করোনা-সতর্কতা কেন জরুরি
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১১ মে ২০২১, ২০:০৬
সম্প্রতি দেশে করোনাভাইরাসের ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট’ পাওয়া গেছে। সরকারিভাবে স্বীকার বা ঘোষণা করার আগে জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিআইএসআইডি) এ তথ্য প্রকাশ করেছে। পরে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। এটি ধরা পড়েছে যশোর এলাকায়। সেখানে আটজন কোভিড-১৯ রোগীর নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করা হলে দেখা যায়, দু’জন হুবহু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। বাকি ছয়জনের মধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট অথবা এর কাছাকাছি ধরনের ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়।
করোনাভাইরাসের সবচেয়ে সংক্রামক যেসব ধরন বিশ্বে বিপর্যয়রূপে দেখা দিয়েছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দক্ষিণ আফ্রিকান, ইউকে, ব্রাজিলিয়ান এবং ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। এসব ভ্যারিয়েন্টের বেশির ভাগই মারাত্মক নয়। একটি ভ্যারিয়েন্ট কেবল তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন সেটি মূল ভাইরাসের চেয়েও বেশি সংক্রামক, বেশি দ্রুত গতিতে ছড়ায়, অপেক্ষাকৃত গুরুতর অসুস্থতা সৃষ্টি করে, কিংবা আগের টিকা গ্রহণের মধ্য দিয়ে অর্জিত ‘ইমিউনিটি’কে উপেক্ষা করতে পারে। এসব দিক থেকে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মক। করোনাভাইরাস শুরু থেকেই বারবার রূপ পাল্টাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা যখন এ ভাইরাসের মোকাবেলায় নানা রকম ওষুধ ও টিকা তৈরি করতে রাতদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন, তখন প্রাণঘাতী ভাইরাসটিও বারবার রূপ পাল্টিয়ে মানুষকে কঠিন থেকে কঠিনতর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, গত বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই করোনাভাইরাস তার শুধু স্পাইক প্রোটিনেই চার হাজার বারেরও বেশিবার রূপান্তর ঘটিয়েছে। এই রূপান্তরকে বলা হয় ‘মিউটেশন’। ভারতীয় যে ভ্যারিয়েন্টের কথা বলা হচ্ছে, সেটি এরই মধ্যে একাধিকবার স্বরূপের পরিবর্তন ঘটিয়েছে বা মিউটেশন করেছে। এ জন্য এটিকে বলা হচ্ছে ‘ডাবল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট’।
এই জোরদার হয়ে ওঠা ভাইরাস ভারতজুড়ে নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যে ভারতে মাত্র শ’খানেক মুসলমান তাবলিগ জামাতের জন্য সমবেত হওয়ায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকার তোলপাড় শুরু করেছিল এবং দেশজুড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল সেই ভারতই ১০ লাখ হিন্দুকে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান কুম্ভমেলায় স্নানের জন্য সমবেত হতে দিলো। সাম্প্রদায়িক এই পক্ষপাত এখন তাদের জন্য আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। শুধু কুম্ভ মেলা নয়, ক্রিকেটের আইপিএল, দেশের পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ইত্যাদি নানা উৎসব নিয়ে মেতে ওঠা ভারতীয়রা এখন চরম খেসারত দিচ্ছে। প্রতিদিনই ছাড়িয়ে যাচ্ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর আগের রেকর্ড। চিকিৎসা দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো। অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে মানুষ। দেখা দিয়েছে টিকার মারাত্মক সঙ্কট। বাংলাদেশের সাথে টিকা সরবরাহের চুক্তি করেও অন্যায়ভাবে তা ভঙ্গ করেছে দেশটি। পরে অক্সিজেন সরবরাহও বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য খাতের অক্সিজেনের জন্য ভারতের ওপরই নির্ভরশীল আমাদের বাংলাদেশ। এমনই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও নেপালের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি গুরুতর বলে উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নেপালেও ছড়িয়ে গেছে ভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট।
আমাদের দেশে মৃত্যুর হার যদিও এই মুহূর্তে কিছুটা কমে এসেছে, তবু যেকোনো মুহূর্তে অবস্থার অবনতির আশঙ্কা থেকেই যায়। আশঙ্কার বড় কারণ, আমাদের অসতর্কতা। কেবল সাধারণ মানুষই যে অসতর্ক তা-ই নয়; সরকারের পদক্ষেপও যে কাক্সিক্ষত পর্যায়ের, তা বলা যাচ্ছে না। ঈদ সামনে রেখে লাখ লাখ মানুষ সারা দেশে যাতায়াত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের সময় অসংখ্য মানুষ ঘরমুখী হবে, এটা জানাই ছিল। গত বছরও হয়েছে।
এবারো যে হবে, তা কারো অনুমানের বাইরে ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে উচিত ছিল, জনসাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানো। পাশাপাশি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিতসংখ্যক যাত্রী নিয়ে যাতে যানবাহন চলাচল করে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে নজরদারির প্রয়োজন ছিল। সরকার সেদিকে খেয়াল করেনি। বরং সবই খোলা রেখেছে। স্থানীয়ভাবে গণপরিবহন খোলা; শপিংমলে ভিড়ের চিত্র প্রায় স্বাভাবিক সময়ের মতো। একমাত্র দূরপাল্লার গণপরিবহন ছাড়া বাকি সবকিছুই চলছে। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যেভাবে মানুষ একসাথে চলাচল করেছে তাতে সংক্রমণের ঝুঁকি শতভাগ। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, অবাধে ঘরে ফেরার এই বিপুল জোয়ারের পর সংক্রমণ এখন শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে।
সরকারিভাবে ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছে দুই সপ্তাহ আগে। এর মেয়াদ গত সোমবার থেকে আরো ১৪ দিন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সীমান্তে জনচলাচল বন্ধ হয়নি। প্রথম ১৪ দিনের মেয়াদে ভারত থেকে তিন হাজারের বেশি মানুষ বাংলাদেশে ঢুকেছে। তাদের যথাযথভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে না। হাসপাতাল থেকে করোনা আক্রান্ত রোগী পালিয়ে যাবার ঘটনা ঘটেছে। ভারত থেকে আসা মানুষের মধ্যে ১৭ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশীরা বিপন্ন হতে পারে।
এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা নেয়া হয়নি; যেমন ভারত থেকে কোনো অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বা অধিবাসী নিজ দেশে ফিরলে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হবে বলে ঘোষণা করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। আমরা এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।
শুধু ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধ করা, প্রত্যাগতদের কোয়ারেন্টিনে রাখা কিংবা তাদের নমুনা নিয়ে জেনোম সিকোয়েন্সিং করা যথেষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ব্যাপকভিত্তিক সিকোয়েন্সিংয়ের উদ্যোগ নেয়া দরকার, যাতে কোথাও এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে থাকলে তা দ্রুত চিহ্নিত করা এবং অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়। সংক্রমণ যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্য এটা করা দরকার। কারণ, করোনাভাইরাস যত বেশি ছড়ায়, এর মিউটেশনের আশঙ্কা ততই বাড়ে। এর ফলে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব হতে পারে, যেগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্যমান টিকাগুলো কার্যকর না-ও হতে পারে। কিন্তু সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এখনো সক্রিয় নয়। এর বাইরে যা দরকার সেটি হলো জরুরি ভিত্তিতে অধিক সংখ্যক লোককে টিকার আওতায় নিয়ে আসা। টিকাদান কর্মসূচি আমরা সফল করতে পারিনি। অথচ ভারত থেকে টিকা সংগ্রহের চুক্তি করা নিয়ে বহু প্রচার-প্রপাগান্ডা করা হয়েছে। এখন সর্বশেষ অবস্থা হলো, আমরা গত দেড় বছরে মাত্র ২৬ লাখ লোককে টিকা দিতে সক্ষম হয়েছি যা সম্ভবত বিশ্বে সর্বনিম্নে। লাখ লাখ লোক দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছে। নতুন কোনো উৎস থেকে টিকা পাওয়ার বিষয় এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা। যুক্তরাষ্ট্র যে টিকার মজুদ করেছে সেখান থেকে ৪০ লাখ ডোজ চেয়েছে বাংলাদেশ। তবে সেটিও দ্রুত পাওয়ার সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্র আগে ভারতকে টিকা সরবরাহ করবে। এরপর হয়তো বাংলাদেশ আশা করতে পারে। দেশে টিকা উৎপাদনের কথাও শোনা যাচ্ছে। দু’টি প্রতিষ্ঠানকে টিকা উৎপাদনে সক্ষম বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। টিকার ফরমুলা বা কাঁচামাল পাওয়ার চুক্তি এখনো হয়নি। সেটির শর্তসহ কিছু বিষয় নিয়ে জটিলতা আছে বলে জানা যায়।
অভ্যন্তরীণ চিকিৎসার সব ব্যবস্থাও থাকা দরকার ছিল। কিন্তু সেই অবস্থা নেই। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ যে চরম নাজুক অবস্থায় রয়েছে; তা কোনো অজানা বিষয় নয়।
সরকারি হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। উচ্চমহলের সুপারিশ ও ধরাধরি ছাড়া সেখানে সিট পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুষকে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করাতে হয়। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলো যতটা না চিকিৎসা দিতে মনোযোগী, তার চেয়েও তাদের বেশি নজর রোগীর ‘গলাকাটা’র দিকে। করোনা রোগী পেলেই তারা অতিরিক্ত ওষুধ, অতিরিক্ত টেস্ট, অক্সিজেনের যথেচ্ছ ব্যবস্থাপত্র দিতে থাকেন। প্রয়োজন না থাকলেও রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করার জন্য চাপ দেন। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে অক্সিজেনের দাম রাখেন অনেক বেশি। একটি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি করালে প্রতিদিন ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বিল ওঠে। কখনো বিলের পরিমাণ হয়ে ওঠে অবিশ্বাস্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা জানাচ্ছে, সরকারি করোনা হাসপাতালে সাধারণ শয্যার একজন রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় গড়ে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা। এর বিপরীতে বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। এসব বিষয়ে সরকারের আদৌ কিছু করণীয় আছে বলে মনে হয় না। তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ একটি দৈনিককে বলেন, করোনাকালে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। এ অবস্থায় সরকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্যাটাগরি (অ্যাক্রিডিটেশন) অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে। সে অনুযায়ী প্রতিটি হাসপাতালে বেড ভাড়া, কোনো পরীক্ষার কী দাম, চিকিৎসকদের কনসালটেশন ফি ইত্যাদি টানিয়ে দিতে পারে। এতে রোগী অথবা রোগীর অভিভাবকেরা হিসাব করে নিতে পারবেন ওই হাসপাতালে চিকিৎসা করালে তাদের কী রকম খরচ হতে পারে।
সরকারি বা বেসরকারি কোনো খাত থেকেই আমরা সাধারণ মানুষ কাক্সিক্ষত সেবা পাবো, এমন কোনো আশা করাই বাতুলতা। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বাংলাদেশে উন্নয়ন নিয়ে সরকারি পর্যায়ে যতই ডামাডোল পেটানো হোক না কেন, স্বাস্থ্য খাতে গত কয়েক দশকে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকারও যে ব্যয় বরাদ্দ করে তা বিশ্ব মানের হওয়া দূরের কথা, উপমহাদেশের মানেও সর্বনিম্ন।
সুতরাং, সাধারণ নাগরিকদের সত্যিই তেমন কিছু করার নেই। গরিবের শেষ ভরসা একমাত্র আল্লাহ। এই কথা মনে রেখে তাঁর নির্দেশনা মেনে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে হবে।
আর সতর্কতা মানে হলো কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড করে হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, মানসম্মত মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং যতদূর সম্ভব ঘরে অবস্থান করা- সবাই করোনা থেকে বাঁচার মূল সূত্র।
ই-মেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা