২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

খাদ্যাভাবে পড়বে না তো দেশ?

খাদ্যাভাবে পড়বে না তো দেশ? - ছবি : সংগৃহীত

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় অভিঘাত প্রচণ্ডতায় আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত তিন-চার দিন ধরে একটানা মৃতের সংখ্যা দৈনিক শতাধিক। এর আশু প্রশমনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কবে নাগাদ এর প্রকোপ কমে আসবে তার কোনো পূর্বাভাস দিতে পারছে না কেউ। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা এখন আর চিকিৎসা বা নিরাময়ের কথা ভাবছেন না; বরং ভাইরাসটির প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। ‘সামাজিক দূরত্ব’ রক্ষার কথা বলছেন তারা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে এক সপ্তাহের শিথিল লকডাউন, তারপর এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউন এবং সবশেষে সেই কঠোর লকডাউন আরও এক সপ্তাহের জন্য বাড়ানো হয়েছে।

লকডাউনের ফলাফল কী হতে পারে, তা এখন আর কারো অজানা নেই। গত বছর মার্চে সেই প্রথম দীর্ঘ লকডাউন ও সাধারণ ছুটির দিনগুলোতে আমাদের জনজীবন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছিল। বহু প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল কলেজ, কোচিং সেন্টার, হোটেল রেস্তোরাঁ, বিনোদনকেন্দ্র ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যায়। এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী, শ্রমিক, জোগালি, এমনকি মালিকরাও কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। বেকার হলেন হাজারও পরিবহন শ্রমিক, রিকশা ও স্কুটার চালক, দিন এনে দিন খাওয়া লাখো দিনমজুর, হকার, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি নিম্ন আয়ের মানুষ। প্রথম দিকে সমাজের সচ্ছল মানুষেরা এগিয়ে আসতেন সাধারণ মানুষের সাহায্যের জন্য। বহু মানুষকে দেখা যেতো চাল, ডাল, আলু ইত্যাদি প্যাকেট করে গরিব মানুষের মধ্যে বিলি-বণ্টন করছেন। কিন্তু সঙ্কটকাল দীর্ঘায়িত হওয়ায় মানুষের সেই উৎসাহে ভাটা পড়েছে। তাছাড়া করোনার প্রকোপ বছর শেষে কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলে মানুষ অনেকটাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সরকারও গা-ছাড়া ভাব দেখায়। বিশেষজ্ঞরা দ্বিতীয় অভিঘাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্কতা জারি রাখলেও সরকারের তেমন কোনো প্রস্তুতি ছিল না। সেটি স্পষ্ট হয়ে গেল গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে সত্যি যখন মহামারীর দ্বিতীয় অভিঘাত শুরু হলো। আবারো দেখা গেল, মানুষ রোগী নিয়ে একের পর এক হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তির জায়গা পাচ্ছে না। বেড নেই, আইসিইউ নেই, অক্সিজেন নেই, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। পরিণতি হলো গুরুতর। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৪০-৫০ থেকে শুরু করে এখন শতাধিক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু আমাদের আজকের বিবেচ্য সেটি নয়। আমরা জানি, করোনায় মানুষের মৃত্যুর চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে এর অর্থনৈতিক প্রভাব। জানি, দেশে গত ৪৮ বছরের বিভিন্ন সরকারের অব্যাহত চেষ্টায় দারিদ্র্যের হার যেভাবে কমে এসেছিল সেটি আর এখন নেই। বরং গত প্রায় দেড় বছরের মহামারীর ধাক্কায় দারিদ্র্যের সেই হার অনেক উপরে উঠে গেছে। সরকারিভাবেই দারিদ্র্য ২০ শতাংশে উঠে গেছে বলে স্বীকার করা হচ্ছে। বেসরকারি হিসাবে এটি দ্বিগুণ বলেও কেউ কেউ দাবি করেছেন। আমাদের কিছু এনজিও এবং অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নানা জরিপে বিষয়গুলো উঠে এসেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বেশ কিছু প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু অন্য সব কর্মসূচির মতোই এসব প্রণোদনার অর্থও সুষ্ঠুভাবে বণ্টন হয়েছে, এমন বলা যাচ্ছে না। গণমাধ্যমের বিভিন্ন রিপোর্টে যেমনটা জানা যাচ্ছে, তাতে শিল্প খাতের বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পমালিকরা কিছু প্রণোদনার অর্থ পেয়েছেন। অন্যান্য শিল্পমালিকও যৎসামান্য পেয়ে থাকবেন। কিন্তু সেই প্রণোদনার অর্থের বেশির ভাগই এখনও বিতরণ করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দ করা অর্থের এক-চতুর্থাংশও যে বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো, এমন রিপোর্ট পত্রিকায় এসেছে। ক্ষুদ্র শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী- এরা প্রণোদনার অর্থ চোখে দেখেননি। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়, সরকারের এই প্রণোদনা কর্মসূচিও সম্ভবত একটি অসফল কর্মসূচি হতে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে সমস্যা আরও তীব্র হবে তাতে সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. আবুল বারকাতের এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এক কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। তারা এখনো কোনো কাজ খুঁজে পাননি। করোনায় যারা বেকার হয়েছে তাদের নিয়ে গবেষণায় তিনি দেখেছেন, দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ছয় কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন, যাদের মধ্যে শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার সেবা খাতের কর্মীরা।

আবুল বারকাতের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় কৃষি খাতে কাজ হারিয়েছেন এক কোটি ১৪ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ আর কাজে ফিরতে পারেননি। এছাড়া শিল্প খাতে প্রায় ৯৩ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এর ৩৭ লাখ শ্রমিকের কাজ হারানোর ফলে শিল্পে ফেরার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি, সেবা খাতে এক কোটি ৫৩ লাখ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এদের মধ্যে ৬১ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। তারা নতুন করে আগের কাজে ফিরতে পারেননি। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, কাজে ফিরতে না পারা এসব মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে করে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ব্যাহত ও স্থবির হচ্ছে।

এটি মানুষের জীবন-জীবিকা উভয়কে অনিশ্চিত করে তুলবে। এর ফলে সঞ্চয় হবে না, হলেও অতি স্বল্প। আর সঞ্চয় না হলে সৃষ্টি হবে বিনিয়োগহীন পরিবেশ। এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারও কমে আসবে।

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এম কে মুজেরি একটি দৈনিককে বলেন, করোনার প্রভাবে গরিব মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। অনেকে বেকার হয়ে নতুন করে কাজে ফিরতে পারছেন না। সরকারকে এখন বেকার ও দরিদ্র মানুষের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। আগামী বাজেটে বেকারদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি রাখতে হবে।

এ দিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এক পর্যবেক্ষণে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, চলমান করোনায় নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়বে প্রায় চার কোটি মানুষ।

আমরা একটু পেছনের কথা মনে করতে পারি। জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত বছরের এপ্রিল মাসেই সতর্ক করেছিল, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব যে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে তা শেষ পর্যন্ত আঘাত হানবে মানুষের পেটে। জেনেভায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে ডব্লিউএফপি বলেছিল, কোভিড-১৯ মহামারীতে পর্যটন খাতে আয় হ্রাস, রেমিট্যান্স হ্রাস এবং ভ্রমণসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের কারণে নতুন করে ১৩ কোটি মানুষ প্রবল খাদ্যসঙ্কটে পড়বে। আগে থেকেই খাদ্যাভাবে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে বিশ্বের সাড়ে ১৩ কোটি মানুষ। অর্থাৎ করোনাভাইরাসের কারণে তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণা ভোগ করবে প্রায় ২৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষ।

জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক ভার্চুয়াল সেশনে ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলে স্পষ্ট করেই জানান, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের ৩৬টি দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে ১০টি দেশের ১০ লাখ মানুষ এখনই অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। অনেক দেশে এ মানবিক সমস্যার কারণে নানা ধরনের সহিংসতা, দ্বন্দ্ব ও বিবাদ সৃষ্টি হতে পারে।

বেসলে গত বছরের এপ্রিলেরও আগে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, মহামারীর কারণে দরিদ্র হয়ে পড়া মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে না পারলে অন্তত তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গত বছর একটি পত্রিকায় একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অর্থনীতিতে নিশ্চিতভাবে মহামারীর প্রভাব পড়ছে। সামনের দিনগুলোতে তা আরো প্রকটভাবে দেখা দেবে। করোনার প্রভাবে এবার অর্থনৈতিক মন্দা হবে আরো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী।’ বৈশ্বিক মন্দার পূর্বাভাস দিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমাদের সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ হলো, যেভাবেই হোক অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। কোনোভাবেই যেন খাদ্যসঙ্কট না হয়, লোকজন যেন খাদ্যের অভাব অনুভব না করে, সেটি নিশ্চিত করা।

সেই প্রস্তুতি সরকারের কতটা আছে আমাদের জানা নেই। তবে সরকারের যে স্বাভাবিক খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা, সেটি কিন্তু এই মুহূর্তে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকে নেমে গেছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। এর কারণ হলো, সরকারের ধান গম সংগ্রহ কর্মসূচির ব্যর্থতা। সুতরাং ভবিষ্যতে যে কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে বলে নানা সূত্রে আভাস ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে সেই পরিস্থিতি সামলে নেয়া কঠিন হতে পারে।

আমাদের সরকার তথা মন্ত্রণালয়গুলো এবং প্রশাসনের অদক্ষতা আছে। গত এক যুগে অযোগ্য লোকে ভরে ফেলা হয়েছে প্রশাসনযন্ত্র। আছে প্রস্তুতিহীনতাও। এসব মিলে দেশ ও জাতিকে চরম সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement