কিন্তু আজো এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি মনোযোগী নন। শুধু প্রতিষ্ঠান গড়া নয়, তা গড়ার পর গুরুত্ব দিতে হবে একটি বহুল প্রচলিত কথার প্রতি যে, ‘ম্যান বিহাইন্ড দি মেশিন’। এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে। সেই দক্ষ ম্যান তৈরি করলেই চলবে না। তার মেধা বুদ্ধি আর শ্রমের উপযুক্ত বিনিময়ের কথাটি স্মরণ রাখতে হবে। তা না হলে গোটা বিশ্বে যে ‘ব্রেন ড্রেন’ তৈরি হয়েছে তার সংযোগ কিন্তু এখানেও হয়ে আছে এবং তা চলমান।

একটি প্রবাদের কথা ভাবতে হবে, ‘আমারই বধূয়া আন বাড়ী যায় আমারই আঙ্গিনা দিয়া’। প্রসাঙ্গান্তর হলেও বলে রাখতে চাই- মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্নের কথা বলা হচ্ছে, তা যদি মরীচিকা হয়ে যায়, তবে কোনোভাবে নিজ ‘বধূকে আন বাড়ী’ যাওয়া থেকে আর ঠেকানো যাবে না। বাংলাদেশের বহু মেধাবী তরুণ দেশের বাইরে গিয়ে সেখানে অর্থনীতি, বিজ্ঞানপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে, মেধার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে। আমরা যদি দ্রুত দেশের অবস্থা পাল্টাতে না পারি, তবে ভবিষ্যতে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন কেবল কল্পনায় ফানুসই হয়ে থাকবে।

প্রকৃতি আর পরিবেশের সাথে যে বিরূপ আচরণ গোটা বিশ্বে করা হচ্ছে, বাংলাদেশও তা থেকে পিছিয়ে নেই। তার ফলে সর্বত্রই বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে; আজ যেমন কোভিড নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ভবিষ্যতে হয়তো ভিন্ন রূপে আরো মারাত্মক কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা আর গবেষণা করা অপরিহার্য হয়ে পড়বে। তখন মেধা ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রয়োজন হবে অনেক বেশি। আমাদের মেধাবী তরুণদের দেশে রাখার প্রয়োজনটা এখনই বুঝতে হবে এবং সে বিবেচনায় পদক্ষেপ নিতে দেরি করা চলবে না। আমাদের সরকার প্রধানের অবশ্য ভিশন আছে; কিন্তু সম্মুখে যে সমস্যার উত্তাল সমুদ্র। এ ক্ষেত্রে প্রায়োরিটিতে করণীয় বেছে নিতে হবে।

সরকারকে অনেক কিছু নিয়েই ভাবতে আর সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তার সব কিছুই যেসব সময় সঠিক তা বলা যাবে না। কোভিড নিয়ে দেশে কিছু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের উদ্যোগ প্রচেষ্টা আগেই লক্ষ করা গেছে। তাতে ভুলত্রুটি কিছু থাকতেই পারে। কিন্তু সঠিক জায়গায় পৌঁছার জন্য চেষ্টা থাকতে হবে। এসব প্রচেষ্টার পেছনে সরকারের যে উৎসাহ সহায়তা থাকা যতটুকু প্রয়োজন ছিল তা লক্ষ করা যায়নি। ভুল থেকেই যে শিখতে হয় সেটা বুঝতে হবে। আমরা লক্ষ করেছি ইরান কোভিড নিয়ন্ত্রণে একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে টিকা তৈরি করে স্বয়ম্ভর হতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আজ না হোক আগামীদিনে সে চেষ্টা সফল হবে, নিশ্চিত।

মানুষ তার জীবনমান আর নিরাপত্তা ও অগ্রগতি আশা করে। এমন ভরসার কথা নিয়তই শোনানো হয়। তার ভিত্তিটা প্রথমে গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে আর উন্নতিটা সবাই শুরু করে গোড়া থেকে। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বসবাস করে। আর রাষ্ট্রীয় নির্দেশও ধনী আর দরিদ্রের ব্যবধান ঘোচানোর। তাই উন্নয়নের কাজটা শুরু করতে হবে সেখান থেকে যেখানে দরিদ্রের সংখ্যা এবং জনবসতি বেশি। এই দুই বিবেচনায় উন্নয়নের কাজটা মফস্বল থেকেই শুরু করতে হবে। কিন্তু এখন যা কিছু হচ্ছে তা তা ঠিক উল্টো দিক থেকেই হচ্ছে। উন্নয়নের পথটা অন্ততপক্ষে সমান্তরাল করতে হবে। আমরা পশ্চিমের কোনো দেশকে যদি মডেল হিসেবে বিবেচনায় নিই, তবে সেখানে নগর-মফস্বল বলে কিছু নেই। সবাই তথা দেশের সব নাগরিক যে যেখানেই বসবাস করুক না কেন, তাদের নাগরিক সুবিধা সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য নেই।

আমাদের বিবেচনায় দেশকে সেটাই অনুসরণ করতে হবে। বড় শহর আর নগরে কাজের সুযোগটা বেশি বলে সে জন্য সারা দেশ থেকে মানুষ ছুটে আসে এসব স্থানে। সে জন্য ঢাকার জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বিপুল। আর এই বিপুল জনসংখ্যার বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মহানগরী হচ্ছে ঢাকা। একটি মহানগরীতে যে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নাগরিকদের জন্য তৈরি করা হয়, সেদিক থেকে ঢাকা প্রকৃতপক্ষে এমন এক নগরী যাকে ‘ইট পাথরের বস্তি’ বললে ভুল বলা হবে না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা বাসস্থান এসব দিক থেকে ঢাকা এতটা পিছিয়ে আছে যে, তা এই শহরের ব্যবস্থাপকদের জন্য প্রচণ্ড মাথাব্যথার কারণ। বিপুল জনসংখ্যা এই নগরীর জন্য নানা সমস্যার কারণ। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই নগরীর এত সমস্যা যা বলে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশে কোভিডের যে বিস্তার ঘটেছে সেখানে ঢাকার পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। এর প্রধান কারণ জনাধিক্য। এখানে মানুষের শৃঙ্খলাবোধ আর সচেতনতার বড় অভাব। মূলত কোভিডের ব্যাপক বিস্তার সে কারণেই ঘটেছে এখানে। কোভিড ছাড়াও এখানে মানুষের ব্যাপক চাপ স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে দিচ্ছে। ঢাকার পরিবেশগত যে সমস্যা সেটার একটি কারণ মানুষের আধিক্য। নগরবাসীর বড় একটা অংশের পরিবেশ নিয়ে কোনো জ্ঞান নেই বললেই চলে। জনসংখ্যার জন্য গণপরিবহন ও অন্যান্য যানবাহনের সংখ্যাও বেশি। ঢাকায় সে কারণে বায়ুদূষণের মাত্রা এতটা ভয়ঙ্কর যে, পৃথিবীর যে সব নগরীর বায়ুদূষণের মাত্রা মানুষের স্বাস্থ্য সঙ্কটের অন্যতম প্রধান কারণ, ঢাকা সেই পর্যায়ও অতিক্রম করে গেছে। এ শহরে এত বেশি যানবাহন চলে যে ঢাকার শব্দদূষণ পরিস্থিতিকে আরো বিপন্ন করে চলেছে। ঢাকার কয়েকটি মাত্র সমস্যার কথা উল্লেখ করলাম, আরো যত সমস্যা রয়েছে তার সুষ্ঠু বৈজ্ঞানিক সমাধান ব্যতিরেকে চার শতাধিক বছরে গড়ে উঠে এই মহানগরী একপর্যায়ে তার সমস্যার ভারে অনাবাসযোগ্য হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে পড়তে পারে। এসব সমস্যা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন। কেননা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে যে নগরী তাকে এখন কোনো পরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য বিপুল অর্থ সম্পদ বিনিয়োগ করা অনেক কারণে অসম্ভব। আর এ শহরের দ্রুত যে বিস্তার ঘটছে তাও কোনো পরিকল্পনার অধীনে নয়। ঢাকা থেকে কিছু মানুষকে সরিয়ে নেয়া অনিবার্য হলেও তা সহজ নয়। কেননা দেশের নাগরিক হিসেবে কে কোথায় বসবাস করবে সেটা ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এভাবে মানুষ বাড়তে থাকলে ঢাকা বস্তুত পরিণত হবে এক বিশৃঙ্খল জনতার শহরে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথাও প্রাসঙ্গিকভাবে আসে। বাংলাদেশের বহু অঞ্চল ভূকম্পপ্রবণ। ঢাকাও এর বাইরে নয়। সে বিবেচনায় ঢাকায় যদি কোনো বড় ধরনের ভূকম্পন ঘটে, তবে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস বিধায় এখানে প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা বেশি।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আরটিআই ইন্টারন্যাশনাল আরবান রিজিলিয়েন্স প্রকল্পের আয়োজিত এক কর্মশালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এটি ভারতীয়, ইউরোপীয় ও মিয়ানমার তিন গতিশীল বা সম্প্রসারণশীল আন্তঃমহাদেশীয় প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত, যার মধ্যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকা। আশঙ্কা করা হচ্ছে কোনো বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকার সমস্ত ভবনের অর্ধেকই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি তা-ই হয়, তবে প্রাণহানির ঘটনা কী পরিমাণ তা তো অনুমান করাই যায়। ঢাকার বিপর্যকর পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। এই শহরে বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাসের কারণে এই পরিবেশে নানা সংক্রামক ব্যাধি দেখা দেয়া খুবই স্বাভাবিক। এত সব কারণে ঢাকাকে নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক মহলকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। ঢাকা মহানগরীকে দু’টি সিটি করপোরেশনে বিভক্ত করা হয়েছে। বৃহত্তর ঢাকাবাসীর নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য এর সমস্যাগুলোর কিনারা করার স্বার্থেই তা করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যার যে ব্যাপকতা সে জন্য দুই নগর পিতার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বে¡ও তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতেও ক্রমান্বয়ে মানুষ আসছে গ্রামাঞ্চল থেকে। গ্রামের কর্মসংস্থানের অভাবই তাদের ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহর নগরমুখী করেছে। গ্রামাঞ্চলে ধান কাটার সময়ই কেবল দুই তিন মাসের জন্য কাজ পাওয়া যায়। বাকি সময় কোনো কাজ থাকে না।

কৃষিকর্মীরা বেকার হয়ে পড়লে তাদের পরিবার-পরিজনদের জন্য অন্ন সংস্থান করা সম্ভব হয় না বলেই তাদের শহরমুখী হতে হয়। কৃষি বিশেষজ্ঞরা যদি গবেষণা ও পরিকল্পনা করে কৃষকদের এই দীর্ঘ অবসরের অবসান ঘটানোর জন্য ফসলের বিভিন্নমুখী ব্যবস্থা করেন বেকার কৃষকদের জন্য, তবে ওদের বসে থাকতে হবে না এবং তাদের পরিবার-পরিজনের কষ্টের অবসান হবে। আর তাতে দেশে কৃষি উন্নতির ক্ষেত্রে এক বিরাট বিপ্লব ঘটে যাবে। মানুষ নির্মল পরিবেশেই থাকতে পছন্দ করে।

গ্রামে ফিরে গেলে সেখানে বসবাসকারীদের জন্য আরো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাও করতে হবে। কৃষিবিজ্ঞানী ও তাদের সহকারীরা যাতে মাঝেমধ্যে সব কিছু সরেজমিন তদারক করতে গ্রামে গিয়ে সেখানে অবস্থান করতে পারেন তারও ব্যবস্থা করতে হবে। পৃথিবীতে সর্বত্রই আজ উন্নত কৃষি কাজ হচ্ছে; তথা যান্ত্রিক চাষাবাদ হচ্ছে। কৃষকদের সেই কৃষিকাজে সহায়তার জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের অর্থনীতিতে কৃষির বিরাট অবদান। তাকে আরো বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে। কৃষির উন্নতি ঘটলে সমগ্র দেশবাসীর জীবনেও তার ছোঁয়া লাগবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের মূল্যবান অবদানের কথা। স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশে আবাদযোগ্য জমির যে পরিমাণ ছিল, এখন তার পরিমাণ অনেক কমেছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে এই জনপদের জনসংখ্যাও ছিল কম। তারপরও ছিল বিরাট খাদ্য ঘাটতি। এখন আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছে কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। এসব কৃতিত্ব আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের। তারা বেশি ফলনযোগ্য বহু ধানবীজ উদ্ভাবন করেছেন। ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে অনেক।

তা ছাড়া দেশে প্রায় পাঁচ শতাধিক উপজেলা রয়েছে, সেখানে সদরে ছোট ছোট টাউনশিপ গড়ে তোলা হয়েছে। সেসব উপজেলা সদরের অবকাঠামোর যদি উন্নতি ঘটানো যায়, সেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলার মতো সুযোগ-সুবিধা সরকার যদি সৃষ্টি করে, শিল্প উদ্যোক্তাদের সেখানে শিল্প গড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে, তবে বহু লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বড় শহর থেকে বহু মানুষ এসব উপজেলায় গিয়ে বসবাসের জন্য মনস্থির করতে পারে; সেখানে যদি তাদের আয় রোজগার হয়। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন নির্বাহ করতে পারে।

তখন বড় শহরের কষ্টকর জীবনযাপন, জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি- এসব বিবেচনায় বহু মানুষ এ শহর ছেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে বহু উপজেলায় ছোট, বড়, মাঝারি শিল্প গড়ে উঠেছে। সেখানে বহু নারী-পুরুষের কাজের সুযোগ ঘটেছে। এমন বসতি গড়ার ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের দায়িত্ব অনেক বেড়েছে। উপজেলায় বসবাসকারীদের নিরাপত্তা আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এখনো উপজেলায় সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা জারি আছে বটে; তবে অনেক ক্ষেত্রে তা নামকাওয়াস্তে। কোথাও চিকিৎসক নেই; আবার কোথাও চিকিৎসাসামগ্রী, ওষুধপত্রের মারাত্মক সঙ্কট। দেশের নাগরিকদের এসব সুবিধা পাওয়ার রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনা রয়েছে। তা ছাড়া দেশের সকল নাগরিককে শিক্ষিত করে তোলাও সরকারের দায়িত্ব। সে জন্য উপজেলা পর্যায়ে সামগ্রিক ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।

উপজেলায় যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের কথা হয়েছে। তার বাস্তবায়নের ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু উপজেলায় এখন চেয়ারম্যান ও ইউএনওকে কাজ করতে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের কাজে এমপিরা হস্তক্ষেপ করে থাকেন। এমপিদের উপজেলায় নাকগলানোর সুযোগ নেই। এমপিদের দায়িত্ব দেশের জন্য আইন প্রণয়ন এবং সরকারের জবাবদিহি নেয়া। মূলত রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই তাদের কাজ। কিন্তু সেখানে তাদের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো নয়। জাতীয় কত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে, সেখানে সংসদে তাদের মূক হয়ে থাকতে দেখা যায়। দেশে যে কোভিডের সৃষ্ট ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এ সংক্রান্ত কত যে সমস্যা সৃষ্টি হয়ে আছে, তা নিয়ে এমপিদের কোনো কথা বলতে শোনা যায় না।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement