২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

প্রতারণার অর্থনীতি

-

‘চোরের উপর বাটপাড়ি’ কাকে বলে? দেশে বহু কবিরাজ চিকিৎসকের দেখা মেলে। মানুষের অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা দিতে না পারলেও তারা ছলচাতুরীতে ওস্তাদ। ভালো কবিরাজও আছেন। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের দুষ্প্রাপ্যতায় তারা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তবে ঠগ, প্রতারক কবিরাজের সংখ্যা অনেক। এরা মানুষের কাছ থেকে কঠিন রোগ সারিয়ে দেয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেয় বিশাল অঙ্কের অর্থ। এভাবে অনেক মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়ার খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। এবার পাওয়া গেল বিপরীত খবর। স্ত্রীর সন্তান না হওয়ার জন্য কবিরাজের চিকিৎসা নিতে এসে চিকিৎসার ফি এক ব্যক্তি দেননি। রোগীর প্রতিনিধি উল্টো কবিরাজের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিশাল অঙ্কের অর্থ। একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সামান্য একজন মুড়ি বিক্রেতার প্রতারণা, শঠতা ও জোচ্চুরি ‘প্রতিভা’র কাহিনী।

প্রতারক নিজের ঠিকানা কখনো দিয়েছে ফরিদপুর, কখনো কুমিল্লা, কখনো ফেনী। এসব এলাকায় কেউ কেউ তাকে চিনলেও তার সঠিক ঠিকানা কেউ দিতে পারেননি। তিনি রাজধানীর হাজারীবাগ ঝাউচর এলাকায় হঠাৎ ‘দানবীর’ হিসেবে আবির্র্ভূত হন। ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যে অনন্য। ধর্ম ব্যবসার উদাহরণ দিতে গিয়ে মজিদের কথা বলতে অনেকে পছন্দ করেন। তবে এই মজিদরা ছিল গুটিকয়। তারা কেবল ধর্মকে ব্যবহার করে জীবন-জীবিকার আয়োজন করেছে। লক্ষ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার আইডিয়া তাদের মাথায় ছিল না। পত্রিকায় উঠে আসা ঘটনার বর্ণনা যদি দেখি, একটিমাত্র ঘটনায় মুড়ি বিক্রেতা লোকমান কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন। সময় লেগেছে মাত্র তিন মাস। আমরা যদি বৃহত্তর সমাজের দিকে তাকাই তা হলে নানা কায়দায় এই প্রতারণা দেখতে পাবো। এদের সংখ্যাও ভুরি ভুরি। হিসাব করলে দেখা যাবে, সমাজ এখন দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত; প্রতারক আর প্রতারিত। একজন মানুষও এখন সমাজে এমন পাওয়া যাবে না, যিনি প্রতারিত হননি।

লোকমান হাজারীবাগ ঝাউচর এলাকার এক শিক্ষকের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। সাবেক এই শিক্ষকের কিছু ব্যবসাও ছিল। লোকমান তাকে ধর্মের বাবা ও তার স্ত্রীকে ধর্মের মা ডাকেন। তিনি গণহারে মানুষকে সেখানে শাড়ি-লুঙ্গি-জুতা উপহার দিয়েছেন। একাধিকবার গণভোজের আয়োজন করে খাওয়ান। তার সাথে ছিলেন ১০-১২ জন। সাথে রঙিন চকচকে প্রাইভেট কার। এলাকায় পরিচিত হয়ে যান ‘দানবীর’ হিসেবে। তিন মাস পরে তিনি উধাও। এর মধ্যে জানা গেল, যেসব ‘দান’ তিনি এলাকায় করেছেন এগুলো সব বাকিতে নেয়া। মুদি দোকানের ডাল-চাল-নুন-তেল থেকে শুরু করে গণভোজের গরুও তিনি বাকিতে এনেছেন। উধাও হয়ে যাওয়ার পর প্রতারিত মানুষের একটি বড় তালিকা পাওয়া গেল। সেখানে দেখা যায়, সমাজের অগ্রসর বুদ্ধিমানরাও এতে রয়েছেন। হিসাব করে দেখা যায়, তিন মাসের শঠতার মাধ্যমে লোকমান এক কোটি ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

‘ধর্মের বাবা’কে জানালেন, তিনি মুড়ি তৈরির কারখানার জায়গা কিনেছেন দুই কোটি টাকা দিয়ে। তার কাছ থেকে এ ব্যবসার অংশীদার বানানোর কথা বলে নেন ১০ লাখ টাকা। একই অংশীদারির কথা বলে আরো দ’ুজনের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। ঘটনার পর জমির মালিক জানান, জায়গাটি লোকমান তার কাছ থেকে সাত লাখ টাকায় দুই বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন। তবে এক টাকাও পরিশোধ করেননি। ভাণ্ডারি নামের এক কবিরাজের সাথে পরিচয় হওয়ার পর তিনি জানালেন, তার বউয়ের সন্তান হয় না। তার কাছে এর চিকিৎসা করাবেন। এই রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ভাণ্ডারি কবিরাজের সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাকে দিয়ে দুই গাড়ি ইট, দুই গাড়ি সিমেন্ট, দুই গাড়ি বালু বাগিয়ে নিয়েছেন লোকমান। এগুলোর দাম এক লাখ ১৩ হাজার টাকা। এই দেনা এখন কবিরাজের ঘাড়ে। স্থানীয় এক ইউপি মেম্বারের কাছ থেকে ১১ লাখ টাকা, আরেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেন ১২ লাখ টাকা। পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিষ্ঠিত মানুষদের কাছ থেকে নানা ছুতায় ধার নিয়েছেন ৫০ লাখ টাকারও বেশি।

এক রিকশাওয়ালাকে টোপ দেন তার ছেলেমেয়েকে চাকরি দেয়ার। তার কাছ থেকে নেন দুই লাখ টাকা। সমাজের শুধু উপরের তলার মানুষ নন, একেবারে নিচুতলার মানুষদেরও তিনি টার্গেট করেছিলেন। এভাবে প্রতারণা বাণিজ্যকে তিনি ‘ম্যাক্সিমাইজ’ করেছেন; যাতে চাতুরি করে আদায় করা টাকার অঙ্কটা বড় করা যায়। অর্থাৎ তিনি ক্লায়েন্ট বাড়িয়ে শঠতা জালের বিস্তার ঘটিয়ে, অল্প সময়ে বেশি অর্থ মেরে দেয়ার কূটচাল বা চালাকি অবলম্বন করেছিলেন। তাতে তিনি দারুণভাবে ‘সফল’ হয়েছেন। অন্তত মুড়ি বিক্রি করে সোয়া কোটি টাকা তিনি একজনমেও আয় করতে পারতেন না। বাংলাদেশে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণার বহু ঘটনা ঘটেছে। তারা প্রতারণার জালকে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে ছড়িয়ে দিত। এরপর বড় একটি অঙ্ক যখন কামানো হয়ে যেত তখন চক্রটি পালিয়ে যেত। সরকারের অগোচরে কিংবা সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতারক চক্র এমন বহু ব্যবসায় করে নিয়েছে। প্রতারিতরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। ওই এলাকায় ধনী-গরিব মিলিয়ে একই সময়ে আরো যে কত মানুষের কাছ থেকে লোকমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তদন্ত করলে বেরিয়ে আসতে পারে।

পত্রিকাটি লোকমানের জোচ্চুরির যে বর্ণনা তুলে এনেছে তা একটি খণ্ডচিত্র বা এপিসোড। এর শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, পাওনাদাররা টাকার জন্য চাপ দেন। তখন তিনি তাদের ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখায় যেতে বলেছিলেন। তারা সেখানে গিয়ে সারাদিন অপেক্ষা করেন। এরপর লোকমান হাওয়া হয়ে যান। জানা গেছে, তার ব্যবহৃত গাড়িটিও উবার থেকে নেয়া। এমনকি ‘উবার’ চালকের পাওনাও পরিশোধ করা হয়নি। উল্টো তার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে গেছেন। প্রতারককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করেছে কি না, খবরে এর উল্লেখ নেই। কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এরপর তার গ্রেফতারে উঠেপড়ে লেগেছে এমনও কোনো ইঙ্গিত আমরা দেখিনি। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি সাধারণ একটি ঘটনা। কারণ এ দেশে সরকারি ব্যাংক থেকেও হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে বেহাত হয়ে যায়। সেসব ঘটনার নাটের গুরুদের বিচারে কার্যকর উদ্যোগ নেই। সে হিসাবে মুড়ি বিক্রেতা লোকমান এক ছোট প্রতারক।

এখানে সাধারণ মানুষের জন্য শঙ্কার বিষয় হচ্ছে- লোকমান আবার কোন সুরতে আবির্ভূত হন। তিনি শঠতার চর্চায় যে ‘উন্নত কৌশল’ দেখিয়েছেন তাতে দেশের অন্য কোনো জনপদে নতুনভাবে তিনি আগমন করতে পারেন। যেমন খবরের মধ্যে থেকে বোঝা যাচ্ছিল, এর আগে কয়েকটি জায়গায় তিনি অন্য ধরনের জোচ্চুরি করেছেন। তবে সেটি এতটা ‘উন্নতমানের’ নয়। হাজারীবাগের পর অন্য এপিসোডে দেখা যাবে তার কায়দা-কানুন, ছলনা আরো আপগ্রেড হয়েছে। এতে আরো অল্প সময়ে তিনি আরো বেশি মানুষের সর্বনাশ করে ফেলতে পারেন।

২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশে অর্থনীতির অন্ধকার দিকটি নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা যায়, এর আকার আমাদের জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপির) ৩০ শতাংশ। যদি দেশে ১০০ টাকার উৎপাদন হয় তা হলে অন্ধকারে হচ্ছে ৩০ টাকা। এর যেমন কোনো হিসাব নেই তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে এর অবদান নেই। এটি মূলত মানুষের পকেট কেটে একশ্রেণীর মানুষ লুটে নিচ্ছে। এর উৎপাদকরা একচেটিয়া এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছেন। মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়ে এই আয় যখন তারা করছেন, তাদের কোনো কর দিতে হচ্ছে না। তাই অর্থনীতিতে এর অবদান নেই। মুড়ি বিক্রেতা প্রতারক লোকমানও এই গোষ্ঠীর। তবে তিনি দেশে চলা নানান প্রতারকদের মধ্যে একেবারে ক্ষুদ্র ও ছিচকে প্রকৃতির।

আমাদের দেশে প্রতারক শ্রেণী কত বড় এবং এক একজন কত বড় প্রতারক হতে পারে, তার নমুনাও ইতোমধ্যে দেখা গেছে। সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে একেক বারে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়া হয়েছে। ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা এখন অনেকটা সুদূর অতীত। এখন নতুন নতুন প্রতারণার ঘটনা সামনে আসছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার খবর জানা যাচ্ছে। প্রভাব খাটিয়ে শঠতার মাধ্যমে মানুষকে নিঃস্ব করা হচ্ছে। ফরিদপুরের এক ছাত্রলীগ নেতা একাই দেশের বাইরে পাচার করেছেন দুই হাজার কোটি টাকা। তিনি সর্বমোট কত টাকা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন সেই খবর এখনো পাওয়া যায়নি। ক্ষমতাসীনদের এটি একটি ছাত্র সংগঠন। তাদের মূল সংগঠন আওয়ামী লীগ ছাড়াও তার চেয়ে প্রভাবশালী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা। তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ কি তাদের পদপদবিকে এর চেয়ে বড় দাগে ব্যবহার করছেন না? সেসবের হিসাবও পাওয়া যেতে পারে। গণেশ উল্টে যাওয়ায় ফরিদপুরের ছাত্রলীগ নেতা বলির পাঁঠা হয়েছেন। অবৈধভাবে অর্থ কামানোর জন্য বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন। বাকিদের ক্ষেত্রে এখনো এমনটি ঘটেনি।

তবে শঠতা, প্রতারণার বড় দানগুলো কত বড় হতে পারে তার একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে আলোচিত পি কে হালদারের কাছ থেকে। তিনি একাই লুটে নিয়েছেন সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। কারো কারো হিসাবে তার লুটে নেয়া অর্থের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই লুটেরা যে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে আনুকূল্য পাচ্ছেন তাও প্রমাণসহ জানা গেছে। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি অর্থ হাতিয়েছেন সেগুলো মনিটর করার দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ববান একটি গোষ্ঠী তার লুটপাটকে ঠেকিয়ে দেয়ার বদলে আড়াল করে নিরাপত্তা দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, তিনি যে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন, তার জন্যও সহযোগিতা তিনি পেয়েছেন। বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি স্থলসীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। আদালতের জেরা থেকে জানা যায়, বিদেশে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞাটি কয়েক ঘণ্টা বিলম্বিত করা হয়েছিল। অথবা তাকে খবর দেয়া হয়েছিল, আদালতের নিষেধাজ্ঞা কখন বন্দরে পৌঁছাবে এর সময়সূচি। তিনি সেই অনুযায়ী তার আগেই দেশ থেকে পালিয়ে যান।

চার দিকে এখন প্রতারণার ফাঁদ। করোনা মহামারী নিয়ে ব্যবসায় করেছেন সাহেদ-সাবরিনারা। ক্ষমতার ম্যাচ মেকিং করে ধনী হয়ে গেছেন পাপিয়ারা। তবে এরা ভাগ্যের ফেরে আটকা পড়েছেন। পি কে হালদারের মতো খেলা ঠিকভাবে খেলতে পারলে ব্যবসাটি তারাও ভালোভাবে চালাতে পারতেন। কেবল অর্থের পরিমাণটি একটু ম্যাচিউরড হলে সীমানা পাড়ি দিতে পারতেন। আরো কতজন হালদার এখন দেশে প্রতারণার অর্থনীতির অন্ধকারে ক্রিয়াশীল, কেউ জানে না। তবে সেটি এক বিপুল বিশাল সিন্ডিকেট, সেটি বোঝা যায়। দেশ থেকে অর্থপাচার হওয়ার যে অঙ্ক পাওয়া যাচ্ছে, সেটা তার ইঙ্গিতই বহন করে। যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা। আর আইএমএফের সমীক্ষা বলছে, দেশের অন্ধকার অর্থনীতির পরিমাণ জিডিপির ৩০ শতাংশের সমপরিমাণ। রাস্তার মুড়ি বিক্রেতা প্রতারক লোকমান থেকে শুরু করে ‘অভিজাত’ সমাজের ‘উন্নত’ প্রতারক পি কে হালদাররা এই কালো অর্থনীতিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে মানুষের সর্বনাশকে ত্বরান্বিত করছেন।

jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement